শারদ সংখ্যা গল্প: ভয়ংকরোবট । কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
গ্ল্যান্স স্টুয়ার্ট তার প্রাত্যহিক কাজগুলো নিয়ে বড় ব্যস্ত ছিল । এমন সময় খবরটা এল । কানাডার সাস্কাচুন শহরের উপর সবে যে অ্যান্টি-গ্র্যাভিটি শহরটা তৈরী হয়েছে, তার মধ্যে থেকে সবচেয়ে বড় বড় বিল্ডিংগুলো হঠাৎ হঠাৎ নাকি নীচে পড়ে যাচ্ছে ।
যদিও ওই বিল্ডিংগুলোয় এখনও লোকবসতি শুরু হয়নি, কিন্তু ওগুলো অমন আকস্মিকভাবে নীচে পড়তে থাকার ফলে তাদের ঠিক নীচে যে বাড়িগুলো রয়েছে, সেগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে । আর এতে শুধু যে বাড়িগুলোর ক্ষতি হচ্ছে তা নয়, সেইসঙ্গে আহত ও নিহত হচ্ছে সেইসব বাড়ির নিরীহ বাসিন্দারা । কিন্তু বহু খোঁজখবর করেও এখন অবধি এই রহস্যময় ঘটনার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি ।
মোটামুটি এই হল খবর । মাঝখান থেকে অন্য বাড়িগুলোর বিভিন্ন ফ্ল্যাটের জন্য যারা অ্যাডভান্স দিয়ে রেখেছিল, তারা এসে তড়িঘড়ি যে যার টাকা ফিরিয়ে নিয়ে গেছে । ফলে আগামী সপ্তাহে শহরটা যে চালু হওয়ার কথা ছিল, তা পিছিয়ে গেল । এবং এর ফলে জনসংখ্যা প্রতিদিনই যে হারে বাড়ছে, তাতে বহু লোককে ফুটপাথে রাত কাটাতে হবে ।
গ্ল্যান্স নিজে থাকে লস্ অ্যাঞ্জেলসে এবং কাজ করে ইসু (ICU) বা ইনভেস্টিগেশন সার্কেল অব্ ইউনিভার্সের নর্থ আমেরিকান ডিভিশনে । এখানে ক্যালিফোর্নিয়া ব্রাঞ্চের পুরোটাই তার দায়িত্বে । কাজেই কানাডা ব্রাঞ্চের সিনিয়র অফিসার মিঃ তাকাহিতো যখন তাকে নিজে এ ব্যাপারটা দেখতে বললেন, তখন সে প্রত্যাখ্যান করতে পারল না ।
এই জাপানি ভদ্রলোকের কোন কথাই ফেরানো যায় না । এতবড় একজন অফিসার, অথচ কী অপূর্ব যে তাঁর ব্যবহার ! যে-কোনও বরফসাফাই কর্মীর সঙ্গে বা লিফ্টম্যানের সঙ্গে পর্যন্ত ভদ্রলোকের টার্মস এত ভালো যে গ্ল্যান্সের মতো লোক, যে কিনা ঠিক টাইমে খাবার না পাওয়া ছাড়া আর কোনও বিষয়ে রেগে ওঠে না, সে-ও পর্যন্ত চিন্তা করে যে ভদ্রলোক কী করে সর্বদা এত ঠান্ডা মাথায় কাজ করেন !
কানাডা অফিসে যখন গ্ল্যান্সের উভচর যান এয়ারোড্স্ গিয়ে পৌঁছোল, তখন আকাশে লুমিসানটা উঠে পড়েছে, তার মানে সন্ধ্যা নামল । গত অর্ধ-শতাব্দী ধরে সূর্য ডোবার সময় থেকেই অপরদিক থেকে ‘লুমিসান’ নামে এই বিকল্প সূর্যটি উঠতে থাকে ; ফলে চাঁদের কমা-বাড়ায় মানুষের আর কিছু যায় আসে না । কারণ এই নকল উপগ্রহটিকে সূর্যের গতি ও ঘূর্ণনপথ অনুযায়ী এমনভাবে ছাড়া হয়েছে, যে তা ঠিক সূর্যের অপরদিকে ঘুরে চলে আর একটা স্নিগ্ধ অথচ দীপ্তিময় আলোয় ভরিয়ে রাখে রাতের পৃথিবী ।
মিঃ তাকাহিতো বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন, গ্ল্যান্সকে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন । কফি খেতে খেতে আসল কথায় এল গ্ল্যান্স । কিন্তু সে রীতিমতো অবাকই হয়ে গেল, যখন দেখল মিঃ তাকাহিতোর মতো মানুষটিও, কেন কে জানে, ভীষণ নার্ভাস আর উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন ।
‘আপনি হয়তো অন্য অনেকের মতোই অবাক হবেন গ্ল্যান্স’,মিঃ তাকাহিতো বললেন, ‘যদি আমি বলি যে এসব কেন হচ্ছে আমি জানি । কিন্তু না, শুধু সন্দেহের ওপর নির্ভর করে, সে সন্দেহ যতই নিশ্চিত হোক, কিছুতেই অন্যায় দোষারোপ করা ঠিক হবে না । আমি শুধু অপেক্ষায় আছি । যেদিন সুযোগ পাব . . .’
