চকোলেটের ইনকুইজেশন ও অপরাধ । অলাত এহ্সান
সুইডিশ সিনেমা ‘চকোলেট’-এ দেখা যায়, ফ্রান্সের এক পুরনো গ্রামে অজ্ঞাত কারণে অসুখী কয়েকটি পরিবার বাস করে। সেখানে আসেন জুলিয়েট বিনোশ। তিনি মায়ের কাছ থেকে শেখা নানা কৌশল খাটিয়ে মজাদার চকোলেট তৈরি করতে পারেন। অস্তিত্বের প্রয়োজনেই সেই পারদর্শিতা কাজে লাগিয়ে তিনি চকোলেটের দোকান খোলেন। এর মধ্যে ডার্ক চকোলেট, হট চকোলেট, লিকুইড চকোলেটের নাম বেশি শোনা যায়। মন ও মুহূর্ত বুঝে বিভিন্ন স্বাদের চকোলেট খাইয়ে জনপ্রিয়তা পায় দোকানটি। তেমনিভাবে একটি চকোলেট খাইয়ে অতৃপ্ত দম্পতির মাঝে ফিরিয়ে আনেন জৈবিক আনন্দ। আগন্তুক পুরুষ জনি ডেপও আপ্লুত হন তার বিশেষ চকোলেট খেয়ে।
সুইডিশ চলচ্চিত্রকার লাসে হালস্ট্রোমের তৈরি ২০০০ সালের এ সিনেমাটি ৭৩তম একাডেমিক অ্যাওয়ার্ডের (অস্কার) আসরে সেরা চলচ্চিত্রসহ পাঁচটি বিভাগে মনোনয়ন পেয়েছিল। পরবর্তী সময়ে জুলিয়েট বিনোশ ইউরোপিয়ান ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডে সেরা অভিনেত্রীসহ সিনেমাটি একটি পদক পায়। সিনেমাটি তৈরিও হয়েছিল আরেক আলোচিত উপন্যাস অবলম্বনে। ১৯৯৯ প্রকাশিত ইংলিশ ঔপন্যাসিক জোয়ান মিচেল হ্যারিসের ‘চকোলেট’ উপন্যাসটি ততদিনে একাধিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। চকোলেটের কারিশমা আর সাহিত্য-সিনেমার এ তথ্য ঠিক আছে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো সিনেমায়ও চিকিৎসায় চকোলেটের জাদুকরী ব্যবহার ও তা তৈরিতে একজন নারীকেই দেখা যায়। এটা ঠিক, সব গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যেই অপরাধপ্রবণ ব্যক্তিদের উপস্থিতি প্রচীনকাল থেকেই ছিল কিন্তু পুরুষতান্ত্রিকতার কারণে কালোজাদুর ধারক হিসেবে নারীকেই বারবার সাব্যস্ত করা হয়েছে। তবে বিপরীতের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের ক্ষেত্রে গরম, তরল, মিষ্টি চকোলেটের মতো নানা ধরন সব সময়ই একটা দারুণ জিনিস ছিল। এর সঙ্গে কী করে অপরাধ ও ইনকুইজেশনের মতো গুরুতর ইতিহাস জড়িয়ে গেল? তা আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে ইতিহাসের পাতায়।
লাতিন আমেরিকার প্রাচীন ওলমেক সভ্যতায় শুরু হওয়া চকোলেটের প্রচলন মায়া সভ্যতা, অ্যাজটেক সভ্যতার ভেতর দিয়ে ইউরোপের স্পেনের বিকশিত হওয়ার ধারাবাহিকতা কম-বেশি অনেকেরই জানা। সেখান থেকে বাকি ইউরোপে ছড়িয়ে পড়া, তারপর উত্তর আমেরিকাসহ আধুনিক যুগে উঠে এসেছে চকোলেট। এর মধ্যে পনেরো শতকে ঘটেছে ‘চকোলেটের ইনকুইজেশন’। ধর্মীয়ভাবে ইনকুইজেশনের শুরু তারও আগে, বারো শতকে। চৌদ্দ শতকের শেষের দিকে স্পেনের একাংশে খ্রিস্টীয় ক্যাথলিক ভাবধারার শাসকদের নেতৃত্বে স্পেন ও পর্তুগালজুড়ে মুসলিম ও ইহুদিদের বিরুদ্ধে গণউচ্ছেদ তথা ইনকুইজেশন শুরু হয়। এর সঙ্গে চকোলেটের সম্পর্ক কোথায়?
এটা বলা হয় যে পনেরো শতকে স্পেনে রাজা দ্বিতীয় চার্লস ইনকুইজেশনে ধরে আনা ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়ার আগে চকোলেট পান করতেন। হয়তো তার পরই ওই ব্যক্তিকে মৃত্যু দেয়া হতো। মজার ব্যাপার হলো, একই সময় ফ্রান্সে ইহুদিদের চকোলেট মার্কেট প্রতিষ্ঠা হয়। নির্দিষ্ট করে বললে, স্পেনে চকোলেটের বাণিজ্যিক কার্যক্রমকে দারুণভাবে খ্রিস্টানবিরোধী আচরণ ও কালোজাদু হিসেবে ধরা হতো। ইনকুইজেশনের সময় মেক্সিকোতে ‘অ-খ্রিস্টীয়’ভাবে চকোলেটের এমন ব্যবহারের নমুনা পাওয়া গেছে। এমনকি ভিন্ন ধরনের চকোলেট তৈরিকারকের ভিন্ন ধরনের সাজা ভোগ করতে হয়েছে, এমন অনেক প্রমাণ আছে।
১৬৮৯ সালের ৬ ডিসেম্বরের এক নথিতে জানা যায়, ইনকুইজেশন নামের স্পেনের উপনিবেশ ‘নিউ ওয়ার্ল্ডে’, মেক্সিকোতে সামান্য ‘অপরাধে’ মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতো। মেক্সিকোর পুয়েবলা শহরের সম্ভ্রান্ত মেয়র দন দিগো মনুজ দে অ্যালবার্দো এমনই মৃত্যুদণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। তবে মৃত্যুদণ্ডের আগে নির্যাতনে তার মৃত্যু হলেও ‘অতো ডি ফি’ উদ্যাপনের জন্য শবদেহ পুড়িয়ে দেয়া হয়। এর আগে ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মে, ইনকুইজেশনের এক নথিতে দেখা যায়, ডার্ক চকোলেট পানের অপরাধ স্বীকার করে ট্রাইব্যুনালের সামনে ‘মার্জনা’ চাইতে রাজি হয়েছেন ফ্রান্সিসকো সাচেজ এনরিজ নামে এক ব্যক্তি। “নিজের অপরাধ স্বীকারে রাজি হয়েছেন ফ্রান্সিসকো সাচেজ এনরিজ। তিনি একজন সৎ লোক। আমি তাকে চিনি। আপনার প্রভুত্বই জানে তাকে কী করা হবে, কিন্তু আমি মনে করি না তার স্ত্রীকে নিরীক্ষার দরকার আছে। তিনি একজন অসুস্থ ও বৃদ্ধ মানুষ (এবং তিনি বলেছেন যে), তিনি ‘মার্জনা’ প্রার্থনা করছেন, এই কথা স্মরণ না করেই যে তিনি এক কাপ চকোলেট পান করেছেন।”
লাতিন আমেরিকায় ঔপনিবেশিক কালপর্বে চকোলেটের মাধ্যমে জাদুবিদ্যা চর্চার অভিযোগ অনেক নারীকে ইনকুইজেশনে হত্যা করা হয়েছিল। চকোলেট-সংক্রান্ত এ ইনকুইজেশনের মূল লক্ষ্য ছিল উপনিবেশ থেকে স্থানীয় বিভিন্ন সামাজিক-ধর্মীয় চর্চাকে উচ্ছেদ করা। লাতিন আমেরিকায় নারীরা চকোলেট উৎপাদনে বড় ভূমিকা রাখতেন, তাই টার্গেটও হতেন তারা। স্প্যানিয়ার্ডরা শত বছর ধরে চলে আসা স্থানীয় আদিবাসীদের চকোলেট কেন্দ্রিক চিকিৎসাবিদ্যাকে জাদু মনে করে ভয়ও পেত।
চকোলেট তৈরির মূল উপাদান কোকো ফল। ফলের একেকটি ছড়ায় ৪০টির মতো গুটি গুটি বিন বা বীজ থাকে। ভাবলে অবাক হতে হয়, শতাব্দীজুড়ে এ কোকো বিন, কোকো, তৈরি চকোলেট ছিল অপরাধীদের অন্যতম টারগেট। চকোলেটের কাঁচামাল, কোকো গুঁড়ো ছিল চোরদের ‘সহজ লক্ষ্যবস্তু’। এমনকি কখনো অপরিশোধিত উপাদান, চক পাউডার, মাটি, আলকাতরা মিশ্রিত নকল চকোলেট বাজারজাত করত তারা। এর কারণে আঠারো শতকে ইউরোপ-আমেরিকায় সতর্কতা জারি করতে হয়েছে তাদের উৎপাদিত চকোলেটের নকলের বিরুদ্ধে। ইংল্যান্ডের বোস্টন শহরে চকোলেট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান জন ব্রেস্টার তাদের চকোলেটে ‘আই, বি’ এঁকে দিত কালোবাজারিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে ওঠার জন্য। এ প্রতিযোগিতা উনিশ শতকেও বিদ্যমান ছিল। যে কারণে ভালো, খাঁটি, অমিশ্রিত নানা তকমার বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতাদের আকর্ষণ করতে হয়েছে তাদের। এখনকার টিভি বিজ্ঞাপনও সেই ঘানি টানে কিনা খতিয়ে দেখার দাবি রাখে। বিশ শতকেও চোরাকারবারিদের দমিয়ে রাখতে ম্যাগাজিনগুলোতে বিস্তর আর্টিকেল লিখতে হয়েছে। আজকের দিনে আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে নকল মশার কয়েল, প্রসাধনী, বিদেশী চকোলেটের কারখানা আবিষ্কার থেকে তার অনেকটাই আঁচ পাওয়া যাবে।
১৮৮১ সালে এক উড়োচিঠি থেকে বোঝা যাবে, সে সময় চকোলেটের বাণিজ্য কতটা লাভজনক ছিল যে বড় ব্যবসায়ীরা সন্ত্রাসীদের টার্গেটে পরিণত হন। চকোলেট ও ব্ল্যাকমেইলের ঘনঘটা ঘটে কানাডায়। সে সময় ওই দেশের বড় চকোলেট উৎপাদনকারী নারী জন পি. মোট্টকে এক উড়োচিঠিতে হুমকি দেয়, ৬০০ ডলারের স্বর্ণমুদ্রা না দিলে সাফ মেরে ফেলা হবে তাকে। এটা ছিল ওই সময়ের মধ্যে দাবি করা সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী মুক্তিপণ। পরে অবশ্য ২৫ জানুয়ারি পুলিশের যোগসাজশে পাতা ফাঁদে ধরা পড়ে ব্ল্যাকমেইলার।
সে সময় পত্রিকার পাতায় প্রায়ই উপনিবেশিত এলাকায় চকোলেট ও চকোলেট তৈরির সরঞ্জাম চুরির বিজ্ঞাপন প্রকাশ হতো। ১৭৬৮ সালে বোস্টনের এক পত্রিকায় রীতিমতো পুরস্কার ঘোষণা করে বিজ্ঞাপন দেন চকোলেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। ‘দক্ষিণ ইংল্যান্ডে, গত সপ্তাহের কোনো এক সময়, একটি তামার পাইপের দুই-চতুর্থাংশ (মানে চোঙ), একটি রুপার চকোলেট—ডাবুর, যার ওজন সাড়ে তিন আউন্স, নিম্নোক্ত ঠিকানায় যদি কোনো সুহূদ প্রতিনিধি তা বিক্রির প্রস্তাব দেন বা যোগাযোগ করেন, যদি তার বর্তমান স্বত্বাধিকারী ফেরত দেন, এমনটি কেউ করেন, তারা এর প্রত্যেকটির জন্য এক ডলার পাবেন এবং কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হবে না।’ এ তো গেল চোরের প্রতি আহ্বান। গুদাম বা কারখানা থেকে এত চকোলেট চুরি যেত যে চুরি যাওয়া পণ্যের তালিকা প্রকাশ করে ক্রেতাদের কিনতে নিষেধ করা হতো। যথারীতি পণ্য উদ্ধার বা চোরকে শাস্তি দিলে পুরস্কার দেয়ার ঘোষণাও করেছে তারা। বোঝা যায়, চোরে কাছে কতটা অসহায় হয়ে পড়েছিলেন চকোলেট উৎপাদনকারীরা, যে চুরি যাওয়া পণ্য পুনরায় কিনতে চেয়ে বা অজ্ঞাত কেউ চোরকে পেটালেও পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন পত্রিকায়। এভাবে খোদ ছিনতাইকারী ও চোরের ৫ ডলার করে পুরস্কৃত হওয়ার নজির আছে ১৮০৮ সালে।
নিউ ইংল্যান্ডের স্বনামধন্য চোর টমাস মাউন্টের চুরি ও কার্যাবলি সে সময় প্রায় প্রকাশ্য ব্যাপার ছিল। ১৭৯১ সালের ২৭ মে রোড আইল্যান্ড রাজ্যে তিনি ধরাও পড়েছিলেন। ফাঁসির মুখে দাঁড়িয়ে তিনি কিছু কথা বলার সুযোগ চেয়েছিলেন। তার বাকপটু, কৌতূহলী স্বীকারোক্তি, অপরাধ-সহজ করা বক্তব্য পরবর্তী সময়ে প্রকাশ হয়। তাতে তিনি বলেন, ‘নরিচ ল্যান্ডিংয়ে নাচের অনুষ্ঠানে এক তরুণীর কাছ থেকে আমি একটা সিল্কের চাদর চুরি করি এবং পকটানক ব্রিজ থেকে দুই-তিন মাইল দূরে বিক্রি করি। তারপর প্রভিডেন্সের উদ্দেশে চলে যাই, সেখান থেকে বোস্টনে। সেখানে জেমস উইলিয়ামের সঙ্গে জীবনে প্রথমবারের মতো জোট বাঁধি। সেখানে কিছু বক্লেস চুরি করে সঙ্গী উইলিয়ামকে নিয়ে নিউবেরি পোর্টের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ি। এখানে একটা স্কুনার ভেঙে তার জন্য কিছু জামাকাপড়, কিছু চকোলেট, কিছু তামাক এবং এক বোতল রাম নিলাম। এ সময় উইলিয়াম জেটির ওপর দাঁড়িয়ে ছিল এবং আমাকে এটা-ওটা নিতে সাহায্য করছিল। তারপর আমরা পোর্টমাউথের উদ্দেশে যাত্রা করলাম এবং পথে আমি একটা কুঠার চুরি করে এক জোড়া জুতার বিনিময়ে বিক্রি করে দিলাম।’ ১৮৬১ সালের নিউইয়র্কের দুই শিশু পাউল লোপেল ও ইলিস এলটিংকে গ্রেফতার করা হয় কাউন্টার থেকে কয়েন চুরির দায়ে। ওই বছরের ৬ মার্চের বিচার প্রক্রিয়া থেকে জানা যায়, তারা সেই পয়সা নিতে গিয়েছিল চকোলেট ও তামাকদ্রব্য কেনার জন্য।
চকোলেটের বাণিজ্য এতটা লাভজনক হয়ে উঠেছিল যে প্রসিদ্ধ কোম্পানি আরো মুনাফার আশায় প্রতারণার আশ্রয় নিতে শুরু করে। ম্যাসাচুসেটসের সালেম এলাকার চকোলেট উৎপাদনকারী গিডিয়ন ফস্টারকে এমন একটি দুর্নীতি করতে গিয়ে ধরা পড়ে ১৮০৬ সালে বোস্টন গেজেট পত্রিকায় আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাইতে হয়েছিল। মেক্সিকো থেকে কার্টনে উল্লেখের চেয়ে বাড়তি ওজনের চকোলেট আনতে গিয়ে কাস্টমস কর্মকর্তার হাতে ধরা পড়েন তিনি। পরে নিজের পণ্যের বদনাম করে পত্রিকা তাকে ক্ষমা চাইতে হয়।
ক্রেতা আকর্ষণে চকোলেটে গন্ধ আনতে কেমিক্যাল মেশানোর শুরু হয় চকোলেট বাণিজ্য শুরুর পর থেকেই। তাছাড়া দীর্ঘ সময় চকোলেট সংরক্ষণের জন্যও কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এর মাত্রার হেরফের বা ক্ষতিকর জীবাণুর ব্যবহার হলেও তা সাধারণ ক্রেতার পক্ষে ধরা সম্ভব নয়। এটা কখনো ক্রিমিনাল অফেন্সও হতে পারে। তেমনই ঘটেছিল ১৬৮৫ সালে ব্রিটিশ রাজা দ্বিতীয় চার্লসের ক্ষেত্রে। তখন তিনি পোর্টমাউথের ডুচেস্টের বাড়িতেই ছিলেন। চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘লর্ড চ্যান্সেল কপারকে বলুন, কিং চার্লস এক পোষ্য দ্বারা জীবাণু আক্রান্ত হয়েছেন।’ রাজাকে এক পাত্র চকোলেট দেয়া হয়েছিল, যার মধ্যে জীবাণু ছিল। এতেই রোগভোগের পর মৃত্যু হয় রাজার। ১৭৩৫ সালের ৪ আগস্ট পেনসিলভানিয়া গেজেটে প্রতিবেদন উল্লেখ করে, ‘গত বৃহস্পতিবার জনাব হামফ্রে স্কালেট তার নিজ শহর ভিক্টলারে স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ ভয়াবহ বিষে আক্রান্ত হয়েছেন; সকালে নাশতার সঙ্গে তারা স্কিল্টে করে যখন চকোলেট খাচ্ছিলেন, তখন তাকে কিছু আর্সেনিক বা ইঁদুরমারা বিষ দেয়া ছিল। সমস্ত দুরবস্থার পরও যখন তাদের পাওয়া গেল, সঙ্গে সঙ্গে তাদের চিকিৎসকের কাছে নেয়া হয়, সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তারা ভালো সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।’ তবে শেষ রক্ষা যে হয়নি তা আগেই বলা হয়েছে।
প্রুশিয়ার রাজা ফ্রেড্রিক দ্য গ্রেটকেও হত্যার চেষ্টা হয়েছিল বলে জানিয়েছিলেন রাজা নিজেই। ১৭৯০ ও ১৭৯২ সালে উত্তর আমেরিকার অধিকাংশ খবরের কাগজ একটা রিপোর্ট প্রকাশ করে যে চকোলেটের নিরাপত্তার জন্য ফ্রেড্রিক তার সতর্কতা বৃদ্ধি করেছেন।
চকোলেটের সঙ্গে সন্দেহাতীতভাবে যে অপরাধকাণ্ড জড়িয়ে আছে, তা সংগঠিত হয়েছে ১৮৭৯ সালে।পেনসেলভানিয়ার কারলিসলে আদালত কর্মী মি. ওইনকুপ ও মিসেস জিল ষড়যন্ত্র করে ম্যারি কিইলের চকোলেটে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করেছেন। এ অপরাধে তাদের শাস্তিও পেতে হয়।
