চলো গল্প শুনি: জলসত্র । বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
বৃদ্ধ মাধব শিরোমণিমশায় শিষ্যবাড়ি যাচ্ছিলেন।……..বেলা তখন একটার কম নয়। সূর্য মাথার উপর থেকে একটু হেলে গিয়েছে। জ্যৈষ্ঠমাসের খররৌদ্রে বালি গরম, বাতাস একেবারে আগুন, মাঠের চারিধারে কোনোদিকে কোনো সবুজ গাছপালার চিহ্ন চোখে পড়ে না। এক-আধটা বাবলা গাছ যা আছে তাও পত্রহীন। মাঠের ঘাস রোদপোড়া—কটা।
ব্রাহ্মণের কাপড়চোপড় গরম হাওয়ায় আগুন হয়ে উঠল, আর গায়ে রাখা যায় না। এক একটা আগুনের ঝলকের মতো দমকা হাওয়ায় গরম বালি উড়ে এসে তাঁর চোখে মুখে তীক্ষ হয়ে বিঁধছিল। জ্যৈষ্ঠমাসের দুপুরবেলা এ-মাঠ পার হতে যাওয়া যে ইচ্ছে করে প্রাণ দিতে যাওয়ার শামিল, এ কথা নবাবগঞ্জের বাজারে তাঁকে অনেকে বলেছিল, তবুও যে তিনি কারুর কথা না-শুনে জোর করেই বেরুলেন, সে কেবল বোধহয় কপালে দুঃখ ছিল বলেই।
পশ্চিম দিকে অনেক দূরে একটা উলুখড়ের খেত গরম বাতাসে মাথা দোলাচ্ছিল। যে–দিকে চোখ যায়, সেদিকেই কেবল চকচকে খরবালির সমুদ্র। ব্রাহ্মণের ভয়ানক তৃষ্ণা পেল, গরম বাতাসে শরীরের সব জল যেন শুকিয়ে গেল, জিব জড়িয়ে আসতে লাগল। তৃষ্ণা এত বেশি হল যে, সামনে ডোবার পাতা-পচা কালো জল পেলেও তা তিনি আগ্রহের সঙ্গে পান করেন। কিন্তু নবাবগঞ্জ থেকে রতনপুর পর্যন্ত সাড়ে চার ক্রোশ বিস্তৃত এই প্রকাণ্ড মাঠটার মধ্যে যে কোথাও জল পাওয়া যায় না, তা তো তাঁকে কেউ কেউ বাজারেই বলেছিল। এ কষ্ট তাঁকে ভোগ করতেই হবে।
ব্রাহ্মণ কিন্তু ক্রমেই ঘেমে-নেয়ে উঠতে লাগলেন। তাঁর কান দিয়ে, নাক দিয়ে নিঃশ্বাসে যেন আগুনের ঝলক বেরুতে লাগল। জিব জোর করে চুষলেও তা থেকে আর রস পাওয়া যায় না, ধুলোর মতো শুকনো। চারিদিকে ধু-ধু মাঠ খররৌদ্রে যেন নাচছে…চকচকে বালিরাশি রোদ ফিরিয়ে দিচ্ছে…মাঝে মাঝে ছোটো ছোটো ঘূর্ণি হাওয়া গরম বালি-ধুলো-কুটো উড়িয়ে নাকে-মুখে নিয়ে এনে ফেলছে।
অসহ্য পিপাসায় তিনি চোখে ধোঁয়া-ধোঁয়া দেখতে লাগলেন। মনে হতে লাগল—একটু ঘন সবুজ মতো যদি কোনো পাতাও পাই তাহলে চুষি…জীবনে তিনি যত ঠান্ডা জল খেয়েছিলেন তা এইবার তাঁর একে একে মনে আসতে লাগল। তাঁর বাড়ির পুকুরের জল কত ঠান্ডা…পাহাড়পুরের কাছারির ইদারার জল সে তো একেবারে বরফ…কবে তিনি শিষ্যবাড়ি গিয়েছিলেন, বৈশাখ মাসের দিন তারা তাঁকে বড়ো সাদা কাঁসার ঘটি করে নতুন কলসীর জল খেতে দিয়েছিল, সে জল একেবারে হিম, খাবার সময় দাঁত কনকন করে।
আচ্ছা, এখন যদি সেই রকম এক ঘটি জল কেউ তাঁকে দেয়?…তাঁর তৃষ্ণাটা হঠাৎ বেড়ে গিয়ে বুকের কলজে পর্যন্ত যেন শুকিয়ে উঠল। এ মাঠটাকে এ অঞ্চলে বলে কচু-চুষির মাঠ। তাঁর মনে পড়ল তিনি শুনেছিলেন, এ জেলার মধ্যে এত বড়ো মাঠ আর নেই; আগে আগে অনেকে নাকি বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসের দুপুরে এ-মাঠ পার হতে গিয়ে সত্যি প্রাণ হারিয়েছে, গরম বালির ওপর তাদের নির্জীব দেহ লুটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে।
অসহ্য জল-তৃষ্ণায় তারা আর চলতে অক্ষম হয়ে গরম বালির ওপর ছটফট করে প্রাণ হারিয়েছে।…সত্যিই তো!…এখনও তো দু-ক্রোশ দূরে গ্রাম…যদি তিনিও?……….শুধু মনের জোরে তিনি পথ চলতে লাগলেন। এই পথ-হাঁটার শেষে কোথায় যেন এক ঘটি ঠান্ডা কনকনে হিমজল তাঁর জন্যে কে রেখে দিয়েছে, পথ-হাঁটার বাজি জিতলে সেই জলঘটিটাই যেন তাঁর পুরস্কার, এই ভেবেই তিনি কলের পুতুলের মতো চলছিলেন। আধক্রোশটাক পথ চলে উলুখড়ের বনটা ডাইনে ফেলেই দেখলেন, বোধহয় আর আধক্রোশ পথ দূরে একটা বড়ো বটগাছ। গাছটার তলায় কোনো পুকুর হয়তো থাকতে পারে, না-থাকে, ছায়াও তো আছে?
বটতলায় পৌঁছে দেখলেন একটা জলসত্র। চার-পাঁচটা নতুন জালায় জল, একপাশে একরাশি কচি ডাব! এক ধামা ভিজে ছোলা, একটা বড়ো জায়গায় অনেকটা নতুন আখের গুড়, একটা ছোটো ধামায় আধ ধামা বাতাসা! বাঁশের চেরা একটা খোল কাতার দড়ি দিয়ে আর একটা বাঁশের খুঁটির গায়ে বাঁধা। একজন জালা থেকে জল উঠিয়ে চেরা বাঁশের খোলে ঢেলে দিচ্ছে। আর লোকে বাঁশের খোলের এ-মুখে অঞ্জলি পেতে জল পান করছে।
গাছতলায় যারা বসেছিল, ব্রাহ্মণ দেখে শিরোমণি মহাশয়কে তারা খুব খাতির করলে। একজন জিজ্ঞাসা করলে—ঠাকুরমশায়ের আগমন হচ্ছে কোথা থেকে?………একজন বলল—আহা, সে-কথা রাখো, বাবা-ঠাকুর আগে ঠান্ডা হোন। শিরোমণিমশায় যেখানে বসলেন, সেখানে প্রকাণ্ড বটগাছটা প্রায় দু-তিন বিঘা জমি জুড়ে আছে। হাতির শুড়ের মতো লম্বা ঝুরি চারিদিকে নেমেছে!…একজন তাঁকে তামাক সেজে দিয়ে একটা বটপাতা ভেঙে নিয়ে এল নল করবার জন্যে।…আ:, কী ঝিরঝিরে হাওয়া। এই অসহ্য পিপাসা ও গরমের পর এমন ঠান্ডা ঝিরঝিরে বাতাস ও তৈরি-তামাকে তাঁর তৃষ্ণাও যেন অনেকটা কমে গেল।