পরের কথাগুলো বিড়বিড় ক’রে বলায় আর শোনা গেল না, কিন্তু মিঃ তাকাহিতোর মুখচোখ এত লাল হয়ে উঠেছে কেন ?
‘মিঃ তাকাহিতো, আপনি কি আমায় একটুও হিন্ট্স্ দিতে পারেন না, যে, কার কাছ থেকে আপনি এই আঘাতটা পেয়েছেন ? নো নো স্যার, প্লিজ চাপবার চেষ্টা করবেন না । জানেনই তো আমার চোখটা শকুনের চোখ বলে খ্যাতি আছে, সেই শকুনি-চোখে যখন ধরা পড়েছে আপনার দুর্লভ উত্তেজনা, তখন আপনাকে সবকিছু আজ খুলে বলতেই হবে । প্লিজ ।’
সংযত গলায় বলেন তাকাহিতো, ‘শুনবেন ?’
‘নিশ্চয়ই । বলুন আপনি ।’ সাগ্রহে নড়েচড়ে বসে গ্ল্যান্স ।
কিন্তু মিঃ তাকাহিতো সেই মুহূর্তে কী যেন বলতে গিয়েও বললেন না । থেমে গিয়ে চুপ করে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবতে থাকেন। অন্যমনস্কভাবে টেবিলের ওপর পেপারওয়েটটা নিয়ে নাড়াচাড়া করেন খানিকক্ষণ । আর তাঁর মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে প্রতীক্ষা করে গ্ল্যান্স । ওর মনের ভেতরে তখন কৌতূহলের তুমুল নড়াচড়া।
কেটে যায় বেশ কিছু মুহূর্ত । তারপর হঠাৎই শুরু করেন তাকাহিতো ।
‘গ্ল্যান্স, আপনি তো জানেন, কানাডার কয়েকটি প্রধান এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার হাতে । আর সেই দায়িত্ব আমি বরাবর সাফল্যের সঙ্গেই পালন করে আসছি । কিন্তু আজ এই পরিস্থিতি এসে দাঁড়িয়েছে যে, আমাকে হয়তো শো-কজের মুখোমুখি এসে দাঁড়াতে হবে । কারণ, খুব শীঘ্রই বোধহয় প্রমাণিত হতে চলেছে যে, আমার কর্মক্ষেত্রে আমি সম্পূর্ণ অপদার্থ ।’
অবাক হয়ে গ্ল্যান্স প্রশ্ন করে, ‘তার মানে ?’
মৃদু বিষণ্ণ হাসেন মিঃ তাকাহিতো, ‘মানেটা বুঝতে গেলে আপনাকে প্রায় সাড়ে-সাত বছর পিছিয়ে যেতে হবে । তবে তার আগে আপনি বলুন, এই যে বাড়িগুলো ভেঙে পড়ছে, এ-ব্যাপারে আপনার ধারণা কী ?’
গ্ল্যান্স ভ্রূ কুঁচকে কিছুক্ষণ চিন্তা করে । তারপর ধীরে ধীরে বিশ্লেষণের ভঙ্গীতে বলে, ‘দেখুন মিঃ তাকাহিতো । এ-ব্যাপারে আমার মনে হয়, সম্ভাবনা দুটো । এক, হয়তো প্রথম থেকে টেকনিক্যালি কোন ত্রুটি থেকে গেছে কোনও কোনও বাড়িতে ; আর সেই বাড়িগুলোই হঠাৎ অ্যান্টি-গ্র্যাভিটি পাওয়ার ফেল করায় এইভাবে পড়ে যাচ্ছে । অথবা দুই, যেভাবেই হোক এর মধ্যে কোন স্যাবোটাজের ব্যাপার আছে । অর্থাৎ কোনও নাশকতামূলক চক্রান্ত । কিন্তু প্রশ্ন হল, স্যাবোটাজই যদি হয়, তাহলে কেন ? উদ্দেশ্যটা কী ? এবং কে বা কারা আছে এর পেছনে ?’
গ্ল্যান্সকে সাপোর্ট করার ভঙ্গীতে মাথা নাড়েন মিঃ তাকাহিতো, ‘বাঃ ! আপনার কথাগুলো খুবই যুক্তিসংগত ; কিন্তু গ্ল্যান্স, আপনার এই দুটো যুক্তিই যে হালে পানি পাচ্ছে না । কারণ প্রথমত আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা গত তিনদিন ধরে নতুন বাড়িগুলো থরোলি চেক-আপ করে দেখেছেন, এবং যে ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক ফিল্ডের সাহায্যে বাড়িগুলো ভেসে আছে, সেখানে কোনও টেকনিক্যাল ফল্ট খুঁজে পাননি । তা সত্ত্বেও গত তিনদিনে আরও দুটো বিল্ডিং পড়ে গেছে ।’
একটু দম নিয়ে যোগ করেন তিনি, ‘আর দ্বিতীয়ত, আমাদের সিকিওরিটি সিস্টেম যেরকম জোরদার, তাতে স্যাবোটাজ করার কোনও সুযোগই নেই । অন্তত ওপরমহল থেকে সেরকমই বলা হচ্ছে । অথচ দেখুন, ঘটনাটা কিন্তু ঘটছে । আমাদের সামনেই ঘটছে, কিন্তু আমরা কোন কূলকিনারা করতে পারছি না । তাহলেই ভাবুন, সমস্যাটা কেমন গুরুতর ।’
মাথা নেড়ে সায় দেয় গ্ল্যান্স । একমনে ভাবতে থাকে পরিস্থিতির গুরুত্ব । আর তখনই ওকে চমকে দিয়ে বলে ওঠেন মিঃ তাকাহিতো, ‘কিন্তু কথাটা কী জানেন গ্ল্যান্স, আসলে এটা স্যাবোটাজই । ইয়েস । এ-ব্যাপারে কোন ভুল নেই । এবং এই স্যাবোটাজের একমাত্র লক্ষ্য আমি ।’
হতবাক গ্ল্যান্স বলে ওঠে, ‘মানে ?’
‘মানে হল এই যে, আমার জীবনে গত সাত বছর ধরে রাহুর মতো লেগে থাকা এক শয়তান আর তার শয়তানী বুদ্ধির খেলার পরিণতি এই ঘটনা । গ্ল্যান্স, আপনি কি জানেন, ওই যে বাড়িগুলো পড়ে যাচ্ছে, ওই প্রত্যেকটা বাড়ির তলায় আছে শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাড়িগুলো ! অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে সেই বাড়িগুলোকেই অকেজো করে ফেলে দেওয়া হচ্ছে — যার তলায় থাকা বিভিন্ন বাড়িতে আছে বেশ কিছু সরকারী দফতর, যেগুলো নষ্ট করে দিয়ে একটা চতুর নৃশংস খেলার মাধ্যমে আমাকে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে কঠিন ফাঁদে । কারণ ঠিক ওই অঞ্চলেরই চল্লিশ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে থাকা সমস্ত সরকারী দফতরের সুরক্ষার দায়িত্ব আমারই ।’
এতখানি একসঙ্গে বলে উত্তেজনায় হাঁফাতে থাকেন মিঃ তাকাহিতো । সেই ফাঁকে বলে ওঠে গ্ল্যান্স, ‘সে কী ! এ তো একটা ভয়ংকর খেলা ! অথচ আপনারা বুঝেও কিছু করে উঠতে পারছেন না ?’
‘উঁহু, আপনি ভুল করছেন গ্ল্যান্স । ‘আমরা’ নয়, আমি । এই ব্যাপারটা এখন পর্যন্ত শুধু আমিই টের পেয়েছি । তবে প্রমাণ তো আমার হাতে কিছু নেই, তাই এখনও পর্যন্ত কোনও স্টেপ নিতে পারিনি । আর ঠিক এজন্যেই আমি আপনার দ্বারস্থ হয়েছি গ্ল্যান্স, কারণ একমাত্র আপনার মতো একজন চৌখশ লোকই পারে এ সমস্যার সুরাহা করতে, এবং আপনি তা পারবেনও, আমি জানি ।’
কিন্তু তার আগে তো পুরো ইতিহাসটা আমার জানা দরকার মিঃ তাকাহিতো । সেই সাত বছর আগের ঘটনা আর সেই মহান ব্যক্তিটির পরিচয় — সবকিছু বলুন আপনি ।’
‘নিশ্চয়ই । সব, সব বলবো আপনাকে । তবে তার আগে আর এক রাউন্ড কফি বলে আসি, কী বলেন ?’
মাথা হেলায় গ্ল্যান্স । মিঃ তাকাহিতো উঠে দরজার দিকে এগিয়ে যান ।
আধঘন্টা পরে মিঃ তাকাহিতোর চেম্বার থেকে বেরিয়ে এল গ্ল্যান্স স্টুয়ার্ট । ওর অবিচল পদক্ষেপে প্রতি মুহূর্তে ধরা পড়ছিল এক কঠোর সংকল্পের চিহ্ন । এই ধ্বংসাত্মক খেলায় ওকে পরিত্রাতার ভূমিকা নিতে হবে । খুঁজে বার করতে হবে এ খেলার প্রধান খেলোয়াড়কে । দিকচিহ্নহীন এই অন্ধকারে সামান্য একটা আলোর রেখা মিঃ জোসেফ মার্টিন নামের এক ধুরন্ধর ব্যক্তির আউটলাইন । ব্যস্, আর কিছু নেই । এটুকু সম্বল করেই ওকে এগোতে হবে ।
তাকাহিতোর সঙ্গে কথোপকথনে পুরনো সব কথাই জানা হয়ে গেছে গ্ল্যান্সের । এই মার্টিন নামের ভদ্রলোক একজন উচ্চপদস্থ সরকারী আমলা । আজ থেকে সাড়ে সাত বছর আগে এক গোপন সরকারী তথ্য পাচারের অভিযোগে আরও দুজন অফিসারের সঙ্গে অভিযুক্ত হয়েছিলেন তিনিও । কিন্তু বাকি দুজনের শাস্তি হলেও মিঃ মার্টিন শেষ মুহূর্তে জাল কেটে বেরিয়ে যান । আর যেহেতু মিঃ তাকাহিতোই ছিলেন সেই ঘটনার কান্ডারি, তাই তারপর থেকেই মিঃ মার্টিনের গোপন প্রতিশোধের আগুনে জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে মিঃ তাকাহিতোর জীবন । সেই আগুনে আহুতি দিয়েছেন মিঃ তাকাহিতোর স্ত্রী । একমাত্র ছেলেকে সেই প্রতিশোধস্পৃহা থেকে বাঁচাতে শিকাগোয় পড়তে পাঠাতে বাধ্য হয়েছেন তাকাহিতো । এবং এখন, সম্ভবত সেই একই কারণে তাঁর বিরুদ্ধে এই জঘন্য চক্রান্ত ।
যদিও এখন পর্যন্ত এটা তাঁর অনুমান ও সন্দেহই, কিন্তু গ্ল্যান্সও যুক্তিপরম্পরা অনুযায়ী এটাকে একেবারে অমূলক বলে উড়িয়ে দিতে পারেনি । আবার সঠিক প্রমাণ ছাড়া এ সন্দেহকে আঁকড়ে থাকাটাও কাজের বলে মনে হয়নি । তাই মিঃ তাকাহিতোর সহকারী রডরিগ্জ্-কে ডেকে প্রয়োজনীয় দু-চারটি নির্দেশ দিয়েছে সে । তাকাহিতোকে আশ্বাসবাণী শুনিয়েছে । আর তারপর দরকারি দুটি ডেটা-ফাইল ওর অপটিক্যাল প্যাডে লোড করে নিয়ে বিদায় নিয়েছে তাকাহিতোর কাছ থেকে । আজ রাত জেগে তাকে কিছু পড়াশোনা করতে হবে । তৈরী হতে হবে আগামী পদক্ষেপের জন্য ।
রডরিগ্জ্ ছেলেটি খুব করিৎকর্মা । সকাল এগারোটায় তাকাহিতোর চেম্বারে যখন পা রাখলো গ্ল্যান্স, তখনই ওর নির্দেশমতো দরকারি সিসিটিভির ফুটেজগুলি নিয়ে এসে টেবিলে সাজিয়ে ফেলেছে রডরিগ্জ্ । সুতরাং, দেরি না করে একটা আলাদা ঘরে গিয়ে চটপট কাজে লেগে পড়লো গ্ল্যান্স । একের পর এক গত দশ দিনের ফুটেজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলো সে । ওই ফুটেজগুলো নতুন শহরের আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকা গুপ্ত ক্যামেরার ফসল । এই রহস্যের কোন-না-কোন সূত্র এর মধ্যেই খুঁজে পাবে বলে ওর বিশ্বাস ।
প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে তন্নতন্ন করে সব ফুটেজ দেখা শেষ করে বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে বসল গ্ল্যান্স । উত্তেজনায় ওর শরীরের সমস্ত শিরা টানটান । অবশেষে একটা আলোর রেখা দেখতে পেয়েছে সে ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকাহিতোকে ডেকে পাঠায় গ্ল্যান্স । আর তিনি আসামাত্রই স্ক্রিনে ফুটে ওঠা একটি ছবির দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে বলে, ‘মিঃ তাকাহিতো, এই লোকটিকে চেনেন ?’
‘এ কী ? এ তো ইঞ্জিনিয়ার মার্ক অ্যালেন !’ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে গ্ল্যান্সের দিকে তাকান মিঃ তাকাহিতো, ‘আপনি কি একে সন্দেহ করছেন নাকি গ্ল্যান্স ? না, না, আপনি বোধহয় ভুল করছেন । এর রেকর্ড তো মারাত্মকরকম ভালো । তা ছাড়া . . .’
একটু ভেবে নিয়ে মিঃ তাকাহিতো বলেন, ‘একেও কিন্তু আমাদের সিকিওরিটি চেকের বাইরে রাখা হয়নি । অথচ প্রত্যেক ঘটনার সময় ওকে ওর টেবিলে বসে কাজ করতে দেখা গেছে । সেক্ষেত্রে . . .’
মৃদু হাসি খেলে যায় গ্ল্যান্সের ঠোঁটের কোণে । ওর গলায় আত্মপ্রত্যয়ের সুর, ‘তবুও মিঃ তাকাহিতো, ওটাই আমার চাঁদমারি । কী কারণে, সেটা না হয় পরেই জানবেন । আপাতত এই লোকটির পুরো ডিটেল আমার চাই। আধঘন্টার ভেতর ।’
বেলা আড়াইটে নাগাদ গ্ল্যান্সকে বসে থাকতে দেখা গেল জোসেফ মার্টিনের টেবিলের উল্টোদিকে । ভদ্রলোক ভীষণ হাসিখুশি আর অমায়িক । লাঞ্চটাইমেও খেতে যাননি, উলটে গ্ল্যান্স দেখা করতে চাইলে তৎক্ষণাৎ সম্মতি দিয়েছেন । ওনার সঙ্গে কথা বলতে বলতে গ্ল্যান্সের মনে তো রীতিমতো প্রশ্ন উঠে গেল, মিঃ তাকাহিতোকে কতটা বিশ্বাস করা যায় ? উনিই কি আসলে ভুল পথে চালাতে চাইছেন গ্ল্যান্সকে ?
মিঃ মার্টিন তখন বলছেন, ‘দেখুন মিঃ স্টুয়ার্ট, সব পার্সোনাল কন্ট্রাক্টের ফাইল আমার কাছে থাকে বটে, কিন্তু সব ডেটা তো আমার মুখস্থ থাকে না । আপনি নির্দিষ্ট করে বললে আমার সুবিধা হয় ।’
‘বেশ । তাহলে বলুন তো মিঃ মার্টিন, মার্ক অ্যালেন নামে কোনও ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারকে আপনি চেনেন ?’
মুহূর্তের জন্য একটা সতর্ক ভঙ্গী খেলা করে গেল জোসেফ মার্টিনের চোখেমুখে, যা গ্ল্যান্স স্টুয়ার্টের শকুনি চোখকে এড়াতে পারল না । আর সেই মুহূর্তে ওর মনে হল, যাক, অঙ্ক মিলেছে । এবার নিশ্চিন্তে খেলা শুরু করা যায় ।
ততক্ষণে মিঃ মার্টিন সামলে নিয়েছেন নিজেকে । আর আগের মতোই অমায়িক হেসে গ্ল্যান্সকে বোঝাতে শুরু করেছেন যে, চেনা তো দূরের কথা, মার্ক অ্যালেন নামটাই শুনেছেন কি না তা-ই তাঁর মনে পড়ছে না ।
‘কিন্তু মিঃ মার্টিন, রেকর্ড বলছে যে এই ব্যক্তিটির রিক্রুটমেন্ট নাকি আপনিই অ্যাপ্রুভ করেছিলেন !’
এক মুহূর্তের জন্য থমকে যান মার্টিন । স্থির চোখে গ্ল্যান্সের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘দেখুন মিঃ স্টুয়ার্ট, ওরকম অনেককে আমি চাকরি করে দিয়েছি । কিন্তু সবার নাম মনে রাখতে হবে, এমন মাথার দিব্যি তো আমায় কেউ দেয়নি ।’
গ্ল্যান্সের উদ্দেশ্যসিদ্ধি হয়ে গিয়েছিল । তাই আরও দু-চারটে কথাবার্তার পর সে-ও এক বিনীত অমায়িক হাসি উপহার দিয়ে বিদায় নিল মার্টিনের কাছ থেকে । তবে আসার আগে ছোট্ট একটা অত্যাবশ্যকীয় কাজ সে করে এসেছে । মার্টিনের ঘরে লাগানো সিসিটিভি-র অলক্ষ্যেই একটা মাইক্রোচিপ লাগিয়ে এসেছে মার্টিনের টেবিলের তলায়, যার পরবর্তী সমস্ত রেকর্ডিং পৌঁছে যাবে রডরিগ্জের সার্ভারে ।
সাস্কাচুন শহরের প্রত্যন্ত একটা অঞ্চলে গ্ল্যান্স তার এয়ারোড্স্টা নামাল । রাত বেশ খানিকটা গড়িয়েছে । লুমিসানের মায়াবী আলোয় এখানকার নির্জনতা আরও প্রকট । মাঝে মাঝে একটা হিমেল হাওয়াও বইছে । স্কার্ফটা আর একটু ভালো করে গলায় এঁটে নিল গ্ল্যান্স । কিছুটা দূরে একটা গোল গম্বুজের মতো বাড়ি দেখা যায় । ওর কাছে যা ইনফর্মেশন আছে, সেই অনুযায়ী ওটাই ওর লক্ষ্য হওয়া উচিত । খুব সাবধানে চারপাশটা দেখে নিল ও । একবার রিস্টওয়াচটার দিকে তাকাল । তারপর নিঃশব্দে এগিয়ে গেল বাড়িটার পিছন দিকে, যেখানে বাড়ির লাগোয়া বড় একটা চৌকো ট্যাঙ্ক । তার আড়ালে লুকিয়েই ওকে ঢুকতে হবে বাড়ির ভেতর ।
ঢোকার দরজাটা খুঁজতে গিয়েই হঠাৎ কাচের আধখোলা জানলাটা দেখতে পেয়ে গেল গ্ল্যান্স । বাড়ির দেওয়ালে মিশে গিয়ে জানলা দিয়ে ভেতরে তাকাল । আর তখনই ওকে অবাক হয়ে যেতে হল । এটা বাইরে থেকে বাড়ির মতো দেখালেও আসলে বিরাট বড় একটা গোডাউন । আর এর ভেতরটায় ভর্তি হয়ে আছে নানান ছোট-বড় ইলেকট্রিক্যাল আর ইলেকট্রনিক্স মেশিন । কয়েকটা প্যানেল, কন্ট্রোল ডেস্ক আর চালু মনিটর বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, রীতিমতো জাঁকালো কোনও কাজ হচ্ছে এখানে । খুঁটিয়ে দেখতে দেখতেই হঠাৎ চমকে উঠলো সে । একধারে একটা পার্টিশনের আড়াল থেকে ভেসে আসছে উত্তেজিত গলার আওয়াজ ।
আর দেরী করা সমীচীন মনে করলো না গ্ল্যান্স । বুকপকেট থেকে একটা ছোট্ট ডিজিটাল যন্ত্র বার করে তার বোতাম টিপতেই যন্ত্রটা সময় গুনতে শুরু করল । এই মুহূর্ত থেকে ওটা একটা সিগন্যাল ছড়িয়ে দিতে শুরু করেছে একটা বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সিতে । নিশ্চিন্তে যন্ত্রটা পকেটে রেখে ভেতরে ঢোকে সে । আর ঢুকতে ঢুকতেই শুনতে পায় একটা অচেনা গলার তীব্র ঝাঁঝ ।
‘দেখুন, আপনার এই সহজ খেলাটা না বোঝার মতো বোকা আমি নই । আমি সরে যাওয়া মানে পুরো দায়টা আমার ঘাড়ে চাপবে, আর সে ফায়দাটা লুটবেন আপনি । কারণ তখন আর আপনাকে জড়ানোর সুযোগ কেউ পাবে না, তাই তো ?’
‘সেটা এখনও কেউ পাবে না মার্ক ।’ এবার একটা চেনা কন্ঠ, কিন্তু সেই মোলায়েম কন্ঠে এখন একটা হিলহিলে সুর, ‘কারণ আমি সেই সুযোগটা দিই না । কিন্তু এই মুহূর্তে কাজ বন্ধ করতেই হবে, কারণ ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের নজর পড়ে গেছে আমাদের দিকে । আমায় নিয়ে চিন্তা কোরো না, আমি ঠিক সামলে নেব । কিন্তু তোমাকে বাঁচতে গেলে পালাতেই হবে মার্ক ।’
‘বেশ, তাহলে আমার আরও পঞ্চাশ হাজার ডলার চাই ।’
‘মানে ? আমি তো তোমার পুরো টাকাটাই দিয়ে দিয়েছি ।’
‘তা দিয়েছেন । কিন্তু মিঃ মার্টিন, অন্য দেশে গিয়ে সেট্ল্ করতে গেলে ওই টাকাটা যে আমার চাই । না হলে আপনার দায়টাও আপনি এড়াতে পারবেন না । সেটা ফোকাস্ড্ হয়ে যাবে ।’
‘হোয়াট ! তুমি আমায় হুমকি দিচ্ছ ! আমাকে হুমকি দেওয়ার পরিণামটা কী জানো মার্ক ? তোমার লাইফটা বরবাদ করতে আমার একটা গোটা দিনও লাগবে না ।’
‘জানি মিঃ মার্টিন । কিন্তু আপনি যেটা জানেন না সেটা হল, আমি কিন্তু মিঃ তাকাহিতোর মতো ভালোমানুষ নই । কাজেই এ-কাজের দায় যখন নিতেই হচ্ছে, তখন টাকাটা আমার চাই, এবং সেটা এই মুহূর্তে।’
‘কিন্তু টাকাটা নেবে কে মিঃ মার্ক অ্যালেন ? আপনি নিজে, না কি আপনার ওই থ্রি-ডি ইমেজ, যাকে টেবিলে বসিয়ে দিয়ে নিজে সবার অলক্ষ্যে বাড়িগুলোকে ধ্বংস করে চলেছেন ?’
অতর্কিতে রঙ্গমঞ্চে ঢুকে পড়েছে গ্ল্যান্স এবং হতভম্ব দুই প্রতিপক্ষকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে চলেছে, ‘তা এই টেকনিক্যাল বুদ্ধিটা কার ? মার্ক অ্যালেন নামের এক নষ্ট হয়ে যাওয়া ইঞ্জিনিয়ারের, না কি আপনার, মিঃ নাটের গুরু ?’
মার্ক অ্যালেন তখনও হতবাক । কিন্তু জোসেফ মার্টিন অন্য ধাতুতে গড়া । হতচকিত ভাবটা কাটিয়ে উঠতে তার দু-সেকেন্ডও লাগেনি । তাই কথা বলতে বলতে গ্ল্যান্স খেয়ালই করেনি, কখন মিঃ মার্টিনের হাতে উঠে এসেছে একটা লেসার রিভলভার । আর খেয়াল করামাত্রই যখন ডানদিকে ঝাঁপ দিল গ্ল্যান্স, তখনই বুঝল যে এক পলকের জন্য মৃত্যুর দিগন্ত ছুঁয়ে ফিরে এল সে । রশ্মিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে একটা ইলেকট্রনিক ডিভাইসে আগুন ধরিয়ে দিল ।
সার্কিট পোড়ার গন্ধটা নাকে আসতে আসতেই গ্ল্যান্স লক্ষ্য করছিল, মার্টিন আবার অস্ত্র তাক করছেন, কিন্তু সেই মুহূর্তে একসঙ্গে দুটো ঘটনা ঘটল । দুজন সিকিওরিটি অফিসার বিদ্যুতের গতিতে এসে মার্ক অ্যালেনের দখল নিয়ে নিল, আর একইসঙ্গে শেরিফ মিঃ ম্যালকমের হাতের অস্ত্র থেকে একটা রশ্মি এসে মিঃ মার্টিনের কনুইয়ের কাছ থেকে ডানহাতটা উড়িয়ে দিল ।
এরা কখন কীভাবে ঢুকে পড়েছে তা বোঝাই যায়নি; কিন্তু এর পরের ঘটনাটার জন্য কেউই তৈরী ছিল না, তাই উপস্থিত প্রত্যেকে যেন অকস্মাৎ স্থবির হয়ে যে যার জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল । সকলের বিস্ফারিত দৃষ্টির সামনে মিঃ মার্টিনের উড়ে যাওয়া কনুই থেকে একগাদা তার আর স্প্রিং মেশানো একটা যান্ত্রিক অংশ বেরিয়ে এসেছে । আর মিঃ মার্টিনের একটা পৈশাচিক হাসির সঙ্গে সেই হাতেই যেন একটা বৈজ্ঞানিক ভেলকি শুরু হয়ে গেছে । বিভিন্ন রঙের তার, স্প্রিং, রড ঘুরিয়ে, বেঁকে, পরস্পর জড়িয়ে তৈরী হয়ে চলেছে কনুই থেকে কবজি, তালু আর আঙুলের স্বাভাবিক গঠন; আর একইসঙ্গে তার ওপরে ক্রমাগত প্রলেপ ফেলে চলেছে একটা বডি কালারের অর্গানিক ফাইবারের আস্তরণ; সব মিলিয়ে একেবারে নিখুঁতভাবে আবার আগের জায়গায় ফিরে আসছে মিঃ মার্টিনের হারিয়ে যাওয়া হাত ।
সম্বিত ফিরে পেতে দু-এক মুহূর্ত সময় লাগলো গ্ল্যান্সের । আর তার পরেই সে প্রায় বাজপাখির মতো উড়ে গিয়ে পড়লো মার্টিনের ওপর । ওর একহাত বাঘের থাবার মতো চেপে বসল মার্টিনের ঘাড়ে, আর অন্য হাতের লোহার সাঁড়াশির মতো আঙুল দিয়ে মার্টিনের কন্ঠনালির জায়গাটা উপড়ে নিয়ে চলে এল সে । দেখা গেল, মার্টিনের গলার কাছটা হাঁ হয়ে গেছে । ওর শরীরের থেকে মাথার অংশের সার্কিটগুলি বিচ্ছিন্ন । সঙ্গে সঙ্গে হাতের অসমাপ্ত অংশটা একই অবস্থায় রয়ে গেল । মাথাটা একদিকে কাত হয়ে পড়ল । শরীরটা হেলে পড়ল গ্ল্যান্সের গায়ে । আর তখন ওর মাথাটা ধরে ঘুরিয়ে গলার কাছ থেকে ছিঁড়ে নিতে গ্ল্যান্সের কোন সমস্যাই হল না । কাটা কলাগাছের মতো ধপ্ করে মেঝেতে পড়ে গেল মার্টিনের মুন্ডহীন ধড়টা ।
‘ওফ্ ! কী ভয়ংকর !’ কপালের কাছ থেকে ঘামটা মুছে নিয়ে বললো গ্ল্যান্স, ‘প্রায় সবই বুঝতে পেরেছিলাম, শুধু এই জোসেফ মার্টিন যে একটি অ্যান্ড্রয়েড রোবট, এটাই বুঝতে পারিনি । আসুন মিঃ ম্যালকম, শত্রুর শেষ রাখতে নেই । তাই শেষকৃত্যটা আপনিই করুন ।’
‘ও সিয়োর !’ এগিয়ে আসেন শেরিফ ।
ঘরের প্রত্যেকটা লোক এতক্ষণ দম বন্ধ করে দেখছিল এই ভয়ংকর দৃশ্যটা । হঠাৎ যেন সাড় ফিরে আসে সবার । আর ওদের চোখের সামনে মিঃ ম্যালকমের অস্ত্রটা দু-তিনটে রশ্মি ছুঁড়ে দেয় জোসেফ মার্টিনের শরীরে । নিমেষের মধ্যে গোটা শরীরটায় আগুন ধরে যায় । আর কাপড়, সার্কিট, ফাইবার সমস্ত একসঙ্গে জ্বলে উঠে আগুনের শিখা ও ধোঁয়ার কুন্ড তৈরী করে । সবকিছুর মিশ্রিত এক জঘন্য গন্ধের সঙ্গে গোটা শরীরটা গলে গলে মেঝেতে মিশে যেতে থাকে ।
ততক্ষণে মিঃ তাকাহিতো আর রডরিগ্জের সঙ্গে আরও কজন অফিসার গোটা জায়গাটা ঘিরে ফেলেছে । মিঃ তাকাহিতো এগিয়ে এসে গ্ল্যান্সের দুটো হাত জড়িয়ে ধরেন, ‘গ্ল্যান্স ! কী বলে ধন্যবাদ দেব আপনাকে ? আপনি শুধু আমার মুখই রাখেননি, সারা জীবনের মতো আমাকে মুক্তিও দিয়েছেন ।’
‘শুধু তাই নয় গ্ল্যান্স,’ এগিয়ে এসেছেন মিঃ ম্যালকম, ‘আমাদের ডিপার্টমেন্টের মুখরক্ষা করেছ তুমি । নইলে যে দিশেহারা অবস্থায় আমরা পড়েছিলাম !’
‘কী বলছেন মিঃ ম্যালকম ! আমার ট্র্যাকারের সঙ্কেত ফলো করে সময়মতো আপনি না হাজির হলে তো আমরা এতক্ষণ এসব আলোচনা করার অবস্থায় থাকতাম না । আর তা ছাড়া, আপনার ডিপার্টমেন্টই কিন্তু আমাকে সাহায্য করেছে ওই মার্ক অ্যালেনকে চিহ্নিত করতে ।’
‘তাই নাকি ? কীভাবে ?’
‘ওই যে, নতুন বাড়িগুলোর সিসিটিভি ফুটেজ । ওগুলোই তো মার্ককে ধরিয়ে দিল । আজ সকালে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেগুলো দেখতে দেখতে হঠাৎই আমি মুহূর্তের জন্য লক্ষ্য করি যে, দিনের একই সময়ে মার্ককে দু-জায়গায় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, যেটা সম্ভবত আপনাদের চোখ এড়িয়ে গেছে । ফলে আরও ক্লোজ-আপ ভিউ নিয়ে, জুম করে দেখে আমি নিশ্চিত হই যে, কাজের টেবিলে বসে কাজ করতে থাকা মার্ক অ্যালেন আসলে তারই একটি ত্রিমাত্রিক প্রতিবিম্ব, যার সাহায্যে সকলকে বোকা বানিয়ে মার্ক নিজে অপকর্মটি করে চলেছে । আর ও নিজে ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার, ফলে ওই বাড়িগুলোর ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক ফিল্ড অকেজো করে দিয়ে বাড়িগুলো ধ্বংস করতে ওর কোন অসুবিধাই হয়নি । কী সাংঘাতিক শয়তানি, একবার ভেবে দেখুন তো!’
‘তুমি নিশ্চিত থাকো গ্ল্যান্স, এই মারাত্মক অপরাধের জন্য মার্ককে সারাজীবন আপশোস করতে হবে।’
‘অবশ্যই। আর আজ দুপুরে আমি চলে আসার পর মার্টিনের সঙ্গে মার্কের যে কথোপকথন হয়, রডরিগ্জের সার্ভারে তা রেকর্ড করা আছে । ওখানেই সাক্ষ্যপ্রমাণ সব পেয়ে যাবেন । তবে . . .’
গলিত মার্টিনের দিকে তাকায় গ্ল্যান্স । তার শরীরটা তখন পোড়া এক ধ্বংসস্তূপের মতো দেখাচ্ছে। শুধু অবশিষ্ট অংশ থেকে তখনও একটা ধোঁয়ার কুন্ডলী উঠে চলেছে । চোখ ফিরিয়ে নেয় গ্ল্যান্স। যেন একটা ঘোরের মধ্যে বলে ওঠে —
‘কেমন একটা ভয় করছে, জানেন ? এখনও যেন ভাবতে পারছি না যে, এই সবকিছুর মূলে একটি অ্যান্ড্রয়েড, যার পৈশাচিক বুদ্ধি মানুষকেও হার মানাতে পারে । তাহলে কি আমরা উন্নত হতে হতে আজ এই জায়গায় পৌঁছে গেছি ? আজ রোবটের মধ্যেও সকলের অলক্ষ্যে জন্ম নিচ্ছে অপরাধ প্রবৃত্তি ?’
মিঃ তাকাহিতো হাত রাখেন গ্ল্যান্সের কাঁধে, ‘কিন্তু আর তো ভয়ের কিছু নেই গ্ল্যান্স । একে তো আমরা ধ্বংস করে ফেলেছি ।’
‘না মিঃ তাকাহিতো,’ সজোরে মাথা নাড়ে গ্ল্যান্স, ‘আমরা ধ্বংস করেছি কেবল একটা অ্যান্ড্রয়েড, কিন্তু এরকম আরও অনেক অ্যান্ড্রয়েড হয়তো আমাদের অজান্তেই ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের চারপাশে, যাদের মধ্যে নানান মানবিক অনুভূতির পাশাপাশি লোভ, হিংসা, প্রতিশোধস্পৃহা এইসব পাশব প্রবৃত্তি মাথাচাড়া দিচ্ছে।’
গ্ল্যান্সের কথায় শিহরণ জাগে উপস্থিত সকলের মধ্যে । গ্ল্যান্স যোগ করে, ‘তাই সামনে অনেক বড় কাজ । মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এই সমস্ত অমানুষগুলোকে খুঁজে বার করতে হবে । আর আমি তা করবই, কথা দিলাম আপনাদের ।’
এক কঠোর প্রতিজ্ঞায় গ্ল্যান্সের চোয়াল দৃঢ়বদ্ধ হয় । মাথা ঝুঁকিয়ে এক অনবদ্য ভঙ্গিতে সকলের কাছে বিদায় নিয়ে বাইরের দিকে পা বাড়ায় সে । লুমিসানটা ঘুরতে ঘুরতে তখন পশ্চিম আকাশে ।
কথাসাহিত্যিক
জন্ম ১৯৬৪। পেশায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। অথচ শিল্প, সাহিত্য আর সংস্কৃতি নিয়েই তাঁর বেঁচে থাকা। তাই অসংখ্য ছোটবড় পত্রিকায় তাঁর বিভিন্ন ধরণের লেখা প্রকাশের পাশাপাশি বিভিন্ন মঞ্চে মঞ্চস্থ হয়ে চলা নাটক ও নৃত্যনাট্য রচনা ও সুরারোপের মাধ্যমেও বিচ্ছুরিত তাঁর প্রতিভা। লেখেন ছোটবড় সকলের জন্যই। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১১, যার মধ্যে ‘দুর্দান্ত দশ’, ‘পাতায় পাতায় ভয়’, ‘ভূতের বৃন্দাবন’, ‘গুহা গোখরো গুপ্তধন’ প্রভৃতি গ্রন্থগুলি ইতোমধ্যেই পাঠকসমাজের কাছে সমাদৃত হয়েছে। তাঁর রচিত ও সুরারোপিত অপেরা-নাটক “আলাদিন” বেশ কয়েকবার মঞ্চস্থ হওয়া ছাড়াও হাওড়ার একটি নাট্য কর্মশালায় ব্যবহৃত হয়েছে। একসময় সম্পাদনা করেছেন সাহিত্য পত্রিকা “আলো অন্ধকার”। পেয়েছেন কয়েকটি পুরস্কার, যার মধ্যে ‘কিশোর ভারতী সাহিত্য পুরস্কার”, “সংশপ্তক পুরস্কার” প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।