| 16 এপ্রিল 2024
Categories
ছড়া সংখ্যা ২০২২

ছড়ায় ছড়ায় লুকিয়ে আছে । অদিতি ঘোষ দস্তিদার

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

“এই তোমাদের ভ্যান ঠাম্মি?”

যশোধরা হাসলেন নাতনির প্রশ্নে। 

“নয়ত কী? তুই কি ভেবেছিলি চারচাকার ভ্যান? এই গ্রামে? নে উঠে পড়। পা ঝুলিয়ে বস, দেখবি কত মজা। আমি সামনের দিকে বসছি। ব্যালান্স রাখতে হয় এই ভ্যানে।”

বসে পড়ল মুন্নি এক লাফে ভ্যান রিক্সায়। ঠাকুমার সঙ্গে এসেছে বাবার মামার বাড়ি, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ডায়মন্ড হারবারের কাছাকাছি এক গ্রামে। ভেতরের রাস্তায় যেতে ভরসা ওই ভ্যান রিক্সা। 

অনেক ছোটবেলাতে একবার এখানে এসেছিল মুন্নি। মনে নেই। সদ্য কলেজের পরীক্ষা শেষ। তাই এবার যশোধরার সঙ্গী হয়েছে সে। 

যশোধরার বয়েস সত্তরের কোটায় হলেও এখনও বেশ শক্তপোক্ত।

বাড়ির সামনেই একটা মস্ত পুকুর। পুকুরপাড় দিয়ে হেঁটে আসা এক বৃদ্ধাকে দেখেই আনন্দে চেঁচালেন যশোধরা।

“ও পিসিমা, কোথায় গেছিলে?”

পিসিমা এগিয়ে এলেন। বাঁধানো দাঁতে হাসি ঝিলিক দিল।

“ওমা যশো! কদ্দিন পর! ইটি কে? মেজোব্যাটার ঝি?”

মুন্নি কিছু একটা বলে উঠতে যেতেই যশোধরা ফিসফিস করলেন, “ঝি মানে মেয়ে।”

তারপর পিসিমাকে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, “তুমি এই অবেলায় কোথায় গেছিলে?”

“আর বলিস কেন? গেসলুম ডাক্তার দেখাতে।”

“ওমা কী হয়েছে? কাউকে নাওনি কেন সঙ্গে?”

“আরে না না। তেমন কিছু নয়। একটু বাতের ব্যথা। কিন্তু সেই বলে না,

‘কথা, কড়া, কারসাজি

তিন ক -তে কবিরাজি’

দিল একরাশ ফিরিস্তি। একগাদা পরীক্ষে নিরিক্ষের। লম্বা কাগজে এত্ত ওষুধ।”

“ওষুধ কিনলে না? পেয়েছো সব?”

গেট ঠেলে বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে প্রশ্ন করলেন যশোধরা।

“দূর দূর!

‘বাকি, বাক্য, বাটপাড়ি

এই তিন নিয়ে দোকানদারি!’

একগাদা সময় দাঁড় করিয়ে রাখল। আর কী দাম চাইছে। খোকাকে দিয়ে কলকাত থেকে আনিয়ে নেব।”

মুন্নি চুপ করে কথাবার্তা শুনছিল এতক্ষণ। এবার টুক করে প্রশ্ন করল,“তুমি সারাদিন ধরে এমন মুখে মুখে ছড়া কাটো দিদিমণি?”

পিসিমাকে এই নামেই ডাকতে শিখিয়েছেন নাতি নাতনিকে যশোধরা।

এক গাল হেসে পিসিমা বলেন, “লেখাপড়া তো আর তেমন করে শিকিনি দিদিসোনা তোমাদের মতো! বিয়েই দিয়ে দিল বাল্যকালে! যা শুনতুম মনে রাখতে পারতুম। ওগুলোই রয়ে গেছে।আমাদের যুগে কী কথা ছিল জানিস? 

“মেয়েছেলে কাদার ঢেলা, ধপাস করে জলে ফেলা।

মেয়ের নাম ফেলি, পরে নিলেও গেলি, যমে নিলেও গেলি!”

তো আমাকে যমের পছন্দ হল না ফেরত এলুম বাপের ঘরে!”

“উফফ কথা শুরু করলে আর থামেন না ইনি। বসতে জিরোতে দিন তো একটু এদের!” 

যশোধরার বৌদি ধমক দিলেন। যশোধরার বাবা মা অনেকদিন হল চোখ বুজিয়েছেন। তাঁদের বড় আদরের ছিলেন এই পিসিমা, আশালতা। এখন যশোধরার দাদা বৌদি আর পিসিমাই আছেন এই বাড়িতে। আর এক ভাইপো, সেই হচ্ছে পিসিমার ‘খোকা।’ বাকিরা চাকরি সূত্রে বিভিন্ন জায়গায়।

মুন্নির কিন্তু ভারি মজা লাগছে এই দিদিমণিকে। খুঁচোয় একটু তাঁকে।

“তোমাদের যুগে বুঝি মেয়েদের একটুও দাম ছিল না?”

“না রে সোনা! সারা জীবন শুনে গেলুম 

‘গাইয়ের বেটি, বউয়ের বেটা,

তবে জানবে কপাল গোটা!”’

যশোধরা আদর করে নাতনিকে টেনে নেন কাছে।

“আমার ইনি বাপু সাত রাজার ধন! নিজের তিন ছেলে, বাকিগুলো সব নাতি, এই একটিই নাতনি আমার! কত্ত বড় চাকরি করবে আমার সোনা। গাড়ি চালিয়ে অফিস যাবে!”

পিসিমাও এগিয়ে আসেন। 

“শুনিচি তুমি নাকি খুব ভালো রিজাল্ট করেছ সোনা! এত্ত পাশের পড়া সব কী করে মুখস্ত করে রাখিস বাপু!”

মুন্নি হাসে,“আর তুমি যে এত্ত ছড়া মনে রেখেছ!”

হাসেন পিসিমাও। 

“সব তো শুনে শুনে। আমাদের যুগে অনেক মেয়ে লেখাপড়া করেছে, কিন্তু আমার বাবা ছিল ভীষণ গোঁড়া। মেয়েদের

লেখাপড়ার বিপক্ষে। আমার ঠাকুমা ছড়া কাটত সেই শুনে শুনে আমি শিকিচি। তারপর যেখানে যা ছড়া শুনিচি মনে রেখে দিইচি! খেয়ে নাও। তারপর আরও অনেক ছড়া শোনাব!”

খেয়েদেয়ে যশোধরা দাদা বৌদির সঙ্গে গল্পে মাতলেন। মুন্নিকে নিয়ে আশালতা বসলেন বাঁধানো পুকুরঘাটের সিঁড়িতে।

“জানিস দিদি, আমার বিয়ের আগে এক ঘটক ঠাকুর আসতেন নানান জায়গা থেকে সম্বন্ধ নিয়ে। সেই সব জায়গার বিত্তান্ত দিতেন ছড়া কেটে। সে সব ভারী মজার ছড়া। শুনবি?”

“নিশ্চয়ই। দাঁড়াও রেকর্ড করে নেব।” 

মুন্নি ফোনের রেকর্ডার অন করে দিল। এই ছড়া নিয়ে তার মনে এখন খুব কৌতূহল। কলকাতায় গিয়ে ভালো করে পড়াশোনা করবে এই বিষয়ে! 

“ঘেঁটেল চেটেল কড়ে

তিন নিয়ে উলুবেড়ে”

“হাওড়ার উলুবেড়িয়াকে বলছে তাই না দিদিমণি?”

“হ্যাঁ রে!”

“মানে কী গো!”

“তা তো জানি না দিদি, শুধু ছড়াগুলো জানি।”

“আচ্ছা, ঠিক আছে, আরো বলো শুনি!”

আশালতা বলে চলেন,

 “পাল ভটচায খাঁ 

তিন নিয়ে মানকর গাঁ।”

এ হচ্ছে বদ্ধমানের মানকরের কথা। ওখানে কথা এগোল না। তারপর বীরভূমের সিংহি বাড়ি থেকে সম্বন্ধ এল। ঘটক বলল, ‘শিমলা বামুনরা খুব মানী ওখেনে। 

সিং শিমলা কর

তিনে জাজীনগর।’

কিন্তু বাবার ইচ্ছে হল না লালমাটির দেশে বিয়ে দেবার। আর একবার এল মুর্শিদাবাদ থেকে। ঘটক আওড়াল,

‘রায় লস্কর খাঁ

তিনে পাতেণ্ডা গাঁ।’ 

রেকর্ডার বন্ধ করে মুন্নি হেসে কুটিপাটি। 

“আরে দাঁড়াও দাঁড়াও। বাপ রে বাপ। ধন্য স্মরণশক্তি বটে!মানে জানে না কিন্তু জলের মত মুখস্থ!” 

“এ মানে তো সোজা! রায়, লস্কর, খাঁ এই সব পদবির লোকেরা আছে সেখেনে। তবে ওই পাতেণ্ডার সম্বন্ধে বাবা রাজি হননি একেবারে। ঘটকমশাই খুব জোরাজুরি করেছিলেন জানিস। তারা নাকি জমিদার। খুব সুখ হবে আমার। কিন্তু বাবা ভাগিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল মুর্শিদাবাদের সব মানুষ অন্যধর্মের। কী আশ্চর্য বল দিদি! আমার জীবনটা হয়ত অন্য রকম হতে পারত! কে জানে!”চোখ ছলছল করে উঠল আশালতার।

কথা ঘোরাতে মুন্নি বলে ওঠে, “আর কিছু মনে আছে তোমার?”

আশালতা একটু অন্যমন্যস্ক। জলের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেন, “দুটো জায়গার কথা মনে আছে খুব। গুপ্তিপাড়া, হুগলির নাম শুনেছিস?” 

মুন্নি না সূচক ঘাড় নাড়ে।

“গুপ্তি পাড়ার সম্বন্ধটাও মন্দ ছিল না। ঘটক বলেছিল পাত্তর নাকি মাস্টার। খুব ভালো পরিবার। বাবা সংস্কৃতের পণ্ডিত।  ছড়া কেটেছিল বুড়ো!

‘গুপ্তিপাড়ার মাটির গুণে

দেবের ভাষা মানুষ জানে!”’ 

বাবা ভেংচি কেটে বলেছিল, “থাক থাক আর ব্যাখ্যান দিতে হবে না, আমি জানি,

‘বাঁদর শোভাকর মদের ঘড়া

 তিন নিয়ে গুপ্তিপাড়া।’ 

ওখেনে মেয়ে দেব না।’

ঘটকঠাকুর বলে ছিলেন, ‘শোভাকর বামুনের বাড়ির সম্বন্ধ। শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ওনারা!’

বাবা ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলেছিলেন, ‘ওসব ছাড়ো। তুমি হাওড়ার সম্বন্ধটাই দেখো।

‘গঙ্গার পশ্চিমকূল বারাণসী সমতুল!’ 

হায় রে!”

দীর্ঘ্ নিশ্বাস ফেললেন আশালতা। তারপর আবার শুরু করলেন, “তো যাই হোক হাওড়ায় বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। 

পাড়ার গিন্নিরা ছড়া কাটলেন, 

‘আশালতা পালং পাতা আজকে আশার বিয়ে

হাওড়া থেকে বর আসবে টোপর মাথায় দিয়ে।’

বর তো এল। চলেও গেলুম শ্বশুরবাড়ি। সে কী জঘন্য পরিবার!

আমার দিদিশাশুড়ি ছিল ঢাকার মেয়ে সে ছড়া কাটত। 

‘ছোট মেয়ে দুধের সর

কেমনে করবে পরের ঘর

পরের বেটায় মারবে চড়

ঘুরইয়া ঘুরইয়াকাম কর!’ 

হাড়ে হাড়ে সত্যি হয়ে গেল সে কথা। বদ ছিলবরটা, জানিস দিদি। চরিত্তির খুব খারাপ ছিল। আমায় মার ধর করত। কী করে মনে নেই বাবার কাছে খবর পাঠিয়েছিল আমার শ্বশুরবাড়ির পাড়ার লোক। ‘মেয়ে নিয়ে যাও নইলে মেরে ফেলবে।’ 

তো আমার বাবার কাছে তো মেয়ে মানেই ওই ফেলি, তাই ভেবেই বাবা হয়তো বলেছিল ওসব দুদিনের, বাচ্চা কাচ্চা হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। দাদা মানে তোর ঠাকমার বাপ কিন্তু সে কথায় কান দেয়নি। বাবার কথা অগ্রাহ্য করে ছুটেছিল। নিয়ে এসেছিল আমায়। প্রাণ বাঁচাল। বুক দিয়ে আগলাল। বৌদি মা হয়ে আশ্রয় দিল।যমে আর নিতে পারল না আশালতাকে। কিন্তু আমার আশালতা সব শুকিয়ে গেল তের বছরেই। চলে এলুম বাপের বাড়ি। তার পরের বছর তোর ঠাকমা হল। সেসব কী আজকের কথা!”

মুন্নির মন ছলছল করছিল। সত্যি কত কষ্ট পেয়েছেন এই পিসিদিদা। এই বয়েসেও কী স্মরণশক্তি! 

কলকাতায় ফিরে এসেও মুন্নির বার বার মনে পড়ছিল আশার কথা আর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বলা ছড়াগুলো।

শুরু করল ছড়া নিয়ে পড়াশুনো। দেখল ছড়ার ভাণ্ডার অফুরান। ছড়া সংগ্রহের কাজটা প্রথম শুরু করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। তাঁর লোক সাহিত্য প্রবন্ধই ছড়া নিয়ে। পরবর্তীকালে প্রচুর কাজ করেছেন আশুতোষ ভট্টাচার্য..তাঁর লোকসাহিত্যের দ্বিতীয় খণ্ডটি পুরোটাই ছড়া নিয়ে। আর ছড়া আর প্রবাদে গ্রাম বাংলার বিভিন্ন জায়গা নিয়ে কাজ করেছেন তারাপদ সাঁতরা। 

আস্তে আস্তে মুন্নি জেনেছে সেই ঘটক ঠাকুরের বলা ছড়াগুলোর অর্থ।

‘গঙ্গার পশ্চিমকূল

বারাণসী সমতুল!’ 

 গঙ্গা মানে অবশ্য এখানে হুগলি নদী। মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসির পর কলকাতার অনেক ব্রাহ্মণ পরিবার কলকাতাকে অধর্মস্থান মনে করে পশ্চিম তীরবর্তী হাওড়ার শিবপুর, শালকিয়া ইত্যাদি অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন। তাই পশ্চিমতীর বারাণসী তুল্য। 

এই ছড়াগুলোর প্রসঙ্গে আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন এগুলো ঠিক প্রবাদ নয়, এগুলো অনেকটা ইংরেজির priamel, কতকগুলো বিপরীতধর্মী চিত্র বা বিষয় দিয়ে জায়গার বর্ণনা। 

যেমন, ‘বাঁদর শোভাকর মদের ঘড়া তিন নিয়ে গুপ্তিপাড়া।’ 

এখানে কিন্তু গুপ্তিপাড়ায় বাঁদর আছে এটাইকেবলমাত্র বোঝান হয়নি। এর ব্যঞ্জনা আরও সুগভীর। 

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র গুপ্তিপাড়া থেকে বানর বানরি এনে লাখটাকার কাছাকাছি টাকা খরচ করে তাদের বিয়ে দেন, সেই উপলক্ষে মহাভোজের ব্যবস্থা করেন। দিকে দিকে তখন গুপ্তিপাড়ার বাঁদরের নাম ছড়িয়ে যায়।

শোভাকর বলতে বোঝান হয়েছে গুপ্তিপাড়ার চট্ট শোভাকর বংশের পাণ্ডিত্যের কথা।

আবার বীরাচারী তান্ত্রিক সাধনার অনুষ্ঠানের জন্যে বিখ্যাত ছিল গুপ্তিপাড়া। পঞ্চ ম কারের সাধনার জন্যে আসত প্রচুর মদ। আবার

গুপ্তিপাড়ার মাটির গুণে

দেবের ভাষা মানুষ জানে!অর্থাৎ

ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের জন্যে গুপ্তিপাড়া খুব বিখ্যাত ছিল। একসময়ে ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে ছাত্ররা দর্শন শাস্ত্র পড়তে গুপ্তিপাড়ায় আসত। 

ঘেঁটেল চেটেল কড়ে

তিন নিয়ে উলুবেড়ে!

উলুবেড়িয়া হুগলি নদীর পারে। ওপারে আছিপুর। তাই ঘাট পারাপার রোজকারের ব্যাপার। সেই কাজ করায় ঘেঁটেলরা। চেটেলরা ছিলেন পথিকদের বিশ্রামস্থল চটির দায়িত্বে। একসময় যখন পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দির দর্শনের তীর্থযাত্রীদের জন্যে উলুবেড়িয়ায় ছিল একটা চটি।তাই জমজমাট ছিল উলুবেড়ে আর তাই ফড়েদের মানে middle man দের আনাগোনা। 

যত জানছে ততই আগ্রহ বাড়ছে মুন্নির। সব নোট করে রাখছে। খুব শিগগিরি যাবে দিদিমণির সঙ্গে দেখা করতে। অনেক বই যোগাড় হয়েছে। শুনিয়েও আসবে বেশ কিছু।

দিদিমণি যে ভীষণ খুশি হবে এ ব্যাপারে মুন্নির কোন সন্দেহ নেই।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত