Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,গৌরকিশোর

শারদ সংখ্যা প্রবন্ধ: গৌড়ানন্দ কবি । ঈশিতা ভাদুড়ী

Reading Time: 5 minutes

 “এই যে একুশ শতক মহাশয়, নমস্কার, আপনার একটু সময় নষ্ট করতে পারি কী”, অথবা “মিসেস থ্যাচার ইন্দিরার পদবীটা লিজ নিতে পারেন” অথবা “আমার ভালো নাম ফ্রাঁসোয়া অগুস্‌ত্‌ রেনে রদ্যাঁ, একাডেমিক কোয়ালিফিকেশন নান্‌”… – আনন্দবাজারে তাঁর সাপ্তাহিক কলাম ‘গৌড়ানন্দ কবি ভনে’ পড়ে পাঠকের গুণমুগ্ধ না হয়ে উপায় ছিল না, ১৯৮৯তে লেখাগুলি গ্রন্থাকারে এসেছিল, বিভিন্ন অধ্যায়ে বিভক্ত, ‘ফ্যামিলি প্ল্যানিং রাজনারায়ণী স্টাইল’, ‘ষষ্ঠ জ্যোতি বসু বনাম প্রথম জ্যোতি বসু’, ‘রাজভবনের লাল্টু আলু’, ‘ম্যাডামের নিরাপদ কেন্দ্র’ ইত্যাদি। ‘গৌড়ানন্দ কবি ভনে’ বইয়ের ভূমিকায় লিখেছিলেন, “বাঙালি বহুদিন যাবৎ মজা করিতে এবং মজা পাইতে ভুলিয়া গিয়াছে। গৌড়ানন্দ কবি বাঙালি পাঠক পাঠিকাকে মজার বাজারে টানিয়া আনিতে চেষ্টা করিয়াছেন। প্রয়াস সফল হইলে তাঁহার পরিশ্রম সার্থক হইবে”। বলা বাহুল্য তাঁর প্রয়াস সফল হয়েছিল। হাফ পাঞ্জাবি, ধুতি, ভারী ফ্রেমের চশমা আর আর অবিন্যস্ত গোঁফে তাঁকে আপাতদৃষ্টিতে যতই গুরুগম্ভীর মনে হোক, বাঙালী পাঠক তাঁর রসবোধ আস্বাদন করতে পেরেছিলেন। নবনীতা দেবসেন বলেছিলেন— “বাংলা সাহিত্যে রসসৃষ্টির নামে ইদানীং প্রচুর ছ্যাবলামির আমদানি হয়েছে, রুচিহীন বাচালতা, অতিরঞ্জিত বাক্য বিন্যাসের ছড়াছড়ি। যে-কোনও শব্দকেই জাতে তোলা যায়, যথাযথ প্রয়োগ করতে জানা চাই। গৌরকিশোর ঘোষের কলমে এই সূক্ষ্ম সামঞ্জস্যের অমূল্য ক্ষমতাটি ছিল বলেই তিনি বারবার বিভিন্ন ছদ্মনামে, স্বনামে, বেনামে বিচিত্র ধরনের সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন—তাঁর সমাজ সচেতনতা তাঁর চাবুকের মতো সমালোচনা সবই কত সহজে সাহিত্য রসে জারিত হয়ে বাংলা ভাষার সম্পদ বৃদ্ধি করেছে”।

অন্তর্ভেদী দৃষ্টির জন্যে গৌরকিশোর ঘোষে-র লেখনী একটি অন্য মাত্রা পেয়েছে। তাঁর একের পর এক রচনা বিদগ্ধ পাঠকদের মধ্যে সাড়া ফেলেছিল। গৌরকিশোর ঘোষের গল্প-সমগ্রের ভূমিকায় গৌতম ভদ্র লিখেছিলেন “লেখকের তীব্র পর্যবেক্ষণ শক্তি, কৌতুকবো্ধ সরস সজীব ভাষা তাঁর চোখে দেখা রূঢ়কঠোর বাস্তবকেও উপভোগ্য করে তুলেছিল”। শুধুমাত্র বাস্তবতার তীক্ষ্ণ হুল নয়, মজার কথা আরও ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে লিখতেও তাঁর জুরি কেউ ছিল না। রসবোধ থেকে লেখা ‘ব্রজদার গুল্পসমগ্র’ গৌরকিশোরের এক অনবদ্য সৃষ্টি, ‘রূপদর্শী’ ছদ্মনামে ধারাবাহিক ভাবে লিখেছেন। পরে সেটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। আরও পরে সিনেমা তৈরি হয় ‘ব্রজবুলি’ নামে। তাঁর অন্যতম উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ সাগিনা মাহাতো, রূপদর্শীর সংবাদভাষ্য। গৌরকিশোর তাঁর ‘রূপদর্শী’ নামের ইতিহাস হিসেবে বলেছেন, সাগরময় ঘোষ ফরমায়েস দিলেন লেখার, পরামর্শ দিলেন বিষয়ের, জীবনের কিছু তাজা ছবি এনে দিতে বললেন, নাম দিলেন ‘রূপদর্শী’। প্রকাশ হতে থাকল কখনো নকশা, কখনো সংবাদভাষ্য। ‘রূপদর্শীর নকশা’, ‘রূপদর্শীর সার্কাস’ নামে তাঁর বিভিন্ন ধরনের লেখা, তাঁর পরিশীলিত চিন্তার ক্রমাগত প্রকাশ। লেখকের অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখা এবং সেই দেখার প্রকাশই ছিল রূপদর্শীর মূল উদ্দেশ্য। তাঁর সমাজ-সচেতনতা, শাণিত কলম, এবং অন্তর্দৃষ্টিই রূপদর্শীকে জনপ্রিয় করেছিল। গৌতম ভদ্র লিখেছেন—“রূপদর্শী তো প্রধানত ভাষ্যকার, প্রদর্শক। সংবাদ সংকলন ঠিক তাঁর কাজ নয়। পরিবেশিত তথ্যে ধরা পড়া আপাতসত্যকে ফর্দাফাই করে দৈনন্দিন ঘটনাগুলি কোন কোন মৌলিক রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কাঠামোয় বিধৃত, সেটাকেই রূপদর্শী বার করে আনেন। এই ভাবেই তাৎক্ষণিক খণ্ড খণ্ড ঘটনার সম্পর্ক বোঝা যায়, দৈনন্দিন আর তুচ্ছ থাকে না। নানা অসম খণ্ড কী করে পারস্পরিকতায় সংলগ্ন থাকে, তা ধরা যায়। রং বা মাটি ধুয়ে যায় কিন্তু পুরনো কাঠামোকে তুলে আবার নতুন প্রলেপে মূর্তি গড়া হয়। নানা রকমারি সংবাদের রকমফেরের মধ্যে সেই কাঠামোকে চেনানোই তাঁর ভাষ্যের কাজ”।

গৌরকিশোর ঘোষ-কে জীবিকার কারণে বহু বিচিত্র পেশা গ্রহণ করতে হয়েছে, ইলেক্ট্রিশিয়ান থেকে আরম্ভ করে রেস্টুরেন্টের বয় অবধি। গৃহশিক্ষকতা ইত্যাদিও করেছেন। আবার ট্রেড ইউনিয়ন সঙ্গগঠক থেকে ইন্সিয়রেন্স কোম্পানির এজেন্ট, আবার কখনো কম্যুনিস্ট পার্টির ছাত্র শাখার কর্মী হিসেবে ফুড কমিটি, রিলিফ কমিটিতে কাজ করেছেন, লঙ্গরখানাও চালিয়েছেন। অলোক রায়ের মতে গৌরকিশোরের এইসব অভিজ্ঞতার প্রতিফলনই তাঁর বিভিন্ন লেখার মধ্যে বিভিন্ন সময়ে উঠে এসেছে।

ভারতবর্ষের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তাৎপর্যময় ও গুরুত্বপূর্ণ সময়কে কেন্দ্র করে তাঁর ত্রয়ী উপন্যাস, ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’, ‘প্রেম নেই’ আর ‘প্রতিবেশী’। ১৯২২-৪৬ সালে রাজনীতিকে কেন্দ্র করে সামাজিক বাতাবরণে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে এবং ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে সংঘাত ক্রমশ গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বে এবং শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে পৌঁছে কীভাবে দেশকে খণ্ড-খণ্ড করেছে সেই সমস্ত ইতিহাস সাহিত্যে ফুটিয়ে তুলেছেন, তার পাশাপাশি উপন্যাসের কাহিনির ব্যক্তিচরিত্রের জীবনের ট্র্যাজেডিগুলিকে খুব সুন্দর ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তাছাড়া তিনি উপন্যাস তিনটির প্রথম থেকেই হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ককে নিখুঁতভাবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। মুসলমান সমাজের আলো-ছায়া আর হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব অসামান্যভাবে তুলে ধরেছেন। লেখক লিখলেন – “টগর কাঁখ থেকেই ঘড়া উপুড় করে ঘড়ার জল ফেলে দিতে লাগল। বিলকিস করুণ চোখে দেখতে লাগল টগরের ঘড়ার জল গড়গড় করে গড়িয়ে এসে ওদের দুজনের মাঝখানে কেমন মোটা একটা দাগ কেটে নদীর দিকেই নেমে যাচ্ছে” – গৌরকিশোর ঘোষের ‘প্রেম নেই’ উপন্যাসে বিশ্বাস বাড়ির ছোট মেয়ে টগর আর হাজি সাহেবের মেয়ে বিলকিস একে অন্যকে ‘গোলাপ ফুল’ পাতায়। সুগন্ধি সাবান নিজের হাতেই ঘষে দেয় বিলকিসের চুলে, নদীর ঘাটে দুই বন্ধুর বাক্যালাপ চলে। টগর আর বিলকিসের একে অন্যের প্রতি যতই অকৃত্রিম আগ্রহ এবং আন্তরিকতা থাকুক, কিন্তু সমাজ সেখানে অস্পৃশ্যতার গন্ডি এঁকে দেয় ধর্মের নামে। টগরকে ঘড়া থেকে ফেলে দিতে হয় পুজোর জল, কেননা সে-জল বিলকিস ছুঁয়েছে। হিন্দু-মুসলমানের যে বিভেদ, টগর আর বিলকিশের কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে সেটি স্পষ্ট করে দেন লেখক। মুসলমান সমাজের গোঁড়ামির পাশাপাশি হিন্দুত্বের অহঙ্কারের চিত্রও লেখক এঁকেছেন। রামানন্দ পন্ডিত ফটিকের বসা চেয়ারে গঙ্গাজল ছিটিয়ে তবেই বসেন এবং বলেন – “তুমি হচ্ছ যবন আর ধনা হচ্ছে চাঁড়াল। তুমরা দুটোই অস্পৃশ্য। তুমরা যতক্ষণ ঘরে ততক্ষণ জলস্পর্শ করি কী করে? গায়ে বামুনের রক্ত আছে যে, ধম্মটা বজায় রাখতি হবে তো?” আবার এই একই মানুষ নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে ফটিককে তোষামোদ করে অন্য ভাষায় কথা বলতেও পিছপা হন না। মনুষ্য-চরিত্র যে কী সাংঘাতিক, ধর্ম ও সমাজ নিয়ে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় কুসংস্কার, নীচতা যে কী সাংঘাতিক, সেসবই তিনি অসামান্য দক্ষতায় তুলে ধরেছেন। নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্যে যে রামানন্দ পন্ডিত আর মৌলবীদের মতন মানুষ বারংবার হিন্দু-মুসলমানের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেসবেরও স্বচ্ছ প্রতিচ্ছবি নিপুণভাবে এঁকেছেন।

