মহানগরের নয়জন নিবাসী (পর্ব-২৫) । ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী
মিজোরামের আইজল শহরের পদার্থ বিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী (১৯৪৮) অসমিয়া সাহিত্যের একজন সুপরিচিত এবং ব্যতিক্রমী ঔপন্যাসিক। আজ পর্যন্ত আটটি উপন্যাস এবং দুটি উপন্যাসিকা, অনেক ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাছাড়া শিশুদের জন্য দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারই ইংরেজি ভাষার একটি নতুন দিল্লির চিলড্রেন বুক ট্রাস্ট থেকে ১৯৯২ সনে প্রকাশিত হয়। দেশ-বিভাজন, প্রব্রজন, ভেরোণীয়া মাতৃত্ব (ভাড়াটে মাতৃত্ব), ধর্ম এবং সামাজিক বিবর্তন ইত্যাদি তাঁর উপন্যাসের মূল বিষয়। আলোচ্য ‘মহানগরের নয়জন নিবাসী’উপন্যাসে ১৯৩২ সনে স্টালিনের বিরুদ্ধে লেলিনগ্রাডের নয়জন টলস্টয়বাদী গান্ধিজির অহিংসা নীতির দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে করা আন্দোলনের ছবি ফুটে উঠেছে। তাঁর ইংরেজি ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ দুটি হল From Valley to Valley (Sahitya Akademi, New Delhi, 2010) এবং The Highlanders (Blue Rose Publishers, New Delhi, 2010)। বাংলা ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ ‘স্থানান্তর’ (অর্পিতা প্রকাশন, কলকাতা, ২০০৭)। বাসুদেব দাসের অনুবাদে ইরাবতীর পাঠকদের জন্য আজ থাকছে মহানগরের নয়জন নিবাসীর পর্ব-২৫।
পাঁচ দিন পরে দুপুরের সময় কয়েকজন সরকারি অফিসার আরক্ষীর সঙ্গে নাডিয়াদের অঞ্চলটির ভূমি সম্পত্তি ক্রোক করার জন্য উপস্থিত হল,টলস্টয়বাদীরা প্রস্তুত হয়ে ছিল।সেই অঞ্চলের দায়িত্বে থাকা ভিক্টর একছুর্স্কি,লিঅ’নিড এডলার এবং নিকোলাইচের্নভ তো ছিলেনই,অন্যান্য অঞ্চলের কাজ সমাধা করে আসা পিটার যেলেনকভ এবং ভলকভরিয়াজনভও এসে সেখানে ইতিমধ্যে উপস্থিত হয়েছিল।সরকারি পক্ষের অরক্ষী থেকে দূরে সারি পেতে তারা দাঁড়িয়েছিল। তার মাঝখানে ছিল শ্বিগানকঝুছুপভ,ভ্লাদিমির ভেলিক্স,য়ুরিফমিসেভ এবং মিখাইল ভেসিলিয়েভ।আর ছিল কুলাকটি।মেক্সিমভিচআন্ড্রয়েভ,রাশিয়ারগোড়া গির্জা এবং ক্যাথলিক পন্থী যাজককয়েকজন।নাডিয়াদের অঞ্চলের লোকদের সঙ্গে অন্যান্য ক্রোক করা অঞ্চল থেকেও টলস্টয়বাদে বিশ্বাসী ত্রিশ জনের মতো মানুষ এসে সমাবেশের জোর বৃদ্ধি করেছিল।দুশোরমতো লোক দেখে পিটার যেলেনকভ মহাশয়ের ভালো লাগল।সঙ্গে সঙ্গে মানুষগুলির দায়িত্বের কথা তার মনটাকেঅসংগঠিত করে তুলল।
সহযোগ করা মানুষগুলির দায়িত্বের শঙ্কা পিটার যেলেনকভ মহাশয়ের ভেসিলিদের অঞ্চলে হওয়া ঘটনার পর থেকেই আরম্ভ হয়েছিল।
সেই জন্যই তিনি দুদিন আগে ছোট একটা টিলার উপরে থাকা নিঃসঙ্গ বড় একটা গাছের নিচে বসে সারাদিনের জন্য অনশন করছিলেন।সঙ্গে ছিল তার সহযোগী টলস্টয়বাদীরা।সেই অনশন ছিল চাষিদের চালানো হত্যা এবং ক্ষেতের ফসল আগুন দিয়েপুড়িয়ে দেবার বিরুদ্ধে।আগেরবারের মতোই হত্যা তাদের কতটা মন খারাপ করেএবং তারা তার কতটা বিরোধ করে সে কথা তিনি হয়তো মানুষদের বোঝাতে পেরেছিলেন।কেননা তিন চার মাইল দূরের আট দশজন মানুষও হেঁটে এসে তাকে একবার দেখে গিয়েছিল আর তাদের হত্যা বিরোধী কথা এবং নিষ্ক্রিয় অহিংস প্রতিরোধের বিবরণ পুনর্বার শুনে গিয়েছিল।সন্ধ্যের পরে নাডিয়ামাথায়কাপড় বেঁধে পাশের তিনজনযুবতির সঙ্গে পাউরুটি মাখন আর সঙ্গে কেটলিতে গরম কফি নিয়ে অনশনের শেষ মুহূর্তে উপস্থিত হয়ে নয় জন টলস্টয়বাদীর মধ্যে খাবার জিনিস বিতরণ করছিল।সেই অনশনের দ্বারা পিটার যেলেনক’ভ মহাশয় মানুষের মধ্যে অহিংসার বার্তা প্রচার করেছেন ঠিকই,কিন্তু আজকের সমাবেশে সমবেত হওয়া মানুষগুলিকে আরক্ষীর হিংস্র হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে কি পারবে না –সেই চিন্তাই তাকে পুনর্বার আশঙ্কিত করে তুলল।
এখানে সেখানে থাকা হালকা ঘরগুলি থেকে কিছু মহিলা উঁকিঝুঁকিদিয়ে এবং অন্য কয়েকজন জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে মানুষ সমবেত হওয়া জায়গাটার দিকে বাইরের দিকে তাকিয়ে পরিস্থিতিটা আন্দাজ করতে চেষ্টা করেছিল। ত্রিশজনের মতো মানুষ তাদের দাবীর ফলক নিয়ে দুশো মানুষের সমাবেশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আর সঙ্গে পনেরোজনআরক্ষী অফিসার তিনজনঅসামরিক অফিসারের সঙ্গে বিমূঢ় হয়ে পড়া যেন দেখে ওদের দুই একজন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল।ওদের সংখ্যা পঁচিশ জনের মতো হল। ওরা ধীরে ধীরে এগিয়ে সমবেত পুরুষদের থেকে পিটার যেলেনক’ভ মহাশয় অনশন করা টিলাটির বড় গাছটার নিচে গিয়ে একত্রিত হল আর সেখান থেকেই দুইপক্ষের দিকে তাকিয়ে রইল।
সমগ্ৰ পরিবেশটা ডিমভেরমতোচ্যাংরা একটা ছেলের মতোএতটাই উত্তেজক এবং আকর্ষণীয় ছিল যে সে তার সঙ্গের দুজনের সঙ্গে মহিলারা সমবেত হওয়া জায়গায় বড় গাছের ওপরের ডালে আগেই উঠে ভালো একটা ডালে বসে চারপাশের সবকিছু লক্ষ্য করছিল।সে নিচে সমবেত হওয়া মহিলাদের মধ্যে নাডিয়া এবং তার মা মাছারমান’ভনাকেও দেখতে পেল।সে কিন্তু মুখ দিয়ে কোনোরকম শব্দ করলনা।
অন্য টলস্টয়বাদীদের মতো লিঅ’নিড এডলার ও সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে ছিল।পাশেরটিলাটিতে সমবেত হওয়া মহিলাদের দেখে সে সেদিকেতাকাল।দেখল মা মাছারমানভ’নার সঙ্গে নাডিয়া সামনে দাঁড়িয়েরয়েছে।সেও অন্য মহিলাদের মতোমাথায় একটি কাপড় বেঁধে এসেছে।কাপড়ের পাশ দিয়েবেরিয়ে থাকা মুগা চুলগুলিই নয় ,তার পা পর্যন্ত পরা দীর্ঘ স্কার্টটা ও বাতাসে নাচছে।
নাডিয়া লিঅ’নিডের তাকানোর কথা জানতে পারল।গম্ভীরপরিবেশটাতে নিহিত হয়ে থাকা আশঙ্কায় তার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল না।ডান হাতটা কিছুটা তুলে সে কেবল তাকে অভিনন্দন জানাল। লিঅ’নিডও তার প্রত্যুত্তর দিল। তার বুকের উৎসাহ যেন অনেক বেড়ে গেল। সে অন্য মানুষগুলির মতো পুনরায় সরকারি পক্ষের দিকে তাকিয়েদাঁড়িয়েরইল।
দূরের সরকারি পক্ষের মধ্যে আরক্ষী অফিসার পাভল’ভ টেলপুগ’ভককেও দেখা গেল।মধ্যবয়সী অফিসারটি মেগাফোননিয়ে থাকা অফিসারের কাছে ঘোড়ানিয়েদাঁড়িয়ে আছে এবং দুজনেই কোনো বিষয়ে কথা বলছে।
একটা সময়মেগাফোনে ১৯২৮ সন থেকে বলবৎ হওয়া পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করা হল।ঘোষণা করা হল যৌথ পাম এবং যৌথ উদ্যোগ গড়ার জন্য মাটির আবশ্যকতার কথা।তাই ক্রোক করার প্রক্রিয়া আরম্ভ করার জন্য সবাইকে সরে যাবার আদেশ দেওয়া হল। ঘোষণার পরে দুবারেরমতোদশজনেরঅশ্বারোহী দলটা সামনে এগিয়েগেল।সমাবেশের সামনে দিয়েকয়েকবার যাওয়া-আসা করল।
মানুষগুলি পিটার যেলেনক’ভের নির্দেশে নিজের নিজেরজায়গায় বসে পড়ল।কিছু মানুষ ফলক তুলে ধরে ধরেশ্লোগান দিতে লাগল।অশ্বারোহীর দলটি এবার জীনের পাশ থেকে ক্লাঠি বের করে নিল।ওরা মানুষগুলির কাছে গেল এবং সামনের দিয়ে টহল দিতে লাগল।মানুষগুলির মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেল।তবুও তারা তাদের জায়গা ছেড়ে গেল না।
অশ্বারোহীদলটির সামনে ছিল অফিসার পাভলভটেলপুগ’ভ।তিনি সামনের সারিতে বসে থাকা লিঅ’নিড সহ টলস্টয়বাদীদের দেখতে পেয়েছিলেন।বয়স্ক পাকা দাড়ি থাকা ধর্মযাজককয় জনের সঙ্গে শান্তিতে বসে থাকা পিটার যেলেনক’ভ,ভ্লাডিমিরভেলিক্স,য়ুরিফমিসেভ,শ্বিগানকঝুছুপভ এবং নিকোলাইচের্নভকেদেখেছিল।মধ্য বয়সী ভলকভরিয়াজনভ এবং ভিক্টর একছুর্স্কির থেকে কিছুটা দূরে দুপাশে যুবক মিখাইল ভেছিলিয়েভ এবং লিঅ’নিড এডলারকেও সে বসে থাকতে দেখে ছিল।তাছাড়া ছিলেন বয়স্ক দর্জি খুড্রিক’ভচমন’ভ মুচি এবং অন্যান্য সাধারণ কৃষকরা। এই নিরীহ শান্ত মানুষগুলির উপরে ঘোড়ানিয়েঝাঁপিয়ে পড়তে পাভল’ভ টেলপুগ’ভের ইচ্ছা হল না। মানুষটাঅশ্বারোহীর দলটি ফিরিয়েনিল এবং মেগাফোননেওয়া অফিসারের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলতে লাগল।
আরো পড়ুন: মহানগরের নয়জন নিবাসী (পর্ব-২৪) । ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী
অশ্বারোহীরদলটিকে শান্তভাবে এক জায়গায়দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লিঅ’নিড মাথা ঘুরিয়ে ছোট টিলাটিতে থাকা গাছের নিচের মেয়ে মানুষের ভিড়টার দিকে তাকাল। নাডিয়া তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। অশ্বারোহীরা চলে যাওয়ায় সে খুব আনন্দ পেয়েছিল।লিঅ’নিডকে তার দিকে তাকাতে দেখে আশ্বাসের ভঙ্গিমা করে ডান হাতটা তুলে সে অনুচকণ্ঠেলিঅ’নিড যাতে বুঝতে পারে সেভাবে ঠোঁট নাড়িয়ে বলল– তোমরা সফল হবে।
লিঅ’নিডের মনে পড়ল গত কয়েকদিন সে তার সঙ্গে নিরালায় দেখা করার সময় এই আশ্বাসই সে তাকে দিয়েছিল। সে বলেছিল– তুমি মাটি আর মানুষকে ভালোবেসেছ, অহিংস অবস্থানে কুকার্যকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছ, কাউকে আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত এবং উদ্যত হওনি। তোমরা সফল হবেই।
লিঅ’নিডের অনুভব হল যেন এই মুহূর্তেও নাডিয়া তাকে সেই সমস্ত কথাই বলল। এই ধারণা তার উৎসাহবহুগুনেবাড়িয়ে তুলল। তার চোখের সামনে থেকে আরক্ষীদের হাতে থাকা তরোয়াল, বন্দুক এবং তার ডগারবেয়নেটগুলি যেন ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে পড়ল।
লিঅ’নিডের মুখটা কোমল হল। নাডিয়ারদিকে তাকিয়ে সে কোনো কথা না বলে হাতের ইশারায় প্রত্যুত্তর দিল– হ্যাঁ, আমরা সফল হব।
ওরাপ্রত্যেকেশান্তভাবে বসে রইল। মাঝেমধ্যেশ্লোগানের শব্দ ভেসে এল।
হয়তো আধা ঘন্টার সময় পার হল। পরিস্থিতি একই ছিল। কিন্তু হঠাৎ আরক্ষীর দলটির মধ্যে একটা চঞ্চলতা ছড়িয়েপড়ল। দশ জনের মতোঅশ্বারোহীকেনিয়ে সেখানে তুফানের মতো তীব্র বেগে উপস্থিত হল সার্জেন্ট নিকোলাইয়াণ্ডটকিন। অসামরিক অফিসারের সঙ্গে দুই একটা কথা বলে অশ্বারোহীরদলটির সামনে এপাশ থেকে ওপাশেঘোড়া কদম চালে চালিয়ে যেতে লাগলেন। ধীরে ধীরে বলে গেলেন– স্টালিনের আদেশের কথা।–’ আমরা অন্য জায়গায় করার মতোই জোর করে ঘর-বাড়ি, জন্তু-জানোয়ার সমস্ত দখল করব। সরকারের আদেশ পালন করব।’
সমস্ত অস্ত্রধারীঅশ্বারোহীদলটির নেতৃত্ব সার্জেন্ট নিকোলাইয়াণ্ডটকিনের হাতে গেল। তিনি ঘোড়াটানিয়েছটফট করে এদিকে ওদিকে গিয়ে আরক্ষীর দলটিকে উত্তেজিত করতে লাগলেন। অসামরিক অফিসারটিকে পুনরায় ঘোষণা করতে বললেন। তারপরে পনেরো জনের মতোঅশ্বারোহীকে সঙ্গে নিয়ে জন সমাবেশের কাছে গিয়ে নিজের শক্তি প্রদর্শন করলেন। তারপর দ্রুত বেগে ফিরে এসে সমস্ত অশ্বারোহী পুনরায় তীব্র বেগে এগিয়ে সমাবেশের বিভিন্ন জায়গায়লাফিয়েপড়ল। কিছু কিছু মানুষ আহত হয়ে পালাতে লাগল, কিছু মানুষ জঙ্গলেই পড়েরইল। তথাপি মানুষের সংখ্যা বেশি থাকার জন্য কয়েকটিঘোড়া মানুষের মধ্যে পড়ে লাফাতে লাগল। তিনজনেরমতোআরক্ষীঘোড়া থেকে ছিটকে পড়ল । কিছু আহত মানুষ ওদেরঘিরে ধরতে দেখা গেল ।
দূরে অসামরিক অফিসারটির কাছে দাঁড়িয়ে থাকা সশস্রআরক্ষী কয়েকজন পিঠের বন্দুক সামনে নিয়ে এল এবং মানুষের মাথার ওপর দিয়ে গুলি চালাতে লাগল।
পরিবেশ আরও হুলস্থলের হয়ে পড়ল। ঠিক তখনই পিটার যেলেনক’ভ মহাশয় হাত তুলে মানুষগুলির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করতে লাগলেন–’ আপনারা শান্ত হোন। কেউ আরক্ষীরগায়ে হাত দেবেন না। আমরা কোনো ধরনের হিংসার পক্ষপাতী নই।’
তার কণ্ঠস্বরকতজন শুনতে পেল বোঝা গেল না। তথাপি মানুষগুলি আরক্ষীকে আক্রমণ করল না। মানুষগুলি কেবল আরক্ষীর আক্রমণের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করল।
তখনই মহিলারা সমবেত হওয়া টিলার গাছটির নিচে হুলস্থুলবেধে গেল। মহিলারা কাউকে ঘিরে ধরেছে। কয়েকজনচিৎকার করে করেকাঁদছে।
এদিকে দৌড়েগিয়ে খবর নিয়ে আসা গ্রেবিল’ভ লিঅ’নিড এবং মিখাইলকে এসে খবর দিল–’ডিমভ গাছের উপরে ছিল। তার গায়ে গুলি লেগেছে। সে সেখান থেকে মহিলাদের মধ্যে খসেপড়েছে।’
দৌড়ে থাকা মানুষ এবং আরক্ষীর ঘোড়ার দৌড়ের মধ্যে ওরাদৌড়েটিলারটির দিকে গেল।
লিঅ’নিড দেখল অন্য একজন মহিলার সঙ্গে নাডিয়াডিমভের রক্তাক্ত দেহটি ধরে আছে। নাডিয়া তার মাথাটা তুলে ধরে কাঁদতেকাঁদতে বারবার তার নাম ধরে ডাকছে। ডিম্ববেরমাথায় যে গুলি লেগেছিল সেটা আর নাডিয়ারখেয়াল নেই। মাথার ক্ষতস্থান থেকে নির্গত হয়ে আসা রক্ত তার কোল রক্তাক্ত করে তুলেছে। তথাপি নাডিয়াচিৎকার করছে –’ ডিমভ, চোখ খোল। চোখ খোল ডিমভ।’
রক্তে রাঙা হয়ে পড়া ডিমভের ওপরের অংশ দেখে মাছারমান’ভনারইনয়,কয়েকজন মহিলার মাথা ঘুরতে শুরু করেছিল।কিন্তুনাডিয়ার মা পাশে থাকা একজন মহিলার গায়ের ওপর ঢলে পড়লেন।শক্তপোক্তমহিলাটির ওজন সামলাতে না পেরে দুয়েক জন মহিলা কয়েকজন মানুষকে সরিয়ে মাছাারমান’ভনাকেবনানির মধ্যে শুইয়ে দিল।
ইতিমধ্যে ঠেলা ধাক্কা দিয়ে মানুষের ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়া লিঅ’নিড এবং মিখাইলের দিকে তাকিয়ে নাডিয়াচিৎকার করতে লাগ্ল-‘লিঅ’নিড-মিখাইল,ডিমককেবাঁচাও।‘
লিঅ’নিডনাডিয়ার কাছে বস্ল।তার কোল থেকে সে ডিমভের মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে নিল।সেওডিমভেররকণ্ঠাস্বর শোনার জন্য অনেক চেষ্টা করল।
মূর্ছিত হয়ে পড়া মায়ের কাছে মিখাইলকে যেতে হল।সে মাকে ডাকতে ডাকতে হাতের তালু ঘষতে লাগল।
সেই সময়ে আরক্ষী এবং চাষিদেরদৌড়াদৌড়ির পরিবেশের মধ্যে গ্রেবিলভ হন্তদন্ত হয়ে পাশের বাড়িটি থেকে এক বালতি জল নিয়ে দৌড়েদৌড়েটিলাটিতে উঠে এল।সে নিয়ে আসা মগটিতেএকমগ জল নিয়ে মিখাইলের হাতে দিল এবং বালতিটানাডিয়ার হাতে তুলে দিল।
‘জল খাইয়ে দাও লিঅ’নিড।সেজেগে উঠবে।’
লিঅ’নিড এক অঞ্জলি জল নিয়ে ডিমভের মুখে ঢেলে দিল।গড়িয়ে যাওয়ায় পাশের মহিলাটি তার মুখটা মেলে ধরল।পুননরায় এক অঞ্জলি জল সে মুখে ঢেলে দিল।
‘ভালোভাবে জল দাও লিঅ’নিড।সেখাবে।জেগেউঠবে।চোখ মেলে তাকাবে।‘
নাডিয়ার এই আতুর ক্রন্দনের শেষ হল না।ডিমভের ঠোঁটের কষ দিয়ে জল বেয়ে পড়ল।সেজেগে উঠল না।চোখ খুলে তাকাল না।ডিমভের মৃত্যু হল।
ইতিমধ্যে সমবেত হওয়া মানুষগুলি ক্রমশ হালকা হয়ে আসছিল।এদিকে ওদিকে পালিয়ে যাওয়া মানুষগুলিকে কয়েকজন অশ্বারোহী খোঁজে বেড়াচ্ছিল।বয়স্কটলস্টয়বাদী কয়েকজনের সঙ্গে কয়েকজন ধর্মযাজক এবং কয়েকজন চাষি আহত হলেও নিজের জায়গাতে বসেছিল।
চোখে জলের ছিটা দিতে থাকায় নাডিয়ার মা মাছারমান’ভনা কিছুক্ষণ পরে জেগেউঠেছিল।কিন্তু ইতিমধ্যে লিঅ’নিডডিমভেরমৃতদেহটি কোলে করে তুলে নিয়ে গিয়েছিল এবং ধীরে ধীরে বয়স্ক মানুষগুলি বসে থাকা জায়গায় নেমে গিয়েছিল।মাকেজেগে উঠতে দেখে নাডিয়ালিঅ’নিডের কাছে গেল।সেডিমভেরমাথাটাতে আলগোছে হাত বুলিয়ে গেল-‘চোখ মেলে তাকা ডিমভ।’
নাডিয়ার মুখে আতুরের ফাটা কণ্ঠস্বরটি ক্ষীণ হয়ে বের হল।
সঙ্গে যাওয়া ছয়জন মহিলার সঙ্গে লিঅ’নিডডিমভেরমৃতদেহটি যখন জ্যেষ্ঠ টলস্টয়বাদীদের কাছে নিয়ে গেল,তাঁরা,যাজককয়েকজন,বয়স্কচাষিকয়েকজন,চমনভ এবং খুড্রিকভ-সবাই উঠে দাঁড়াল আর আফিসারদের সঙ্গে মেগাফোন নিয়ে ঘোড়ায় উঠে থাকা অসামরিক অফিসারের কাছে যাওয়া লিঅ’নিডেরপেছনপেছন গেল।
ডিমভেরমৃতদেহটা তুলে ধরেই লিঅ’নিড জোরে জোরে বলতে লাগ্ল-আমরা অহিংস আন্দোলন ক্রেছিলাম।এইশিশুটির মৃত্যু হল কেন?আমরাও আমাদের ভূমিকে ভালোবাসি,দেশকেভালোবাসি,মানুষকেভালোবাসি।কিন্তু এই মৃত্যু কেন?আমরাস্বেচ্ছাচারী জারের শাসন থেকে মুক্ত হয়েছিলাম।কিন্তু এই স্বেচ্ছাচারিতাকেন?এই মৃত্যু কেন?
