| 20 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক

ইরাবতী ধারাবাহিক: কদমতলি (পর্ব-২১) । শ্যামলী আচার্য

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

   

       “সত্তরের শেষভাগ থেকে আশির দশক ধরে এই যে ভাগচাষের সংস্কার, এটা কিন্তু খুব কম কথা নয়। ‘অপারেশন বর্গা’ না থাকলে ভাগচাষীদের ফসলের ভাগের পরিমাণও বাড়ত না, আবার জমি থেকে উচ্ছেদের ভয়ও কাটত না। মনে রাখবেন কমরেড, বামফ্রণ্ট সরকার এসে কিন্তু এই জায়গাটাতেই জোর দিয়েছিল।”   

       কথার শেষে ‘হ্যাঃ’ বলে এক-একটা শব্দ করেন রজদ্দা। ওই শব্দে একটা তৃপ্তি লুকিয়ে আছে। সাফল্যের গর্ব। উত্তম আড়চোখে লক্ষ্য করে আজ জয়দীপ এসেছে। লোক্যাল কমিটির এই শাখায় জয়দীপ আসে বেশ রাতের দিকে। অনেকেই বলেছে ও নাকি ইচ্ছে করেই দেরি করে। পাকা মাথা বুড়োদের সঙ্গে বসে, কথা বলে, চা-বিড়ি খায়। এখানে ও নাকি খুব মাই ডিয়ার টাইপ। জয়দীপ চেয়ারে একটু পিঠ এলিয়ে বসে আছে। চেয়ারে ওর বসে থাকা দেখলেও কেমন শরীরের মধ্যে অস্বস্তি হয়। একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব। উত্তম মনে মনে বলে, সবজান্তা, হামবাগ একটা।

       “এছাড়াও উদবৃত্ত জমি যেখানে যা ছিল, সব বিলিয়ে দেওয়া হল ভাগচাষীদের। পঞ্চায়েত সিস্টেমকে শক্তিশালী না করলে কিন্তু এত কিছু করা সম্ভব ছিল না। জাস্ট একবার ভাবুন কমরেড, জমি দিয়ে দিলেই তো হবে না, গরিবগুর্বো মানুষগুলোকে চাষের জন্য ভালো বীজ দিতে হবে, ভালো সার দিতে হবে, ঠিকঠাক পরিকাঠামো দিতে হবে। তবে তো ভালো ফসল ফলবে। বেশি ফসল, ভালো ফসল উৎপাদন মানেই সার্বিক বৃদ্ধি। হরেদরে সেই অর্থনৈতিক অগ্রগতি। প্রগ্রেসের সহজ ইকুয়েশন। আরে ভাই, এটা তো সুইচ টিপে একদিনে হয়নি। একটা কথা তো মানবেন, ভাগচাষি ফসলের যত বেশি ভাগ পাবেন, জমি থেকে তার উচ্ছেদ হওয়ার সম্ভাবনা যত কমবে, ততই তিনি আরও উৎসাহ নিয়ে উদ্যমী হয়ে চাষের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়বেন।”   

       রজতের কথা শেষ হতে না হতেই হাত তোলে জয়দীপ। উত্তম জানে, জয়দীপ এমন কিছু একটা প্যাঁচালো বিষয় তুলবে, আজকের আলোচনাটাই ঘেঁটে যাবে পুরো।

       “কিন্তু রজদ্দা, চাষের গুরুত্ব ক্রমশ কমবে, আর শিল্পের গুরুত্ব একটু একটু করে বাড়বে, এটা কিন্তু আমাদের একদিন মানতেই হবে… মানে ওই ক্লাসিকাল থিংকিঙে আমরা যে শ্রম, পুঁজি আর ভূমির কথা শুনে আসছি, তার প্রয়োজন হবে কিন্তু নতুন ফর্মে, সব চাষী আর তখন চাষী থাকবে কী?”

       রজত কথা থামিয়ে চুপ করে থাকেন খানিকক্ষণ।

জয়দীপ বলে, “সারা পৃথিবীর ধনী দেশের উন্নয়নের ছকটা ভালো করে খেয়াল করলে কিন্তু দেখবেন কৃষি থেকে শিল্প আর শিল্প থেকে পরিষেবা— এই লাইন ধরে এগোচ্ছে সব।”    

“আমরা শিল্পবিরোধী কোনও কথা বলছি বলে মনে হচ্ছে আপনার কমরেড? যতদূর জানি, আজ আমরা অপারেশন বর্গা আর পঞ্চায়েত সিস্টেম নিয়ে কিছু বেসিক জিনিস ঝালিয়ে নিচ্ছি। অনেকেই নতুন এসেছেন, কেউ কেউ আমাদের সদস্যপদ নেবেন… অনেকের অনেক প্রশ্ন আছে, আর তাছাড়া আপনি তো এই ক্লাসগুলো আগেও অনেকবার করেছেন…” রজতের কথায় প্রচ্ছন্ন উষ্মা জয়দীপকে চুপ করিয়ে দিল। উত্তম মনে মনে খুশি হল খুব। বেশ হয়েছে শালা, সব জায়গায় এসে খাপ খুলবে। বদমাইশ।     

রজদ্দা খুব ভালো কতগুলো কথা বলছিলেন, মাঝপথে খেই হারিয়ে একটু ক্ষুব্ধ হলেন। সামলে নিয়ে আবার শুরু করলেন। বাকিরা তো শুনতেই এসেছে, প্রশ্ন করতে নয়।

জমি ভাগ হতে পারে, জমির মালিকানা ভাগ হতে পারে, কিন্তু সমস্যা তখন অন্য জায়গায়। জমি ভাগ হলেই কি সকলে একসঙ্গে কোনও বড় জমি বিক্রি করতে রাজি হবে? আর তাছাড়া, জমির বাজার তো আর পাঁচটা বাজারের মতো নয় যে জমির দাম বাড়লেই ফসলের জোগান বেড়ে যাবে। বরং যেই মুহূর্তে জমির মালিক দেখবেন হু হু করে তাঁর জমির দাম বাড়ছে, তিনি আরও বেশি করে তাঁর জমিকে আঁকড়ে ধরবেন। বিক্রি করতেই চাইবেন না। ভাববেন, ভালোই তো হল, আরও দাম বাড়ুক। বেশি দামের জমি মানে তার আরও অনেক বেশি আর্থিক নিরাপত্তা। এই সিকিয়োরিটি কেউ সহজে ছাড়তে চায়? কিন্তু খুব ভালো করে ভেবে দেখুন, যে চাষী খুব ধনী, যার হাতে অনেক জমি, তার কিন্তু ইচ্ছে হতেই পারে, খানিক জমি বেচে দিই, খানিক বরং হাতে থাকুক। যে পরিবারের হাতে জমি কম, যে পরিবার টিঁকে আছে চাষবাসের ওপর, তারা কিছুতেই জমি বিক্রি করবে না। ফলে একটা ভিশাস সার্কল কিন্তু তৈরি হচ্ছে। আপনারা যদি কেউ অর্থনীতির ছাত্র হন, তাঁরা সহজেই বুঝতে পারবেন আমাদের রাজ্যের অর্থনীতিতে এটা একটা খুব বড় ফ্যাকটর হয়ে যাচ্ছে।     

উত্তম মন দিয়ে শোনে, কৃষিই আমাদের ভিত্তি। শোনে, ষাটের দশকের গোড়ায় মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে সারা দেশের এগিয়ে থাকা রাজ্যগুলোর মধ্যে একটি ছিল পশ্চিমবঙ্গ। ঘোর লেগে যায় তার। খাদ্য আন্দোলনের গল্প বলেছিল না বাবা? আজ বাড়ি গিয়ে ফুরসত পেলে আর একবার বসলে হয়।

সঙ্গে বসলেই যে শিবপদ সব কথা বলবেন, এমনটা নয়। বলেন ঠিকই, কিন্তু অনেক বেছে। কিছু রয়েসয়ে। যেন সব বলা যায় না।    


আরো পড়ুন:  কদমতলি (পর্ব-২০) । শ্যামলী আচার্য


উত্তম ক্লাস করতে করতে অন্যমনস্ক হয়ে যায় মাঝেমধ্যে। কলেজে তো সেভাবে ক্লাসে যাওয়াই হয় না। ওর হয়ে অ্যাটেনডেন্স প্রক্সি দিয়ে দেয় নিরুপম। উত্তমের অবশ্য কলেজে ক্লাস করতে খুব একটা ভালো লাগে না। সাবজেক্ট ওকে টানে না। অধ্যাপকদের পড়ানোতে রস নেই। খুব কঠিন আর অর্থহীন লাগে। তার প্রাইভেট টিউটরও নেই কোনও। নিরুপমকেই বলা আছে। ও ক্লাস নোটস নেয়, কার্বন পেপার দিয়ে কপি করে রাখে। নিরুপম বলেছে, প্রাইভেটে যার কাছে পড়ে, তার নোটসও উত্তমকে দিয়ে দেবে।

পার্টি অফিসে বসে বসে উত্তম ভাবে, গ্র্যাজুয়েশনটা ঠিকঠাক করতেই হবে। না হলে পরে খুব মুশকিল হবে।

মিষ্টু পড়াশোনায় বরাবর খুব মনোযোগী। ভাল ছাত্রীরা যেমন হয়। নিজের চেষ্টায় প্রেসিডেন্সি কলেজে চান্স পেয়ে দেখিয়ে দিল তো! ওর জন্য বাবার গর্বের শেষ নেই। মা অবশ্য চুপচাপ। কোনওদিনই কোনও কিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি উচ্ছ্বাস দেখায় না। দুই ছেলে-মেয়েই তার কাছে সমান। ঠাকুমার কাছেও তাই। যে পড়ে, সে’ও ভাল, যে পড়ে না, সে’ও।

সবার বাড়ি এমন হয় না। মেয়েদের আড়ালে রাখা হয়, ছেলেদের জন্য আলাদা কদর, বাড়তি যত্ন। ওদের বাড়িতে কোনওদিনই তা’ নয়। মনে মনে খুব তৃপ্তি হয় উত্তমের। যে কোনও সংস্কারের বীজ তো আগে নিজের বাড়িতেই লালন করা উচিত। শিবপদ বিশাখার উদারতা, অনঙ্গবালার সহনশীলতা মিলিয়ে ওদের অভাব আর টানাটানির সংসারেও একটা সুবাতাস বয়ে চলে সর্বক্ষণ।

একেই কি লক্ষ্মীশ্রী বলে?

শব্দটা মনে হতেই হাসি পায় উত্তমের। কমিউনিস্ট বাড়িতে লক্ষ্মী? এসব আনপার্লামেন্টারি শব্দ মনে পড়াও ঠিক কথা নয়। কিন্তু শিবপদ কি কখনও তার মায়ের ঘরের পুজোর জায়গা নিয়ে আপত্তি করেছে? করার কথাই নয়। ধর্ম ধারণ করে। বিশাখার যীশু মানুষের পাপ ধুইয়ে দিতে চেয়েছেন, অনঙ্গবালার শ্যামসুন্দর পীতাম্বর গোপীজনবল্লভ তাঁকে আশ্রয় দেন। তফাৎ তো শুধু বহিরঙ্গে। বিশ্বাসে তো নয়।      

রজদ্দার হাঁকাহাঁকিতে আনমনা ভাবটা কেটে যায় উত্তমের। খামোখা কী সব আং সাং ভাবছিল ও। ফালতু খানিক জরুরি আলোচনা মিস করল।

“পার্টির কোনও না কোনও সংগঠনে কাজ করতে হলে নিয়মিত একটা চাঁদা তো দিতেই হবে। ইউনিট কমিটির কাছ থেকে সব তথ্য ঠিকঠাক পেয়ে গেলে সভ্য করার প্রসেসিং শুরু হবে। আর সব সময় মনে রাখবেন কমরেড, আপনি ঠিক এক বছর প্রার্থী-সভ্য থাকবেন। আর অন্য দলে নাম লেখাতে চাইলে…” এই অবধি বলে রজদ্দা চোখ মটকে হাসেন, “অবশ্য যাবেনই বা কোথায়… দল বলে তো আর কিছু নেই, সব পোস্টার, তা’ও যদি যেতে হয়…,” কথাটা শেষ করেন না রজদ্দা। অন্য দলকে অবহেলায় ভাসিয়ে দেওয়ার মতো করে কথাটা বাতাসে হালকা করে উড়িয়ে দেন।  

“প্রার্থী-সভ্যরা ঠিক কতটা কী, একটু বলবেন?” একটি ছেলে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করে।    

“সেরকম মারাত্মক কিছু নয় কমরেড, পূর্ণ সভ্যদের যে সব কর্তব্য আছে, অধিকার আছে, প্রার্থী সভ্যদের বেলাতেও সেই একই কর্তব্য, একই অধিকার, কিন্তু নির্বাচন করা, নির্বাচিত হওয়া বা পার্টির কোনও প্রস্তাবের ওপর তিনি ভোট দেবার অধিকার পাবেন না, ঠিক আছে?” রজদ্দা থামলেন।    

“আমরা পুর্ণ সভ্য হিসেবে সম্প্রতি জয়দীপকে পেয়েছি, আর প্রার্থী সভ্য হিসেবে এই ইউনিট থেকেই বেশ কিছু নাম ওপরতলায় গেছে, সময় লাগবে, একটু সময় তো লাগবেই। যাকে তাকে যখন তখন তো এই দলে নিয়ে নেওয়া যায় না। এটা একটা রেজিমেন্টেড দল। সব সময় মনে রাখবেন এখানে একটা প্রপার সিস্টেম মেনে কাজ করতে হয়। একটা ডিসিপ্লিন আছে।”  

রজদ্দার কথা শেষ হতে না হতেই কেউ একজন বলে ওঠেন, “চীনের খবর শুনেছেন?” ঘরের দরজায় একটা লম্বা চেহারার ছায়া। সকলে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে কুশল ব্যানার্জি।

“কী ঘটল আবার?”

রজতের প্রশ্নের উত্তরে কুশল বলে, “বিবিসি সব বলেনি। খবরে তো কিছু রেখেঢেকেই বলছে। পুরোটা অবশ্য আমি নিজের কানে শুনিনি। তবে, তিয়েন আন মেন স্কোয়ারে ছাত্রদের ওপর গুলি চালিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সেনাবাহিনী।”  

“সেকি! যদ্দূর শুনেছি, মে মাস থেকেই তো ছাত্রদের লাগাতার অনশন চলছিল। ওদের পিটিশন শুনতে চায়নি, র‍্যাদার পাত্তাই দিচ্ছিল না সরকার পক্ষ।”   

“চীনের বাইরের পৃথিবী কিন্তু কেউ টের পেত না জানো তো। ওরা সব কথাবার্তা চেপেই রেখেছিল। গর্বাচেভ যাবেন বলে তিয়েন আন মেন স্কোয়্যার ছেড়ে দিতে বলেছিল ছাত্রদের, তারাই বা ছাড়বে কেন? এই সময়ই তো বাইরের দেশের সাংবাদিকদের কাছে সব ফাঁস হয়ে গেল। অতএব সব ফুটতে ফুটতে… যা হয়… কিন্তু তার জন্য সেনা পাঠিয়ে ট্যাংক পাঠিয়ে… ছাত্রদের এভাবে মারা যায়?”   

“কী বলছিস রে!” চেঁচিয়ে ওঠেন রজত।  

“হুম। বেসরকারি কোম্পানি আর বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পোয়াবারো… কট্টরপন্থীরাই জিতল কিন্তু।”

“আচ্ছা, পরে কথা বলছি দাঁড়া, “রজত হঠাতই থামিয়ে দেন কুশলকে। ঘরের মধ্যে চোখ বুলিয়ে একবার দেখে নেন কারা রয়েছে ঘরের মধ্যে। যারা রয়েছে তাদের সামনে হয়ত আর এই আলোচনা করবেন না এরা।  

ঘরের মধ্যে নৈঃশব্দ্য, বিহবল হয়ে পড়ে কেউ কেউ। খবরের কাগজ সবাই যে সব সময় সকলে মন দিয়ে পড়ে তা’ নয়। রাজ্য রাজনীতি, দেশের খবর ছাপিয়ে চীনের ছাত্র আন্দোলনের খবর সকলে রাখেও না।

কিন্তু নাড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা তো বটেই। দেশের শাসক ছাত্র-আন্দোলন দমন করতে নির্বিচারে অস্ত্র প্রয়োগ করছে, এটা সভ্য পৃথিবীর ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় নয়?

“আমাদের কিন্তু কলেজে এটা নিয়ে একটা প্রচার দরকার। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।” উত্তম বলে ফেলে।

জয়দীপ যেন মুখিয়ে ছিল। দীর্ঘক্ষণ ক্রিজে টিঁকে থাকা গাভাসকরের ক্যাচ নেওয়ার মতো করে লুফে নেয় কথাটা।

“একদম তাই। আর আমার মনে হয়, উত্তম ইজ দ্য রাইট পার্সন। ওরই উদ্যোগ নিয়ে ছাত্রদের কাছে বিষয়টা প্রচার করা উচিত। সবাই জেনে নিলে তারপর একটা সভা ডাকতে হবে। আর তাতে মূল বক্তা হিসেবে উত্তমই থাকবে। ছেলেমেয়েরা ওকে বেশ পছন্দ করে…,” বলেই তাকায় কুশলের দিকে, “কী বলো কুশলদা?”

কুশল ব্যানার্জি জয়দীপের দিকে তাকান। “চীনের কমিউনিস্ট পার্টি তার ছাত্রদের সঙ্গে কী করবে, সেটা তাদের ব্যাপার। হাইকমাণ্ডের সঙ্গে কথা না বলে আমরা কিচ্ছু করতে পারি না। এটা নিয়ে বিবৃতি দেবার মতো অনেক বড় বড় লোক আছেন।”              

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত