ইরাবতী ধারাবাহিক: কদমতলি (পর্ব-১৭) । শ্যামলী আচার্য
“জ্বর হলে খুব পেয়ারা খেতে ইচ্ছে করে। তাই না মা?”
অনঙ্গবালা স্মিতমুখে তাকান বিশাখার দিকে। “আমাগো কালে এইসব কইলে মায়ে দিত পিঠের উপর দু’ঘা। তবু তো চুপি চুপি পুকুরঘাটে বইস্যা কইষটা পেয়ারাগুলান খাইতাম চিবাইয়া… এই দ্যাশে আইস্যা না পাইলাম সেই ঘাট, না আসে সেই গাছপালা… চারদিক অ্যাতো শুকনা, পিপাসা পায়। জল খাইয়া শান্তি পাই না।”
চোখ ছলছল করে আসে অনঙ্গবালার।
আজকাল প্রায়ই আনমনা হয়ে যান অনঙ্গ। ঘুরেফিরে ছেলেবেলার কথা বলেন। সেই মামাবাড়ির গাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ধলেশ্বরী, সেই শ্বশুরঘরের লোক-লৌকিকতা, আচার-বিচার, তাঁর মায়ের কথা বিচ্ছিন্ন টুকরো টুকরো হয়ে উঠে আসে তাঁর কথায়। অথচ সেই কতকাল ধরে রয়েছেন কলকাতায়। দেশভাগের দাঙ্গা দেখেছেন নিজের চোখে। একটি ছেলের প্রাণ গিয়েছে অকালে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন দূর প্রবাসে। স্বামীর সামান্য উপার্জনের ভরসায় কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের দুই-তৃতীয়াংশ। যা পড়ে আছে, সবটাই তছনছ হয়ে যাওয়া এক দীর্ঘ অতীত। তার মধ্যে অপ্রাপ্তিই বেশি। শহরে এসে প্রথমে অনটন, তারপর নিজের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আর শিকড়কে ধীরে ধীরে ভুলতে বসা।
“ও মা, আপনার বিয়ের গল্প বলুন না, কেমন করে গ্রাম পেরিয়ে আরেক গ্রামে এলেন… বাবা বিয়ের আগে দেখতে গিয়েছিলেন আপনাকে?”
কোনও কোনও দুপুর স্মৃতিতে ডুব দিতে চায়। জ্বরের আঁচ হয়ত আদর খোঁজে। ছেলেবেলার খুশি। পুরনোবেলার রঙ। ফেলে আসা বেলার ডাকাডাকি। বিপাশার মুখের দিকে তাকান অনঙ্গ। অবিকল সেই মুখ। কোঁকড়ানো চুলের সীমানা বেড় দিয়ে রেখেছে তার ছোট্ট কপালটিকে। ফর্সা নয়। চাপা রঙ। পোশাকি ভাষায় উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। এককালে এমন গায়ের রঙে মেয়ের বাপ গলায় গামছা রেখে মাথা নিচু করে থাকত। যেন মেয়ের রঙে সাদা পোঁচ কম পড়েছে বলে তার অপরাধ ঢাকতে তাঁকে গুনাগার দিতে হবে।
বিশাখার রঙটিই যা চাপা। হাসির রঙে মুখটি উজ্জ্বল হয়ে থাকে তার। মুখশ্রী কাটা কাটা। ঠাকুমা হলে বলতেন, এরে কয় কাটের মুখ। পাথর কুঁদে কাটা হলেও লাবণ্যে ভরা। অনাবিল প্রশান্তি দুটি বড় বড় ভাসা চোখে। টিকোলো নাক। শ্যামলা মুখে ঠোঁটের ডানদিকে একটি বড় কালো তিল। ওই তিলটি তার মুখের ছাঁদে এক বাড়তি টান।
অনঙ্গবালাকে গল্প পেয়েছে আজ। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। যেন আঁচ নিলেন সেই হারিয়ে আসা সময়টার। ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন…
ঘটকের নৌকো আসত গ্রামে। পাত্রপক্ষ সঙ্গে। পাত্রী দেখবে তারা। জ্যাঠতুতো দিদিকে এসে দেখে গেলেন। আমি তখন কত ছোট। গুছিয়ে শাড়ি পরতে পারি না। মা-ঠাকুমা-জ্যাঠাইমা গাছকোমর করে ঠেসে বেঁধে দেন। তা’ও আমাকেও সাজিয়ে গুজিয়ে বসানো হল দিদির সঙ্গেই। ছোট হলেই বা। দেখিয়ে রাখতে দোষ কি। মুখে মুখে কথা ঘুরবে ফিরবে, ওই গ্রামের ওই বাড়িতে পাত্রী আছে এমন একটি।
পাত্রপক্ষ বসে আছেন। তাদের সঙ্গে ঠাকুর্দার আলাপ-আলোচনা চলছে। আমি উসখুস করছি। আমার আগের দুই দিদি মাথা নিচু। কাঠের পুতুলের মতো চুপ করে বসে আছে তারা। আমি দেখছি বেড়ার ফাঁকে জোড়া জোড়া চোখ। বেশ জানি, বাড়ির ছোট পোলাপানদের ভিড়। একবার দাঁত খিঁচিয়ে ভেংচি কেটেছিলাম। বেশ মনে আছে। চোখ ফিরিয়েই দেখি মেজজ্যাঠামশায়। কী কঠিন দৃষ্টি। দেখেই তো বুকের রক্ত শুকিয়ে গেছে আমার। এরা চলে গেলে কপালে জোর দুঃখ আছে আজ। মেয়েমানুষের গায়ে হাত পড়ে না ঠিকই। কিন্তু মায়ের হাত থেকে ছাড়ান নেই। অভব্যতার অপরাধে তিন-চারদিন কথাই বলবেন না হয়ত।
আরো পড়ুন: কদমতলি (পর্ব-১৬) । শ্যামলী আচার্য
ওই যে একবার দিদিদের সঙ্গে বসেছিলাম, তার পরে আরও একবার পাত্রপক্ষের সামনে গিয়ে সেজেগুজে বসতে হয়েছিল। সেই শেষ। সেখানেই বিয়ে হয় আমার।
সে বিয়ে তো বিয়ে নয়। উৎসব। দিদিদের বিয়েতেও তেমনটিই হত। আমি কিনা নগেন্দ্রবালা আর গণেশচন্দ্রর বড় কন্যা, আর চাটুজ্যেবাড়িতে ছোট মেয়ে, তাই একটু বেশিই আয়োজন ছিল যেন। গ্রামে একটা বিয়ে হলে এমনিই ছোটদের হুল্লোড়, পুরুষের হাঁকডাক চেঁচামেচি চলতেই থাকে। সানাই উলু আর শঙ্খ, সব মিলিয়ে সে এক অন্যরকম আবহাওয়া। ঘরে ঘরে খবর দেওয়া হয়। দুপুরে রান্নাবাড়ার পাট সেরে কোলের সন্তান কাঁখে নিয়ে গ্রামের এয়োরা চলে আসেন বাড়িতে। একধারে একটি আম আর কাঁঠাল গাছ বড় হয়ে উঠেছে জড়াজড়ি করে, অনেকটা জায়গা জুড়ে ঠাণ্ডা ছায়া। তার তলায় পিঁড়ি পাতা। গাছতলায় দু’দলে ভাগাভাগি করে বসেন সকলে। সামনে থাকে পান আর গোটা সুপারি। আর থাকে জাঁতি। বড় রেকাবিতে সরষের তেল। সিঁদুরকৌটো থেকে সিঁদুর নিয়ে কয়েকফোঁটা তেল দিয়ে গোলা হয় একটি বড় সবুজ পাতায়। এয়োরা তেল-সিঁদুর দেন কপালে। শাঁখা-পলায় ছোঁয়ান। জাঁতি দিয়ে সুপুরি কুচিয়ে নেন মিহি করে। তারপর পান দোক্তা মুখে দিয়ে তাদের সমবেত গানের পালা। ওই গানের মধ্যেই থাকবে বিয়ের কত আচার অনুষ্ঠানের ফর্দ। সুপুরি কাটো রে, পান সাজো রে, ক্ষীর-সন্দেশ বানাও রে, পুকুরে জাল ফেলো, টোপর মুকুট বানাতে দাও মালীকে… কাজ কী কম?
বিয়ের আগের দিন অধিবাস। দিদিদের বিয়েতে আমিই দল বেঁধে যেতাম ভোর রাতে। জল ভরতে যাওয়া সকলে। শেষ রাত থেকে সানাই বাজে। সানাইয়ের সুর ডিঙিয়ে যেই ঢাকের বাদ্যি কানে আসে, অমনি ছুট। জলভরার দল রওনা হল বলে। গঙ্গাকে নেমন্তন্ন করতে হয় যে। এখানে তো গ্রামের নদীই গঙ্গা। মা-গঙ্গাকে সব নিয়ম আর বিধি মেনে নিমন্ত্রণ করতে হয়। জলভরার দলে সঙ্গী পুরুষ থাকেন একজন। তিনি নদীর জল কাটেন, আর তাঁর স্ত্রী সেই জল কলসী ভরে আনেন। তার কাঁখে কলসী। স্বামীসোহাগী বউদের সেদিন আলাদাই কদর। তার হাসিমুখে ভরে আনা জল দিয়েই বাসিবিয়ের দিন স্নানের পালা। এয়োস্ত্রীরা এই জল দিয়ে বরকনেকে স্নান করাবেন।
বিয়ের দিনের কথা আর তেমন কিছু মনে নেই। অনেক রাতে ছিল লগ্ন। পিঁড়েতে বসে ঢুলছিলাম। কারা যে পিঁড়িতে তুলে নিয়ে সাত পাক ঘুরিয়ে নিল, কখন হল শুভদৃষ্টি, কার গলায় মালা দিলাম, কিচ্ছু মনে নেই। মনে থাকবে কী করে! ঘুম তখন দু’চোখ জুড়ে। পাড়ার মামী-কাকীরা দুদিক থেকে শক্ত ধরে রেখেছিল শুনেছি। তা’ না হলে ওই যজ্ঞের আগুনেই উলটে পড়তাম হয়ত।
রাঙা চেলি, বুকের কাছে লাল টুকটুকে গাছ-কৌটো, অনেক দূরের পথ পেরিয়ে ডুলি করে গিয়ে পৌঁছলাম শ্বশুরঘরে। চৌধুরীবাড়ি। বনেদি ঘর। বিরাট দালান। অনেক জমি-জায়গা। আত্মীয়স্বজন গমগম করছে। সন্ধে হয়নি তখনও। বিকেল গড়িয়ে গোধূলি। ডুলি থেকে শাশুড়িমা উঠোনে নামিয়েছিলেন কোলপাঁজা করে। নেমে দেখি কমলা রঙা আলো। এমনই গরমের দিন। ভরা জৈষ্ঠ্যেও আগেরদিন তুমুল বৃষ্টি হয়েছিল মনে আছে। বৃষ্টির দাপটে গরমের তেজ কম। জল টেনে নিয়েছে শুকনো মাটি। ঝোপেঝাড়ে অল্পস্বল্প কাদা ছিল ঠিকই। তবু বেশ মনে আছে উঠোন জোড়া আলপনা। খুড়োশাশুড়ি আর পাড়ার আর দুই জন জ্ঞাতি কুটুম। গ্রাম সম্পর্কে খুড়িমা। পিঁড়েতে অপূর্ব আলপনা আঁকতেন। একে একে হ্যাজাকের বাতি জ্বলে উঠল বেশ কয়েকটা। দুধে-আলতায় গোলা বিরাট পাথরটির ওপর দাঁড়িয়েছিলাম কতক্ষণ। তারপর কোথা দিয়ে কে যে কোথায় নিয়ে গেল… শুনেছি ওই পাথরখানায় আমার দিদিশাশুড়ি এসে দাঁড়িয়েছেন, আমার জেঠিশাশুড়ি, শাশুড়ি, আমার বড় জায়েরা।
“পাথরখান… ওই পাথরখান আর ভরতে পারি নাই বউমা। বড় ভারী যে। বালিশের খোলে গয়না, কিছু বাসন আর কয়খান কাপড়চোপড়… যে পাথরে বাড়ির লক্ষ্মী আইস্যা খাড়াইতেন এক লহমার জইন্য, আর সারা পাড়ায় উলুধ্বনি, শাঁখ বাজাইত এয়োরা… দ্যাখ গা আইস্যা, চৌধুরীগো ঘরে নতুন বউ আইল, ধন-সম্পদ এইবার উথলাইয়া পড়বে সংসারে… সেই পাথরখান…
হীরেন খুড়া আগের দিন কইয়া গ্যালেন, ঠিক একবার শাঁখের আওয়াজ শুনলেই বাইরাইয়া পড়বেন। খাড়াইবেন না। সিধা ঘাটের কাসে…
উঠানের পুবধারে গোপালভোগ আমগাছটার তলায় গিয়া খাড়াইলে ঘাট দেখা যায় পষ্ট। শিবু গিয়া আমগাছের তলায় লুকাইয়া খাড়ায়। অর হাতে দুইখান পুঁটলি। ঘর ছাইড়্যা বাইরাইয়া আসি। পাথরখান নিয়া রাখলাম শাশুড়ির ঘরের দুয়ারে। চৌকাঠের সামনে পাইত্যা দিয়া আইলাম তারে। মনে মনে কইসিলাম, যদি তেমন দিন আসে, এই পাথরেই আবার চৌধুরীবাড়ি-র লক্ষ্মী আইস্যা…”
ডুকরে কেঁদে উঠলেন অনঙ্গবালা। চৌধুরীবাড়ি-র বউ বিশাখা জ্বরতপ্ত বাঁ হাতটি বেড় দিয়ে জড়িয়ে ধরে অনঙ্গবালাকে। তারও গরম গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে কয়েক ফোঁটা।

জন্ম ’৭১, কলকাতা
বর্তমানে আজকাল প্রকাশনা বিভাগের অ্যাসিস্ট্যাণ্ট ম্যানেজার পদে কর্মরত।
১৯৯৮ সাল থেকে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের এফ এম রেইনবো (১০৭ মেগাহার্তজ) ও এফ এম গোল্ড প্রচারতরঙ্গে বাংলা অনুষ্ঠান উপস্থাপক।
কলকাতা দূরদর্শন কেন্দ্রের ক্যাজুয়াল ভয়েস ওভার আর্টিস্ট।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে যাদবপুর ইউনিভার্সিটি কমিউনিটি রেডিওতে (JU ৯০.৮ মেগাহার্তজ) ‘এবং রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক সাপ্তাহিক ধারাবাহিক অনুষ্ঠানের নিয়মিত গবেষক ও উপস্থাপক।
২০১৮ সালের জুলাই মাস থেকে ‘সানন্দা’ ও ‘আনন্দলোক’ পত্রিকায় ফ্রিলান্সার অ্যাডভার্টোরিয়াল কনটেন্ট লেখার নিয়মিত দায়িত্ব।
কর্মসূত্রে ‘আজকাল’, ‘আবার যুগান্তর’, ‘খবর ৩৬৫’ ও অন্যান্য বহু পত্র-পত্রিকায় ১৯৯৬ সাল থেকে ফিচার এবং কভারস্টোরি লেখার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা।
‘একদিন’ পত্রিকার বিভাগীয় সম্পাদক হিসেবে ‘নারী-শিশু-বিনোদন-স্বাস্থ্য’ বিভাগে দীর্ঘদিন কাজের সুযোগ।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর এবং ‘ফ্রেশ ওয়াটার ইকোলজি’ বিষয়ে গবেষণা করে পি এইচ ডি ডিগ্রি।
একমাত্র প্যাশন গল্প লেখা।
‘গাংচিল প্রকাশনা’ থেকে প্রথম গল্প সংকলন ‘অসমাপ্ত চিত্রনাট্য’; সংকলনের গল্পগুলি বিভিন্ন সময়ে আনন্দবাজার পত্রিকা, সানন্দা, এই সময়, একদিন, উনিশ-কুড়ি, প্রাত্যহিক খবর, তথ্যকেন্দ্র পত্রিকায় প্রকাশিত।
পরবর্তী গল্পসংকলন
“প্রেমের বারোটা” রা প্রকাশন
“ব্রেক আপ চোদ্দ” রা প্রকাশন
প্রকাশিত উপন্যাস—“জলের দাগ” (রা প্রকাশন), “সুখপাখি”, “এবং ইশতেহার” (সংবিদ পাবলিকেশন)
কিশোর গল্প সংকলন – ‘পড়ার সময় নেই’ (সৃ প্রকাশন)
কিশোর উপন্যাস – ‘বিষচক্র’ (কারুবাসা প্রকাশনী) এবং ‘এক যে ছিল রু’ (কেতাবি প্রকাশন)
এছাড়াও গবেষণাঋদ্ধ বই ‘শান্তিনিকেতন’। প্রকাশক ‘দাঁড়াবার জায়গা’।
আরও একটি ফিচার-সংকলন ‘মলাটে দৈনিক’। প্রকাশক ‘দাঁড়াবার জায়গা’।