| 19 এপ্রিল 2024
Categories
শারদ সংখ্যা’২২

শারদ সংখ্যা গল্প: চিনি । সত্যজিৎ দত্ত

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

ঘরে একটুও চিনি নাই।

সব্জি নাই। লাকড়ি নাই। মাছ মাংসের তো প্রশ্নই নাই। এ কেমন দিন! দু’টো বাড়িতে কাজ ছিল। না বলে দিয়েছে। এখন নাকি লকডাউন। কেউ বাইরে বেরোবে না। টুসি বেরোয় না। মন্তি বেরোয় না। অভি সবার ছোট। তার তো বেরোনোর কথাই নেই। ভাঙ্গা টিন লোহা পুরনো কাগজ বেঁচে ওদের বাপ। সেও বেরোয় না। সকাল থেকে গাঁজা টানে। হাতে কাজকর্ম না থাকলে বোধহয় পুরুষ মানুষগুলো এমনই করে। সরকার কেবল চাল দিচ্ছে। টাকা পয়সা ছাড়া। রেশন দোকানে কার্ড জমা দিয়েছে কৌশল্যা। জমা দিয়েছে অন্যরাও। দিয়ে অপেক্ষায় থাকে। কাপড়ে নাক মুখ ঢাকা। কেউ কাউকে চিনতে পারে না। চিনলেও কথা হয় নিশ্চুপ।

– চলতাছে কেমনে ?

– চলতাছে কই!

– তোর তো চোখ মুখ দেখলে মনে হয়…

– কি মনে হয়? কৌশল্যা জানতে চায়।

– মনে হয় ভালো চলতাছে।

– নারে। ভালো নাই।

– ঠাট্টা করলাম। ভালো নাই কেউ। ইটের স্তূপে বসতে বসতে বলে বিজয়া। মাথার উপর রোদ

থাবা বসায় । ঘাম হয় শরীরে। ব্লাউজ ভিজে ওঠে জায়গায় জায়গায়। মাথায় মাথায় করে চাল যায়। কার্ডের স্তুপ ছোট হয়। এক সময় ডাক আসে কৌশল্যার। পেছনের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়ায়।

– চাল আছে। চাল লও। ডিলারের গলা থেকে ধাতব আওয়াজ আসে।

– ডাল নাই?

– না।

– আটা ?

– আটাও নাই।

– চিনি থাকলে … । কৌশল্যা নরম গলায় বলে।

চিনি আছে। তুমি পাইবা। টাকা লাগব না। তবে এখন না। সন্ধ্যার পর আইও। গলা নামিয়ে বলে রেশন শপ ডিলার যতন। চোখে মুখে চকচক করে লোভ। মাথা নিচু করে চালের বস্তার মুখ বাঁধে কৌশল্যা।বেশ ভারি। ডিলার সদয় হয়ে মাথায় তুলে দেয়। কৌশল্যার চোখে পড়ে যতনের লোমশ বুক। সোনার ভারি চেন। নাকে এসে ধাক্কা দেয় চিনি চিনি গন্ধ।

– আইবা তো?

– দেখি। দরজার দিকে এগোতে এগোতে ছোট করে জবাব দেয়।

দিন আর রাত এখন যেন অনেকটাই বড়। ঘরের পেছনে দু’চার গাছ মরিচ। বারোমাস্যা বেগুন। কলার ঝাড়ও রয়েছে। দু’দিন আগে নামানো হয়েছে একটা ছড়ি। একটা দুটো করে পাঁকছে। ভাতের সাথে কলা মেখে চলছে কাল থেকে। সঙ্গে একটু লবন। টুসি মান্তি খেয়ে নেয় চুপচপ। অভি ঘ্যানঘ্যান করে চিনির জন্য।

– এট্টু চিনি দ্যাও।

– চিনি নাই ঘরে। কৌশল্যা মুখ ঝামটা দেয়। কে শোনে কার কথা। জেদ ধরে থালার সামনে

বসে থাকে ছেলেটা। টুসি আদর করে। মন্তি করে। কৌশল্যার মনে আদর আসে না। পিঁড়ি ছেড়ে দৌড়ে পালায় অভি। তুলসি তলার পাশে পড়ে আছে ছোট ছোট শুকনো ডাল। চুলো জ্বলে। তার থেকেই একটা তুলে নেয় কৌশল্যা। রাগের মাথায় দু’চার ঘা বসিয়ে দেয় ছেলের পিঠে। কান্নার শব্দে গেটের পাশে ডেকে ওঠে কালো রঙের একটা কুকুর। সাড়া শরীরে হাড্ডি গোনা যায়। এঁটো কাঁটা খেয়ে বড় হয়েছে। ক’দিন ধরে ভালোমতো খাবারও জুটছে না।

কৌশল্যার মন খারাপ এক সময় হেলে পড়তে থাকে। সূর্যের সাথে। পশ্চিমে। সরকারি গাড়ি আসে ধুলো উড়িয়ে। বাইরে বেরোতে নিষেধ জানায়। মাস্ক পরতে বলে। হাত ধুতে বলে বারবার। রথীন্দ্র’র ছেলে ফিরেছে বেঙ্গালোর থেকে। গেটের বাইরে নোটিশ লাগানো। রথীন্দ্ররা বেরোয় না। কেউ যায় না ওদের ঘরে। শুনশান রাস্তায় একা একা হাঁটে সে। পাগলের মতো। দূরে শ্মশান কালির মন্দিরে কারা যেন বসে আছে। সকাল থেকে ঘরে নেই সুবল। পথেড় পাশে কাঁত হয়ে আছে ভাঙ্গা লোহা টিনের রিক্সা। সেটিও ভাঙ্গা। মন্দিরের চাতালে গাঁজা টেনে পড়ে আছে হয়তো। পেটে ভাত নেই। শরীর দড়ি হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। অসুখটা তাদের মারবে না। মারতে পারবে না। না খেতে পেয়ে না মরে যায় গুষ্ঠিশুদ্ধ। কতদিন যে চলবে এই লক ডাউন।