তামাক খাওয়া শেষ হল। একজন বললে—ঠাকুরমশায়, হাত-পা ধুয়ে ঠান্ডা হোন। ভালো সন্দেশ আছে ব্রাহ্মণদের জন্যে আনা, সেবা করে একটু জল খান, এই রোদে এখন আর যাবেন না—বেলা পড়ুক।…………তারপর শিরোমণিমশায় জিজ্ঞাসা করলেন—এ জলসত্র কাদের?…………—আজ্ঞে ওই আমডোবের বিশ্বেসদের। শ্ৰীমন্ত বিশ্বেস আর নিতাই বিশ্বেস নাম শুনেছেন? শিরোমণিমশায় বললেন—বিশ্বেস? সদগোপ?………………..–আজ্ঞে না, কলু।
সর্বনাশ! নতুন মাটির জালা ভর্তি জল ও কচি ডাবের রাশি দেখে পিপাসার্ত শিরোমণিমশায় যে আনন্দ অনুভব করেছিলেন, তা তাঁর এক মুহূর্তে কপূরের মতো উবে গেল। কলুর দেওয়া জলসত্রে তিনি কী করে জল খাবেন? তিনি নিজে এবং তাঁর বংশ চিরদিন অশূদ্রে প্রতিগ্রাহী; আজ কি তিনি—ওঃ! ভাগ্যে কথাটা জিজ্ঞাসা করেছিলেন।নইলে, এখনি তো………..শিরোমণিমশায় জিজ্ঞাসা করলেন—এ জলসত্র কতদিনের দেওয়া?……—তা আজ প্রায় পনেরো-ষোলো বছর হবে। শ্ৰীমন্ত বিশ্বেসের বাপ তারাচাঁদ বিশ্বেস এই জলসত্র বসিয়ে যায়। সে হয়েছিল কী বলি শুনুন। বলে লোকটা সেই কাহিনি বলতে আরম্ভ করলে।
আমডোবের তারাচাঁদ বিশ্বেস যখন ছোটো, চোদ্দো-পনেরো বছর বয়স, তখন তার বাপ মারা যায়। সংসারে কেবল ন-দশ বছরের একটি বোন ছাড়া তারাচাঁদের আর কেউ ছিল না। ভাই-বোনে মাথায় করে কলা-বেগুন-কুমড়ো এইসব হাটে বিক্রি করত; এতেই তাদের সংসার চলত। সেবার বোশেখ মাসের মাঝামাঝি তারাচাঁদ ছোটো বোনটিকে নিয়ে নাবাবগঞ্জের হাটে তালশাঁস বিক্রি করতে গিয়েছিল।
ফেরবার সময় তারাচাঁদ মাঠের আর কিছু ঠিক পায় না—নবাবগঞ্জ থেকে রতনপুর পর্যন্ত এই মাঠটা সাড়ে চার ক্রোশের বেশি হবে তো কম নয়। কোথাও একটা গাছ পর্যন্ত নেই। বোশেখ মাসের দুপুর রোদে মাঠ বেয়ে আসতে তারাচাঁদের ছোটো বোনটা অবসন্ন হয়ে পড়ল। তারাচাঁদের নিজের মুখে শুনেছি ছোটো বোনটি মাঠের মাঝামাঝি এসে বললে—দাদা, আমার বড়ো তেষ্টা পেয়েছে, জল খাব।
তারাচাঁদ তাকে বোঝালে, বললে—একটু এগিয়ে চল, রতনপুরের কৈবর্ত পাড়ায় জল খাওয়াব।……সেই ‘একটু এগিয়ে’ মানে দু-ক্রোশের কম নয়। আর খানিকটা এসে মেয়েটা তেষ্টায় রোদে অবসন্ন হয়ে পড়ল। বারবার বলতে লাগল—ও দাদা, তোর দুটি পায়ে পড়ি, দে আমায় একটু জল…
তারাচাঁদ তাকে কোলে তুলে নিয়ে এই বটগাছটার ছায়ায় নিয়ে এসে ফেললে। ছোটো মেয়েটা তখন আর কথা বলতে পারছে না। তারাচাঁদ তার অবস্থা দেখে তাকে নামিয়ে রেখে ছুটে জলের সন্ধানে গেল। এখান থেকে আধক্রোশ তফাতে রতনপুরের কৈবর্তপাড়া থেকে এক ঘটি জল চেয়ে এনে দেখে, তার ছোটো বোনটা গাছতলায় মরে পড়ে আছে, তার মুখে একটা কচুর ডগা! এই বটগাছটা তখন ছোটো ছিল, ওরই তলায় অনেক কচুবন ছিল। তেষ্টার যন্ত্রণায় মেয়েটা সেই বুনো কচুর ডগা মুখে করে তার রস চুষেছিল—সেই থেকে এই মাঠটার নাম হোল কচু-চুষির মাঠ।
তারাচাঁদ বিশ্বেস ব্যাবসা করে বড়োলোক হয়েছিল। শুনেছি নাকি তার সে বোন তাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলত—দাদা, ওই মাঠের মধ্যে সকলের জল খাবার জন্য তুই একটা জলসত্র করে দে।…তাই তারাচাঁদ বিশ্বেস এখানে এই বটগাছ পিতিষ্ঠে করে জলসত্র বসিয়ে গেছে—সে আজ পনেরো-ষোলো কী বিশ বছরের কথা হবে। ঠাকুরমশায়, কচু-চুষির মাঠের এ-জলসত্র এদিকের সকলেই জানে। বলব কি বাবা ঠাকুর, এমনও শুনেছি যে মাঠের মধ্যে জলতেষ্টায় বেঘোরে পড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে, এমন লোক নাকি কেউ কেউ দেখেছে একটা ছোটো মেয়ে মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে বলছে—ওগো আমি জল দেব, তুমি আমার সঙ্গে এসো।…
লোকটা তার কাহিনি শেষ করলে; তারপর বললে—সত্যি-মিথ্যে জানিনে ঠাকুরমশায়, লোকে বলে তাই শুনি, বোশেখ মাসের দিন ব্রাহ্মণের কাছে মিথ্যে বলে কী শেষকালে……..লোকটা দুই হাতে নিজের কান মলে কপালে দু-হাত ঠেকিয়ে এক প্রণাম করলে।
বেলা পড়ে এল। কত লোক জলসত্রে আসতে-যেতে লাগল। একজন চাষা পাশের মাঠ থেকে লাঙল ছেড়ে বটতলায় উঠল। ঘেমে সে নেয়ে উঠেছে। একটু বিশ্রাম করে সে তৃপ্তির সঙ্গে ছোলা, গুড় আর জল খেয়ে বসে গল্প করতে লাগল।
এক বুড়ি অন্য গ্রাম থেকে ভিক্ষা করে ফিরছিল। গাছতলায় এসে সে ঝুলি নামিয়ে একটু জল চেয়ে নিয়ে হাত-পা ধুলে। একজন বললে—আবদুলের মা, একটা ডাব খাবা?…….আবদুলের মা একগাল হেসে বললে—তা দ্যাও দিকি মোরে, আজ অ্যাকটা খাই। মরব তো, খেয়েই মরি।
একজন লোক পরনে টাটকা কোরা কাপড়ের ওপর নতুন পাটভাঙা ধপধপে সাদা টুইলের শাট, হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তোলা পায়ে এক-পা ধুলো, বটতলায় এসে হাতাশভাবে ধপ করে বসে পড়ল। কেউ জিজ্ঞাসা করলে—ছমিরুদ্দি মিঞা যে, আজ ছানির দিন ছিল না?
ছমিরুদ্দি সম্পূর্ণ ভদ্রতাসংগত নয় এরূপ একটি বাক্য উচ্চরণ করে ভূমিকা ফেঁদে তার মোকদ্দমার একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণনা করে গেল এবং যে উকিলের হাতে তার কেস ছিল, তার সম্বন্ধে এমন কতকগুলো মন্তব্য প্রকাশ করলে যে, তিনি সেখানে উপস্থিত থাকলে ছমিরুদ্দির বিরুদ্ধে আর একটা কেস হত। তারপর সে পোয়াটাক আখের গুড়ের সাহায্যে আধসের আন্দাজ ভিজে ছোলা উদরসাৎ করে একছিলিম তামাক খেয়ে বিদায় নিলে।
ক্রমে রোদ পড়ে গেল। বৈকালের বাতাসে কাছেরই একটা ঝোপ থেকে ডাঁশা খেজুরের গন্ধ ভেসে আসছিল। হলুদ রং-এর সোঁদালি ফুলের ঝাড় মাঠের পেছনটা আলো করে ছিল। একটা পাখি আকাশ বেয়ে ডানা মেলে চলেছিল—বউ কথা-ক–বউ কথা-ক।
শিরোমণি মশায়ের বসে বসে মনে হল, বিশ বছর আগে, তাঁর আট বছরের পাগলি মেয়ে উমার মতোই ছোটো একটি মেয়ে এই বটতলায় অসহ্য পিপাসায় জল অভাবে বুনো কচুর ডাঁটার কচু রস চুষেছিল, আজ তারই স্নেহ করুণা এই বিরাট বটগাছটার নিবিড় ডালপালায় বেড়ে উঠে এই জলকষ্টপীড়িত পল্লি-প্রান্তরের একধারে পিপাসার্ত পথিকদের আশ্রয় তৈরি করেছে।
এরই তলায় আজ বিশ বছর ধরে সে মঙ্গলরূপিণী জগদ্ধাত্রীর মতো দশহাত বাড়িয়ে প্রতি নিদাঘ-মধ্যাহ্নে কত পিপাসাতুর পল্লি-পথিককে জল জোগাচ্ছে!…চারিধারে যখন সন্ধ্যা নামে…তপ্ত মাঠ যখন ছায়া-শীতল হয়ে আসে…তখনই কেবল সমস্ত দিনের পরিশ্রমের পর সে-মেয়েটি অস্ফুট জ্যোৎস্নায় শুভ্র-আঁচল উড়িয়ে কোন অজ্ঞাত ঊর্ধ্বলোকে তার নিজের স্থানটিতে ফিরে চলে যায়।…তার পৃথিবীর বালিকা-জীবনের ইতিহাস সে ভোলেনি।
যে-লোকটা জল দিচ্ছিল, তার নাম চিনিবাস, জাতে সদগোপ। শিরোমণিমশায় তাকে বললেন—ওহে বাপু, তোমার ওই বড়ো ঘটিটা বেশ করে মেজে একঘটি জল আমায় দাও, আর ইয়ে—ব্রাহ্মণের জন্য আনা সন্দেশ আছে বললে না?….
কথাসাহিত্যিক। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টম্বর পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনা জেলার কাঁচরাপাড়ার নিকটবর্তী ঘোষপাড়া-মুরারিপুর গ্রামে মাতুলালয়ে জন্ম। তাঁর পৈতৃক নিবাস ওই জেলারই ব্যারাকপুর গ্রামে। পিতা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সংস্কৃত পন্ডিত; পান্ডিত্য ও কথকতার জন্য তিনি ‘শাস্ত্রী’ উপাধিতে ভূষিত হন।
স্বগ্রামের পাঠশালায় বিভূতিভূষণের পড়াশোনা শুরু হয়। তিনি বরাবরই একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। এন্ট্রান্স (১৯১৪) ও আইএ (১৯১৬) উভয় পরীক্ষায় তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। বিএ (১৯১৮) পরীক্ষায়ও তিনি ডিসটিংকশনসহ পাস করেন। পরে এমএ ও আইন বিষয়ে ভর্তি হয়েও পাঠ অসমাপ্ত রেখে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি হুগলির একটি মাইনর স্কুলে শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করেন। কিছুদিন তিনি ‘গোরক্ষিণী সভা’র ভ্রাম্যমাণ প্রচারক হিসেবে বাংলা, আসাম, ত্রিপুরা ও আরাকানের বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণ করেন। পরে তিনি খেলাৎচন্দ্র ঘোষের বাড়িতে সেক্রেটারি ও গৃহশিক্ষক এবং তাঁর এস্টেটের ভাগলপুর সার্কেলের সহকারী ম্যানেজার হন। পরে ধর্মতলাস্থ খেলাৎচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করার পর তিনি গোপালনগর স্কুলে যোগদান করেন এবং আমৃত্যু সেখানেই কর্মরত ছিলেন।
১৩২৮ বঙ্গাব্দের (১৯২১) মাঘ প্রবাসীতে প্রথম গল্প ‘উপেক্ষিতা’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে বিভূতিভূষণের সাহিত্যিক জীবন শুরু হয়। ভাগলপুরে চাকরি করার সময় ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি পথের পাঁচালী রচনা শুরু করেন এবং শেষ করেন ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো: অপরাজিত (১৯৩১), মেঘমল্লার (১৯৩১), মৌরীফুল (১৯৩২), যাত্রাবদল (১৯৩৪), চাঁদের পাহাড় (১৯৩৭), কিন্নরদল (১৯৩৮), আরণ্যক (১৯৩৯), আদর্শ হিন্দু হোটেল (১৯৪০), মরণের ডঙ্কা বাজে (১৯৪০), স্মৃতির রেখা (১৯৪১), দেবযান (১৯৪৪), হীরামানিক জ্বলে (১৯৪৬), উৎকর্ণ (১৯৪৬), হে অরণ্য কথা কও (১৯৪৮), ইছামতী (১৯৫০), অশনি সংকেত (১৯৫৯) ইত্যাদি।
পথের পাঁচালী বিভূতিভূষণের শ্রেষ্ঠ রচনা। প্রথম রচিত এই উপন্যাসের মাধ্যমেই তিনি বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। অপরাজিত পথের পাঁচালীরই পরবর্তী অংশ। উভয়গ্রন্থে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের ছায়াপাত ঘটেছে। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় পথের পাঁচালীকে চলচ্চিত্রে রূপদানের মাধ্যমে তাঁর পরিচালক জীবন শুরু করেন এবং এর জন্য তিনি দেশিবিদেশী বহু পুরস্কার লাভ করেন। তিনি অপরাজিত এবং অশনি সংকেত উপন্যাস দুটি অবলম্বনেও অসাধারণ চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রশংসিত হন। পথের পাঁচালী উপন্যাসটি ভারতীয় বিভিন্ন ভাষাসহ ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
নিভৃতচারী এই কথাশিল্পীর রচনায় পল্লীর জীবন ও নিসর্গ রূপায়ণে বাংলার আবহমানকালের চালচিত্র ও মানবজীবনের অন্তর্লীন সত্তা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রচনায় প্রকৃতি কেবল প্রকৃতিরূপেই আবির্ভূত হয়নি, বরং প্রকৃতি ও মানবজীবন একীভূত হয়ে অভিনব রসমূর্তি ধারণ করেছে। মানুষ যে প্রকৃতিরই সন্তান এ সত্য তাঁর বিভিন্ন রচনায় প্রতিফলিত হয়েছে। প্রকৃতির লতাপাতা, ঘাস, পোকামাকড় সবকিছুই গুরুত্বের সঙ্গে স্বস্বভাবে তাঁর রচনায় স্থান পেয়েছে। প্রকৃতির অনুপুঙ্খ বর্ণনার মধ্য দিয়ে বিভূতিভূষণ গভীর জীবনদৃষ্টিকেও তুলে ধরেছেন। তবে তাঁর রচনায় নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালির জীনবচিত্র ও সমকালের আর্থসামাজিক বাস্তবতাও সমভাবে উন্মোচিত হয়েছে। তাই বাংলা কথাসাহিত্যে শরৎচন্দ্রের পরে বিভূতিভূষণই সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় সাহিত্যিকের মর্যাদা পেয়েছেন।
সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি বিভূতিভূষণ সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেন। তিনি চিত্রলেখা (১৯৩০) নামে একটি সিনেমা পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তাছাড়া হেমন্তকুমার গুপ্তের সঙ্গে যৌথভাবে তিনি দীপক (১৯৩২) পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ইছামতী উপন্যাসের জন্য বিভূতিভূষণ মরণোত্তর ‘রবীন্দ্র-পুরস্কার’ (১৯৫১) লাভ করেন। ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর ব্যারাকপুরের ঘাটশিলায় তাঁর মৃত্যু হয়।