নাডিয়ালিঅ’নিডের কাছে দাঁড়িয়ে ডিমভের মাথাটা আলগোছে আদর করছিল।চিৎকার করে করে বলা কথাগুলির শেষে যখন লিঅ’নিডেরকণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে গেল,তখন সে লিঅ’নিডের শরীর ধরে কাঁদতে লাগল।
দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দুই একজন মানুষ পুনরায় লিঅ’নিড এবং অন্য টলস্টয়বাদীদের কাছে আসতে শুরু করেছিল।তখনই এদিকে ওদিকে দৌড়ে দৌড়ে মানুষ তাড়িয়েবেড়ানোঅশ্বারোহী কয়েকজনকে নিয়ে ঘোড়া দৌড়িয়ে কাছে চলে এল সার্জেন্ট নিকোলাইয়াণ্ডটকিন।তিনি ঘোড়া সামলানোর জন্য কর্কশ কণ্ঠেচিৎকার করতে লাগলেন-‘এসব চলবে না।‘
তখনই টিলাটির ওপার থেকে কয়েকজন মানুষকে আসতে দেখা গেল।ওদের হাতে হাতেকৃ্ষকেরসরঞ্জাম।ওরা আক্রোশে চিৎকার করে করে দৌড়ে আসছে।সঙ্গেসঙ্গেঅন্যদিক থেকে আরও কিছু মানুষকেআক্রমণ করার জন্য উদ্যত হয়ে দৌড়ে এগিয়ে আসতে দেখা গেল।
সার্জেন্টটিঅশ্বারোহী কয়েকজনকে বন্দুক নিয়ে প্রস্তুত করাল।তারপরেচিৎকার করে গুলির আদেশ দিল।
বন্দুকের গুরুমগুরুম শব্দ এবং নলী থেকে বেরোনো ধোঁয়া বারুদের গন্ধে জায়গাটা ভরে গেল।দৌড়ে নেমে আসা দুই একজন মানুষ এখানে সেখানে গড়িয়ে পড়তে দেখা গেল।অন্যেরা চারপাশে পালাতে লাগল।
নাডিয়ার মায়ের হুঁশ আসায় ছেলে মিখাইলের সঙ্গে জ্যেষ্ঠ মানুষগুলির কাছে এসে পৌছেছিল।বন্দুকের গুলি কাছ থেকে চলে ধোঁয়া-কুয়াশা হয়ে বারুদের গন্ধে ভরে পড়ায় সঙ্গে দূরে দুই একটি মানুষ রক্তে মাখামাখি হয়ে গড়িয়ে পড়তে দেখে মাছা্রমানভ’না পুনরায় মূর্ছিত হয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল।
লিঅ’নিডের মুখে কথা জোগালনা।সেডিমভের নিথর মৃতদেহটা নামিয়ে বনানিতেশুইয়েদিল।নাডিয়া কাছে বসে ফোঁপাতে লাগল।
আক্রমণ করতে উদ্যত হয়ে আসা মানুষগুলিকে তাড়িয়ে পরিস্থিতিটা সামলেনেওয়ার পরে সার্জেন্ট নিকোলাইয়াণ্ডটকিনমেগাফোননেওয়া অফিসারের দিকে তাকিয়েচিৎকার করে বলল-‘ প্রত্যেককেঅ্যারেস্ট কর।’
প্রথমেই রক্তে উপচে থাকা লিঅ’নিডকে ধরা হল। তারপরেটলস্টয়বাদীদের, এবং চাষি কয়েকজনকেও জড়ানো হল। পঁচিশ জনের মতো মানুষকে ধরে বেঁধে একাংশ আরক্ষী চলে যাবার আগে মাকে ধরে থাকা নাডিয়ার কাছে ঘোড়ানিয়েপাভল’ভ টেলপুগ’ভ এল। তিনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মা এবং নাডিয়ার দিকে ভাবলেশহীনভাবে তাকাল এবংতারপরেবন্দি মানুষগুলির দলটিতে ঢুকে চলে গেলেন।
সন্ধ্যে পর্যন্ত আরক্ষীর অন্য দলটি খালি হয়ে পড়া কয়েকটি ঘরের দখল নিয়েনিল। রাতে আরক্ষীর সংখ্যা যথেষ্ট বৃদ্ধি হল।
গ্ৰেবিলভ পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। তথাপি সে দূর থেকে নাডিয়াদের লক্ষ্য করছিল। অন্ধকার হওয়ারসময়ও মুক্ত জায়গার এখানে সেখানে ছয় সাতটি মৃতদেহপড়েছিল। নাডিয়া তখনও বুকে এক হাতে চাপা দিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বসে থাকা মায়ের কাছে গিয়েছিল, অন্যবারডিমভেরমৃতদেহের কাছে গিয়েকাঁদছিল।দর্জিখুড্রিক’ভ ছাড়া কেউ কিছু না হওয়াডিমভের কাছে ভয়েএগিয়ে আসছিল না। বুড়ো দর্জিকেও আরক্ষীছমন’ভ মুচি এবং অন্য মানুষের সঙ্গে ধরে বেঁধে নিয়েগিয়েছিল।
সন্ধ্যে হওয়ার পরে গ্রেবিল’ভ কুঁজো হয়ে হয়েছায়ারমতোনাডিয়াদের কাছে উপস্থিত হল।
‘ আমি কী করবওগ্ৰেবিল’ভ?’
নাডিয়াকাঁদতে লাগল।
‘ চিন্তা করনা নাডিয়া।’– সে বলল।’ তুমি মাকে ধরে ধরেহাঁটিয়ে আনতে পারবে কি? আমি ডিমভকে ধরছি।’
নাডিয়ার দু চোখ দিয়ে জলের ধারা বইতে লাগল। সে মাকে বসা থেকে দাঁড়করানোর চেষ্টা করল। মা উঠে দাঁড়াল। তার কাঁধে ধরে এক পা এক পা করে এগোতে চেষ্টা করল।
‘ আমি পারছি গ্রেবিল’ভ। তুই ডিমকভকে ধর।’– সে বলল । কথাটা বলতে গিয়ে তার দুচোখদিয়ে পুনরায় তপ্ত অশ্রুজল গড়িয়েপড়ল ।
গ্রেবিল’ভ ডিমভেরঠান্ডা শরীরটা তুলে নিল। তারপর টিলাটির দিকে নয় কিছুটা নিচের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।
দিগ্বলয়ে থাকা আলোর জন্য দূর থেকে নাডিয়াদের ঘরের এটিকটাওদের চোখে পড়ল। ওরা সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল।ঘরটির এখানে সেখানে আলো দেখা যাচ্ছে। দু একটি মানুষ আসা-যাওয়া করার ছায়া জানালার কাচে পড়েছে। শরীরের ছায়া এবং টুপির ছায়াগুলিআরক্ষী লোকদের। ওরা বোধ হয়মদিনা পান করে মশগুল হয়ে পড়েছে, কেননা সমস্বরের অট্টহাসি মাঝেমধ্যে ভেসে আসছে।
নাডিয়ার দুর্বল হাতের বন্ধন ছাড়িয়ে মা মাছারমান’ভনা জায়গাতেই বসে পড়ল। তার দুচোখদিয়েও জলের ধারা বইতে লাগল। নাডিয়া বসে মাকে জড়িয়ে ধরল।
গ্ৰেবিল’ভ ডিমভের দেহটা বনানিতেশুইয়ে দিল।
‘নাডিয়া’– সে বলল–’ বাড়িতে যাওয়াটা ঠিক হবে না। আমি একটু আসছি। ভয় কর না।’
গ্ৰেবিলভ অন্ধকারে নাই হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে হন্তদন্ত হয়ে সে যখন ফিরে এল ততক্ষণেনাডিয়ার মা কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছে।
‘ এসো।’ ডিমভেরমৃতদেহটা তুলে সে মায়ের সঙ্গে নাডিয়াকে একটা হেলে পড়া ঘরের কাছে নিয়ে গেল। ঘরটা একটি খড়ের ভান্ডার। দূরে গোয়ালঘর।
‘ তোমরা ভেতরে যাও। তাতে হয়তো বসে বা শুয়ে বিশ্রাম নিতে পারবে। আমি ডিমভকে কবর দিয়ে আসছি।’
‘ ওকে এখানে শুইয়েরাখগ্ৰেবিলভ। দিনের আলোতে ওকে কবর দিবি।’—নাডিয়া আতুর কণ্ঠে বলল।
‘নাডিয়া,দিনেআরক্ষীর ভয়। রাতে শেয়ালের ভয়। কোথাও বেরোতে পারে।’
গ্রেবিল’ভডিমভেরমৃতদেহ নিয়ে অন্ধকারে বেরিয়ে যাবার সময় নাডিয়া নিথর হয়ে বসে রইল। তার চোখের জল বের হল না।
গ্রেবিল’ভ যখন ঘেমে নেয়ে রাত দুপুরে ফিরে এল তখন মাছারমানভ’না খড়ের উষ্ণতায়শুয়ে পড়েছিল।নাডিয়া কাছে বসেছিল। এই দুর্যোগের সময়েও তার লিঅ’নিডের কথা মনে পড়ছিল। কেন না গত তিনদিনেরমতো সে লিঅ’নিডের সঙ্গে এই ধরনের খড়ের ভাঁড়ার ঘরে মিলিত হয়েছিল।
গ্রেবিল’ভ বলল—‘ওকে শুইয়ে রেখে আসছি নাডিয়া।‘
তখনও আরক্ষী দখল না করা খালি ঘর একটা থেকে সে কয়েকটি ফল,কয়েক পিস পাউরুটি এবং একটি কাচের বোতলে কিছুটা দুধ নিয়ে এসেছিল। কাগজ দিয়ে মোড়া পুঁটলিটা সে নাডিয়ার দিকে এগিয়ে দিল। নাডিয়া তার হাতে বালির মতো গুড়ো মাটির স্পর্শ পেল-কবরের মাটি,ডিমভের কবরের মাটি।
চারদিন পরে গ্রেবলি’ভ একটা খবর নিয়ে এল। সে খবরটা চুপিচুপি নাডিয়াকে জানাল—এখানে যাকে যেখানে পাচ্ছে ,জড়িয়ে নিচ্ছে।পুরুষ,যুবক,যুবতি এবং সন্তানহীনা মহিলা—যাকে যেখানে পাচ্ছে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।ওদের নাকি সমবায় পাম,উদ্যোগপাম এবং আড়াল পর্বতের খনিতে দাস-কর্মী হিসেবে কাজ করানোর জন্য নিয়ে যাচ্ছে।‘
ওরা চিন্তিত হয়ে পড়ল।
নাডিয়া বলল—‘গ্রেবিল’ভ,তুই আমার বান্ধবী মারিয়া এন্টন’ভনা এবং তার স্বামী ডিমিট্রিগরিনের সঙ্গে দেখা করতে পারবি কি?লিঅ’নিড-মিখাইলের খবরও আনতে পারবি কি?’
সে তাকে ওদের ঠিকানা দিল।
সে কয়েকটি খবর নিয়ে চারদিন পরে ফিরে এল।
সে নাডিয়াদের থাকা খড়েরভাঁড়ারঘরের কাছে গিয়েইভেতরে অস্বাভাবিক শব্দ শুনতে পেল। সে দরজাটা খুলে ভেতরে প্রবেশ না করে উঁকি দিয়ে দেখে অবাক হল। মোমবাতির ক্ষীণ আলোতে সে দেখল নাডিয়া খড়ের স্তূপের এক কোণে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বসে রয়েছে। দুটো পা হাত দিয়ে খামচে ধরে বসে আছে। তারগায়ের ওপরের অংশে গরম কাপড় নেই। ব্লাউজটা ছেঁড়া এবং তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে দানবরূপীএকজন আরক্ষী।সে তার পেতলের বোতাম লাগানো বড় কলারের ইউনিফর্মের গরম ওভার কোটটা ইতিমধ্যে খুলে ফেলেছে এবং কোমরের বেল্টটা খুলতে উদ্যত হয়েছে।
গ্রেবিলভ ভাঁড়ার ঘরের কাছে থাকা দীর্ঘ নালের আবর্জনা পরিষ্কার করার সরঞ্জাম একটা হাতে তুলে নিল।এবং তুফানের মতো দরজা খুলে ঢুকে মাথা ঘুরিয়ে তাকানো আরক্ষীটার মাথায় তি্নবার আঘাত করল।মানুষটা ছিটকে পড়ল।
গ্রেবিল’ভ ভয়ে কাঁপতে থাকা নাডিয়াকে হাতে ধরে উঠিয়ে বলল—‘চিন্তা কর না নাডিয়া। আমি এসে গেছি।‘
গ্রেবিল’ভ মারিয়া এবং ডিমিট্রিকেলেনিনগ্রাডে দেখা করে এসেছে।ওরা তাকে সরকারি কার্যালয়ে নিয়ে গিয়ে পাভল’ভটেলপুগভের মাধ্যমে মিখাইল লিঅ’নিডদের আদালতে নিয়ে আসার একটা দিনের খবর জোগাড় করে এনেছে। সঙ্গে এনেছে নাডিয়ার কাছে মারিয়াদের অনুরোধতোরা ওখানে সুরক্ষিত নস।ওখান থেকে চলে আয়। আমাদের সঙ্গে কষ্ট করে থাকবি।
গ্রেবিল’ভ বলল—‘দেরি কর না নাডিয়া। মায়ের সঙ্গে তোমার বান্ধবী তোমাকে ডেকেছে। আমরা এখনই যাব। দুদিন পরে লিঅ’নিডমিখাইলের সঙ্গে দেখা হবে।‘
শীত এবং উত্তেজনায় কাঁপতে থাকা নাডিয়া কিছুই বলল না।লিঅ’নিডদের নাম শুনে সে দ্রুত কাপড় পরতে লাগল।খড়ের স্তূপের ওপর অচেতন হয়ে পড়ে থাকা মা রমানভ’নার জ্ঞান ফিরে এসেছিল। নাডিয়া মাকেও বের করে তৈরি করাল।
গ্রেভিল’ভখড়ের ওপরে পড়ে থাকা আৰক্ষীটির গলায় হাত দিয়ে বলল—‘মরে নি,অজ্ঞান হয়ে গেছে। ও জ্ঞান ফিরে পাবার আগেই আমাদের এখান থেকে চলে যেতে হবে। গ্রেবিল’ভ এবং নাডিয়াদুপাশেধরাধরি করে মাছারমানভ’নাকে বের করে আনল।
কিছুদূর আসার পরে ওরা এক জায়গায় বসে পড়ল। লজ্জা অপমানে নাডিয়ারদুচোখ দিয়ে জলের ধারা বইছিল। তার নিজের আত্মগ্লানি লাঘব করার জন্য গ্রেবিল’ভকে মনে মনেজিজ্ঞেস করল—‘তোর কেন দেরি হল গ্রেবিল’ভ?’
‘মানুষের খোঁজ করতে গিয়ে দেরি হল নাডিয়া। তাছাড়া আদালতের খবর আনতেও সময় লাগল।‘-সে বলল।
‘তোর আসতে দেরি দেখে আমি খাবারের খোঁজে গিয়েছিলাম। তাতেই বিপদ হল গ্রেবিল’ভ।‘
গ্রেবিল’ভ ক্ষীণ কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বলল—‘কোনো চিন্তা কর না নাডিয়া ।এখন দুপুর রাত। আমরা ভোরবেলাওখটিনস্কি সেতু বা ট্রাম লাইন পেয়ে যাব।‘
তার কথা শুনে নাডিয়া আশ্বস্ত হল।হয়তোসকাল হলে দুর্যোগের অন্ত পড়বে।
গ্রেবিল’ভ অন্ধকারে চারপাশে তীক্ষ্ণভাবে তাকিয়ে বলল—‘চল।‘
অনুবাদক