Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,ছানা

ছানা: ঐতিহ্যের সঙ্গে মেখে থাকা কিছু ‘মিষ্টি’কথা । হৈমন্তী ভট্টাচার্য

Reading Time: 4 minutes
 
 
 
 
ছানা, তুমি কার? কোথায় তোমার আদি বাস?
 
ছানা তার তুলতুলে মুখটা তুলে এদিক ওদিক চাইল। ধপধপে চাঁদপানা নরম মুখখানা দেখেই আপনিও গলে গেলেন। যাবারই কথা। তার মুখে একটু মোটাদানার চিনি দিলেন। ছানা আহ্লাদে আটখানা। আপনিও।
 
তারপর?
 
আপনি আর না পেরে টপ করে মুখে চালান করে দিলেন ছানাকে।
 
…এই না না চমকাবেন না। এ ছানা সে ছানা নয়। দুধেরই ছানা, তবে দুধ খায় না, দুধ থেকে জন্মায়। শরৎ আকাশের পেঁজা-তুলো মেঘের মত সবজেটে জলে ভাসা লেবু দিয়ে দুধ কাটানো ছানা।
 
কোথায় তার আদি নিবাস?
 
ছানার আবির্ভাব নাকি পর্তুগিজদের হাত ধরে। ষোড়শ শতকে তারা ভারতে আসে ছানাপোনা নিয়ে। বাংলার ব্যান্ডেল অঞ্চলে ঘাঁটি গাড়ে। তখনই নাকি এদেশের লোকের তাদের থেকে ছানার ব্যবহার শেখা। তারা ছানা দিয়ে পনির কটেজ চিজ এসব বানিয়ে খেত।
 
তবে কি ছানা সত্যিই বিদেশ থেকে আগত আগন্তুক? ধবধবে সাহেব মেমেদের মত ফর্সা হতেই পারে, তা বলে তার উৎসও কি ভারতে নয়?
 
ছানা পর্তুগিজরা শিখিয়েছে বললেই হবে! অমনি আমরা সরল নাজুক ছানাকে তাদের সম্পত্তি বলে মেনে নেব!
না, একেবারেই না!
মহারাজা বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার এক রত্ন অমরসিংহের লেখা অমরকোষে (ব্রহ্মবর্গ: ২/৫৬) বলা আছে, উষ্ণ দুধে দধি যোগ করলে তাকে ‘আমীক্ষা’ বলে। দুধকে বিকৃত করার একটা উপায় এটা। খুবই খটমট নাম। এর পরে ছানা হয়ে যে সাদা টুকরোগুলো তৈরি হয় সেগুলোর নাম ‘দধিচূর্ণিকা’। অতএব এতেই দিব্যি প্রমাণ হয় ছানা ভারতীয়।
 
‘মোরেন্তক!’ খটমট লাগছে নামটা? দাঁত ভেঙে যাবার মত? না না, ভাঙবে না, বিশ্বাস করুন। বরং দাঁত আর জিভ সোহাগে আহ্লাদে আটখানা হয়ে যাবে। দ্বাদশ শতাব্দীতে কল্যাণের রাজা সোমেশ্বর খেতেন মোরেন্তক। তার রেসিপিবুক ‘মানসোল্লাসে’ যেসব খাবারের বর্ণনা আছে, তার মধ্যে এটা অন্যতম। কী জিনিস জানেন? ময়দার সঙ্গে ছানা মেখে তৈরি ময়ূরের ডিমের মত মিষ্টি। এই টাইপের মিষ্টি কিন্তু আপনি আমিও খাই, রাজা-গজা না হয়েও। অতএব ছানা দিয়ে তৈরি খাবারের চল অনেক আগে থেকেই ছিল।
 
দুধ ননী মাখনের সাথে যার নাম সব্বার আগে আসে তিনি কি ছানা খেতেন? ননীচোরা গোপাল? মা যশোদা সকালবেলা দাওয়ায় হামাগুড়ি দেওয়া গোপালকে ঝিনুকের চামচ দিয়ে ছানা খাওয়াচ্ছেন। গোপালের কচি মুখের চারপাশে ছানা লেগে থাকছে।…. এমন কল্পনা আমরা করতেই পারি মনে মনে, কিন্তু আসল কথা হল দেবদেবীর ভোগে ছানা কিন্তু চলবে না।
কেন?
মনুর বিধান। মনু, হ্যাঁ, গুচ্ছের নিয়মে ঠাসা মনুসংহিতার প্রণেতা। তাঁর মতে ছানা তৈরি হয় দুধ কাটিয়ে , এতে ‘ছিন্ন’ করতে হয়, দুধের ‘বিকৃতি’ হয়। ঘি মাখন ক্ষীর ইত্যাদি দুধের স্বাভাবিক পরিণতি। অতএব সেগুলো চলবে দেবভোগে। ছানা বেচারা ব্রাত্য। এমনকি ছানার তৈরি মিষ্টিও। ক্ষীরের পেঁড়া চলবে, কিন্তু ছানা দিয়ে বানানোর কাঁচাগোল্লা, আমসন্দেশ নয়। বুঝুন ঠ্যালা!
 
‘ছানা’ নাম হল কেন? গবেষক সুকুমার সেন ‘কলিকাতার কাহিনী’তে লিখেছেন দুধ ‘ছিন্ন’ করে ছানা হয় বলেই এর নাম ‘ছানা’। আবার এই মতটিও প্ৰচলিত যে কাপড় দিয়ে ছেনে জল ঝরিয়ে ছানার মণ্ড তৈরি হয় বলে এর নাম ছেনা বা ছানা, সেকালের উত্তর কলকেতার ভাষায় ‘ছ্যানা’।
 
ছানা খুবই পুষ্টিকর ও সুস্বাদু খাবার। শুধু চিনি দিয়েই খেয়ে ফেলা যায়। হালকা লেবুর গন্ধ, যদি লেবু দিয়ে কাটানো ছানা হয়। লেবু ছাড়াও ছানা কাটানোর পাউডার, দই, ছানার জল সহ নানা কিছুর প্রয়োগ হয়। তবু লেবুগন্ধী ছানা আর অল্প চিনি প্রাতরাশে মন ভালো করে দেবেই।
 
ছানা ‘এমনি এমনি খাওয়া’ গেলেও ছানা দিয়ে তৈরি খাবার দাবারের লিস্টি বলে শেষ করার নয়। নোনতা খাবারের মধ্যে আছে পনির চিজ ইত্যাদি। তা ছাড়াও ছানার বড়া করে তরকারি , পেঁয়াজ রসুন এমনকি চিকেন/মাটন কিমা দিয়েও এর সাত্বিকভাব ঘুচিয়ে রেঁধে ফেলা যায় হরেক পদ। ছানার কোপ্তা খুব সুস্বাদু একটি প্ৰচলিত রান্না।
 
ছানার সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ মিষ্টি তৈরিতে। ছানার অজস্র মিষ্টি ছানাপোনাদের মধ্যে সবচেয়ে কদর নিঃসন্দেহে রসগোল্লার। রসগোল্লা কার? উড়িষ্যা না বাংলা? হাইকোর্টে হাতাহাতির পর বাংলার জয় হয়েছে। রসগোল্লার আদি উৎস সম্পর্কে মতভেদ আছে। কেউ বলেন নদিয়া জেলার ফুলিয়ার হারাধন ময়রা নাকি রসগোল্লার স্রষ্টা। কারোর মতে বরিশাল অঞ্চলে এর জন্ম। তবে স্পঞ্জ রসগোল্লার কলম্বাস হলেন কলকাতার বাগবাজারের নবীন ময়রা। নবীন ময়রার স্পঞ্জ রসগোল্লার সৃজন নিয়ে ‘রসগোল্লা’র মত মিষ্টি চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। সৈয়দ মুজতবা আলী ‘রসগোল্লা’ গল্পে শুনিয়েছেন ইতালিতে রসগোল্লা নিয়ে কীরকম কাড়াকাড়ি পড়ে গিয়েছিল,
 
“রসের গোলক, এত রস কেন তুমি ধরেছিলে হায়।
ইতালির দেশ ধর্ম ভুলিয়া লুটাইল তব পায়। “(রসগোল্লা, সৈয়দ মুজতবা আলী)
 
লেডিকেনি‘, ছানা পরিবারের আরেক গুরুত্বপূর্ণ মেম্বার। বাংলার প্রথম গভর্নর ক্যানিংএর স্ত্রীর সম্মানে তৈরি ভাজা মিষ্টি। ‘ল্যাংচা’ই বা কেন পিছিয়ে থাকবে? কথিত আছে কৃষ্ণনগরে এই মিষ্টি রাজবাড়ির কোনো সদস্য খেতেন। যিনি বানাতেন, তিনি খঞ্জ ছিলেন। সেই অনুসারে মিষ্টির নাম হয় ল্যাংচা। বর্তমানে শক্তিগড়ের ল্যাংচা খুবই বিখ্যাত।
 
আরেকটি ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি হল, বহরমপুরের ছানাপোড়া। ঘন রসে চোবানো কড়া করে ভাজা ছানার কালচে মিষ্টি। একবার খেলে ভোলার নয়।
 
রসে ফেলা ছানার মিষ্টির বংশে আরও আছে আছে কমলাভোগ, রাজভোগ, চমচম , রসমালাই।
 
তৈরি হয় ‘ছানার পায়েস’। বাংলার আরেকটি ঐতিহ্যবাহী ছানার মিষ্টি। সাধারণত ছানার সংস্পর্শে এলে স্বাভাবিকভাবেই দুধ ফেটে যায়। কিন্তু ছানার পায়েসে এমনটা হয়না। দুধের সরোবরে ছানার মণ্ড সাদা হাঁসের মত ভেসে বেড়ালেও দুধ থাকে পরিবর্তনহীন। যত দুধ ঘন হবে ততই বাড়বে স্বাদ। কতটা সময় ধরে দুধ ফোটানো প্রয়োজন, কেমন করে মাখতে হবে সেই ছানার মন্ড সবই প্রস্তুতকারকের হাতের খেল। ছানার পায়েসকে আরো সুস্বাদু বানাতে দেওয়া হয় পেস্তা, কাঠবাদাম, জাফরানের স্পর্শ।
 
ছানা-র সন্দেশ। শুকনো সন্দেশে নকুড় ভীম নাগ সূর্য মোদকের একের পর এক পরীক্ষা নিরীক্ষা জন্ম দিয়েছে কাঁচাগোল্লা, জলভরা, বাবুসন্দেশ, কালাকাঁদ এরকম হরেক কিসিমের মিষ্টির। চন্দননগরের সূর্য মোদকের মনকাড়া জলভরা তালশাঁস ছানারই সন্দেশ। তাদের বেকড ভার্সন, চকোলেটের সাথে জোড়া, বিদেশি জাতভাইদের সাথে ফিউশন এসবই হল ছানা পরিবারের একেলে রকস্টার। ডাবসন্দেশ, স্ট্রবেরি সন্দেশ, পেয়ারা থেকে শুরু করে সব রকম মরশুমি ফলের স্বাদ ও গন্ধ জুড়ে যাচ্ছে ছানার সাথে। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন মিষ্টি। আরও কত যে ভাবনা চিন্তা নিত্য হচ্ছে ছানার মিষ্টি নিয়ে তার ইয়ত্তা নেই। ছাঁচে, রঙে, স্বাদে ফিউশনে দেশে বিদেশে ছানার মিষ্টির জয়যাত্রা অব্যহত।
 
ছানাটুকু তুলে নিলে শুধু হবে না, যে সবজেটে রঙের জলটা থাকে, সেটাও ফেলনা নয়। ছানার জলে রয়েছে অ্যালবুমিন ও গ্লোবিউলিন নামে দু‌টি প্রোটিন। আর রয়েছে কার্বোহাইড্রেট ও ল্যাকটোজ। এছাড়াও এতে উপস্থিত রিবোফ্ল্যাভিন নামে একটি ভিটামিন যা শারীরিক বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং শরীরে শক্তির যোগান দেয়।
 
‘ছানা’ এখন গমগমে মিষ্টি পরিবারের সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরা কর্তা। তার ভরা সংসার। বাংলা তথা দেশের ঐতিহ্যের পতাকা হাতে নিয়ে সে গৌরবের সাথে এগিয়ে চলেছে বিদেশেও। তবুও তার কচি নিষ্পাপ শুভ্ররূপে সেই একই রকম সারল্য। আর সেটা রসিকজনের মন থুড়ি জিভকে ভিজিয়ে তোলে বৈকি।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>