ঝুপ করে একসময় নেমে পড়ে সন্ধ্যা। ঘরে ঘরে জ্বলে ওঠে আলো। দুর্ভাবনা জড়ো হতে থাকে ঘরে ঘরে। কারও সন্তান দূরে আছে। রেল বন্ধ। প্লেন বন্ধ। মোবাইলে কথা হয়। কান্নাকাটি হয়। কথা শেষ হলে টিভি চলে। মৃত্যুর পরিসংখ্যান ভাসে পরদায়। চা চলে ঘন ঘন। ভালো মাছ পাওয়া যাচ্ছে না বলে দুঃখ করে। মদের দোকান বন্ধ। দ্বিগুন দামে বিক্রি হচ্ছে চোরাই পথে। সকাল বিকালে হাঁটা বন্ধ অনেকের। ছাদে পায়চারি চলে। বাড়তি যত্ন পায় টবের গাছ।

এসব নিয়ে যতনের কোন হেলদোল নেই। রেশন শপ এখন এক বেলা খুলতে হয়। সরকারি আদেশ। না মেনে উপায় নেই। অভ্যাসের বশে তবু সন্ধ্যার পর এসে বসে। একা একা। দরজা খোলে না। জানালা খোলে না। আলোও জ্বালে না সবক’টা। প্রায়ান্ধকার ঘরে পাখা চলে। ঘরঘর শব্দ হয়। ঘরময় ভেসে বেড়ায় চাল চিনি কেরোসিনের গন্ধ। ছোট কাঁচের গ্লাসে মদ ঢালে যতন। জল মেশায়। কড়া তরল গলায় ঢালে। ঢিল দিয়ে দিয়ে মুখে ফেলে ভাজা বাদাম। সিগারেট জ্বালে আয়েশ করে। মাথার ভেতর ঝিমঝিম আবেশ। চেয়ারে হেলান দিয়ে অঙ্ক কষে। চালের হিসাব। চিনি। কেরোসিন। আটা। চম্পা। বন্দনা। টুনি। কৌশল্যাকে অনেকদিন ধরে মাপছে। ধরা দিচ্ছিল না কিছুতেই। আজ সকালে টোপ ফেলেছে। চোখ বন্ধ করে অপেক্ষায় থাকে যতন। ভরাট শরীর। মেয়েলি গন্ধ। অস্থির অস্থির লাগে যতনের। এদিক ওদিক ছুটে যায় দু’য়েকটা ইঁদুর। টিকটিকি ডাকে দেয়ালে। পোকা ধরে। দূরে সাইরেন বাজিয়ে ছুটে যায় অ্যাম্বুলেন্স। শহর জুড়ে আর কোন শব্দ নেই। যেন মৃত্যু ওত পেতে বসে আছে। খুব কাছে কোথাও। যতন আরও একটু মদ ঢালে গ্লাসে। জল মেশায়। গলায় ঢালে কড়া তরল। ভাজা বাদাম চিবোয়। পাখা চলে ঘরঘর শব্দে।

বাইরে একাদশীর চাঁদের হাত ধরে আরও একটু গড়ায় সময়। আরও একটু গাঢ় হয় অন্ধকার। আলো ছড়ায় কেবল গোটা কয়েক স্ট্রীট লাইট। সেই আলোয় মাথা নিচু করে হাঁটে কৌশল্যা। হাতে প্লাস্টিকের একটা ব্যাগ। পা চলে কি চলে না। মনের ভেতর ছোট্ট কৌটোয় লটর পটর করে ছক্কা। কখনও সিঁড়ি। কখনও সাপ। সন্ধ্যা জুড়ে এই এক খেলা চলছে। মাথা কাজ করে না। পা চলে। অন্ধকার। আলো। আলো অন্ধকার। সাদা কালোর ছক কাটা পথ। বড় ক্লান্ত লাগছে। ঘুম পাচ্ছে যেন। টলতে টলতে পরিচিত ঘরের সামনে এসে দাঁড়াতে ডেকে ওঠে টুসি।

– মা! কই আছলা?

– এমনেই ঘুরি। নিজেকে আড়াল করতে করতে কোনমতে উত্তর দেয়।

– বাবা মাছ ধইরা আনছে। মান্তি এসে দাঁড়ায় দিদির পাশে।

– চিনিও আনছে। ঠোঁটের কোণায় অভিমান লুকোতে লুকোতে বলে অভি। কৌশল্যা কোন কিছু

বলে না। ভালো লাগায় পুলকিত হতে থাকে তার শরীর। আস্তে আস্তে ঝাপসা চোখের সামনে স্পষ্ট হয় মিষ্টি একটা ঘর। অনটনের সুতোয় বোনা। আনমনেই তার হাত থেকে খসে পড়ে প্লাস্টিকের ব্যাগ। শূন্য।

পেছনে পড়ে থাকে তেতো একটা পথ। ক্ষুধার্ত অজগরের মতো।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত