শারদ সংখ্যা সাক্ষাৎকার: ইরাবতীর মুখোমুখি কবি চৈতালী চট্টোপাধ্যায়
রাগরাগিণীর ঘরে জন্ম চৈতালী চট্টোপাধ্যায়ের। মা শচীনকর্তার ভাগ্নি বিভাস কুমারী দেববর্মণ। ত্রিপুরা রাজপরিবারের মেয়ে। বাবা তীব্রভাবে সৎ, কল্পনাপ্রবণ হরিপদ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। চৈতালী বর্ণপরিচয়ের দ্বিতীয়ভাগ না পড়ে, নিজেই যুক্তাক্ষর শিখে নিয়েছিলেন। বইয়ের সরবরাহ যোগাতে যোগাতে ক্লান্ত বাবা-মাকে ক্ষান্ত করতে ছোট মেয়েটি উল্টোভাবে ধরে বই পড়ত, সময় বেশি লাগবে বলে। যাপনে ছিল, আজও আছে কবিতা আর তীব্র অনিশ্চয়। উত্তর কলকাতার সরু গলি, উঠোন, ময়ূরের খাঁচা, রুপোলি মাছ ছিটকে-আসা গঙ্গাজলের কল, রোমান ক্যাথলিক স্কুলের চ্যাপেল ও অর্গানের অনুষঙ্গ, এসবই ভাসতে ভাসতে তাঁর কবিতার অভিমুখী হয়। বিষয় পদার্থবিদ্যা হলেও বিষয়ান্তর, সাহিত্য। আর, পেশা ছিল প্রখ্যাত বিজ্ঞাপন সংস্থায় কপিরাইটিং। বহুল প্রচারিত সব সংবাদপত্রে একের পর এক লিখে চলেছেন নানাকিছু। কবিতা,গল্প ও প্রবন্ধবই প্রকাশ পেয়েছে অভিজাত প্রকাশনা থেকে। পেয়েছেন সরকারি (কেন্দ্রীয় ও পশ্চিমবঙ্গের), বেসরকারি বিভিন্ন সম্মাননা। ২০২০ সালে ১১ জানুয়ারি চৈতালী চট্টোপাধ্যায়কে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রবর্তিত বিভা চট্টোপাধ্যায় স্মারক সম্মান অর্পণ করা হয়েছিল বাংলা কবিতায় তাঁর সামগ্রিক অবদান স্মরণে রেখে। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শৌনক দত্ত।
তুমি কবিতার মানুষ। তোমার কাছ থেকে কবিতার কথা জানতে চাই। কবিতাকে কিভাবে দেখো তুমি?
চৈতালী চট্টোপাধ্যায়: বহুবার এ-প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। এখন ক্লিশে লাগে। কবিতার মানুষ মানে কী।বহুজন,এক অক্ষরও কবিতা লেখেন না, কিন্তু কবিতার মধ্যেই তাদের বাস, যাতায়াত থাকে। আমার হাসি কান্নার রিফ্লেকশন পড়ে কবিতায়।সে আমার আনন্দ অপমানের মেনিফেস্টো। কিন্তু আমার মনে হয়,ব্যক্তিক আমিকে যদি ছাপিয়ে যায় সেটা, তবে অন্যরাও মনে গেঁথে নিতে পারবে। নীল আকাশের নীচে ভাঙা বাড়ির কার্নিশে একটা নয়নতারা ফুটে আছে। কিংবা আমার মেয়ের সদ্য ঘুমভাঙা মুখ, সবকিছুই কবিতা সাজায় আমার জন্য।
জীবনের শুরুতে কারা তোমার ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিলেন?
প্রথম কবিতা লেখার গল্পটা শুনতে চাই?
পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করে কবিতায় কাটিয়ে দেয়ার গল্পটা কি?
চৈতালী চট্টোপাধ্যায়: স্কুলে থাকাকালীন বাংলা ও ফিজিক্স একসঙ্গে ভালোবেসেছি আমি। কবিতা লিখতাম। ফিজিক্যাল অপটিক্সও পড়তাম। কোথাও কোনও বিরোধ নেই তো! পদার্থবিদ্যার দ্বিতীয় চ্যাপ্টার,এমন শিরোনামও দিয়েছি কবিতায়। ফিজিক্স নিয়ে পড়ব,স্বপ্ন ছিল। কিন্তু সাহিত্যকে বাদ দিয়ে চলব,এমনটা ভাবিনি কখনও।
এত বছর পরে যদি কবিতা লেখার প্রস্তুতির কথা বলতে বলি কোন তরুনের প্রতি কি বলবে? কিভাবে শুরু করা উচিত?
তোমার কবিতা যাপন মুহূর্ত বা রচনার মুহূর্ত জানতে ইচ্ছে করে…কবিতায় তোমার নিবিষ্ট যে ভ্রমণ… একান্ত যে বিচরণ সেগুলোর কথা।
কাব্যরচনা তো একটা চ্যালেঞ্জ তা সেটা কতটা প্রতিভানির্ভর,কতটা প্রস্তুতিনির্ভর বলে মনে কর?
প্রতিটি শিল্পের সাথে যাপন মিশে থাকে, জীবনের অভিজ্ঞতা থাকে-তোমার কী রকম? কবিতায় তোমার যাপন কতটা পায় পাঠক?
চৈতালী চট্টোপাধ্যায়: ব্যক্তিগত যাপন,মানসযাপন,সবই মিশে যায় আমার লেখায়। তাকে কবিতা বলব কি। ঘোরতর সন্দেহ আছে।সে যাই হোক,যে মেয়েটি অলস জীবন কাটাচ্ছে,এ জীবন লইয়া কী করিব,যাকে ভাবাচ্ছে না, আমার অ্যান্টেনা তাকে ছোঁয় যেমন, তেমন কাচবসানো পাঁচিলের ওপর দিয়ে হেঁটে চলা মেয়েটিকেও ধরে ফেলে।যুদ্ধ, রাজনীতি, দুর্ভিক্ষ, অর্থনীতি সবই তো নিজের যাপন।তাই লিখি আমি।পাঠক কতটা পায়,সে তো পাঠক-ই বলবে!
তোমার কবিতার গভীরে একটা না পাওয়ার আবহ পাওয়া যায়। কোনো প্রেম,সময়ের জ্বালা, এর সঙ্গে লেখা না-লেখার সংযোগ…
তোমার কবিতার নির্মাণ ভাবনা বা বিনির্মাণ নিয়ে জানতে চাই?
কবিতায় আছো কয়েক দশক ধরে শুরুর সেই সময় আর আজকের মধ্যে পার্থক্য কিভাবে দেখ?
তোমার পারিবারিক একটা ঐতিহ্য আছে,রাজরক্ত বইছে তোমার শরীরে। তোমায় গানের গলাও অসাধারণ সংগীত নিয়ে তোমার ভাবনা… এ সম্পর্কে কিছু জানতে চাই।
সংগীতের সঙ্গে কবিতার কোনো প্রেম আছে কিনা?
নামী বিজ্ঞাপন-সংস্থা, নারী-পত্রিকা ও নিউজ ম্যাগাজিনে চাকরি-করা, চাকরি-ছাড়ার অনিশ্চয়তার সাথে কিভাবে মেলাবে বিজ্ঞাপনের মেয়ে, বিষাক্ত রেস্তোরাঁ, দেবীপক্ষে লেখা কবিতা তিনটি কাব্যগ্রন্থকে?
সারা পৃথিবীতে প্রযুক্তির অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে। এর ছোঁয়া আমাদের দেশেও লেগেছে। কিন্তু এই প্রযুক্তি তো মানুষকে আরো বেশি অমানবিক করে তুলছে। আমাদের এখন আর কোনো গল্প নাই, আড্ডা নাই। তবে কি এই প্রযুক্তি মানুষের শেষ হাসিটুকু নিংড়ে নেবে? নাকি প্রযুক্তিসম্পন্ন সমাজে এটাই স্বাভাবিক? কবিতা ও প্রযুক্তির অগ্রগতিকে কিভাবে দেখ?
একজন কবির পঠন-পাঠন কেমন হওয়া উচিত বলে মনে কর?
সামাজিক মাধ্যম ও প্রযুক্তির অগ্রগতিতে প্রতিদিন একজন চাইলে একশজন কবির কবিতা পড়তে পারছে, এই অধিক পাঠ কি সেই কবির মনজগতে ও লেখায় প্রভাব ফেলছে বলে মনে কর?
তোমার সমকাল এবং পরবর্তী দশকগুলোতে বাংলা কবিতা কী ছিল আর কী হয়েছে সেই সম্পর্কে তোমার ভাবনা জানতে চাই?
জীবনানন্দ দাশের কবিতার ভাষা কি পরবর্তী বাংলা কবিতাকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে?
কবিতা ছাড়াও তোমার গল্প, প্রবন্ধ বা গদ্য সমান গতিশীল,কী ভাবে এবং কখন বুঝতে পারো যে একটা লেখা হয়ে উঠলো?
তোমার প্রিয় বই? যা সব সময় কাছে রাখতে চাও?
প্রিয় কবি? প্রিয় ব্যক্তিত্ব?
প্রিয় উপন্যাস?
ভবিষ্যতে কি মানুষ কবিতা লিখবে–পড়বে? কবিতার কি আর প্রয়োজন হবে ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে?
চৈতালী চট্টোপাধ্যায়: ভবিষ্যৎ জানে এসব দুরুহ প্রশ্নের উত্তর। আমি জানি না।
কবি ও কথাসাহিত্যিক। জন্ম ৭ আগস্ট, উত্তরবঙ্গের কোচবিহারে। স্কুল জীবন থেকেই লেখালেখির সূত্রপাত। সম্পাদনা করেছেন বেশ কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকা এবং ওয়েবজিন। বর্তমানে ইরাবতী ডেইলি ওয়েবজিনের সাথে যুক্ত। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : জল ভাঙে জলের ভেতর [২০১১], ঠোঁটে দাও জ্যোৎস্নার বিষ [২০১২], ডুব সাঁতার [২০১৭], নিরুদ্দেশ গাছে সন্ন্যাসীর মুখ [২০১৭]। গল্পগ্রন্থ : কারুময় খামে অচেনা প্রেম [২০১২]। উপন্যাস: ইতি খন্ডিত জীবন [২০২২]। প্রবন্ধ সংকলন: মাটির গন্ধ [২০২২]। সম্পাদনা গ্রন্থ: দুই বাংলার সাম্প্রতিক গল্প [২০২২] ।
শখ বইপড়া, লেখালেখি, ছবিতোলা, গান শোনা ও ভ্রমণ। বেশ কিছু গানও লিখেছেন তিনি।