Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,চা

বিশেষ রচনা: চায়ের ইতিহাস । সুকন্যা দত্ত

Reading Time: 5 minutes
উসখো খুসকো মনে ভেজা কুয়াশা
 
কবিতার বই খুলে এক কাপ চা
 
আঁধারীর কালো জলে যুগল ছায়া
 
নিদে ভেজা আঁখি খুলে এক কাপ চা ।
 
 
শ্রাবণ বরষা মনে রৌদ্র আশা
 
স্বপ্ন পেয়ালা ভরা এক কাপ চা
 
মগ্ন চেতনা মাঝে যখনই দুরাশা
 
ব্যাকুল আমি চাই এক কাপ চা ।”
 
 
আয়ুব বাচ্চুর এই গানটি মনে হয় সব বাঙালির চাওয়া পাওয়া। আড্ডার আসর এক কাপ চা ছাড়া জমে না। ঘুমের রেশ ভাঙাতে না ভাঙতেই ধোঁয়া ওঠা চা চাইই চাই। এই তো সেদিন গোবিন্দ বাবু পাড়ার দোকানে চায়ের কাপে ঝড় তুলে ইস্টবেঙ্গল সেরা নাকি মোহন বাগান সেরা, তা নিয়ে সরিৎ বাবুর সাথে বিতর্ক জুড়লেন। ঝন্টুদার চায়ের দোকান তখন উত্তাল। সে মুহূর্তে ঝন্টু দা হাসিমুখে দু কাপ চা নিয়ে এসে ওনারদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
 
” দাদাবাবুরা, এই লেবুটা চা টা খেয়ে মাথাটা একটু ঠান্ডা করেন তো। ব্যাস অমনি দুজন তর্ক ভুলে চায়ের কাপ হাতে তুলে চুমুক দিতেই মেজাজ উধাও। হাসি মুখে চায়ের তারিফ করে গোবিন্দ বাবু বললেন,
 
” ঝন্টু রে, বড় ভালো বানিয়েছিস চা খানা।”
 
প্রেমে পড়ার পর বৃষ্টি ভেজা দিনে দুজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ভাঁড়ের চা খেতে খেতেই কথা হয় একরাশ।
 
শ্রাবণ হোক বা শীত, তেলেভাজা চা ছাড়া অসম্পূর্ণ। ছোটো থেকে বড়ো হওয়ার মাপকাঠিও বোধহয় চা ই। আমার মা বলতেন,
 
” ছোটোরা চা খায়না, বড়ো হয়ে চা খাবে।”
 
 
ট্রেনে হকার যখন ” চা এ এ এ গরম চা এ এ এ ” হেঁকে যায়, তখন সবসময় সেই ডাক উপেক্ষা করা যায় না। চায়ের কথা বলতেই মনে আসে চীনের নাম। এবার এই চায়ের ইতিহাসটা একটু জানাই আপনাদের।
 
 
 
চায়ের ইতিহাস প্রাচীন চীনে, প্রায় ৫০০০ বছর আগে। কিংবদন্তী অনুসারে, ২৭৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে
 
সম্রাট শেন নুং চা আবিষ্কার করেছিলেন। একদিন তিনি খাওয়ার জন্য জল গরম করছিলেন। দমকা বাতাসে দু একটি বন্য গাছের পাতা উড়ে এসে ফুটন্ত জলের পাত্রে পড়ে যায়। সেই পানীয়ের মনোরম ঘ্রাণে তিনি মাতোয়ারা হয়ে যান। সেই পানীয়ের কিছু তিনি পান করেন। কথিত আছে, এ বিষয়ে সম্রাট তার উষ্ণ অনুভূতি বর্ণনা করেছিলেন। যখন তিনি অজানা পানীয়টি পান করছিলেন, তখন তরলটি তার শরীরকে শিহরিত করে তুলছিলো।
 
 
 
শেন নুং ব্রুটির নাম দিয়েছেন “চা’, চীনা অক্ষরে যার অর্থ ‘পরীক্ষা করা’ বা ‘তদন্ত করা’।
 
২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হান রাজবংশের এক সম্রাট ঘোষণা করেন, চায়ের উল্লেখ করার সময় একটি বিশেষ লিখন ব্যবহার করতে হবে। কাঠের ডাল ও ঘাসের মাঝে একজন পুরুষ চিত্রিত থাকবে। এই চিত্রটি হবে চা এর প্রতীক। ওনার উদ্দেশ্য ছিলো”চা” শব্দটি উচ্চারণে মানবজাতির কাছে চীনা সংস্কৃতির এই ছবিটি যেন ফুটে ওঠে।
 
 
 
চীনে চায়ের জনপ্রিয়তা চতুর্থ থেকে অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। শুধুমাত্র চা পানীয় রূপে নয়, ঔষধি গুণাবলীর জন্য ও এর ব্যবহার শুরু হয়। এছাড়া প্রতিদিনের আনন্দ এবং সতেজতার জন্য এর মূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। স্থানে স্থানে চায়ের বাগান ছড়িয়ে পড়তে থাকে। চা ব্যবসায়ীরা ধনী হয়ে ওঠে, এবং ব্যয়বহুল, সুস্বাদু চা সম্পদ এবং মর্যাদার প্রতীক হয়ে ওঠে।
 
 
 
চীনা সাম্রাজ্য কঠোরভাবে চা ফসল প্রস্তুতি এবং তার চাষ নিয়ন্ত্রণ করে। এমনকি এটি নির্দিষ্ট করা হয়, শুধুমাত্র অল্পবয়সী মহিলারা, সম্ভবত তাদের বিশুদ্ধতা ও কমনীয়াতার কারণে, চা পাতাগুলি পরিচালনা করবে। তবে সেই যুবতী মহিলাদের রসুন, পেঁয়াজ বা মশলা জাতীয় খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয় কারণ আঙুলের ডগায় ঐ জাতীয় খাদ্যের গন্ধে চা পাতা দূষিত হতে পারে।
 
 
 
কালো চায়ের আবিষ্কার
 
 
17 শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত, চীন দেশের সমস্ত চা ই ছিল গ্রীন টি। বৈদেশিক বাণিজ্য বৃদ্ধির সাথে সাথে, চীনা চাষীরা আবিষ্কার করেছিল যে তারা একটি বিশেষ গাঁজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চা পাতা সংরক্ষণ করতে পারে।
 
ফলস্বরূপ ব্ল্যাক টি এর স্বাদ এবং সুগন্ধ আরও বেশি সূক্ষ্ম হয়, গ্রীন টি-এর চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং অন্যান্য দেশে রপ্তানি যাত্রার জন্য আরও সুবিধাজনক হয়।
 
 
তিব্বতের চায়ের ইতিহাস
 
 
 
চীনারা ৯ ম শতাব্দীর প্রথম দিকে তিব্বতে চা প্রবর্তন করেছিল। তিব্বতের রুক্ষ জলবায়ু এবং পাথুরে ভূখণ্ডে তাদের নিজস্ব চা চাষ করা ছিলো কঠিন। তাই ইয়াক এর মাধ্যমে চীন থেকে এদেশে চা আমদানি করা হতো। চীন থেকে দূর্গম পার্বত্য পথে চা আসতে ইয়াকগুলোর প্রায় একবছর সময় লাগতো। শুধু কঠিন পথের দীর্ঘ ক্লান্তিকর যাত্রাই নয় চোর এবং দস্যুদের দ্বারা চুরির সম্ভাবনাও ছিলো প্রবল। সে সময় তিব্বতে চায়ের চাহিদা মেটাতে প্রতিদিন প্রায় দুই থেকে তিন শতাধিক চা বোঝাই ইয়াক দেশে প্রবেশ করতো।
 
 
 
চা তিব্বত এবং আশেপাশের অঞ্চলে এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে এটি বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে মুদ্রার মতো ব্যবহৃত হতে থাকে। তুলনামূলক নিকৃষ্ট চা প্রায় যেকোনো কিছুর জন্য একটি সাধারণ ধরনের অর্থপ্রদানের মাধ্যম ছিল এবং শ্রমিক এবং কর্মচারীদের নিয়মিতভাবে এইরূপে অর্থ প্রদান করা হত।
 
 
ঐতিহ্যবাহী তিব্বতি চা
 
 
ঐতিহ্যগতভাবে, তিব্বতি চা তৈরির প্রক্রিয়ারটি একটু ভিন্ন। ঘোড়ার চুলের দ্বারা নির্মিত (কখনও কখনও প্লাস্টিকের তৈরি) ছাঁকনির মাধ্যমে তৈরি চা ছেঁকে নেওয়ার আগে প্রায় আধ ঘন্টা একটি কাঠের পাত্রে জল দিয়ে চা পাতা সিদ্ধ করা হয়। এছাড়া চা এর সাথে ইয়াকের দুধের মাখন এবং লবণ যোগ করে ঝাঁকিয়ে সেই চা মন্থন করা হয়। হিমালয়ের অধিক উচ্চতায় বসবাসকারী মানুষের শরীরে লবণ ও চর্বির ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য এই ব্যবস্থার প্রচলন আছে।
 
 
 
৯ ম শতাব্দীর প্রথম দিকে, চীনে জাপানি দর্শনার্থীরা চায়ের মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হয়।
 
বৌদ্ধ সন্ন্যাসী দেঙ্গিও দাইশি বিদেশে বিদ্যার্জন করে ফিরে আসার সময় চীন থেকে জাপানে চায়ের বীজ নিয়ে আসেন। এজন্য তারা সম্মানিত হন। চা জাপানী মঠ জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠে। পূর্বে সন্ন্যাসীরা ধ্যানের সময় সতর্ক থাকতে চা ব্যবহার করতেন।
 
১৩০০ শতকের এর গোড়ার দিকে চা পুরো জাপানি সমাজে জনপ্রিয়তা লাভ করে। এর প্রাথমিক ধর্মীয় গুরুত্ব স্থায়ীভাবে চায়ের সাথে জাপানিদের সম্পৃক্ততার অর্থ ও মূল্যকে রাঙিয়ে তোলে এবং সরাসরি জাপানি চা অনুষ্ঠান রূপে মর্যাদা পায়।
 
 
 
জাপানি চা অনুষ্ঠান
 
 
১৫০০ শতকের শেষের দিকে জেন বৌদ্ধধর্মের জাপানি দর্শনের প্রভাবে বিকশিত হয়েছিল পবিত্র জাপানি চা উৎসব , “ছানয়ু”। এই উৎসব পালিত হয় চা তৈরি এবং চা পান কে সম্মান করার জন্য।
 
জেন বৌদ্ধধর্ম ” ছানয়ু” উদযাপনের সময় জাপানি দর্শনের অপরিহার্য উপাদান (সম্প্রীতি, বিশুদ্ধতা, সম্মান এবং প্রশান্তি) গুলিকে গুরুত্ব প্রদান করে।
 
চা উৎসব সেই আমলে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে বাড়ির পিছনের দিকের বাগানে বিশেষ চা ঘর তৈরি করা হতো এমনকি বিবাহের জন্য এই উৎসব আয়ত্ত করা তৎকালীন মহিলাদের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল।
 
 
 
ঐতিহ্যবাহী জাপানি চা
 
 
“ম্যাচা” নামক গ্রীন টি ফেটিয়ে ছানয়ু উৎসবের জন্য চা তৈরি করা হয়। গ্রীন টি সূক্ষ্মভাবে গুঁড়িয়ে এই ম্যাচা হয়। জাপানিরা সাধারণ চা পাতা দিয়ে চা তৈরির পদ্ধতির চেয়ে মাচা-এর তাজা, সবুজ স্বাদ পছন্দ করত।
 
 
 
আধুনিক জাপানে চা
 
 
বর্তমানে জাপানি সংস্কৃতির সাথে চা সম্পূর্ণরূপে মিশে গেছে। এদেশে চা প্রতিটি খাবারের সাথে পরিবেশন করা হয়, এবং প্রত্যেক অতিথিকে অভ্যর্থনা জানাতে ব্যবহৃত হয়। দোকানে দোকানে বোতলজাত চা, ভেন্ডিং মেশিন এমনকি “গ্রিন টি” স্বাদের আইসক্রিমও পাওয়া যায়। সীমিত ভূমির কারণে চা চাষের জন্য পাহাড়ের ধারের কঠিন সোপানগুলি খোদাই করা হয়।
 
জাপানের চা শিল্প বিশ্বের সবচেয়ে প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত। বর্তমানে, জাপানি বাগানগুলি চা উৎপাদনে বিশেষ মেশিন ব্যবহার করে।
 
 
 
 
রাশিয়ার চায়ের ইতিহাস
 
 
 
১৬১৮ সালে, চীনারা রাশিয়ার জার অ্যালেক্সিসকে চা উপহার দেয়। রাশিয়ার সবাই নতুন পানীয় সম্পর্কে কৌতূহলী ছিল এবং দ্রুত সে দেশে চা জনপ্রিয়তা অর্জন করে। দেশে চা পরিবহনের জন্য উটের সারি চলাচলের কারণে বাণিজ্য পথের উদ্ভব হয়েছিল। এই উটের দল সে সময় ১১০০০ মাইল জুড়ে এবং প্রায় দেড় বছর ভ্রমণ করেছিল। প্রতি বছর রাশিয়াবাসীদের চা এর তৃষ্ণা মেটাতে প্রায় ৬০০০ উট এর প্রতিটি ৬০০ পাউন্ড চা বহন করে রাশিয়ায় প্রবেশ করতো। ১৯০৩ সালে উট চলাচলের পথটিতে বিখ্যাত ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলওয়ে লাইন গড়ে ওঠে। এর ফলে যাতায়াতের দেড় বছর সময় এক সপ্তাহে পরিণত হয়।
 
 
ভারতীয় চায়ের ইতিহাস
 
 
 
ভারতে চায়ের বিশাল সাম্রাজ্য নির্মাণের কৃতিত্ব ব্রিটিশদের। তারা ১৮০০ শতকের গোড়ার দিকে ভারতে চা আবিষ্কার করেন। ১৯৪৭ সালে গ্রেট ব্রিটেন ভারতের স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত প্রচুর পরিমাণে চা চাষ ও ব্যবহার করেন।
 
 
১৭৭৪ সালের দিকে, ওয়ারেন হেস্টিংস চা চাষের ক্ষেত্রে রোপণের জন্য ভুটানে তৎকালীন ব্রিটিশ দূত জর্জ বোগলের কাছে চীন থেকে আমদানিকৃত চায়ের বীজ পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু এই গবেষনায় তেমন আশানুরূপ সাফল্য আসে না। ১৭৭৬ সালে, মহান ইংরেজ উদ্ভিদবিজ্ঞানী স্যার জোসেফ ব্যাঙ্কসকে লিখিত তথ্য প্রস্তুত করতে বলা হয়। এও বলা হয়, ভারতে চা চাষ করা হবে।
 
 
 
১৭৮০ সালে রবার্ট কিড চীন থেকে আমদানিকৃত একটি চালান থেকে বীজ নিয়ে ভারতে চা চাষের পরীক্ষা করেন। কয়েক দশক পরে
 
রবার্ট ব্রুস উচ্চ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বন্যভাবে বেড়ে ওঠা চা গাছ আবিষ্কার করেন। ১৮২৩ সালের মে মাসে আসাম থেকে প্রথম ভারতীয় চা সর্বজনীন বিক্রির জন্য ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়।
 
 
আধুনিক সময়ে চা নিয়ে পরীক্ষা নীরিক্ষার শেষ নেই। লঙ্কা চা, লেবু চা, তেঁতুল চা, মাল্টা চা এমন নানান চা এ সক্কলে মাতোয়ারা। এমনকি প্রখর গরমে ঠান্ডা চা এর জুরি মেলাও ভার।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>