ছড়া: শক্তিশালী শিল্পমাধ্যম ও বিভিন্ন ভাবনা । বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
ছড়া মানে নিছক অন্ত্যমিল সহযোগে কবিতা লেখার প্রয়াস নয়। যেকোন সাহিত্যেই ছড়া এক মহাপরাক্রমশালী শিল্পমাধ্যম। মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হতে হতে সহজেই তা মানুষের হৃদয়ের তন্ত্রীতে বেজে ওঠে। মাথার ভেতর রেখে যায় দীর্ঘস্থায়ী অভিঘাত। এর মধ্য দিয়ে একদিকে শিশুর ভাবনাজগত যেমন সমৃদ্ধি লাভ করে, সাথে সাথে বড়দের মধ্যেও অনাবিল আনন্দের চিহ্ন রেখে যায়। সব ছড়াই শুধুমাত্র মজার জন্য নির্মিত হয় এমন মনে করার কোন কারণ নেই। মজা তো আছেই প্রাথমিক শর্ত হিসেবে, কিন্তু নিছক মজাটুকুই নয় আরোও বৃহত্তর পরিসর আছে। সামাজিক অনুভাবনা আছে, মননশীলতা আছে, আছে সামাজিক দায়বদ্ধতাও। যদিও ছড়া হচ্ছে সাহিত্যের সুপ্রাচীন এবং সম্পন্ন এক শাখা। কিন্তু এই সম্পন্নতা একদিনে অর্জিত হয়নি। ছেলে ভুলানো ছড়া ক্রমিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে তা বিকাশ লাভ করে আজকের এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে।
কবিতাকে যেমন নির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞার আদলে বাঁধা যায় না। ছড়াও তাই। একে সীমানা দিয়ে কাঁটাতারের বেড়ায় বন্দি করা যায় না। তবু এ প্রসঙ্গে শ্রদ্ধেয় অন্নদাশংকর রায়ের কথাগুলি তুলে ধরা যেতে পারে। তিনি বলেছেন-“ ছড়া যদি কৃত্রিম হয়, তবে তা ছড়াই নয়, তা হালকা চালের পদ্য। তাতে বাহাদুরি থাকতে পারে, কারিগরি থাকতে পারে, কিন্তু তা আবহমান প্ররচলিত খাঁটি দেশজ ছড়ার সঙ্গে মিশ খায় না। মিশ খাওয়ানোটাই আমাদের লক্ষ্য।যদি লক্ষ্যভেদ করতে পারি তবে আমার ছড়া মিশ খাবে, নয়তো নয়”। যদিও এই বক্তব্যের সাথে পুরোপুরি একমত হওয়া সম্ভব নয় আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে। কেননা ছড়ার সাবেকিয়ানা থেকে পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্য দিয়ে অনেকদূর পথ হেঁটে এসেছি আমরা। ছড়াকার আবদুল হাসিবের মত হল- ‘ ছন্দ আর অন্ত্যমিলের প্রতি যত্নশীল থেকে হালকা চালে সহজ শব্দের সমন্বয় সাধনের মধ্য দিয়ে কোন বিষয়কে চিত্তাকর্ষক করে তোলার ছন্দময় প্রকাশ হচ্ছে ছড়া’ এই মতামত আমাদের অংশত আকর্ষণ করে। ছড়া শব্দটির মূলে আছে আছে ছটা। শব্দের বিকিরণ এবং মনমাতানো ছন্দের আলোকসম্পাত ছড়া ছড়া লেখা অসম্ভব।
‘তেলের শিশি ভাঙল বলে
খুকুর পরে রাগ করো
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা
ভারত ভেঙে ভাগ করো
তার বেলা ?’
ছড়া কি নিছক মজা? হালকা চালে লেখা কিছু সহজ শব্দের সমন্বয়।না কি তার বাইরেও আরও এক বৃহত্তর সীমানা আছে তার? উপরের ছড়াটি তো মজার পাশাপাশি আমাদের হৃদয়ের এক কোণে অমোঘ জিজ্ঞাসাও রেখে যায়। আবার যখন আমরা পড়ি-“ তেজ পাতা তেজ কেন , ঝাল কেন লঙ্কায়? / নাক কেন ডাকে আর পিলে কেন চমকায়?’ তখন মনে হয় পৃথিবীতে সব কেন’র উত্তর আমাদের জানা নেই। কিছু কিছু বিষয়কে আমাদের স্বীকার্য হিসেবেও মেনে নিতে হয়। বিন্দু কাকে বলে? এর উত্তরে আমরা বলি যার দৈর্ঘ্য নেই, প্রস্থ নেই, উচ্চতা নেই কিন্তু অবস্থান আছে। এই কাল্পনিক বিষয়টিকে প্রশ্নহীন মেনে নিলে জ্যামিতির জন্ম হয়।
ছড়া যেকোন কালে যেকোন দেশের সাহিত্যে এরকম নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কার করেছে। নতুন জ্যামিতির জন্ম দিয়েছে।
ছড়ার মধ্য দিয়ে সুন্দর সুন্দর ছবি তুলে এনেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই ছবিগুলি চিরজাগরুক কল্পনার পৃথিবী নির্মান করেছে একদিকে। অন্যদিকে আনন্দের অনাবিল স্রোতে ভেসেছে শিশুমন।
১
তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে
উঁকি মারে আকাশে।
মনে সাধ কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়
একেবারে উড়ে যায়
কোথা পাবে পাখা সে ?
২
ছায়ার ঘোমটা মুখে টানি
আছে আমাদের পাড়াখানি
দিঘি তার মাঝখানটিতে
তালবন তারি চারি ভিতে
বাঁকা এক সরু গলি বেয়ে
জল নিতে আসে যত মেয়ে
বাঁশ গাছ ঝুঁকে ঝুঁকে পড়ে
ঝুরু ঝুরু পাতাগুলি নড়ে
৩
কুমোর পাড়ার গোরুর গাড়ি
বোঝাই করা কলসি হাঁড়ি
গাড়ি চালায় বংশীবদন
সঙ্গে যে যায় ভাগ্নে মদন।
লোকমুখে প্রচলিত ছড়ার যে ধারাবাহিকতা আমি সেই প্রাচীন সময়ে যাচ্ছি না।বিবর্তনের মধ্য দিয়ে ছড়া যে সম্ভ্রমের জায়গায় এসে উপস্থিত হয়েছে আমার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু সেই উত্তরণকে চিহ্নিত করেই। ছড়াশিল্পী হিসেবে সাম্প্রতিক সময়ে যে নামগুলি সকলের কাছে সুপরিচিত এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু নাম পবিত্র সরকার, ভবানীপ্রসাদ মজুমদার, সুনির্মল চক্রবর্তী, শ্যামলকান্তি দাশ, রতনতনু ঘাটি, দিগম্বর দাশগুপ্ত, শ্যামাপ্রসাদ ঘোষ মৃত্যুঞ্জয় কুণ্ডু, অপূর্ব দত্ত, দীপ মুখোপাধ্যায়, অপূর্বকুমার কুণ্ডু, রূপক চট্টরাজ, সুখেন্দু মজুদার, মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, অশোক রায়চৌধুরী, অমিয়কুমার সেনগুপ্ত, ব্রজেন্দ্রনাথ সরকার,গোপাল কুম্ভকার, হাননান আহসান, আনসার-উল হক, চন্দন নাথ, শংকর দেবনাথ, মালি পাখি, সতীশ বিশ্বাস, মধুসূদন ঘাটি, সরল দে, শৈলেনকুমার দত্ত, উৎপলকুমার ধারা, মৃত্যুঞ্জয় দেবনাথ, মৃনালকান্তি দাশ, অমল ত্রিবেদী, প্রদীপ দেববর্মন, শঙ্খশুভ্র পাত্র, দেবাশিস বসু দেবাশিস দণ্ড, অতনু বর্মন, শুভ্র চট্টোপাধ্যায়, আশিসকুমার মুখোপাধ্যায়, তরুনকুমার সরখেল, অচিন্ত্য সুরাল, অশ্রুরঞ্জন চক্রবর্তী, সুজিতকুমার পাত্র, আরণ্যক বসু, উত্থানপদ বিজলী, সমর পাল, পার্থ সিনহা, পার্থপ্রতিম আচার্য, শরকৃষ্ণ চট্টসূর্য,অংশুমান চক্রবর্তী, তারক চট্টোপাধ্যায় থেকে আরম্ভ করে সুমিতকুমার বেরা ( এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না বলে প্রচুর নাম বাদ গেল, আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত)
ছড়ায় চিন্তা চেতনাকে অস্বীকার করার কোন জায়গা নেই। আমরা তা দেখেছি বিভিন্ন ছড়ার মধ্যে। কবি শামসুর রাহমানের ছড়ায় যেমন দেখেছি- ‘শীত সকালে লোকটা কাঁপে/ কাঁদে সবার পা ধরে/ একটা শুধু জামা ছিল/তা-ও ছিঁড়েছে ভাদরে/ হি-হি শীতে থাকে পড়ে/ ডাকে না কেউ আদরে।’ শুধু শামসুর রাহমান বা কবি শঙ্খ ঘোষের ছড়াতে নয় আমরা পরবর্তী ক্ষেত্রেও দেখেছি-
১
মাছ মাংস দূরের কথা জোটেনি ভাত পিঁয়াজও
ফুটপাতেতে গনশার মা ভাবছে খাবে কি আজ ও ?
সে জানে না রাজনীতি কি কিংবা কোথায় গদি কার?
সে শুধু চায় একমুঠো ভাত একটি রুটির অধিকার। ( ভবানীপ্রসাদ মজুমদার)
২
সেই মাঠে আর হয় না খেলা বাড়ির পাশে বাড়ি
সকাল বিকেল দাঁড়িয়ে থাকে প্রমোটারের গাড়ি।( শ্যামলকান্তি দাশ)
৩
একের পরে দুই
ইচ্ছে করে আকাশ তোমায়
একটু খানি ছুঁই
তিনের পরে চার
সত্যি করে বলো দেখি
আকাশ তুমি কার?
পাঁচের পরে ছয়
মা বলেছে আকাশ নাকি
সবার বন্ধু হয়।
সাতের পরে আট
এ নাও আকাশ তোমায় দিলাম
ভুবনডাঙার মাঠ ( অপূর্ব দত্ত)
৪
বেঁচে আছি কত দুঃখে কষ্টে তোমরা রয়েছ
অনন্তসুখে
আমি যে আমার কান্নাগুলোকে ছড়া বানিয়েছি
ছেঁড়া নোটবুকে।
……
ছড়া আলো দেয় জোনাকির মতো এই
চোখদুটো ছলছল করে
মায়ের হাসিতে ছড়া খুঁজে যাই ছেলেবেলাকার
সেই খেলাঘরে। ( দীপ মুখোপাধ্যায়)
৫
একুশের গানে প্রাণের গভীরে ঢেউ জেগে ওঠে যদি
কেন সে শ্যাওলা বাঁধবে বলো এ বর্ণমালার নদী।
যে নদীর থেকে উথলিয়ে ওঠা অক্ষরে অক্ষরে
সূর্যের আলো চাঁদের জোছনা দিনরাত ঝরে পড়ে। ( চন্দন নাথ)
৬
রুমাল ছিল, বেড়াল হল, গল্প সে তো জানা
পর্ণকুটির প্রাসাদ হল আহ্লাদে আটখানা
কেমন করে হয় যে এসব?
আল্লা জানেন, জানেন কেশব
আমরা হলাম নির্বিবাদী, ভানটা করি কানার। (পার্থ সিনহা)
৭
রক্ত দিয়ে যে ছেলেরা
বাঁচায় বাংলাভাষা
দাবি তারা করতে পারে
শ্রদ্ধা ভালোবাসা। ( হাননান আহসান)
৮
পথটি চেয়ে বসে থাকে
মতিউরের মা
বুকের ভিতর ধুকপুকানি
ফিরবে কখন ছা? ( আনসার-উল হক)
তাহলে ছড়ার মধ্যে কি শুধু বাস্তবের সমস্যাগুলিই প্রতিফলিত হবে? এরকম কোন শর্ত অবশ্যই নেই। কিন্তু মজার আড়ালে যদি তা বলা হয়, তাহলে অসুবিধা নেই। ছড়াকে লঘুই হতে হবে তার মধ্যে চিন্তার কোন উপাদান থাকবে না এমন নয়। আমার বক্তব্য এটাই যে ছড়ার কোন দিগন্ত নেই। বিষয় বা ভাবনার এক রৈখিকতা দিয়ে ছড়াকে আবদ্ধ করার যে প্রবণতা দেখা যায় ছড়া সেই সীমানার মধ্যে আবদ্ধ নয়। অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের মতো সেও মুক্ত,স্বাধীন, সর্বত্রগামী।
আল মাহমুদ যেমন লেখেন-“ ছড়া সেও কাব্যকথা,হৃদয়ভাঙা মিল/ ঠিক দুপুরে উড়তে থাকা পাখ ছড়ানো চিল/ নেইকো ছড়ার মালমশলা নেইকো কথা মিল/এই শহরে কোথায় পাব নীল্পরিদের ঝিল?
ছড়া সে তো পাখ ছড়ানো চিলের মতো সুদূর আকাশে বিচরণশীল। তার কোন গ্রাম নেই, তার কোন শহর নেই। সাম্প্রতিক ভাবনা যেমন তার বিষয় হতে পারে একইভাবে আবহমান যে জীবন তাও উঠে আসে ছড়ায়। বাস্তবের পাশাপাশি মায়াজাগত, রূপকথার দুনিয়া থেকে অলীক কল্পনা আমাদের বিচিত্র দিগন্তের সন্ধান দেয়। কখনও বুজরুকির বিরুদ্ধে তা প্রতিবাদ, কখনও বিজ্ঞানমনস্কতার জাগরণ হয়ে ওঠে ছড়ার আশ্রয়ভুমি। বিভিন্ন ছড়ায় একদিকে যেমন নিসর্গ প্রকৃতি সৌন্দর্যচেতনার কথা আছে। অন্যদিকে আছে নির্মল শুভ্র হাসির সম্ভার। আবার কখনও কখনও ছড়া প্রতিবাদের চাবুক হয়ে উঠেছে। শ্লেষ , বিদ্রূপ এবং রসাত্মক প্রতিবাদের আশ্রয় হয়ে উঠেছে তাঁর শিশুদের জন্য তাঁর শিল্পভাবনা। পরীক্ষা নিরীক্ষাও কম হচ্ছে না শিশুতোষ কবিতা নিয়ে। ছন্দ নিয়ে , বিষয় নিয়ে এবং ভাবনার অভিনবত্ব নিয়ে বিভিন্ন সময়ে তিনি ছড়াকে সময়োত্তীর্ণ করার নিরলস প্রয়াস চলছে ।
যন্ত্রসভ্যতার রূপ ও বিকাশ, প্রযুক্তির বিস্তার নিয়ে তিনি যখন ছোটদের মনের জিজ্ঞাসগুলিকে ছোটদের মতো করে তুলে আনছেন ছড়াকারেরা আবার খেলাধুলার আনন্দভূবনকেও আমরা দেখতে পাই ছন্দের জাদুমন্ত্রে। আমাদের চিরায়ত কৈশোর ঘুমিয়ে আছে আমাদের মধ্যে। ছড়াকারদের জাদুকাঠিতে আমরা তা ফিরে পাই। এই জাদুস্পর্শ আমরা দেখতে পাই শ্যামলকান্তি দাশের ছড়ায়-
ছেলে ঘুমাল পাড়া জুড়োল
রাঙা ধুলার পথ ফুরোল
পথ ফুরোল বনের ধারে
চাঁদ উঠেছে অন্ধকারে।
এছাড়া আরও কিছু উদাহরণ তুলে ধরা যেতে পারে-
১
আয় না রে ঘুরে আসি নয় বেশিদূরে
দল বেঁধে চলে যাই ছেলেবেলাপুরে।
সেখানে থাকবে না তো পিছনের টান
মুঠো মুঠো লুটে নেব আলো-হাসি-গান।
দুকানে শুনব পথ হারানোর সুর
যাবে না কি একবার ছেলেবেলাপুর। ( অপূর্বকুমার কুণ্ডু)
২
লাল রঙ নিতে যাবো শিমূলের কাছে
বসন্ত তুমি নিতে দিও অনুমতি
যদি দাও তবে নেব মন থেকে সুর
মনের সে সুর নিতে হলে তুমি নিও।( শ্যামাপ্রসাদ ঘোষ)
৩
ওই ছেলেটা যাবি হাতটা বাড়াস যদি
সেথায় গেলে পাবি একটা নদী
আঁচল ভরা জল শালুক ফোটার দিন
ঢেউয়ের কোলাহল মাছ করে কিলবিল।( উৎপলকুরার ধারা)
৪
এই যে মেয়ে দিগন্তিকা তুমি কি সেই অন্তহীনা?
যারা তোমার সঙ্গে ঘোরে তাদের আমি ঠিক চিনি না।
সবাই তারা রাজপুত্র, সোনার তির তাদের হাতে
উষ্ণীষে কি হিরের ছটা! কী আসে যায় আমার তাতে? ( রতনতনু ঘাটী)
৫
লাগছে ভালো কী যে!
রাজকন্যা আজ এসেছে
আজ এসেছে আমার ঘরে নিজে।
কল্পলোকের গল্পকথায়
ছন্দের মৌতাতে
কাজ ফেলে আজ
কাটিয়ে দেব রাজকন্যার সাথে। ( শংকর দেবনাথ)
৬
টুং করে হেসে দিলে টুনটুনি রায়
ওমনি আকাশে নাকি মেঘ ভেসে যায়।
ভাসে না ভাসে না মেঘ , মেঘের মতন
উলের ফতুয়া গায়ে বক উড়ে যায়। ( পার্থপ্রতিম আচার্য)
৭
পাঁচ সকালে আঁচ করেছি
সোনা রোদের হাসি,
ওদের মতো কেউ বলে না
তোদের ভালোবাসি।( শঙ্খশুভ্র পাত্র)
এর পাশাপাশি হাসিই যেখানে ছড়ার মূল উপাদান। নিছক কৌতুকই হয়ে উঠেছে ভাবনার নিউক্লিয়াস। এই ছড়াগুলিই ছোট বড় সবার কাছে সমান ভাবে আদৃত।
১
বাড়ি কোথায়? জুতোওলা
শুধোয় খরিদ্দারে,
ক্রেতা বলেন, ডোবাগ্রামে
তিস্তানদীর ধারে।
জুতাওলা বলল তবে
দিন বগলের মাপ,
ক্রেতা রেগেই বলেন ছিঃ ছি?
ইস কী মহাপাপ।
জুতোওলা বলেন মশাই
করেন কেন ছিঃ ছিঃ
সাত সকালেই আমার উপর
চটেন মিছিমিছি।
ডোবাগ্রাম তো সারাবছর
ডুবেই থাকে জলে
জুতো কি আর পায়ে দেবেন
থাকবে তো বগলে।
২
গোকুল ধাড়ার লম্বা দাঁড়ি সেই দাড়িতে চালায় বুরুশ
দাঁড়ি দেখে চমকে উঠে পালায় ভূতের চৌদ্দ পুরুষ।
এমন দাঁড়ি রয় কজনের দাঁড়ি দেখে সবাই কাহিল
সিংহ হাতি বাঘরা ভয়ে দৌড়ে পালায় তিরিশ মাইল।
এমন দাঁড়ি দেখতে আসে চিন রাশিয়া জাপান থেকে
এই দাঁড়িকে নিয়েই বা কেউ ছড়া এবং কাব্যি লেখে।
এই তো সেদিন রেলগাড়ি এক উলটে ছিল বিপদ ভারি
ট্রেন তোলা ক্রেন ফায়ার ব্রিগেড ব্যর্থ হল তুলতে গাড়ি।
বলল সাহেব গোকুলকে ডাক, গোকুল গিয়ে সেইখানে
হেঁইয়ো বলে তুলল গাড়ি লম্বাদাড়ির এক টানে ।( মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়)
৩
ঢাকায় গেলে হাতঘড়িটা
আধঘণ্টা স্লো যায়
দোকানদারকে সেই ছেলেটা
হঠাৎ সেদিন বোঝায়।
হতেই পারে অসুখবিসুখ
থাকলে পরে শরীর
দোকানদারও দমেন না তাই
কমান না দাম ঘড়ির।
এগিয়ে যেত ঘণ্টাকয়েক
থাকত যদি স্পেনে
সময় দিত তেমনি আজন
জাপান বা সুইডেনে।
বলল ছেলে ঘাট হয়েছে
মাফ করো গুস্তাফি
হাতঘড়িটার সঙ্গে আমি
কলকাতাতেই থাকি। ( দীপ মুখোপাধ্যায়)
এরকম অজস্র ছড়ার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। হাতের সামনে বইগুলি নেই বলে তা থেকে বিরত থাকলাম। তাছাড়া এই লেখা খুব দ্রুত লিখতে হচ্ছে বলে বাংলাদেশের ছড়াকারদের এই তালিকাভুক্ত করা গেল না। এই দেশে ছড়া নিয়ে ছড়ার ব্যাপ্তি, বিশালতা এবং বৈচিত্র্য নিয়ে প্রচুর কাজ হচ্ছে। সেসব অন্য কোন লেখায় বিস্তারিত তুলে ধরা যাবে।
বাংলা ছড়াকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন সুকুমার রায়। তিনি বাংলা সাহিত্যে এক যুগান্তকারী বিপ্লব এনেছিলেন। ফলে ছড়া সাহিত্যে নতুন যুগের সুত্রপাত যদি এরকম একজন পরাক্রমশালী মানুষের হাতে হয়ে থাকে হয়ে থাকে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে উজ্জ্বল সম্ভাবনাই জোরালো হওয়ার কথা ছিল। তা হয়তো হয়নি। এতে নিরাশার কোন জায়গা নেই। বিকশিত ধারায় সময়ের স্রোতে তার গায়ে অনেক অলংকার আভরণের প্রাচুর্য। তবু যে ঐতিহ্য থেকে এর সূত্রপাত হয়েছিল তার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে ছন্দের সময়োপযোগী উপস্থাপনার কথা আমাদের চিন্তায় রাখতে হবে। দিন বদলের সাথে সবকিছুই বদলে যায়।ছড়া শুধুমাত্র শিশুদের সুতরাং খুব বেশি বুদ্ধিদীপ্ত হলে তা ছড়া নয়, এ ধারণা ভুল। আজকের শিশুরা অনেক পরিণত অনেক বেশি চিন্তাশীল। তাছাড়া ছড়াকে বয়সের গণ্ডি দিয়ে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া ঠিক নয়। ছড়া স্বাধীন, মুক্ত, সর্বত্রগামী।
কবি, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক
জন্ম ১৯৭২, পুরুলিয়ায়। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতকোত্তর। দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনে কর্মরত। প্রকাশিত গ্রন্থ এক ডজন। পেয়েছেন ত্রিবৃত্ত পুরস্কার মালীবুড়ো সন্মান সহ বেশ কিছু পুরস্কার ও সন্মাননা। কেতকী পত্রিকার সম্পাদনার সাথে যুক্ত।