Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,চাতক

গীতরঙ্গ: লোকসংগীতে চাতক পাখি তাৎপর্য ও ব্যাখ্যা

Reading Time: 3 minutes

.

চাতক প্রায় অহর্নিশি
চেয়ে আছি কালো শশী
হব বলে চরণ-দাসী,
ও তা হয় না কপাল-গুণে ।।
 
মেঘের বিদ্যুৎ মেঘেই যেমন
লুকালে না পায় অন্বেষণ,
কালারে হারায়ে তেমন
ঐ রূপ হেরি এ দর্পণে।।
 
যখন ও-রূপ স্মরণ হয়,
থাকে না লোক-লজ্জার ভয়-
লালন ফকির ভেবে বলে সদাই
(ঐ) প্রেম যে করে সে জানে ॥
 
মিলন হবে কত দিনে
আমার মনের মানুষের সনে ॥

……
বাংলা লোকসংগীতে চাতক, চাতকিনী শব্দের ব্যবহার আমরা প্রায়ই লক্ষ্য করি। চাতক কি ? কেনইবা এর কথা আমাদের গানে উল্লেখ করা হয়?
এর কী তাৎপর্য?

এ প্রসংগে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্নের সম্মূখীন হই। অনলাইনে এবং অফলাইনে অনেকেই ব্যাপারটা জানতে চান। সম্প্রতি অন লাইনে লক্ষ্য করলাম একটি বিশালাকৃতির বক সদৃশ পাখির ছবি দিয়ে কেউ একজন বাহবা নেবার প্রয়াস চালাচ্ছেন। ঐ ছবিতে দেখা যাচ্ছে বক বা সারস পাখির মত এক প্রকার পাখী কোন এক সাগর সৈকতে পানির খুবই নিকটে তার বিশাল ঠোঁট দুটি প্রসারিত করে অর্থাৎ হা করে বসে রয়েছে। মনে হবে যেন পাখিটি হা করে পানির অপেক্ষায় রয়েছে। প্রকৃতপক্ষ্যে এটি চাতক পাখি বলে ভুল প্রচার পেয়ে গেছে, বাস্তবে এটি চাতক পাখি নয় (ভুল ছবিটির সাথে সঠিক চাতকের ছবি ও দেয়া হলো)। চাতক এত বিশাল আকৃতির কোন পাখি নয়। যে ছবিটি দেয়া হয়েছে এটি হলো- ‘পেলিক্যান ‘ বা এক জাতীয় সারস পাখির ছবি।
চাতক পাখি আমাদের দেশে রয়েছে। এটি কোন কাল্পনিক বা পৌরানিক পাখি ও নয়। বুলবুলি থেকে একটু বড়, ঘুঘু,কোকিল, ইত্যাদি পাখির আকৃতি বা সাইজের একটি পাখি হলো চাতক। বাংলাদেশ সহ ভারতীয় উপমহাদেশে, আফ্রিকায় এ পাখি দেখা যায়। আমরা পাপিয়া বলে একটি পাখির নাম শুনি, হয়তোবা কেউ কেউ চিনিও, সেই পাপিয়ারই আরেক নাম হলো- চাতক। তবে চাতকেরই ভিন্ন প্রজাতি পাখিকে পাপিয়া বলা হয়। স্ত্রী পাখি বুঝাতে অথবা গানে এ পাখির নাম ব্যবহারে ছন্দে মিল দেয়ার প্রয়োজনে কখনওবা চাতকী/চাতকিনী বলেও উল্লেখ করা হয়। অনলাইনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেলো, আমাদের দেশের একটি প্রথম শ্রেণীর দৈনিকে চাতক পাখিকই ‘আবাবিল’ পাখি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বর্ণনার সাথে যে ছবি দেয়া হয়েছে তা আসলে চাতক পাখির নয়। এটা আবাবিল পাখিরই ছবি। আরেকটি ওয়েব, শিক্ষকদের বাতায়নে একজন শিক্ষক পূর্বে উল্লিখিত পেলিক্যান পাখির ছবি দিয়ে একই ভুল করেছেন , বলছেন এটি চাতক পাখি ! চাতক পাখির বৈজ্ঞানিক নাম হলো: Clamator Jacobinus. চাতক পাখিরই আরেকটি গোত্র রয়েছে যার নাম-ফটিক জল। কবি নজরুলের একটি গজলের বই এর নাম-চোখার চাতক। ফটিক জল কথাটাও তাঁর গানে পাই:

‘বুকে তোর সাত সাগরের জল
পিপাসা মিটল না কবি ,
ফটিক-জল ! জল খুঁজিস যেথায়
কেবলি তড়িৎ ঝলকে ।।
..
এত জল ও কাজল চোখে
পাষানী আনলে বলো কে ।।’
চাতকের কথা কেন গানে আসে:

এক কথায়- নিষ্ঠা বা একাগ্র সাধনা বুঝাতে চাতকের উদাহরণ আমাদের লোক সংগীতের মহাজনরা তাঁদের গানে ব্যবহার করে থাকেন। প্রশ্ন আসতে পারে,
চাতকের সাধনা আবার কি ?
প্রচলিত লোকশ্রুতি হলো: চাতক মেঘের বা বৃষ্টির পানি পান করে। এ ছাড়া নদী, পুকুর বা অন্য কোন জলাধারের পানি পান করেনা। তাই সব সময় আকাশের দিকে চেয়ে বৃষ্টির জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। কখন বৃষ্টি আসবে, সে একটু পানি পান করে বুকভরা তৃষ্ণা নিবারণ করবে, সে প্রতীক্ষায় থাকে চাতক। তার কাছে পরম কাংখিত সাধনার বস্তু হলো ঐ আকাশের মেঘ।
ঠিক তেমনি আমাদের লোক সংগীতে, পরম সাধনার ধন, মুর্শীদ বা গুরুর সুদৃষ্টি পাওয়া, তাঁর নিকট সান্নিধ্য পাওয়া, মনের মানুষের প্রীতি লাভ করতে পারা হলো এক ধ্যান ও জ্ঞানের বস্তু। অভিষ্ট লক্ষ্য। ঠিক ঐ চাতকের সাধনার মতো। সে পটভূমিতে প্রেমিক জন তার প্রেমাষ্পদেকে পাওয়ার জন্য চাতকের মতো অপেক্ষায় থাকে। মনের মানুষকে পাওয়াই তার ধ্যান ও জ্ঞান।


আরো পড়ুন: কেন পুরুষ পাখিরাই সুন্দর


বিভিন্ন বাউল বা মরমী মহাজনরা তাঁদের গানে বিভিন্ন প্রসংগে ঠিক এ অর্থেই চাতকের উল্লেখ করে থাকেন।
আরো কিছু কথা:
চাতক পাখি মেঘের পানি ছাড়া অন্য কোন উৎস থেকে পানি পান করে কিনা, এ ব্যাপারে একজন ভারতীয় পাখি বিশেষজ্ঞ গবেষণা করেছেন, তাঁর পর্যবেক্ষণ:
১ শারীরিক গঠন কাঠামোর কারণে জলাশয়ের পানি পান করা এ পাখির জন্য বেশ কষ্টকর।
২ চাতক পাখিকে খাঁচাবদ্ধ করে পাত্রে রাখা পানি দিয়ে দেখা গেছে যে, ঐ পানি পান করেনা। তবে পানি ছিটিয়ে (স্প্রে করে) দিলে তা পান করে।
৩ শিশির বিন্দু থেকে যে পানি পাওয়া যায় তা পান করে।

এ হলো আধুনিক যুগের দীর্ঘ গবেষণা ও পর্যবেক্ষনের ফলে পাওয়া তথ্য। আজ থেকে কমপক্ষে পাঁচ শত বছর আগের সময়কালে চাতকের এসব আচরণ পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়নি বলেই বোধ করি ধারণা (মিথ) তৈরী হয়েছে যে, মেঘের জল ছাড়া চাতক অন্য জল পান করেনা। তখনকার লোকজ ও বাউল গানের উত্তরসূরী আমাদের আজকের লোকগানে এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে ‘চাতকের ধ্যান বা সাধনা’ সম্পর্কিত উপমা এবং লোকশ্রুতি।

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>