শারদ অর্ঘ্য প্রবন্ধ: লুুইস এলিজাবেথ গ্লুকের কবিতা । সায়মা মনি
নোবেল বিজয়ী কবি লুুইস এলিজাবেথ গ্লুকের জন্ম ২২শে এপ্রিল ১৯৪৩ সাল।বতর্মানে তিনি ৭৭। আর ৭৭ বছর বয়সী কারোর চেহারাও যে এমন সাহসী এবং ঐন্দ্রজালিক হতে পারে তা বোধহয় তাকে না দেখলে কখনো জানা হতোনা।তার ছবি তার ব্যাক্তিত্বের পরিচায়ক।তার জন্মের পূর্বে তার বড়বোন আর পরবর্তীতে তিনি নিজে এনেরোক্সিয়া নার্ভোসা রোগে ভুগতেন।এ রোগের ফলে রোগী খেতে পারেনা।তার মনে হয় তিনি মোটা হয়ে যাচ্ছেন।কিন্তু আসলে তিনি অস্বাভাবিক রকমের রোগা।তাকে সাত বছর মনস্তাত্বিক চিকিৎসাধীন থাকতে হয়েছে যা আখেরে ওনার কবিতা রচনায় কাজেই এসেছে।তার কবিতায় তার ব্যাক্তিজীবনের ছাপ বরাবরই থেকেছে। ব্যর্থ সম্পর্ক আর তার বিষাদ যেমন আছে তেমনি নিস্পাপ সত্ত্বার খোঁজ, সম্পর্কের নৈতিকতা নির্ধারণ করার চেষ্টাও তার কবিতায় আমরা পাই। তার জীবনের বাঁকে বাঁকে তাকে তার কবিতাই যে শক্তি যুগিয়েছে তার বেশ অনেকগুলো প্রমানও পাওয়া যায়।যেমন চার্লস হার্টজের সাথে বিয়ে হয় ১৯৬৭ সালে এবং অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই ডিভোর্স হয়।ডিভোর্সের পর ১৯৬৮ এ তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হলেও তিনি প্রায় তিন বছর রাইটার্স ব্লকে ভোগেন।হয়তো এই সম্পর্কের ভাঙনই এর পেছনে কাজ করেছে।রাইটার্স ব্লক কাটে ১৯৭১ সালে এবং ১৯৭৩ সালে তিনি প্রথমবারের মতো মা হওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। সুতরাং সম্পর্কই শক্তি ফিরে পাওয়ার পেছনে কাজ করেছে হয়তো।১৯৯৬ সালে জন ড্রেনোর সাথে ডিভোর্স হয়।এবং তাতে যৌথ ব্যাবসাও ক্ষতিগ্রস্থ হয়।সবটা মিলিয়ে যে অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে তাকে যেতে হয় তারও প্রতিফলন পাওয়া যায় সে সময়ের লেখা meadowlands কাব্যগ্রন্থে।শুধু যে সম্পর্কের কষ্টই আছে জীবনে তাতো নয়।অন্য কষ্টেও তিনি কিন্তু কবিতার আশ্রয়ই নিয়েছেন।তার বাড়িঘর পুড়ে গেল। মনের দুঃখে একিলিসের বিজয় কবিতাটি লিখলেন।তাই বলে সরাসরি মনের কষ্টের কথা কবিতায় বলবেন এমন জেলো তো আবার তিনি নন।একিলিসের বিজয় কবিতায় পেট্রোক্লাসের মৃত্যু একিলিসকে যেন তার মরণশীল প্রকৃতির কথাই মনে করিয়ে দেয়।যত ক্ষমতাধরই হোন না কেন সেও একজন মানুষের মতই। আগুনে বাড়িঘর পুড়ে যাওয়ায় গ্লুক কি তবে পার্থিব সব কিছুর অস্থায়ীতার কথাই নিজেকে মনে করিয়ে দিল!তিনি সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন প্রথমত তার দ্য ওয়াল্ড আইরিশ কবিতার জন্য।এখানে ফুুল মালির সাথে,দেবতার সাথে কথা বলে।একটি ফুলের বুদ্ধি, আবেগ এমনকি কন্ঠও আছে। পার্থিবতায় তিনি অপার্থিবতা নিয়ে আসেন।আবার যখন দেবতা পৃথিবীর আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তিত হয়ে কথা বলে তখন তাকে পার্থিব মনে হয়।আর বিভিন্ন পুরাণ কাহিনীতে দেব দেবীরা যখন মানুষের মনস্তত্বের ধারক হয় তখন অপার্থিবতা পার্থিবতার রূপ নেয়।যেমন ভক্তির পুরাকথায় হেডস তো অন্য যে কোনো প্রেমিকের মতোই।মোদ্দাকথা তার কবিতাগুলো একেবারেই আত্মানুসন্ধানী ধরনের।তা না হলে কি তিনি বলতেন, মানসিক আঘাতই জীবনের গূঢ়ার্থ নির্ণয়ের পথের দিকে নিয়ে যায়! এবং এভাবেই তিনি তার আবেগের তীব্রতাকে কবিতায়, হয়তো জীবনেও নিয়ন্ত্রন করে ধীরে ধীরে ত্রুটিহীন কবি সত্ত্বায় পরিনত হয়েছেন।তারপরেও তাকে অনেক ভুল বোঝাবুঝির সম্মুখীন হতে হয়েছে নানা কারনে। একদিকে যেমন দ্য ড্রাউনড চিলড্রেন কবিতাটি লেখার জন্য তাকে গ্রেগ কুজমা শিশু বিদ্বেষী বলেন।অন্যদিকে তার কবিতা এত সরল হওয়ার পরেও কেউ কেউ বুঝতে পারেনা এবং তার কবিতাকে টিনএজারের কবিতা বলেও মন্তব্য করে।লাল পপি কবিতায় সূর্যের আগুন আর অন্তরের আগুন এই দুই আগুনকেই শক্তির উৎস বলেছেন কবি।
আর আমি নিজেকে উন্মুক্ত করি।
আমার অন্তরের অাগুন
তাকে দেখাই।
যেমনি আগুন
জ্বলজ্বল
তাঁর উপস্থিতি
এখানে বোঝাই যায় কবি আগুনকে যে রূপকার্থে ব্যবহার করেছেন,সমালোচক তা বুঝতে পারেননি।এমনকি বাংলাদেশেও কিছু কিছু কুসমালোচক তাকে নারী কবি বলে নোবেল পেয়েছেন,এমন মন্তব্যও করেছেন বিভিন্ন পত্রিকায়।
কথায় আছেনা যে ছোটবেলার শেখা কোনকিছু বৃথা যায়না।নোবেল বিজয়ী কবির কবিতা পড়ে আমাকে যা সর্বপ্রথম আকৃষ্ট করলো তাহলো পৌরাণিক কাহিনীগুলোর ভিন্ন প্রেক্ষিতে বর্ণনা।আমি প্রথমে ধরেই নিয়েছি গ্লুক ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী। পরে মনে হলো ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী হোক বা না হোক পুরাণ কাহিনী এত প্রভাবিত করার কারন হলো ছোটবেলায় তিনি এইসব কাহিনী গল্পের মত করে তার বাবা মায়ের কাছে শুনেছেন এবং তারই ফল এটি।যেমন তার একিলিসের বিজয়, ভক্তির পুরাকথা,ইথাকা প্রভৃতির কথা বলা যায়।প্রতিটি কবিতাই কবির নিজস্ব চিন্তাভাবনাকে এমনভাবে প্রতিফলিত করে যে তা ভীষণভাবে সমসাময়িক হয়ে ওঠে।আবার আমরা একটু চমকে যাই আর ভাবি এই পুরাণ গল্পটাকে ঠিক এভাবেতো কখনো দেখা হয়নি।
নারী পুরুষ সমতার যুগে দাঁড়িয়ে একটি কথা আমার সবসময়ই মনে হয় সেটি হলো দুই ধরনের কোন কিছু কি করে সমান করা যায়।তাতে তো কাউকে ছোট করতে হবে অথবা কাউকে বড় করতে হবে।আমার মনে হয় এটা হতে পারে স্লোগান যে নারীকে হেয় করা যাবেনা।ছোট করা যাবেনা আর সমান মানতে হবে দুটো দুই বিষয়।নারী পুরুষ যে আলাদা তার বড় প্রমান হলো নারী পুরুষের সম্পুর্ন ব্যাক্তিগত সম্পর্ককে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পুর্ন ভিন্ন।যেই নারীর নিজের মতো করে দেখার ভঙ্গি আছে তা অন্য নারীর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ন হলেও পুরুষের থেকে আলাদা হয়।তবে হ্যাঁ পুরুষেরা যখন পুরুষ থেকে উত্তীর্ন হয় আর নারী যখন নারীত্ব থেকে উত্তীর্ণ হয় তখন তা আলাদা সত্ত্বায় পরিনত হয়।তখন সে সব কিছুর সাথেই নিজেকে একাত্ব করতে পারে।ইংরেজিতে যাকে বলে এন্ড্রোজেনাস।আমাদের আলোচ্য বিষয় এন্ড্রোজেনাস সত্ত্বা নিয়ে নয় বরং গ্লুকের নারী সত্ত্বা নিয়ে। সম্পর্ক নিয়ে যে দীর্ঘ সময় যাবত কষ্টের চিত্র আমরা তার জীবন কাহিনীতে এবং কবিতায় পাই তা আমাদেরকে কিন্তু তার নারী সত্ত্বা এবং নারীর দৃষ্টিকোণের কথাই মনে করিয়ে দেয়। গতানুগতিকতার দিক থেকে গ্লুকের কবিতা একেবারেই নারীবাদী নয়।তবে নারী দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে প্রচ্ছন্ন ভাবে।মাতৃত্বের কষ্টের চিত্র আমরা পাই উপকথা কবিতায়।আবার অন্য কবিতায় ___
“আমরা একসাথে দূরে চলে এসেছি
সমাপ্তিতে।
অবসানের ভয় আর পাইনা।
এমনকি আমি এই রাতের ব্যাপারেও
নিশ্চিত নই।
তবে আমি অবসানের অর্থ জানি।
আর তুমি, যে কিনা একজন মানুষের সাথে ছিলে।
আর প্রথমবার কান্নার পরে
আনন্দ নয়,
ভয় ছিল নিঃশব্দতায়।”
রুপালি লিলি কবিতার এই পংক্তিতে আমরাতো একজন নারীকে তথা একজন প্রেমিকাকেই কষ্ট পেতে দেখি।আবার নারীসুলভ মমতার চিত্রও পাওয়া যায় ঘুম পাড়ানি গান কবিতায়।প্রেমিকার সুখের চিত্রও আছে সুুখ কবিতায়।
মনস্তাত্বিক বিষয় বলতে প্রথমেই যেটা মনে হয় সেটা হলো গ্লুকের কবিতার কেন্দ্রবিন্দুতে যেন সম্পর্ক নিয়ে হতাশা থাকে।এবং এটা যেন দৃশ্যমান যে কবি লিখেছেন শুধুমাত্র তার ব্যাক্তিগত কষ্ট থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে।আচ্ছা এ কথাটা যত সহজে বলে দেয়া যায়, এর ভেতর দিয়ে যাওয়া কি ততটা সহজ ছিল! মোটেই তা নয়।একজন অনুভূতিপ্রবণ মানুষই কবিতা লিখে এটা যেমন সত্যি, একজন অনুভূতিপ্রবণ মানুষের মনে কষ্টগুলো বেজে ওঠে বেশি, এটাও একই রকম সত্যিই। টি.এস.এলিয়েটের ভাষায়, ” Human flesh cannot bear very much pain.”সেদিক থেকে লুইস গ্লুককে জীবনান্দ দাসের সাথে তুলনা করা যায়।দুইজনেরই কবিতার কেন্দ্রবিন্দুতে হতাশা আর বিষন্নতা রয়েছে।ছোটবেলায় গ্লুক দীর্ঘ সময় মানসিক রোগে ভুগেছেন। সাত বছর তাকে চিকিৎসাধীন থাকতে হয়েছে।আর তাই হয়তো তার কবিতায় হতাশা আর দুঃখই নয়, এর থেকে উত্তরনের বাস্তব সম্মত পথ পরিক্রমাও রয়েছে যা দিনশেষে আমাদের ভীষন প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে।এই ছেলেবেলার অস্বাভাবিকতা এবং মনস্তাত্বিক সমস্যার ভেতর দিয়ে তার যাত্রা, পরবর্তীতে সম্পর্কের ভেতর দিয়ে পাওয়া অশান্তি তাকে যেন এক নিরাভরণ সত্য আর সৌন্দর্যের দিকে পরিচালিত করে। কবিতা চর্চা তার জন্য একরকম ধর্মচর্চার রূপ নেয়।এর ফলে তার কবিতা অনাবশ্যক অলংকারের ভার বর্জিত একরকম সরাসরি সত্য অনুভূতির প্রকাশ হয়ে ওঠে।ফলে ব্যাক্তিগত কষ্টের অনুভূতি যেন সার্বজনীনতার রূপ পায়।
হ্যাঁ, ভয় পেয়েছিলাম
কিন্তু তোমাদের মাঝে এসে
আবার কাঁদছি।
নিশ্চয়ই ঝুঁকিই আনন্দ।
উপরোক্ত লাইনগুলো তুষারপাত কবিতা থেকে নেয়া যেখানে ব্যাক্তিগত কষ্ট আর তা থেকে উত্তরণের পথ বাতলে দেয়া আছে আর এভাবেই কবিতাটি সার্বজনীন হয়ে ওঠে।আবার অন্যদিকে ভক্তির পুরাকথা কবিতায় পাই
একটি নকল পৃথিবীতে
শুধু সেখানে ভালোবাসা থাকবে
সবাই তো ভালোবাসা চায়, তাই না?
যেখানে নারী পুরুষের ভালোবাসার সংজ্ঞায় যে বিস্তর ফারাক তা এমন রূপকের সাহায্যে দেখানো হয়েছে যে প্রথম পাঠে হাসি আটকানো মুশকিল হয়ে যায় এবং মুহুর্তের মধ্যেই বিষাদ ভর করে কেননা নারী পুরুষের এই দুরত্ব দূর করা দুই মেরুকে এক করার মতোই অসম্ভব মনে হয়।পুরুষের মন বোঝাতে দেবতাকে রূপকাকারে নেয়া হলেও সত্যিই তো পুরুষের অধিকারবোধের বাড়াবাড়িতে কত নারীর জীবন বিষিয়ে ওঠে, ক’জন তার খোঁজ নেয়।আবার উল্টোটাও হয়।নারীর নিরাপত্তাহীনতার বোধ বেশি হলে সেও বাড়াবাড়ি করে পুরুষের জীবন বিষিয়ে দেয়।মাঝখান থেকে ভালোবাসা উড়াল দেয় বৈকি।বাড়াবাড়িটুকুই সম্পর্কে থেকে যায় ভালোবাসার ভুল সংজ্ঞা বহন করার জন্য।অথচ ক’জন আমরা তা তলিয়ে দেখি।লুইজ গ্লুক এমন পরিমিতিবোধের সাথে সমসাময়িকতা ধরে রেখে পুরাণ কাহিনীকে ব্যাবহার করেছেন যে আমাদের যেন তৃতীয় চক্ষু খুলে যায়।
প্রেমের জন্য কবির যে আকুতি তা সর্বত্র প্রকট এবং চিরন্তন একটা ছাপ রেখে গেছে যেন।সকাল নয়টায় স্বগোতক্তি কবিতায় দেখতে পাই যে কবি হয় তার মৃত্যু কামনা করছে নয় তার প্রেমিকের সম্পুর্ন নিঃশর্ত প্রত্যাবর্তন কামনা করছে।জীবনের এত চরাই উৎরাই পার হয়েও যে আকূলতা তার প্রেমিকের জন্য,সম্পর্কে সুখী হওয়ার জন্য তা তার নিষ্পাপ মনেরই পরিচয় দেয়।কবিতাই তার ভালো থাকার শক্তিও যুগিয়েছে আবার একই সাথে তার মনের বিশুদ্ধতাও ধরে রেখেছে।কবিতাই তার মনের পবিত্রতা ধরে রাখে হয়তো।
লুুইস গ্লুকের যাপিত জীবন আর জারিত জীবন তথা কবি জীবন বিশ্লেষন করে মনের কোণে যেন একটি আলো জ্বলে উঠলো।মনে হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের সুরে গাই
আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে ॥
তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে ॥
জীবনের যত বাঁকে বাঁকে যত দুঃখ, মৃত্যু আর হতাশাই জীবন লুকিয়ে রাখুকনা কেন তার সর্বোৎকৃষ্ট রূপান্তর ঘটানোও সম্ভব।কবি লুুইস গ্লুক তা করে দেখিয়েছেন।প্রতিটি সৃজনশীল মানুষই তার সৃজনীশক্তিটুকু জীবনের কাছ থেকে পাওয়া এইসব মানসিক আঘাত থেকেই সংগ্রহ করে।এই আলোর বিচ্ছুরণই তার কবিতায় পাওয়া যায়।
তিনি ইংরেজি সাহিত্যের নিয়ে পড়াশুনা করে এখন এম ফিল করছেন টি.এস. এলিয়েটের কবিতা নিয়ে।বর্তমানে শিক্ষকতার সাথে জড়িত আছেন।