ইতিহাসের এত ঘটনার সঙ্গে যুক্ত এ পণ্য দামি হবে, তা ভাবাই যায়। কিন্তু এর বাইরে আরেক নির্মম ইতিহাস আছে। ধনী দেশের বা ধনাঢ্য মানুষের শৌখিন খাদ্যতালিকায় চকোলেট যত ওপরেই থাকুক না কেন, এর উৎপাদন সবটাই দরিদ্র দেশগুলোতে। পনেরো শতকের ইউরোপের ইতিহাসের সঙ্গে এর মিল নেই। বিশ্বের বেশির ভাগ কোকো এখন ঘানা, আইভরিকোস্ট, নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন, ডোমেনিকান রিপাবলিক, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, মেক্সিকো, একুয়েডর, পেরুতে জন্মে। সবই প্রায় আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশ।
লাতিন ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ উপন্যাসে একটা দৃশ্য আছে—এক পাদ্রি গরম চকোলেট খেলে মাটি থেকে ওপরে উঠে যাওয়া বা ওড়ার অনুভূতি পান। লাতিন ও আফ্রিকার বাইরে তা জাদুবাস্তব মনে হলেও এর প্রতীকী সত্যতা আছে। সেখানে নারীরা এ চকোলেট তৈরির সঙ্গে যুক্ত। এর একটা অংশ অবিবাহিতা, বিধবা, স্বামী ত্যাগী সংসারমুক্ত নারী। এরা বিবেচিত হন জাদুকরী হিসেবে। লাতিনে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসন শুরু হওয়ার পর এ নারীদের উদ্ভব এবং সেই সময় চালু হওয়া চকোলেট উৎপাদনের প্রক্রিয়ার মধ্যেই তারা স্থায়ী হয়ে গেছেন।
একটু পরিসংখ্যানের দিকে চোখ দেয়া যাক। দুনিয়ায় প্রায় ১৪ মিলিয়ন গ্রামীণ কৃষক উৎপাদন করেন চকোলেটের মূল উপাদান কোকো। এর আনুমানিক ১৪ শতাংশ, অর্থাৎ ২ মিলিয়নই হচ্ছে মধ্য পশ্চিম আফ্রিকার শিশু। তারা প্রতি পাউন্ড কোকো উৎপাদন করে ৭৬ সেন্টের কম আয় করে। অলাভজনক নৈতিক ব্যবহারের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘গ্রিন আমেরিকা’ জানাচ্ছে, বড় চকোলেট করপোরেশনগুলো বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে, আর কোকো চাষীরা প্রতি পাউন্ডে কেবল পেনি অর্জন করে। এটা গরিব দেশগুলোর আধুনিক শ্রমদাস শিবিরের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
ইনকুইজেশনের নির্মমতা বাদ দিলে, হূদয়ের বিচিত্র অভিব্যক্তি, আর্তি প্রকাশে স্পেন ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো নানা ধরনের চকোলেট উপাদেয় ব্যাপার। এমন আর্তি ভরা এক কাপ চকোলেট সতেরো-আঠারো শতকে কতটা গুরুত্বপূর্ণ উপাচার ছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়। সে সময় সম্ভ্রান্ত পরিবারে কনে পছন্দের ক্ষেত্রে চকোলেট দিয়ে আপ্যায়ন ও পাত্রীর চকোলেট তৈরির পারদর্শিতাও বেশ আগ্রহ ভরে জানতে চাওয়া হতো। এ তো গেল ইতিহাসের কথা। চকোলেট কিনে না দেয়ায় আদরের সন্তানের আত্মহত্যা, কিংবা চকোলেটের লোভ দেখিয়ে যৌন নিপীড়নের খবর আজকের দিনের পাঠকদের জানাই আছে বোধ করি।
অলাত এহ্সান : গল্পকার ও সমালোচক