গৌরকিশোরের গল্প-উপন্যাসে যেভাবে মুসলমান-সমাজের নিখুঁত বর্ণনা উঠে এসেছে, তার প্রধান কারণ তিনি সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে ছিলেন। তিনি মানবতাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। শুধুমাত্র ধর্ম নয়, যে কোনো স্তরের মানুষের অধিকারের জন্যে সর্বদা সোচ্চার হয়েছেন। রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাতের প্রতিবাদ করতেও পিছপা হননি কখনো। প্রধানমন্ত্রী কে খোলা চিঠিও দিয়েছিলেন।  এই বিষয়ে পুত্রের উদ্দেশে চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন— ‘আমি ষড়যন্ত্রকারী নই, রাজনীতির দলবাজী করি না, আমি মাত্রই এক লেখক। এবং দায়িত্বশীল। এবং সমাজসচেতন। এবং যুক্তিবাদী। নিজেকে সৎ রাখবারও চেষ্টা করি। তাই যখন বুঝলাম, প্রধানমন্ত্রী চোরাবালিতে পা ঠেকিয়েছেন, তখন সেটা প্রকাশ্যে জানিয়ে দেওয়াটাই আমার কর্তব্য বলে জ্ঞান করলাম। আমার বিন্দুমাত্র অহমিকা নেই, তাই আমি জানি আমার কথাতে প্রধানমন্ত্রী কানও দেবেন না। কিন্তু তাতে কি? আমি তো সর্বনাশ দেখতে পেয়েছি। আর তাই আমাকে তা বলতেও হবে’।


আরো পড়ুন: উৎসব সংখ্যা ২০২১


তবে লেখক গৌরকিশোরকে ছাপিয়ে সাংবাদিক গৌরকিশোর যে এগিয়ে ছিলেন তার প্রমাণ আমরা তাঁর বিভিন্ন রচনায় পেয়েছি আমরা। সাংবাদিকতায় নতুন মোড় এনেছিলেন গৌরকিশোর ঘোষ। মুক্তচিন্তা ও গণতান্ত্রিক চেতনার জন্যে জনপ্রিয় নির্ভীক গৌরকিশোরকে ১৯৭৫ সালের ‘মিসা’ (MISA) অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ জন-নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। জ্যোতির্ময় ঘোষের সম্পাদনায় ‘কলকাতা’ পত্রিকা এক ‘বিশেষ রাজনৈতিক সংখ্যা’ প্রকাশের ব্যবস্থা করলো। সেখানে কিশোর ছেলেকে লেখা পিতা গৌরকিশোরের একটি চিঠি প্রকাশিত হয়েছিল, সেখানে জরুরি অবস্থার অন্ধকারের কথা উল্লিখিত ছিল, বাক্‌স্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকার কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা হয়েছিল। পুত্রকে লিখেছিলেন, “ আমি মনে করি আমার লেখার অধিকার, আমার মত প্রকাশের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার অর্থ আমার অস্তিত্ত্বকে হত্যা করা। এই কারণে আমি বর্তমান সেন্সর ব্যবস্থাকে মানবিক ন্যায়-নীতিবিরোধী, গনতন্ত্র বিরোধী এবং স্বাধীনতার পরিপন্থী বলে মনে করি”। গণতন্ত্রের মৃত্যু হয়েছে বলে মাথা কামিয়ে অশৌচ পালনও করেছিলেন তিনি। সাংবাদিকদের অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বহু নির্যাতন সহ্য করেও নিরন্তর সংগ্রামের ব্রতী ছিলেন। একবছর বন্দী ছিলেন, কিন্তু তাঁর বন্দীত্ব তাঁর লেখনীকে থামাতে পারেনি। কারাগারে বসেই তিনি লেখেন ‘প্রধানমন্ত্রীকে খোলা চিঠি’ এবং ‘দাসত্ব নয়, স্বাধীনতা’। এইসব প্রবন্ধের মাধ্যমে সামাজিক অভিঘাতের উপাদানগুলিকে চিহ্নিত করার পাশাপাশি কারাগারে থাকাকালীন বিভিন্ন কবি্তা, মতামত, পত্রালাপের মাধ্যমেও তদানীন্তন সময়ের মূল্যায়ণ উঠে এসেছে।

তাঁর পুরস্কারের ঝুলিও নেহাৎ কম ছিল না। সাংবাদিকতার জন্যে তিনি ১৯৭৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ‘কো জয় উক’ স্মৃতি পুরস্কার এবং ১৯৮১ সালে ম্যাগসাসে পুরস্কারে সম্মানিত হন। একই বছর মহারাষ্ট্র সরকারের পুরস্কার, ১৯৯৩ সালে হরদয়াল হারমোনি পুরস্কার, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ পুরস্কার পান। তিনি ১৯৭০ খৃষ্টাব্দে আনন্দ পুরস্কার পেয়েছিলেন এবং ১৯৮২ তে বঙ্কিম পুরস্কার পান তাঁর ট্রিলজি উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ড ‘প্রেম নেই উপন্যাসটির জন্য ।

গৌরকিশোরকে একসময় সিআইএ-র এজেন্ট বলেও রটানো হয়েছিল। আমেরিকা থেকে কয়েকজন তাঁর বাড়িতে এসে কনসার্ট করার পর সেই প্রচার আরও জোরদার হয়। বিষয়টি এতদূর গড়ায় যে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের তিনজন ছাত্র-প্রতিনিধি তাঁর চুনিবাবুর বাজারের ফ্ল্যাটে সরেজমিন তদন্তে গিয়েছিলেন। তাঁরা শুনেছিলেন, অতি বিলাসবহুল জীবনযাপন তাঁর। দামি আসবাব, আগাগোড়া কার্পেটে মোড়া বাতানুকূল ফ্ল্যাট। গিয়ে দেখেন ছোট্ট ঘরে তক্তাপোষের জীবনযাপন। ১৯৭০-এ নকশাল আন্দোলন চলাকালীন নকশালদের কোপের মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। আদর্শের দোহাই দিয়ে খুনের রাজনীতির বিপক্ষে তীক্ষ্ণ আক্রমণ ছিল তাঁর লেখায়। তাঁর মুন্ডু চাই বলে নকশালরা ডাক দিয়েছিল।  কিন্তু গৌরকিশোর ভীত হয়ে লেখা থামাননি। বরঞ্চ যখন তিনি মনে করেছেন, তখন তিনিই আবার নকশালদের বিরুদ্ধে পুলিশের নির্বিচার দমন নীতির প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন। ‘রূপদর্শী’র কলমে বারবার লিখেছিলেন, পুলিশ যেভাবে নকশাল-নিধন চালাচ্ছে তা অমানবিক। আসলে শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিশ্বাস নয়, ধর্ম, সম্প্রদায়, আচার, নিয়ম সর্বক্ষেত্রেই গৌরকিশোর মুক্তচিন্তক, মানবতাবাদী, সংস্কাররহিত, উদারপন্থী ছিলেন। ১৯৯২ সালে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর উত্তেজনার আঁচ পৌঁছে ছিল কলকাতার কিছু কিছু এলাকায়। শুনেছি তখন গৌরকিশোর ঘোষ বিভিন্ন সংবেদনশীল পাড়ায় ঘুরে বাসিন্দাদের অবস্থা দেখে তা লিখতেন এবং মানুষদের সম্প্রীতি রক্ষার গুরুত্ব বোঝাতেন।

যে কোনো প্রচলিত রীতি-নিয়মকে অস্বীকার করতে পিছপা হতেন না গৌরকিশোর ঘোষ। এমন কী তাঁর বিবাহ নিয়েও অনেক কথা শুনেছি। তাঁর বিবাহের অনুষ্ঠানে নাকি প্রবেশ মূল্য করেছিলেন পাঁচ টাকা! টিকিট না কেটে ঢোকা যাবে না। তাঁর বাবাকেও টিকিট কাটতে হয়েছিল। আমন্ত্রিত রাজশেখর বসু গৌরকিশোর ঘোষকে চিঠি লিখে বলেছিলেন, ‘‘তোমার বিয়ে নিয়ে আগ্রহ নেই। আমার আগ্রহ সেই মেয়েটিকে নিয়ে, যে তোমাকে পছন্দ করল।’’

এককথায় অসামান্য প্রতিভাবান এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। প্রথিতযশা সেই সাংবাদিক ও সাহিত্যিক গৌরকিশোর ঘোষে-র জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধা।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>