| 29 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক

ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-১৮) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

পাড়ার সবচেয়ে বড় আমগাছটার ছায়ায় আমরা খেলা করলেও পড়ে থাকা আম কুড়িয়ে নেওয়া ছাড়া গাছে হাত দেবার সাহস ছিলনা। ওই আমগাছের মালকিন ছিলেন সাংঘাতিক কলহপ্রিয় এক মহিলা, নাম কুড়ুনদি।তাকে আমরা ভয় পেতাম তাঁর তীব্র গালাগালির জন্য।

কিন্তু কালবৈশাখীর ঝড় উঠলে পাড়াশুদ্ধু ছেলেমেয়ের দল নির্ভয়ে ছুটত ওই আমবাগানের মাঠে আম কুড়োতে।আমরা আম কুড়িয়ে কোঁচড় ভর্তি করছি,আর তিনিও আমাদের দ্রুততার সঙ্গে না লড়তে পেরে তেড়ে এসে বাবা মায়ের নাম ধরে বাছাবাছা গালাগাল দিচ্ছেন, অথচ আমরা কিছু গায়ে মাখছি না।দৃশ্যটা মনে করলে আজও খুব মজা লাগে। না, তিক্ততা তখনও ছিলনা, এখনও নেই।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

পুকুরের ধার বরাবর একটু উঁচুতে  টানা রাস্তা ছিল। খুব সরু রাস্তা। বর্ষাকালে সে রাস্তা একেবারে ভেসে যেত। পুকুরের চওড়ার সমান দৈর্ঘ্যের সেই রাস্তার ধারে একটানা সাদা রঙের একতলা পাকা বাড়ি ছিল একটি । ঘরের জানলাগুলো সব পুকুরের দিকে মুখ করা। ওই বাড়িতে ছিল চারজন ভাইএর আলাদা আলাদা সংসার। পুকুরের দিকে জানলাওলা ঘর আর পেছনদিকে বারান্দার কোলে যার যার পার্টিশান করা খোলা উঠোন,কলতলা। সে বাড়ির একটি মেয়ে


আমার স্কুলের বন্ধু।তাই ওই বাড়িটির অন্দরে আমি অনায়াসে ঘোরাফেরা করি।

   একদম ছোটতে মনে হত, ওরা  আমাদের পাড়ার সবার থেকে কোথায় যেন একটু আলাদা। মুখের ভাষা বাংলা, কিন্তু সেই বাংলার সবটা আমাদের মত নয়। ওরা পূর্ব বাংলার লোক, ওরা…।একটু বড় হলে, বাড়িতে জানতে চাই , “ওরা কী? সবাই যে বলে ওরা বাঙাল।”

আমার সত্যিকারের  শিক্ষিতা ঠাকুমা বলেন “না। ওই কথাটা বলবে না।ওই শব্দটা খারাপ। দরকার পড়লে পূর্ব বাংলার লোক বলবে।”

“ওরা যে আমাদের ‘ঘটি’ বলে।বলে, ‘আয় ঘটি , আয় বাটি ।”

“বলুক,তোমরা কিছু বলবে না।”

তখন এমন ছিল। আমরা ঘটি ওরা বাঙাল, এরকম একটা দূরত্ব ছোট থেকে বড় সবার মধ্যে অল্পবিস্তর কাজ করত।পরে বড় হতে হতে দেখলাম ওই ফাঁকটা ভরাট হয়ে গেল আস্তে আস্তে। পূর্ববঙ্গের মেয়ে বা ছেলের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের খাস ঘটির ঘরের ছেলেমেয়েদের বিয়ে শাদি শুরু হল। ভাষার ব্যবধানও ঘুচে গেল ক্রমশঃ।এখন বাড়িতে  নিজের বঙ্গের ভাষা চালু রাখলেও বাইরে খুব কম কাউকে ওই ভাষায় কথা বলতে শুনি।

তারপরেও বাংলাদেশের যুদ্ধে আমাদের উন্মাদনা, শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা, সর্বোপরি বাংলাভাষা নিয়ে এক পাকিস্থানের মধ্যে দুই পাকিস্থানের জন্ম, কেমন করে যেন বিভেদের পাঁচিলটাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে ।এখনও যাদের মধ্যে একটু একটু আমরা এদেশী তোমরা ওদেশী  ভাব আছে, তারা সঙ্কীর্ণতার অপবাদের ভয়ে সবার সামনে নিজেদের মনোভাব প্রকাশ করতে সাহস পায়না। শুধুমাত্র বাংলা ভাষার জন্য বাংলাদেশে আমাদেরও এক অলিখিত অধিকার আছে, এই বোধও ওই আমরা তোমরা  বিদ্বেষকে কিছুটা হলেও কমিয়ে দিয়েছে হয়ত।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


সে যাই হোক পাড়ার মধ্যে সব কিছুতেই ওই লম্বা বাড়ির সব মানুষেরা আমাদের মধ্যে মিলে মিশেই থাকতেন। শুধু ঝগড়া হলে খোঁটা দিতে ছোট থেকে বড় সবাই ওই কথাটাই আওড়াতেন ।“তোমরা তো …।”

সে ঝগড়াও মিটত অনায়াসে। লক্ষীপুজোর দিন ওই লম্বা টানা বাড়িটিতে প্রসাদ নিতে সবার ভিড় উপচে পড়ত।


আরো পড়ুন: ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-১৭) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়


সব পাড়াতেই একজন দুজন পাগল, এক বা তার বেশি জ্ঞানী ব্যক্তি, একের বেশি গুলবাজ, খুব শৌখিন বা খুব এলোমেলো মানুষ থাকতেন। বাকিরা তাদের মানিয়ে নিত।আসলে পাড়াগুলো ছিল তখন বৃহৎ পরিবারের মত, অথবা বলা যায়  প্রতি পাড়াতেই কিছু বৃহৎ পরিবার একজোট হয়ে বাস করত।আমাদের পাড়ার বিখ্যাত পাগল ছিল সুনে পাগলা। শোনা যায় কলেজে ফিজিক্স নিয়ে পড়তে পড়তেই তার পাগলামির শুরু। অনেকবার পাগলাগারদে পাঠিয়েও তাকে সুস্থ করা যায়নি। সারা দিন পথে পথে ঘুরে নিজের বাড়ি ফিরত সন্ধে নামলেই। বাড়ির লোকেরা কয়েক বালতি জলে চান করিয়ে, জামাকাপড় ছাড়িয়ে আর এক দফা জামাকাপড় পরিয়ে  খেতে দিত।সারাদিন তার মুখে চলত একটাই বুলি, “টান, …টানছে,……. ।” একটা হাত সে সারাক্ষণ এমনভাবে সামনের দিকে বাড়িয়ে রাখত যে অদৃশ্য কারো টানের অনুভব লক্ষ করতাম আমরা।

হারু মন্ডলের গুল গাপ্পির গল্প টেনিদা বা ঘনাদার থেকেও কম সরেস ছিলনা। গোবিন্দ বর্মণ ছিলেন হাইস্কুলের রিটার্য়াড সংস্কৃত শিক্ষক। মেঘদূত থেকে কাদম্বরী কাব্যের নিখুঁত ব্যাখ্যা শোনার ভয়ে কেউ তার ধারেকাছে ঘেঁসত না।প্রথমজন রকে বসলে সবাই গুল দেওয়া গল্প শোনার জন্য ভিড় করত, দ্বিতীয়জন বসলে অব ধারিত ভাবে রক ফাঁকা। সাদা ধবধবে ধুতি পাঞ্জাবী পরা অনিমেষ সমাজপতির সঙ্গে চুলে কাকের বাসা ,আধ ময়লা জামা প্যান্টের অরুণ রায়ের সর্বক্ষণ জোট বেঁধে থাকাটাও আমাদের খুব অবাক করত।

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত