| 28 মার্চ 2024
Categories
সাক্ষাৎকার

নিষ্ঠুরতা হচ্ছে কমেডির মূল উপাদান । চার্লি চ্যাপলিন

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

[চার্লি চ্যাপলিনকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নাই। তারপরও ভূমিকায় অতি সংক্ষেপে একটু পরিচিতি দেয়া গেলো। হলিউড সিনেমার প্রথম থেকে মধ্যকালের বিখ্যাততম শিল্পীদের একজন চ্যাপলিন পৃথিবী বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালকও বটে। চ্যাপলিনকে চলচ্চি্ত্রের পর্দায় শ্রেষ্ঠতম মূকাভিনেতা ও কৌতুকাভিনেতাদের একজন বলেও মনে করা হয়। চলচ্চিত্র শিল্প জগতে চ্যাপলিনের প্রভাব অনস্বীকার্য। নির্বাক চলচ্চিত্র যুগের অন্যতম মৌলিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব চ্যাপলিন নিজের ছবিতে নিজেই অভিনয়, সংলাপ রচনা, পরিচালনা, প্রযোজনা এমন কী সঙ্গীত পরিচালনা পর্যন্ত করেছেন। শিশুশিল্পী হিশেবে ইংল্যান্ডের ভিক্টোরিয়ান নাট্যমঞ্চ ও মিউজিক হলে সূচীত চ্যাপলিন-এর ৬৫ বছরের কর্মজীবনের যবনিকাপাত ৮৮ বছর বয়সে তার মৃত্যুতে। চ্যাপলিন অভিনীত মুখ্য চরিত্র তার নিজের সৃষ্ট ভবঘুরে দ্য ট্রাম্প, ১৯১৪ সালে। ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, পর্তুগালে ’শার্লট’ নামে পরিচিত চ্যাপলিনের ট্রাম্প ভবঘুরে হলেও বিট্রিশ ভদ্রজনোচিত আদব-কায়দায় সুসংস্কৃত এবং সম্মানবোধে অটুট। শার্লটের পরনে চাপা কোট, সাইজে বড় প্যান্ট, বড় জুতো, মাথায় বাউলার হ্যাট, হাতে ছড়ি আর একমেবাদ্বিতীয়ম টুথব্রাশ গোঁফ। চ্যাপলিনের বর্ণময় ব্যক্তিজীবন তথা সমাজজীবন খ্যাতি-বিতর্ক দুইয়েরই নিম্ন থেকে শীর্ষবিন্দু ছুঁয়ে গেছে। চ্যাপলিন ১৬ এপ্রিল, ১৮৮৯ সালে ইস্ট স্ট্রিট, ওয়ালওয়ার্থ, লন্ডনে জন্ম গ্রহণ করেন। চ্যাপলিনের কোনো বৈধ জন্ম প্রমানপত্র পাওয়া যায়নি, তাই তার জন্ম নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। সংবাদমাধ্যম নানা সময়ে নানা রকম তথ্য দিয়েছে তার জন্মস্থান সম্পর্কে। এমনকি তার চলচ্চিত্র জীবনের প্রথমদিকে চ্যাপলিন নিজেও একবার বলেছেন যে তিনি ফ্রান্সের ফঁতেউব্ল শহরে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। ১৮৯১ সালের আদমশুমারি থেকে জানা যায় যে চার্লি তার মা হান্নাহ চ্যাপলিন এবং ভাই সিডনির সঙ্গে ওয়ালওয়ার্থ, দক্ষিণ লন্ডনের বার্লো স্ট্রিটে থাকতেন, এটি কেনিংটন জেলার অন্তর্গত। ইতোমধ্যে তার পিতা চার্লস চ্যাপলিন জুনিয়ারের সঙ্গে তার মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে গেছে। চ্যাপলিন এর শৈশব কাটে প্রচণ্ড দারিদ্র্য আর কষ্টের মাঝে আর তাই হয়তো তিনি উপলদ্ধি করতেন দেওয়া ও পাওয়াতে কী আনন্দ। তিনি একটা কথা প্রায়ই বলতেন যে বৃষ্টিতে হাঁটা খুবই ভালো কারণ এই সময় কেউ তোমার চোখের অশ্রু দেখতে পায় না। অত্যধিক দারিদ্রই চ্যাপলিন-কে শিশু বয়সেই অভিনয়ের দিকে ঠেলে দেয়… তার মা-বাবা দুজনেই মঞ্চের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন, তাই এই পেশাতে আসাটাই তাঁর কাছে সহজ ছিল। চ্যাপলিন সেইসময়ের জনপ্রিয় লোকদল ’জ্যাকসন্স এইট ল্যাঙ্কাসায়ার ল্যাডস’ এর সদস্য হিসাবে নানা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। এরপর ১৪ বছর বয়সে তিনি উইলিয়াম জিলেট অভিনিত শার্লক হোমস নাটকে কাগজওয়ালা বিলির চরিত্রে অভিনয় করেন। এই সুবাদে তিনি ব্রিটেনের নানা প্রদেশে ভ্রমণ করেন ও অভিনেতা হিশেবে তিনি যে খুবই সম্ভাবনাময় তা সবাইকে জানিয়ে দেন।

১৯৬৬ সালে ‘লাইফ’ ম্যাগাজিনের সম্পাদক, লেখক, সাংবাদিক রিচার্ড মেরিম্যান চার্লি চ্যাপলিন এর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। এবং এটি হারিয়েও গিয়েছিলো বা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। তার কিছু অংশ উদ্ধারের পর দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা প্রকাশ করে। আর তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে ১ নভেম্বর ২০০৩ সালে। আর সেই অসম্পূর্ণ সাক্ষাৎকারটিতেও উঠে আসে চ্যাপলিন এর হয়ে উঠার অনেক অজানা কথা। কথাবলিতে ২০১৬ তে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটি ভাষান্তর করেন হাসনাত শোয়েবইরাবতীর পাঠকদের জন্য তা পুনঃপ্রকাশ করা হল।]


এই সাক্ষাৎকারটি পুরোপুরি আপনার কাজ এবং শিল্পসম্পর্কিত আর কিছুই না। আমি আদতে কিছু ইঙ্গিত দিতে চাই আপনি কীভাবে কাজ করেন তা নিয়ে।

আমার চরিত্রের সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা হচ্ছে আমি আমার কাজ সম্পর্কে সচেতন। আমি যা করি সবকিছু নিয়েই সচেতন। যদি আমি অন্যকিছু এরচেয়ে ভালো করতে পারতাম, আমি সেটাই করতাম। কিন্তু আমি অন্যকিছু পারি না।

আপনি কি আপনার এইসব ভবঘুরে সাজ ধারণের মুহূর্ত সম্পর্কে বলবেন?

প্রয়োজনের তাগিদেই এই সাজ ধরেছিলাম আমি। ক্যামেরাম্যান আমাকে বলল কিছু মজার মেকআপ করতে এবং বিন্দুমাত্র ধারণা ছিলো না কী করতে হবে। আমি পোশাকবিভাগে যাই এবং যেতে যেতে চিন্তা করি আমি সবকিছুকে স্ববিরোধী আকারে দাঁড় করাব। ঢোলা প্যান্ট, টাইট কোট, বিশাল মাথা, ছোট টুপি। দুঃস্থ আবার একইসময়ে ভদ্দরলোকও দেখাবে এমন। আমি জানতাম না চেহারা নিয়ে কীভাবে কী করব। কিন্তু এটাকে বিষন্ন এবং গম্ভীর দেখাতে হবে এটুকু জানা ছিলো। চেহারার কৌতুকময়তাটা আমি আড়াল করতে চাচ্ছিলাম। তো আমি গোঁফটা বসাই এবং এই গোঁফের ধারণা কিন্তু চরিত্রাঙ্কনের সময় ছিলো না। কেবল বলা হয়েছিলো এটা কেবল বোকা বোকা দেখাতে হবে। যা আমার অভিব্যক্তি লুকাতে পারবে না।

এরপর নিজের দিকে তাকিয়ে আপনার কী মনে হয়েছিলো?

আমি করব। এটা কোনো কিছুকে প্রজ্জ্বলিত করতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে আমি অভিনয় করতে যাচ্ছি। প্রবেশের পর মনে হলো আমি কিছু একটা পরেছি, সেই সঙ্গে আমার একটা নিজস্ব ভঙ্গি আছে। আমার ভালো লাগলো এবং চরিত্রটা আমার কাছে ধরা দিলো। দৃশ্যটা ( মার্বেল স্ট্র্যাঞ্জ প্রেডিকম্যান্ট থেকে) ছিলো হোটেল লবিতে এবং ভবঘুরে লোকটি ভাব ধরার চেষ্টা করলো যেনো সে অতিথিদের একজন, কেবল মাত্র নরম চেয়ারে বসে সে কিছুক্ষণ আরাম করতে পারে। সবাই তার দিকে খানিকটা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে, এবং আমি সবকিছুই করেছি যা হোটেলে একজন অতিথি করে। রেজিস্টারের দিকে তাকানো, সিগারেট বের করা, এটা জ্বালানো, পাশ দিয়ে চলে যাওয়া প্যারেডের দিকে তাকানো। এবং এরপর আমি কাস্পিডারের ওপর পা ফসকে পড়ে গেলাম। এটা ছিলো আমার করা প্রথম তামাশার দৃশ্য। এবং চরিত্রটি জন্ম নিলো। আমি ভাবলাম, এটা খুবই ভালো চরিত্র। এরপর আমি যতগুলি চরিত্রে অভিনয় করেছি, কমেডি চরিত্রগুলির ক্ষেত্রে একই পদ্ধতি অনুসরণ করিনি। আমি ঐ ভবঘুরের কাপড়ের দিকে যতটা না লক্ষ্য রেখেছি তারচেয়ে বেশি রেখেছি ওই কালশিটে জুতোর প্রতি। সে কতটা উচ্ছ্বসিত বা উৎফুল্ল সেটা ব্যাপার না, তার সবসময় ছিলো ক্লান্ত এবং বড় চরণযুগল। আমি ওয়ারড্রব থেকে খুঁজে বড় বড় পুরোনো জুতা দুখানা বের করে আনি কারণ আমার পা ছিলো অদ্ভুতভাবে ছোট। তাই আমি বড় জুতাগুলি চাচ্ছিলাম এবং আমি জানতাম এগুলি আমাকে হাঁটার ভঙ্গিকে কৌতুকময় করে তুলবে। আমি স্বাভাবিকভাবে বেশ সাবলীল ছিলাম কিন্তু বড় পা নিয়েই সাবলীল হতে চাচ্ছিলাম, যেটা বেশ মজার ছিলো।

ভবঘুরের এই ধারণা বর্তমান সময়ে কাজ করবে বলে মনে করেন?

আমি মনে করি না, বর্তমানে এই ধরনের মানুষের জন্য কোন স্থান আছে। পৃথিবী এখন কিছুটা বেশিই শৃঙ্খলিত। আমার মনে হয় না কোনো অর্থেই এটি এখন আর সুখী। আমি লক্ষ্য করেছি, বাচ্চারা ছোট জামা পরছে এবং বড় চুল রাখছে এবং মনে হয় তাদের কেউ কেউ ভবঘুরে হতে চায়। কিন্তু পরিস্থিতি এখন আগের মতো শান্ত নাই। তারা জানেনা শান্তি কী। তাই এটা এখন প্রাচীন কিছু একটাতে পরিণত হয়েছে। এটা অন্য কোন জগতের। তাই এরকম কিছু এখন আর করিনা। এবং অবশ্যই ‘শব্দ’ আরেকটা কারণ। যখন কথা বলার বিষয়টা আসল আমার চরিত্রে কিন্তু তা ছিলো না। আমি জানতামও না তার কণ্ঠস্বর কেমন হবে? তাই তাকে বিদায় নিতে হলো।

ভবঘুরের কোন দিকটা আবেদনময়ী বলে মনে করেন?

এখানে কিঞ্চিৎ ভদ্রোচিত দারিদ্রতা থাকে। প্রত্যেক পরিবেশনকারী নিজেকে অলংকৃত করে এবং ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে উপস্থাপন করতে চায়। চরিত্রের এই দিকটা আমি খুব উপভোগ করি; সবকিছুর ব্যাপারে বেশ খুঁতখুঁতে এবং বেশ ফিটফাট। কিন্তু কখনোই আমি আবদনের প্রেক্ষিতে ভবঘুরে নিয়ে ভাবি নাই। ভবঘুরে হচ্ছে এমন কিছু যা আমার ভিতরে আছে, আমি প্রকাশ করতে চাই। আমি দর্শকের প্রতিক্রিয়া দ্বারা প্রভাবিত হয় কিন্তু আমি দর্শকদের সঙ্গে নিজেকে কখনো যুক্ত হতে দেই না। দর্শক আসে বানানোর পর, বানানোর সময় তার কোন কাজ নেই। আমি সবসময় আমার ভিতরে থাকা একধরণের কমিক স্পিরিটের সঙ্গে যুক্ত থাকি, যা আমাকে সেটা প্রকাশ করতে বলে। এটা বেশ মজার।

কীভাবে একটা কৌতুক দৃশ্য আপনার কাছে আসে? এমনি এমনি আসে বা কোন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে?

নাহ, এখানে প্রক্রিয়া নাই। পরিস্থিতিই সেরা চিন্তাটা বের করে আনে। যদি তুমি একটা ভালো কৌতুকপূর্ণ পরিস্থিতি পাও এটা চলতেই থাকে এবং এর অনেক ব্যাপ্তি থাকে। ‘স্কেটিং রিং'(দ্য রিং) দৃশ্যায়নের মতো। আমি একজোড়া স্কেটস দেখতে পাই এবং লাফিয়ে উঠে যাই, দর্শকসহ সবাই নিশ্চিত ছিলো আমি পড়ে যাব। কিন্তু এর পরিবর্তে আমি দর্শনীয়ভাবে এক পা দিয়ে চারপাশে স্কেট করি। দর্শক একজন ভবঘুরের কাছ থেকে এরকম আশা করে না। অথবা ল্যাম্পপোস্ট কৌতুকের (ইন ইজি স্ট্রিটে) কথাও বলা যায়। যেখানে আমার চরিত্র ছিলো পুলিশের এবং একজন গুন্ডাকে দমন করার চেষ্টা করছি। আমি একটা লাঠি দিয়ে তার মাথায় বারবার আঘাত করতে থাকি। এটা একটা দুঃস্বপ্নের মতো ব্যাপার ছিলো। আমার আঘাতে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়েই সে ধীরে ধীরে শার্টের আস্তিন গোটাতে থাকে। এরপর সে আমাকে উপরে তুলে আবার নিচে নামিয়ে দেয়। এরপর আমি বুঝতে পারি তার প্রচুর শক্তি, ফলে সে ল্যাম্পপোস্টটাকেও টেনে নিচে নামাতে পারবে এবং যখন সে এটা করতে শুরু করে, আমি লাফিয়ে তার পেছনে উঠে যায়। তার মাথাটকে ধাক্কা দিয়ে বাতির ভিতর ঢুকিয়ে গ্যাস ছেড়ে দেই। আমি এমন কিছু মজার জিনিশ করি যা সবাইকে দারুণভাবে হাসতে বাধ্য করে।

কিন্তু এখানে নিদারুণ যন্ত্রণাও আছে। কোনো কিছু না করতে পারার যন্ত্রণা এবং আরো বেশি হতাশ হয়ে পড়া। এটা আমার ওপর ছিলো তাদেরকে হাসানোর জন্য কিছু একটা করা। এবং হাসার পরিস্থিতি ছাড়া তুমি কখনো হাসাতে পারবে না। সম্ভবত তুমি ভুল করে কৌতুকময় কিছু করতেও পারো কিন্তু সে জন্য তোমার অবশ্যই একটা মজার পরিস্থিতি থাকতে হবে।

আপনি কী লোকজনকে এসব করতে দেখেন নাকি যা আপনার মনে আসে তাই করেন?

নাহ। আমরা নিজেদের একটা পৃথিবী তৈরি করি। আমারটা হচ্ছে ক্যালিফোর্নিয়ার স্টুডিওতে। আমি যখন সেটে থাকি সেটাই সবচে’ আনন্দের মুহূর্ত। আমার কাছে গল্প নিয়ে একটা চিন্তা অথবা পরামর্শ থাকে এবং সেটা আমার ভালো লাগে। এরপর বাকিসব একে একে ঘটতে থাকে। এটাই একমাত্র উৎস যা আমার থাকে। তুমি ত জানোই, ক্যালিফোর্নিয়ার সন্ধ্যাটা বরং অনেক বেশি নির্জন। বিশেষ করে হলিউডে। একটা কৌতুকময় পৃথিবী তৈরির জন্য এটা একটা অসাধারণ জায়গা। গতানুগতিক দিন থেকে আলাদা একটা দুনিয়া এবং এটা আনন্দময়। তুমি এখানে বসে অর্ধেক দিন অনুশীলন করতে পারো, শুট করতে পারো এবং এটুকুই।

বাস্তববাদ কি কমেডির অভিচ্ছেদ্য অংশ?

হ্যাঁ, অবশ্যই। আমি বিশ্বাস করাতে চাই, যেকোন বিদঘুটে পরিস্থিতিকে তোমার পুরোপুরি বাস্তবতা দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে। এবং দর্শকরা তার সঙ্গে পরিচিত বলেই এর ভাবের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখে। এটা তাদের কাছে খুব বাস্তব এবং বিদঘুটেও। এটা তাদেরতে উল্লসিত করে তোলে।

এটার অংশ হিশেবে তো এইখানে তো ব্যাপক নিষ্ঠুরতা আছে।

নিষ্ঠুরতা হচ্ছে কমেডির মূল উপাদান, যা সাধারণত স্বাভাবিক বলে দৃশ্যমান হয় তা আসলে অস্বাভাবিক এবং তুমি যদি এটা নিয়ে যথেষ্ট বিদ্রূপ করতে পারো, তারা এটা পছন্দ করে। দর্শকরা এটাকে জীবনের ওপর প্রহসন বলে চিহ্নিত করে এবং তারা মরে না গিয়ে বা কান্না না করে এটা নিয়েন হাসাহাসি করে। এটা একটা প্রশ্ন যে রহস্যময় জিনিশ সরলতাকে ডেকে আনে। একজন বৃদ্ধ ভুল করে কলার খোসায় পা ফসকে ধীরে ধীরে পড়ে যাচ্ছে । এই দৃশ্যে আমরা হাসিনা। কিন্তু একই ঘটনাটা যদি একজন কেতাদুরস্ত ভদ্রলোকের সঙ্গে ঘটে যার ব্যাপক অহংকার রয়েছে তখন আমরা হাসব। সকল বিব্রতকর পরিস্থিতি আসলে মজার। বিশেষ করে যদি সেটাকে রসবোধ দ্বারা ব্যবহার করা যায়। একজন সঙয়ের সঙ্গে সাংঘাতিক কোন কিছু ঘটাটা তোমাকে অবাক করবে না।কিন্তু যদি একজন লোক রেস্টুরেন্টে গিয়েছে যে নিজেকে অনেক ভদ্র মনে করে অথচ দেখা গেলো তার প্যান্টে বিশাল জায়গা জুড়ে ছেঁড়া। যদি এই বিষয়কে রসবোধযুক্ত করে ব্যবহার করা যায় এটি মজার হতে বাধ্য। বিশেষত মর্যাদা এবং গর্বের সঙ্গে যদি এটি করা হয়।

আপনার কমেডি অংশত ঘটনার কমেডিও বটে। এটা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে বানানো কিছু না। এটা যা ঘটে চলেছে সেটাই। যেটা বেশ মজার।

আমি সবসময় ভাবি, এই বিভিন্ন ঘটনা জোড়া লাগিয়ে একটা গল্প তৈরির কথা। অনেকটা বিলিয়ার্ড টেবিলে পুল গেমসের যে সেটিং থাকে তার মতো। প্রত্যেক বলই আলাদা আলাদা ঘটনা। তুমি দেখবে, একটা আরেকটাকে স্পর্শ করে একটা পূর্নাঙ্গ ট্রায়াঙ্গল তৈরি করে। এই ইমেজটি আমি আমার কাজের সময় ব্যাপকভাবে ধারণ করি।

আপনি সবসময় দুর্দান্তভাবে গতি ধরে রাখতে পছন্দ করেন এবং একটার পর একটা ঘটনাকে সারিবদ্ধভাবে সাজান। আপনি কি মনে করেন এটা আপনার স্বভাবগত বিষয়?

বেশ। আমি জানি না এটা আমার স্বভাবগত বিষয় কি না? আমি অন্য কমেডিয়ায়ানদের দেখি যারা তাদের গতি শিথিল করে রাখেন। আমার গতি কমিয়ে দেয়ার চেয়ে, গতি বাড়িয়ে রাখতে বেশি ভালো লাগে। গতি কমিয়ে দেয়ার ব্যাপারে আমি মোটেই আত্মবিশ্বাসী নয় এবং আমি যা করছি তা নিয়েও।

কিন্তু সবসময় গতিই কেবল বিষয় নয়। সবকিছুর একটা বিকাশ থাকতে হবে। অন্যথায় ঘটনাটা তার বাস্তবতা হারাবে। তোমার কোন সমস্যা থাকলে তুমি থাকে তীব্র করে তুলতে পারবে। কিন্তু তুমি ইচ্ছাকৃতভাবে এটাকে তীব্রতর করার মধ্য দিয়ে শুরু করতে পারবানা। তুমি বলো, এরপর তুমি কোথায় যাবে? তুমি বলো এটার প্রকৃত ফলাফল কী? বাস্তবিক এবং নিশ্চিতভাবে সমস্যা আরও জটিল থেকে জটিল হয়ে পড়বে। এবং তোমাকে অবশ্যই যৌক্তিক হতে হবে অন্যথায় তোমার কাছে একধরনের কমেডি ত থাকবে, কিন্তু তা রোমাঞ্চকর কিছু হবে না।

আপনি কি ভাবালুতা কিংবা গতানুগতিকতা নিয়ে চিন্তিত থাকেন?

নাহ, মুখাভিনয়ের ক্ষেত্রে না। তুমি এটা নিয়ে চিন্তিত হতে পারোনা, তুমি স্রেফ এটা এড়াই যেতে পারো। এবং আমি গতানুগতিকতা নিয়ে অতো ভাবি না। আমরা কখনো মৌলিকতা নিয়ে পড়ে থাকি না। তিনবেলা খাওয়া-পরার মধ্যেই আমরা আমরা বাঁচি এবং মরি, প্রেমে পড়ি আবার ভেঙেও দেই। প্রেমকাহিনীর চেয়ে ক্লিশে আর কিছুই হয়না এবং এটা ততক্ষণ পর্যন্ত চালিয়ে নিতে হয় যতক্ষণ পর্যন্ত এর মজা থাকে।

আপনি কি জুতা খাওয়ার অংশটা (গোল্ডরাশ-এ) অনেকবার করেছিলেন?

এই দৃশ্য রি-টেক করার জন্য আমাদের হাতে দুইদিন সময় ছিলো এবং বেচারা বৃদ্ধ অভিনেতা (ম্যাক সোয়াইন) দুই দিন ধরে অসুস্থ ছিলো। জুতাগুলি তৈরি করা হয়েছিলো যষ্টিমধু দিয়ে এবং সে এটা অনেকটুকুই খেয়ে ফেলেছিলো। এরপর সে বলল, ‘আমি এই জঘন্য জুতাগুলি আমি আর খেতে পারবোনা। ‘আমি এই কৌতুকের আইডিয়াটা পেয়েছিলাম ডোনার পার্টি থেকে (যেখানে একটি ওয়াগন ট্রেন ১৮৪৬ সালে ৮১ জন মাটিকাটা শ্রমিক নিয়ে ক্যালোফোর্নিয়া যাওয়ার পথে সিয়েরা নেভাদার কাছে তুষারে আটকা পড়েছিলো) তারা নরমাংস এবং হরিণের চামড়া খেয়ে বেঁচেছিল। এবং আমি ভেবেছিলাম ‘স্ট্যুয়েড বুটে’র কথা। সেখানটাই কিছু মজা ছিলো। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা ‘ক্ষুধা’র মতো একটা সহজ বিষয় পাচ্ছিলাম গল্পটাকে দ্যোতনা দেয়ার জন্য, সময়টা বেশ যন্ত্রণাদায়ক ছিলো। তোমার কাছে আইডিয়া ধরা দিবে যখন তুমি ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করতে পারবা এবং ঘটনা ঘটার সাধ্যতা, বাস্তবতা এবং সম্ভাব্যতা যাচাই করতে পারবা। এইটা এই ছবির একটা সেরা দিক।

আপনার কি শব্দের ব্যাবহারে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোন উদ্বেগ বা সন্দেহ কাজ করেছে?

হ্যাঁ, স্বাভাবিকভাবেই। প্রথম অবস্থায় আমার অভিজ্ঞতা ছিলো, কিন্তু কোনো একাডেমিক ট্রেনিং ছিলোনা এবং বেশ ভালোই পার্থক্য ছিলো। কিন্তু আমি জানতাম আমি মেধাবী এবং সহজাত অভিনেতা। আমি জানতাম কথা বলার চেয়ে মুখাভিনয় আমার জন্য অনেক সহজ। আমি একজন শিল্পী এবং আমি এও জানতাম ‘কথা’র অনেকটাই হারিয়ে যাবে। ভালো বাচনভঙ্গি এবং কণ্ঠস্বর না থাকলে আমি অন্যদের তুলনায় ভালো করতে পারবো না। যেটা কাজটাকে অনেক কঠিন করে দেয়।

এটা কী প্রশ্ন হতে পারে যে বাস্তবতার বিভিন্ন ধরনের মাত্রা নির্বাক চলচ্চিত্রের ফ্যান্টাসিকে নষ্ট করেছে?

হ্যাঁ অবশ্যই। আমি সবসময় বলে এসেছি মুখাভিনয় অনেক বেশি কাব্যিক এবং এটার একটা সার্বজনীন আবেদন আছে যা ভালোভাবে করতে পারলে সবাই বুঝতে পারে। উচ্চারিত শব্দ সবাইকে একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় কর্কশ করে দেয়। কণ্ঠস্বর একটা সুন্দর জিনিশ, সবচেয়ে বেশি প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু আমি আমার আর্টকে অনেক বেশি প্রকাশ করতে চাই না কারণ এটা সীমাবদ্ধতা দেখাতে পারে। অনেক কম কণ্ঠস্বর আছে যা বিভ্রমের গভীরতাকে ধরতে পারে বা যেহেতু গতিবিধি হচ্ছে অনেকবেশি প্রকৃতির কাছাকাছি যেভাবে একটি পাখি আকাশে উড়ে। চোখের অভিব্যক্তির কোন শব্দ হয়না। মুখের প্রকৃত অভিব্যক্তি হলো সেটা যা কখনো আড়াল করা যায়না। যদি এটা একটা হতাশা হয় এটা সবসময় সুক্ষ্ম হতে পারে। আমি যখন কথা বলতে শুরু করেছি আমাকে এসব মনে রাখতে হয়েছে। আমি ভালো করেই জানতাম আমি অনেক বাগ্মিতা হারিয়েছি। এটা কখন ভালো হতে পারেনা।

আপনার কোনো প্রিয় ছবি আছে?

হ্যাঁ। আমার মনে হয় আমি ‘সিটি লাইট’ পছন্দ করি। আমার ধারণা এটা ভালোভাবে নির্মিত। ‘সিটি লাইট’ প্রকৃত অর্থেই বিনোদন।

এটা একটা শক্তিশালী সিনেমা । যা আমাকে মুগ্ধ করেছে তা হলো এখানে ট্রেজেডি এবং কমেডি অনেক কাছাকাছি অবস্থান করছে।

এটা আমাকে কখনো টানেনি। আমার ধারণা মতে যেটা অনুভূত হয়েছে তা হলো আত্মনিষ্ঠা। আমি সবসময় অনুভব করেছি কমবেশি এটা আমার দ্বিতীয় সত্তা। এটা পরিবেশের কারণেও হতে পারে এবং আমি মনে করি অন্য এক মানুষের প্রতি সমবেদনা এবং সহমর্মিতা ছাড়া কেউ কখনো কৌতুক করতে পারে।

আমরা কি ট্র্যাজেডি থেকে মুক্তি চাই?

নাহ। আমি মনে করি জীবন এরচেয়ে অনেক বেশি কিছু। যদি সেটাই কারণ হয় তবে আমার মনে হয় সেখানে আরো অনেক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটবে। মানুষ জীবন থেকে মুক্তি চায়। আমি মনে করি জীবন একটা দারুণ ব্যাপার এবং অবশ্যই সমস্যার মধ্যেই মানুষকে বাঁচতে হবে। অনেক দুঃখের মধ্যেও। আমি জীবনের পক্ষে। অভিজ্ঞতার পক্ষে। আর কিছু না কেবল অভিজ্ঞতার জন্য। আমি মন করি হাস্যরস একজন মানুষের মানসিক সুস্থতাকে রক্ষা করতে পারে। অতিরিক্ত ট্র্যাজেডির ফলে আমরা অনেক বেশি অসংযত হয়ে যেতে পারি। ট্র্যাজেডি অবশ্যই জীবনের অংশ। কিন্তু আমাদের ভারসাম্য রক্ষা এবং প্রতিরোধ করার জন্য হাতিয়াড় দেওয়া হয়েছে। আমি মনে করি ট্রেজেডি জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণে এবং একে প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের হাতে আছে রসবোধ । রসাবোধ হচ্ছে সার্বজনীন, যা আমি মনে করি কমবেশি দুঃখবোধ থেকে উদ্ভূত।

প্রতিভার মতো আর কিছু আছে বলে আপনি মনে করেন?

আমি আসলে ভালো করে জানি না প্রতিভা কী জিনিশ? আমি মনে করি কেউ একজন খুবই মেধাবী, যে তার কাজের প্রতি খুবই আবেগপ্রবণ। সকলেই কোন না কোনোভাবে সহজাত গুণ সম্পন্ন। একজন গড়পরতা মানুষ গতানুগতিক অ-কল্পনাপ্রবণ চাকরি জীবন কাটিয়ে দেয় কিন্তু একজন জিনিয়াস সেটা করে না। সে ভিন্ন কিছু করে, কিন্তু সেটা সে বেশ ভালোভাবেই করে। সব কাজের কাজি হতে যাওয়া একজন প্রতিভাবান লোকের জন্য ভুল।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত