Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,ছড়া

ছড়ার কালবৃত্ত । পারমিতা চক্রবর্ত্তী

Reading Time: 5 minutes

ছড়া নামটার মধ্যেই একটা অতিপ্রিয় স্বর লুকিয়ে আছে।’ছড়া’ শব্দর সাথে আমাদের পরিচয় একেবারে জন্মলগ্ন থেকেই৷ ছোটবেলায় মা’র মুখে শুনতাম মা সুর করে করে ছড়া গানের মত করে গান গেয়ে ঘুম পাড়াতেন।

“ঘুম পাড়ানি মাসি-পিসি

মোদের বাড়ি এসো,

খাট নাই পালং নাই

খোকার চোখে বসো।

বাটা ভরে পান দিবো

গাল ভরে খেয়ো,

খোকার চোখে ঘুম নাই

ঘুম দিয়ে যেয়ো। “

এই ছড়া আজও শোনা যায় গ্রাম, শহরের প্রতিটি ঘরে ঘরে। সুতরাং ছড়া কাকে বলে তার কিন্তু কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা পাওয়া যায়নি৷ এই নিয়ে বিশেষজ্ঞ হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ছড়া’ শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করেছেন এভাবে- সংস্কৃত-ছটা > প্রাকৃত-ছড়া > প্রা, ম-ছিটা > ছড়া ৷রাজশেখর বসু, যােগেশচন্দ্র রায় প্রমুখ পণ্ডিত এই মতের সমার্থক। অর্থাৎ ছড়া কাকে বলে সে নিয়ে প্রচলিত কোন ব্যাখা পাওয়া যায়নি৷ তবে এটা বলা যায়  শ্রুতিমধুর কবিতাকে ছড়া বলা চলে৷ প্রাচীন কাল থেকে ইংরেজী  ভাষায় ননসেন্স রাইম প্রচলিত রয়েছে কারণ ছড়ার প্রধান দাবি ধ্বনিময়তা ও সুরঝংকার, অর্থময়তা নয়।

যেমন-

কুমড়ো পটাশ

(যদি) কুমড়ো পটাশ নাচে-

খবরদার এসো না কেউ আস্তাবলের কাছে ;

চাইবে নাকো ডাইনে বাঁয়ে চাইবে নাকো পাছে ;

চার পা তুলে থাকবে ঝুলে হট্টমুলার গাছে !

(যদি) কুমড়ো পটাশ কাঁদে-

খবরদার! খবরদার! বসবে না কেউ ছাদে ;

উপুড় হয়ে মাচায় শুয়ে লেপ কম্বল কাঁধে ;

বেহাগ সুরে গাইবে খালি ‘রাধে কৃষ্ণ রাধে’ !

সুকুমার রায়ের বিখ্যাত ছড়া পড়তে এবং শুনতে সব বয়সের মানুষদের আজওখুব ভালো লাগে৷ তার কারণ সহজবোধ্য শব্দ I ভাষার মধ্যে শব্দের কোন কারুকরি নেই৷ আছে নিপাট সরলতা।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছেলে-ভুলানাে ছড়া’ প্রবন্ধে লিখেছেন- ‘আমি ছড়াকে মেঘের সহিত তুলনা করিয়াছি। উভয় পরিবর্তনশীল, বিবিধ বর্ণে রঞ্জিত, বায়ু স্রোতে-যদৃচ্ছা ভাসমান। দেখিয়া মনে হয় নিরর্থক। ছড়াও কলাবিচার শাস্ত্রের বাহির, মেঘ বিজ্ঞান শাস্ত্র নিয়মের মধ্যে ভালাে করিয়া ধরা দেয় নাই অথচ জড় জগতে এবং মানব জগতে এই দুই উশৃঙ্খল অদ্ভূত পদার্থ চিরকাল মহৎ উদ্দেশ্যে সাধন করিয়া আসিতেছে।’

সুতরাং এর থেকে বোঝা যাচ্ছে ছড়া নিয়ে বাধাধরা কোন নিয়ম নেই৷ অভিধানকারগণও ছড়া বলতে ‘গ্রাম্য কবিতাকেই’ বুঝিয়েছেন। কবি গান, তরজা পাঁচালির আসরে তাৎক্ষণিকের প্রয়ােজনে বাদানুবাদে ছড়া কাটা হতাে। দৈনন্দিন জীবনে, গার্হস্থ্য বিষয়ে, হাসি-কান্না, ঝগড়া বিবাদ, সামাজিক-পারিবারিক উৎসব, অনুষ্ঠান, পার্বণ, অবসর বিনোদন প্রভৃতি সময় ছড়া বলা হয়। মুখে মুখে রচিত অথবা কণ্ঠস্থ এই সমস্ত বিষয়ই গ্রাম্য কবিতা। অর্থাৎ গ্রাম্য কবিতা বা ছড়ার ব্যবহার লােকভাষাতেই ছিল। অবশ্য তখনকার দিনে ছড়া বলতে শ্লোক’ ‘ছিকলি’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হতাে।

ছড়ার কাল নির্ণয় :

ছড়া বিভিন্ন সময় , বিভিন্ন ভাবে মুখে মুখে তৈরী হতে পারে ৷ যেমন – বিয়ের মালাবদলের সময় ছাউনি নাড়ার কবিতা আবার নবজাতকের জন্মের ষষ্ঠীপুজোর অনুষ্ঠানে মুখে মুখে ছড়া কাটা হয়৷ মাঝি নৌকা বওয়ার সময় গুনগুন করে গান করেন তাকে ছড়া বলা যেতে পারে৷ আবার ছাদ পেটানোর সময় এক রকম ছড়ার মত গান করা হয়ে থাকে। মাটি কোপানোর সময় মুখে মুখে ছড়া বলা হয়৷  লােকবিজ্ঞানী M. Bloomfield-মতে ছড়া হচ্ছে মানুষের striking example of the poetic primitive’ যার সূচনা almost of the primitive archaic’ কালে। মুখে মুখে আবৃত্তির জন্য যা রচিত তাই ছড়া, এমন একটা প্রচলিত ধারণা থাকলেও ছড়া মাত্রই আবৃত্তি করা হয় না, গাওয়াও হয়। অনেক সময় আবার স্বল্প সুরের আভাস ফুটিয়ে গান ও আবৃত্তির মধ্যবর্তী একটা অনুসরণ সৃষ্টি করা হয়ে থাকে।

ছড়ার মধে কী থাকবে , কী থাকবে না !

১) শব্দের আড়ম্বর থাকবে না। খুব সহজ , সরল হবে।বুদ্ধির থেকে আবেগ অনুভূতির প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয় বেশি।

২)শিশুদের উপযােগী মনে করা হলেও ছড়াতে সকল বয়সী নারী-পুরুষই- অংশগ্রহণ করতে পারে।

৩) বিষয়ের দিক থেকে ছড়া বৈচিত্র্যধর্মী ।

সুতরাং ছড়ার মধ্যে একটা সুন্দর ছন্দবোধ থাকবে৷ একটির অংশের সঙ্গে আর একটির অংশ অতি সহজেই জুড়ে যায়, তার ফলেই একই ছড়ার মধ্যে ভাব ও চিত্রগত বিভিন্নতা দেখতে পাওয়া যায়। ছড়ার পদগুলাে পরস্পর সুদৃঢ়ভাবে সংবদ্ধ নয়, বরং নিতান্ত অসংলগ্ন; সেজন্য একটি পদ থেকে আর একটি পদ যেমন সহজেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে,তেমনই বিভিন্ন স্থান থেকে নতুন নতুন পদ এসেও নতুন ছড়ার অঙ্গে জুড়ে যেতে পারে । রবীন্দ্রনাথের সংগ্রহে একটি ছেলে খেলার ছড়া এই প্রকার-

“আয়রে আয় ছেলের পাল মাছ ধরতে যাই। মাছের কাঁটা পায়ে ফুটল দোলায় চেপে যাই। দোলায় আছে ছ’পন কড়ি গুণতে গুণতে যাই৷৷ এ নদীর জলটুকু টলমল করে। এ নদীর ধারেতে ভাই বালি ঝুর ঝুর করাে৷৷ চাঁদমুখেতে রােদ লেগেছে রক্ত ফুটে পড়ে৷৷ “

সুতরাং এর থেকে আমরা বলতে পারি ছড়া মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত ঝংকারময় পদ্য। এটি সাধারণত স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত।

কোনটাকে ছড়া বলব আর কোনটাকে কবিতা –

১)কবিতাতে শিক্ষামূলক অনেক কিছু থাকে কিন্তু ছড়ায় শিক্ষামূলক তেমন কিছু থাকে না।

২) কবিতায় একটি বাস্তবিক কাহিনী থাকে। অন্যদিকে ছড়ায় বাস্তবিক কাহিনী থাকে না। এটা বেশিরভাগ অবাস্তবিক।

৩) কবিতায় ভাষা সবসময় সহজবোধ্য ও সুস্পষ্ট হয়। অন্যদিকে ছড়ার ভাষায় রহস্যময়তা থাকে,যা ভালোভাবে বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়।

৫। ছড়া চারপাশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংঘটিত৷ অসংগতিগুলোর ব্যঙ্গ বিদ্রুপ কৌতুক বা কটাক্ষের মাধ্যমে উদ্ভট বা নাটকীয় উপস্থাপিত হতে পারে। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের মতে- রূপের মধ্যে অরূপের সন্ধানই হল কবিতা।

সুতরাং ছড়া মাত্রই কবিতা তা বলা যায় না ৷

ছড়ার শ্রেণীবিভাগ –

ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য তাঁর লোক সাহিত্য’ গ্রন্থে ছড়াকে লৌকিক ছড়া, সাহিত্যিক ছড়া ও আধুনিক ছড়া—এই তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। এছাড়াও ছড়াকে বিভিন্ন প্রকারে ভাগ করা হয়। যেমন- শিশুতোষ ছড়া, রাজনৈতিক ছড়া, ছড়ার ছন্দাশ্রিত কিশোর কবিতা প্রভৃতি। এর মধ্যে শিশুতোষ ছড়া তৈরি হয় কেবলমাত্র শিশু-মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে।লৌকিক ছড়া তৈরী হয় মুখে মুখে। সংসারের অজস্র কাজের ফাঁকে অবােধ শিশুকে ভুলিয়ে রাখার জন্যই ছেলেভুলানাে ছড়াগুলির সৃষ্টি, মায়ের মুখেই তাই ছেলেভুলানাে ছড়ার বিকাশ। দু হাঁটুর উপরে শিশুকে বসিয়ে দোল দিতে দিতে মা ছড়া কাটেন, আর অবােধ শিশু সেই সুরের মায়াজালে আটকে পড়ে। বৃহত্তম অর্থে ঘুমপাড়ানি ছড়াগুলি ছেলেভুলানাে ছড়ার অন্তর্গত হলেও শিশুদের ভােজন, শয়ন, বিশ্রাম, কান্না ইত্যাদি নানাকিছু ছেলেভুলানাে ছড়ার অন্তর্গত। “এ দুধ খায় কে রে/সােনা মুখ যার রে।/ঘন দুধের ছানা, সবাই বলে দেনা…”। দুধ মাখা ভাত, বিলের শাক, সরু চালের ভাত ইত্যাদি নানাকিছুর আয়ােজন থাকে ছেলেভুলানাে ছড়ায়। কান্না থামানাের জন্যও সেখানে থাকে অজস্র আয়ােজন-

হাল করিয়া হাসিয়া দুব দুধ খাইতে গাই। রাখাল রাখিতে দুব শ্যামের ছােট ভাই।

এগুলোকে লৌকিক ছড়া বলে আবার অনেকসময় খেলাকে অবলম্বন করে ছড়াগুলি তৈরি হয়। কখনও ছড়াকে অবলম্বন করেও খেলার পরিকল্পনা হয়। এখানে দু-ধরনের ছড়া পাওয়া যায়। বাইরের খেলাভিত্তিক ছড়া। বাইরের গ্রামীণ খেলার অন্যতম হাডুডু-কে নিয়ে লেখা ছড়া—”চু যা চরণে যাব।/পাতি নেবুর মাতি খাব।”

অন্দরের খেলা ভিত্তিক ছড়া। বৃষ্টির দিনে যখন বাইরে যাওয়া যায় না, সেই সময় ঘরের মধ্যে খেলায় গুণে গুণে নির্দিষ্ট কাউকে চোর ইত্যাদি বানানাের জন্য ছড়া কাটা হত-

আপন বাপন চৌকি চাপন,

ওল, ঢোল, মামার খােল

ওই মেয়েটি খাটিয়া চোর।

কখনও নিজেদের মধ্যে ঝগড়া হলে তাকে মান্যতা দেওয়ার জন্য বলা হত—

“আড়ি আড়ি আড়ি

কাল যাব বাড়ি

পরশু যাব ঘর

কি করবি কর…”।

আবার সাহিত্যিক ছড়া বলতে ছড়া প্রসঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘সুদূর কাল থেকে আজ পর্যন্ত এই কাব্য (ছড়া) যারা আউড়িয়েছে এবং যারা শুনেছে তারা অর্থেও অতীত রস পেয়েছে। ছন্দতে ছবিতে মিলে একটা মোহ এনেছে তাদের মধ্যে। সেই জন্য অনেক নামজাদা কবিতার চেয়ে এর (ছড়া) আয়ু বেড়ে চলেছে।’ এক সময় ছড়াকে মনে করা হতো শুধুই শিশু সাহিত্য। তবে এখন আর তা মনে করা হয় না, বাংলা সাহিত্যে ছড়া তাঁর নিজস্ব অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে।

আধুনিক ছড়া বলতে  বৃটিশ-ইন্ডিয়ায় মুদ্রণযন্ত্রের প্রচলন হলে আমরা জানি যে উনিশ শতকের শেষভাগে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও যোগীন্দ্রনাথ সরকার বাংলা লোকছড়ার সংগ্রহ এবং তা সাহিত্য পত্রিকার মাধ্যমে ও পুস্তকাকারে জনসমক্ষে প্রথম প্রকাশের উদ্যোগ নেন। অতএব মুখে মুখে লোকছড়া রচনাকালের সাথে আধুনিক ছড়া রচনার একটা কালক্রমের আভাস আমরা এ থেকে পেয়ে যাই। আর মুখে মুখে রচিত লোকছড়ার রচয়িতারা যেহেতু সরাসরি কৃষিভিত্তিক সমাজের প্রতিনিধি ছিলেন, তাই লোকছড়ার প্রাণ ও রূপটিও সেই কৃষি-সংশ্লিষ্ট উপাদান, উপকরণ, উপাচার ও জীবনযাত্রাকেই প্রতিফলিত করে। অন্যদিকে আধুনিক ছড়াও তার কালকে কোনভাবেই উপেক্ষা করতে পারে না। তাই লোকায়ত শ্রুতি ও স্মৃতিনির্ভর জীবনধারার বাহুল্যবর্জিত সারল্য, তত্ত্ব-উপদেশমুক্ত লঘু চিন্তা, ভাব ও প্রাকৃত ছন্দ লোকছড়ায় প্রতিফলিত হলেও আধুনিক জীবনধারায় স্বভাবতই তা অধিকতর জটিলরূপে উদ্ভাসিত।আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রেঁনেসাকালে যখন আধুনিক সাহিত্য তার অবয়ব নিতে শুরু করেছে, তখন নমুনা হিসেবে ইউরোপিয় সাহিত্য ছাড়া অন্যতম নিজস্ব লৌকিক সম্পদ হিসেবে ছড়ানো ছিটানো ছিলো বিপুল পরিমাণ বাংলা প্রাকৃত লোকছড়ার উজ্জ্বল উপস্থিতি। ফলে ছড়া একটি পৃথক আঙ্গিক হিসেবে রূপলাভ করার আগ পর্যন্ত সাহিত্যের গঠনবৈচিত্র্যে এর ব্যাপক প্রভাব আমরা লক্ষ্য করি। বলা যায় লোকছড়াই বাংলা সাহিত্যের আদি প্রাণ।

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>