ভাষার উপনিবেশ বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (পর্ব-১)
বাংলা ভাষার উদ্ভব, উনিশ শতকে কলিকাতার সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতদের দ্বারা সংস্কৃতায়িত বাংলার সৃষ্টি, বাঙালির সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে গত দুইশ বছর ধরে পরতে পরতে লেখা হয়েছে মিথ্যা আর ভুল তথ্যভিত্তিক বানোয়াট ইতিহাস। দুইশ বছর ধরে আমরা অইসব ভুল বা বানানো ইতিহাস মেনে নিয়ে এর ভিত্তিতেই পুনরায় আমাদের ভাষা আর সংস্কৃতির বয়ান রচনা করে গেছি। আর এভাবে বাংলা ভাষা পরিণত হয়েছে সংস্কৃতের উপনিবেশে। এই প্রথমবারের মত বানানো ইতিহাসের স্তর খুঁড়ে বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বাঙালি সংস্কৃতির রদবদলের আদত ইতিহাস উদঘাটনের চেষ্টা চালিয়েছেন উত্তর উপনিবেশী তাত্ত্বিক ফয়েজ আলম তার “ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস”বইয়ে।
ফয়েজ আলম ঐতিহাসিক ও ভাষাতাত্ত্বিক তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে দেখিয়েছেন ‘বাংলা ভাষা সংস্কৃতের কন্যা’ এটি সচেতন চেষ্টায় তৈরি একটি মিথ্যা বয়ান, যে মিথ্যা রচনার পিছনে কাজ করেছে ধর্মীয় আবেগ ও উপনিবেশি প্রশাসকদের প্রশ্রয়। আসলে সংস্কৃত এবং বাংলা দুটো ভাষাই এসেছে স্থানীয় ভাষা থেকে (যাকে প্রাকৃত ভাষা বলা হয়ে থাকে)। প্রাচীনকালে ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে (বর্তমান পাকিস্তানের অংশ বিশেষসহ) প্রচলিত স্থানীয় ভাষাকে কিছু নিয়মে বেঁধে দেন পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির বাসিন্দা পাণিনি নামের এক পন্ডিত; সেটিই পরে ধর্মচর্চা আর ধর্মীয় লেখাজোকায় কাজে লাগানো হয় আর সংস্কৃত ভাষা নাম পায়। এটি কখনো কোনো মানবগোষ্ঠির মুখের ভাষা ছিলো না। একই সময়ে আমাদের দেশে প্রচলিত স্থানীয় ভাষা মানুষের মুখে মুখে স্বাভাবিক রদবদলের নানা ধাপ পার হয়ে ৬৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি বাংলা ভাষার আদি রূপ নেয় । সংস্কৃতের সাথে বাংলার কোনো সরাসরি সম্পর্কই নাই। অথচ দুইশ বছর ধরে ভাষার ইতিহাসে আর পাঠ্য বইপুস্তকে বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতের মা বানিয়ে রাখা হয়েছে। এরকম অনেক বানোয়াট ধারণা ভেঙ্গে দিয়েছেন ফয়েজ আলম ভাষার উপনিবেশ বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস এই ধারাবাহিকে আজ থাকছে পর্ব- ১।
উপনিবেশি শাসনের প্রশ্রয়ে বাংলা ভাষার রূপান্তর আর নির্মাণের ইতিহাসে ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড, উইলিয়াম জোনস ও উইলিয়াম কেরি গুরুত্বপূর্ণ তিন নাম। সংস্কৃত ভাষা সম্পর্কে এদের নিজেদের জানা, বোঝা আর তার প্রকাশ্য ঘোষণা উনিশ শতকের শুরুতে ভাষা হিসাবে বাংলার বিকাশের গতিপথ অনেকটাই ঠিক করে দিয়েছিলো। এদের মধ্যে হ্যালহেড ও জোনস ছিলেন সরাসরি উপনিবেশক, কেরি খ্রিস্টের মাহাত্ম্য প্রচারক ধর্মযাজক যে-ভূমিকা শেষপর্যন্ত এদেশে বৃটিশ উপনিবেশ ভালোভাবে প্রতিষ্ঠা আর টিকিয়ে রাখার কাজেই লেগেছে।
১৭৭৮ সালে হ্যালহেড তার A Grammar of the Bengal Language -এর মুখবন্ধে লেখেন: “সংস্কৃত হলো ভারতীয় সাহিত্যের মহত্তম উৎস, পারস্য উপসাগর থেকে চীন সাগর পর্যন্ত প্রচলিত প্রায় প্রতিটি কথ্য ভাষার জন্মদাতা”।১ এবং হিন্দুস্তানের পবিত্র ভাষা সংস্কৃত থেকে সরাসরি বাংলার ভাষার উৎপত্তি। এর বছর সাতেক পর ১৭৮৬ সালের ফেব্রুয়ারীতে কোলকাতায় রয়্যাল সোসাইটি অব বেঙ্গল-এ সভাপতির তৃতীয় বার্ষিক বক্তৃতায় উইলিয়াম জোনস ঘোষণা করেন সংস্কৃত ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব। তিনি বলেন:
সংস্কৃতের প্রাচীনত্ব যাই হোক এর গঠন চমৎকার, গ্রীকের চেয়ে নিখুঁত, প্রাচুর্য্যে লাতিনকে ছাড়িয়ে, এবং এগুলোর তুলনায় অসাধারণ পরিশীলিত। এ সত্ত্বেও ক্রিয়ামূল ও ব্যাকরণ উভয় দিক থেকে ঐ দুই ভাষার সাথে সংস্কৃতের যে-প্রবল আত্মীয়তা তা কোন দুর্ঘটনাক্রমে হতে পারে না। এই সমন্ধ এতটাই ঘনিষ্ট যে এ তিন ভাষা পরীক্ষা করতে গেলে যে কোন ভাষাতাত্ত্বিকের অবশ্যই মনে হবে এগুলো কোন একক উৎস থেকে জন্ম নিয়েছে এখন হয়তো সেটি আর টিকে নেই।২
এরপর জোনস বিভিন্ন আলোচনা, নিবন্ধ রচনা, হিতোপদেশ-এর অনুবাদ, কালিদাসের নাটক শকুন্তলা’র অনুবাদ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে ইউরোপে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যকে বেশ একটা পরিচিতির জায়গায় নিয়ে যান।
হ্যালহেড যখন Bengal Language Grammar লেখেন তখন ভারতীয় ভাষার ইতিহাস লেখার বওনি হয়েছে মাত্র। সে সময় কারো জানা ছিলো না সংস্কৃতের সাথে বাংলার মিল এজন্য যে, উভয় ভাষাই একই মূল প্রাকৃত অর্থাৎ সাধারণ মানুষের ভাষা থেকে এসেছে: প্রাকৃতের এক আঞ্চলিক রূপ নিয়ে একে ঘঁষেমেজে আলাদা করে নিয়ে পানিনি তৈরি করেন ‘পরিশুদ্ধ’ বা ‘সংস্কৃারকৃত’ ভাষার নিয়মাবলী ও নমুনা, যা কখনো কোন জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা ছিলো না; আর আরেক অঞ্চলের প্রাকৃতের রূপ থেকে স্বাভাবিক বিবর্তনের মাধ্যমে জন্ম হয় বাংলা ভাষার। বাংলার মতই ভারতের (দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠী ব্যতিত) অন্যসব প্রচলিত ভাষা বিভিন্ন অঞ্চলের প্রাকৃতের বৈচিত্র থেকে কালক্রমে বিকশিত হয়েছে। তাই এসকল ভাষার সাথে সংস্কৃতের এবং ভাষাগুলোর নিজেদের মধ্যে এমন গভীর মিল। সুদূর ইংল্যান্ড থেকে টাকা রোজগারের জন্য বাংলায় আসা হ্যালহেডের এ রকম গভীর গবেষণাসুলভ বিষয়ে কোন পরিষ্কার ধারণা থাকার কথা নয়। তিনি এখানে এসে চাকরির দরকারে বাংলা ভাষাটা ভালো করে শিখে নেন আর উপনিবেশি প্রভুর জাতের শরীক হিসাবে উপনিবেশের মানুষের বিভিন্ন বিষয়ে ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে ঢালাও মন্তব্য শুরু করেন। শব্দভান্ডারের সাদৃশ্য আর ব্যাকরনের মিল দেখে ঘোষণা দেন সংস্কৃত হলো ভারতের তাবত জীবিত ভাষার মা-বাপ।
বাংলা, অহমিয়া, হিন্দিসহ প্রায় সকল ভারতীয় ভাষা প্রাকৃত থেকে বিকশিত হওয়ার কারণে এদের মধ্যে প্রচুর মিল। এমনও তো হতে পারত হ্যালহেড এগুলোর একটাকে আরেকটার মা হিসাবে ঘোষণা দিতে পারতেন। আসলে ভারতে আসার আগেই সংস্কৃত ভাষার প্রাচীনত্ব ও পুরান সাহিত্যিক রচনার প্রাচুর্যের কথা জেনেছিলেন হ্যালহেড তার কালের ও আগের লেখকদের বইপত্র থেকে। এও জানতেন সংস্কৃতের সাদৃশ্য আছে গ্রিক, লাতিন প্রভৃতি ভাষার সাথে। ভারতে এসে সংস্কৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের মুখে শুনে এ ভাষার ধর্মীয় ভক্তিমিশ্রিত উঁচু অবস্থানের কথাও তার মাথায় ঢোকে। একদিকে সংস্কৃত ভাষার প্রাচীনত্বের বিবরণ ও শ্রদ্ধাভক্তির আধিক্য অন্যদিকে, ভারতের বহু কথ্য ভাষার শব্দভান্ডারের সাথে এর মিল দেখে শব্দভান্ডার ও ব্যকরণিক মিলের উপর নির্ভর করে হ্যালহেড সংস্কৃতকেই আর সব ভাষার মা-বাপ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকবেন হয়তো।
যে কারণেই ঘটে থাকুক, ১৭৭৮ সালে হ্যালহেড কর্তৃক ভুলভাবে সংস্কৃতকে ভারতীয় সকল জীবন্ত ভাষার জন্মদাতা ঘোষণা আর ১৭৮৬ সাল থেকে জোনস কর্তৃক এ কথার পনুরাবৃত্তি এবং ইউরোপীয় লেখকদের নিকট সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের গুণকীর্তনের মাধ্যমে তার মহত্ব প্রতিষ্ঠা–এই দুই ঘটনা বাংলা ভাষার উপর সংস্কৃতের ভবিষ্যত পিতৃ-মাতৃত্বের দাবীর পথ পরিষ্কার করে দিয়েছিলো। এরও প্রায় এক যুগ পর যাজক উইলিয়াম কেরি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ছত্রছায়ায় তার বাস্তব রূপ দেন, একদল ভারতীয় পন্ডিতের সহায়তায়। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের তত্ত্বাবধানে নতুন বাংলাগদ্য বানানোর আগে পরে বাংলার উপর সংস্কৃতের এইসব অভিভাবকত্ব-মাতৃত্ব-পিতৃত্ব সম্পর্কিত ঘোষণা, দাবী ও মনোভঙ্গি বাংলা ভাষাকে শাসন করেছে ২০০ বছরেরও অধিক সময় ধরে, এমনকি আজ পর্যন্ত।
আর সব ইংরেজ উপনিবেশকের মতো ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড (১৭৫১-১৮৩০) ভারতে আসেন ভাগ্য পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে। তার আগে প্রথমে হ্যারো স্কুল পরে উইলিয়াম জোনসের পরামর্শে অক্সফোর্ডে প্রাচ্যবিদ্যা পড়েন, পারসি ভাষাও কিছুটা আয়ত্ত করেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাইটার হিসাবে তাকে নিয়োগ দেয়া হয় ১৭৭১ সালের ডিসেম্বরে।
ভারতে এসে মহা হিসাব রক্ষকের কার্যালয়ে যোগদানের পর তাকে বাস্তব জ্ঞান অর্জনের জন্য কাশিমবাজারে পাঠানো হয় কাপড়ের আরঙগুলোর সাথে লেনদেন ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দিয়ে। এ কাজ করতে গিয়ে বাংলা ভাষার সাথে ঘনিষ্ট সংযোগ ঘটে হ্যালহেডের। কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ১৭৭৫ সালে বিবাধ নিরসন সম্পর্কিত হিন্দু আইনের একটি ফারসি বইয়ের ইংরেজী অনুবাদ করেন A Code of Gentoo Laws শিরোনামে। এরপর লিখেন A Grammar of the Bengal Language । ১৭৭৮ সাল হুগলি থেকে ছাপা হয় বইটি। এ কাজের জন্যই প্রথম বাংলা মুদ্রণযন্ত্র স্থাপিত হয় হুগলিতে। বইয়ে ব্যবহৃত বাংলা অক্ষর খোদাই করেন পঞ্চানন কর্মকার; তত্ত্বাবধান করেন উইলকিনস।
ঐ সময় বৈষয়িক স্বার্থ ছাড়া বইপত্র লেখার পেছনে সময় দেয়ার কোন কারণ ছিলো না ইংরেজদের। বইটির মুখবন্ধে রচনার পটভূমি সম্পর্কে লম্বা ব্যাখ্যা দিয়েছেন হ্যালহেড। বাংলাদেশে বৃটিশদের শাসনের সূচনা হয়েছে উল্লেখ করে হ্যালহেড লিখেন যে, এখন অন্যতম গুরুপূর্ণ কাজ হলো প্রজার জাতকে সঠিকভাবে চিনে নেয়া আর তাদের সাথে আলাপ-আলোচনার ও ভাব বিনিময়ের জন্য একটি সাধারণ (ভাষিক) মাধ্যম সৃষ্টির চেষ্টা করা। কোন উপরি উপরি জ্ঞান তিনি অর্জন করতে চান না, বরং প্রয়োজনীয় সবকিছুকে যথাযথভাবে বুঝতে চান। তিনি লক্ষ্য করেন বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের প্রায় সকলেই দৈনন্দিন কথা বলা, চিঠিপত্রাদি পাঠানো ও যোগাযোগের কাজটা করে বাংলা ভাষায়। এদের সাথে কোম্পানির কর্মচারীদের নিত্যদিনের যোগাযোগ, চিঠিপত্র লেখা, হিসাবের রেকর্ড রাখা এসবই হয়ে থাকে বাংলায়। এর জন্য বিভিন্ন কেন্দ্রে বাঙালি দোভাষীর খরচ বহন করতে হয়। কোম্পানির লোকেরা যদি বাংলা ভাষা শিখে নেয় তাহলে এসবের প্রয়োজন হবে না। হিসাব রক্ষণের কাজ সহজ হবে। কিছু বাড়তি সুবিধা পাওয়া যাবে বিচার সংক্রান্ত কাজেও।
হ্যালহেড মনে করেন বাংলায় অক্ষরের সংখ্যা বেশি। তবে ব্যাকরণের নিয়মগুলো খুব সহজ লাগে তার কাছে। এরপরই তিনি তার ভুল আন্দাজের উপর দাঁড়িয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ শুরু করে, মন্তব্য করেন যে ফারসি না জেনে যেমন আরবি ভাষা ভালোভাবে রপ্ত করা সম্ভব নয়, তেমনি সংস্কৃত বিষয়ে মোটামুটি জ্ঞান অর্জন ছাড়া বাংলা ভালোভাবে শেখা সম্ভব নয়। এই বিশেষ মন্তব্যটিও উনিশ শতকের শুরুতে বাংলা গদ্যচর্চাকারীদেরকে সংস্কৃতের দিকে ঠেলে দেয়ার জন্য দায়ী বলে মনে করি।
হ্যালহেড স্বীকার করেন যুগে যুগে বিভিন্ন জাতি রাজনৈতিক বা অন্যান্য কারণে বাংলাদেশে এসে বসতি করেছে। এভাবেই মুসলমানদের ভাষার বিভিন্ন উপাদান এসে মিশেছে বাংলা ভাষার সাথে। এই ঐতিহাসিক সত্য মেনে নিয়েও তিনি লেখেন:
এ রচনায় বাংলা ভাষাকে নিছক তার মাতৃস্থানীয় সংস্কৃত থেকে জন্ম নেয়া ভাষা হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আমি বেশ খেয়াল রেখেছি যাতে এমন কোন শব্দ আলোচনায় না আসে যেগুলো এদেশীয় নয়। এ কারণে আমি কেবল প্রাচীন আর (দেশীয় হিসাবে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য) রচনা থেকে উদাহরণ নিয়েছি। . . . এ সত্ত্বেও আমি বলবো কেউ যদি বাংলা ভাষায় অনুবাদক হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে চান তাহলে তিনি যেন ফারসি ও হিন্দুস্তানি ভাষাগুলির প্রতি মনোযোগ দেন।৩
শেষে বাংলা হরফ প্রস্তুতের জন্য উইলকিন্সের প্রশসংসা করেন তিনি। উপনিবেশী ক্ষমতার নিচে চাপা পড়ে থাকে বাংলা হরফের আসল প্রস্তুতকারক পঞ্চানন কর্মকারের নাম।
এখানে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি আলাদা দৃষ্টি দেয়া দরকার। প্রথমত, হ্যালহেড জানতেন না স্থানীয় ভাষার সাথে বৈদিক জনগোষ্ঠীর ভাষার সংমিশ্রণে সৃষ্ট প্রাকৃত ভাষা থেকে সংস্কৃত ভাষা প্রস্তুত করা হয়েছিলো। স্বভাবতই সে ভাষায় স্থানীয় ভাষার শব্দভান্ডারের সাথে বৈদিক ভাষার শব্দও ছিলো। বিদেশি বৈদিক শব্দসহ ঐ শব্দরাজিকেই হ্যালহেড দেশী শব্দভান্ডার হিসাবে গ্রহণ করেন। একই ভাবে পরবর্তী সময়ে তুর্কী, আরব, মোঘলরা এদেশে আসে এবং তাদের ভাষার প্রচুর শব্দ ও বাগবিধি বাংলার সাথে মিশে যায়। কিন্তু হ্যালহেড স্বাভাবিক ভাষিক প্রক্রিয়ায় মিশে যাওয়া এসব শব্দকে আবার বিদেশি অনুপ্রবেশ হিসাবে চিহ্নিত করেন এবং তার ব্যাকরণে সেগুলো সতর্কতার বর্জন করেন। যেসব শব্দকে তার আরবী ফারসি তুর্কী মনে হয়েছে সেগুলো তিনি বাদ দেন। কিন্তু ঐ সময় আরবী-ফারসি-তুর্কী-পতুর্গিজ-ইংরেজী শব্দসহ যে ভাষা সেটিই ছিলো বাংলা ভাষা; এ সকল শব্দই যুক্ত হয় বাংলা ভাষার স্বাভাবিক বিকাশ ও বিবতর্নের মধ্যদিয়ে। হ্যালহেড তা বুঝতে পারেননি। তাই প্রচলিত বাংলা ভাষাকে খন্ডিত করে কেবল সংস্কৃত অনুগামী রচনার উদারহরণ নিয়ে সেগুলোর নিয়ম ব্যাখ্যা করেন হ্যালহেড। সমস্ত উদাহরণ নেয়া হয় ধর্মীয় সাহিত্য বিশেষত মহাভারত থেকে। ভাষাকে খন্ডিত করার মতো এমন অনুচিত একটা কাজ কেন করলেন হ্যালহেড? এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তার বইয়ের ভূমিকাতেই।
আরো পড়ুন: উত্তর উপনিবেশবাদ ও অন্যান্য (পর্ব-১) । ফয়েজ আলম
কেবল হ্যালহেডই নয়, যেসব ইংরেজ বাংলায় বা ভারতে বা তাদের কোনো উপনিবেশে থাকতে আসেন তখন তারা সঙ্গে করে নিয়ে আসেন নতুন দেশ আর তার মানুষ ও পরিবেশ সম্পর্কিত কিছু জ্ঞান, যার বেশিরভাগই ধারণা, অনুমান, মিথ্যা-অনুমান এবং উপনিবেশক জাতির বিপুল অহংকার। উপনিবেশক-উপনিবেশিত সম্পর্কটা এরকম একটা অবস্থা নির্ধারণ করে দেয়। হ্যালহেডও আসেন এ রকম মনোভাব নিয়েই। তাই ‘ইংরেজরা এখন বাংলার প্রভু’ কথাটা বলার মধ্যে সেই অহংকারের আনন্দটা উপভোগ করেন তিনি। বাংলাদেশ সম্পর্কে সকল ধারণা, অনুমান এমনকি শোনা গালগল্পকেও সত্য বলে মনে হয় তার। তিনি লেখেন যে, বাঙালি প্রজার জাতকে ইউরোপে খুব নিচু চোখে দেখা হয়। ওখানে প্রায় কেউ-ই বিশ্বাসই করে না যে মুসলমানদের ‘মুর’ ভাষা ছাড়া ওদের (বাঙালিদের) নিজস্ব কোনো ভাষা আছে। তাই ইউরোপীয়দের ‘ভুল ধারণা ভেঙ্গে’ দেয়ার জন্য তিনি বাঙালির দৈনন্দিন কথ্যভাষার ব্যাকরণিক বিশ্লেষণ হাজির করছেন। হ্যালহেড পরিষ্কারই বলেছেন ইউরোপীয়দের ভুল ধারণাটা হলো, মুসলমানদের ‘মুর’ নামের ভাষা ছাড়া বাঙালির নিজস্ব কোনো ভাষা নাই। কাজেই এই ভুল ভাঙাতে হলে ‘মুর’ ভাষা অর্থাৎ মুসলমানের ভাষা থেকে দূরে থাকতে হবে তাকে। হয়তো এ জন্যই বাংলা ভাষার ব্যাকরণ লেখার সময় হ্যালহেড আরবী ফারসি শব্দকে সযতনে এড়িয়ে গেছেন, পাছে ইউরোপীয়রা আবার আরবী ফারসি শব্দের প্রাধান্য দেখে বাংলাকেই ‘মুর’ ভাষা বলে না বসে। ৪
হ্যালহেড উপনিবেশে ভাগ্যান্বেষী ইংরেজ, ভাষাবিজ্ঞানী বা নৃবিজ্ঞানী নন। তার কথা থেকেই জানা যায় তিনি মনে করতেন বাঙলায় মুসলমান একটি জাতি যাদের ভাষার নাম ‘মূর’, আর, বাঙালি আরেকটি জাতি যাদের ভাষা বাংলা। তার জানা ছিলো না বাঙালি জাতির অর্ধেকই মুসলিম এবং ‘বাঙলা’, ‘বাঙালি’ ধারণাগুলি সর্বপ্রথম মুসলমানরাই ব্যবহার করে পরিচিত করে তোলে। তার এও জানা ছিলো না চর্যাপদের পরে প্রাচীনতম বাংলা কাব্যের রচয়িতা শাহ মুহম্মদ সগীর ধর্মের দিক থেকে একজন মুসলমান। মুসলমানদের বাংলায় বসবাসের সূত্রে আরবী-ফারসি শব্দ, বাগধারা, বাগবিধি, অন্যান্য উপাদানের মিশ্রণে এবং সাড়ে পাঁচশ বছরের মুসলিম শাসনামলের পরিচর্যায় বাংলাদেশের সকল ধর্মের মানুষের মায়ের ভাষা হিসাবে যে ভাষা বিকশিত হয় সেটিই বাংলা ভাষা– এ তথ্যও তার জানা থাকার কথা নয়।
মুসলমানরা যখন এদেশে আসে তখন বাংলাভাষা তার সূচনা পর্ব পার করছে। ভাষা বিকাশের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মুসলমানদের মুখের ভাষার সাথে মেশার ফলে আরবী ফারসি শব্দ ও বাকভঙ্গি নিয়ে বাংলা ভাষা ধীরে ধীরে মধ্যযুগীয় সমৃদ্ধির দিকে আগাচ্ছিলো। সংস্কৃত যেমন, তেমনি আরবী ফারসিও বাংলায় আত্তীকৃত শব্দ। আঠারো শতকের বাংলা ভাষায় তার পূর্ণ বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। প্রমথনাথ বিশীর ভাষায়, “এতে ফারসী, বাংলা, সংস্কৃত (এবং ইংরেজী) সমস্ত মিশেল ঘটেছে আর কোনো একটা দিকে ঝোঁক না থাকায় ভারসাম্য ঘটে আগের নমুনাগুলোর চেয়ে সরল ও সুবোধ্য হয়ে উঠেছে।”৫ এইসব গবেষণাসুলভ তথ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাইটার হ্যালহেডের জানার কথা না। তাই ভুল জানা আর অনুমানের উপর দাঁড়িয়ে এই ভারসাম্যপূর্ণ, সরল, সুবোধ্য বাংলা ভাষা থেকে সব আরবী ফারসি শব্দ বাদ দিয়ে অন্যান্য শব্দ নিয়ে ব্যাকরণিক ভাষ্য রচনা করেন হ্যালহেড, যাতে ইউরোপে প্রমাণ করা যায় ‘মুর’ ভাষার সাথে বাংলার কোনো সম্পর্ক নাই।
এখানেই শেষ নয়, সংস্কৃত ভাষার প্রাচীনত্বের প্রমাণস্বরূপ হ্যালহেড আজগুবি গালগল্পও জুড়ে দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন ভাষা, রাজনীতি ও ধর্মের প্রাচীনত্ব নিয়ে খুব গর্ব আছে মিশরের। কিন্তু এই নিয়ে তর্ক আছে। অতপর মিশরের ভাষার প্রাচীনত্ব খর্ব করার জন্য তিনি এক অদ্ভুত অবিশ্বাস্য গল্প হাজির করেন। তিনি লিখেন যে, কৃষ্ণ নগরের রাজা তাকে সম্প্রতি একট বিষয়ে বলেছেন। তার আগে রাজাকে তিনি আঠারো শতকের বাংলার সবচেয়ে বিদ্বান হিসাবে পরিচয় দেন। হ্যালহেডের ভাষ্য:
কৃষ্ণনগরের রাজা সম্প্রতি তাকে নিশ্চিত করেছেন যে, রাজার কাছে এমন কিছু সংস্কৃত বইপত্র আছে যেখানে অতীতে মিশর ও বাংলার মধ্যে গভীর যোগাযোগের কথা বর্ণিত আছে। সেখানে মিশরীয়রা বার বার শিষ্য হিসাবে উল্লিখিত হয়েছে, শিক্ষক হিসাবে নয়, আর বলা হয়েছে তারা ভারতে আসতো হিন্দুস্তানের উদারনৈতিক শিক্ষা এবং বিজ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জনের জন্য। কারণ তাদের দেশ মিশরে অত জ্ঞানী কেউ নাই যে এরূপ জ্ঞান বিতরণ করতে পারেন।৬
এসব থেকে বোঝা যায় হ্যালহেডের মাথায় সংস্কৃতের অতিপ্রাচীনত্ব, সংস্কৃত থেকে বাংলার জন্ম, এবং ‘মুর’ (মুসলমানদের) সম্পর্কে বিশেষ কিছু ভুল ধারণা আগে থেকেই বাসা বেঁধেছিলো। ফলে বাংলা ভাষার সাথে আরবী ফারসির সম্পর্কটাকে ভাষার স্বাভাবিক বিকাশের ফল হিসাবে দেখার দৃষ্টি আগেই হারিয়ে বসেছিলেন তিনি। এমনকি জমিদার কৃষ্ণচন্দ্রের নামে আজগুবি গল্প চালিয়ে দিতেও দ্বিধা করেন নাই।
দ্বিতীয়ত, তিনি নিজেই স্বীকার করেন, বাংলা যেভাবে তার মাতৃস্থানীয় সংস্কৃত ভাষা থেকে বিকশিত হয়েছে (বলে মনে করতেন হ্যালহেড) মোটামুটি সেভাবেই একে উপস্থান করা হয়েছে। তিনি এ সিদ্ধান্তও দেন যে, সংস্কৃত ভাষা মোটামুটি না জেনে বাংলা চর্চায় সাফল্য অর্জন করা যাবে না। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পন্ডিতরা যে সংস্কৃতের অনুকরণে বাংলা গদ্য সৃষ্টির দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন তার পেছনের তাড়না হিসাবে এ পরামর্শও কাজ করে থাকতে পারে বলে ধরে নেয়া যায়। এ প্রবণতা থেকে মুক্তি পাননি পরবর্তী কালের লেখকরাও। তৃতীয়ত, হ্যালহেড কোন অজ্ঞাত কারণে শেষে এই পরামর্শ দেন যে, কেউ যদি বাংলা ভাষায় অনুবাদক হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে চান তাহলে তিনি যেন ফারসি ও হিন্দুস্তানি ভাষাগুলির প্রতি মনোযোগ দেন।
লন্ডনে থাকতেই হ্যালহেডের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিলো জোনস-এর সাথে। Grammar of Bengal Language বইটি উইলিয়াম জোনস কে পাঠানো হয়েছিলো এবং জোনস সেটি ভালোভাবে পড়েছিলেন। রয়্যাল সোসাইটি অব বেঙ্গলের সভাপতির তৃতীয় বার্ষিক বক্তৃতায় সংস্কৃতের সাথে গ্রীক, লাতিন ইত্যাদি ভাষার মিল এবং এগুলো কোন একটা মূল ভাষা থেকে উদ্ভুত হওয়ার ব্যাপারে উইলিয়াম জোনস যা বলেছিলেন সেটিই তাকে ক্রমে বিখ্যাত করে। এমনকি অনেকে তাকে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী এবং তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের আবিষ্কারক বলে অভিহিত করেন। আদতে জোনসের ঐ বহুপ্রচারিত ভাষনের মৌলিক মন্তব্যগুলোর বেশিরভাগই হ্যালহেড প্রমুখ অগ্রজ লেখকদের এর ওর কাছ থেকে নিয়ে তার প্রবন্ধে জুড়ে দিয়েছিলেন। সাথে যোগ করেছিলেন নিজের কিছু আজগুবি অনুমান। মহামতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত ’স্যার’ উইলিয়াম জোনস-এর বিষয়ে আজ এত বছর পর এ রকম সমালোচনা কানে বাজতে পারে। আমরা তাই মন্তব্য বাদ দিয়ে সরাসরি তথ্যভিত্তিক তুলনায় যাই।
জোনস-এর আগে অনেক লেখকই সংস্কৃত ভাষার সাথে অন্যান্য ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার অথবা ইউরোপীয় ভাষাগুলির পারস্পরিক সাদৃশ্যের বিষয়টি বুঝতে পারেন এবং তাদের লেখায় উল্লেখও করেন। এদের মধ্যে ইতালীয় ব্যবসায়ী-পর্যটক ফিলিপ্পো সাসেত্তি (১৫৪০-১৫৮৮), ইংলিশ ধর্মপ্রচারক-ভাষাতাত্ত্বিক থমাস স্তেফান (১৫৪৯-১৬১৯), সুইডিশ ভাষাতাত্ত্বিক আঁদ্রে জ্যাগার (১৬৬০-১৭৩০), ইংলিশ ভাষাতাত্ত্বিক ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড (১৭৫১-১৮৩০) প্রমুখের নাম বলা যায়। এসব ভাষার একক একটি উৎসের কথা সবচেয়ে দৃঢ়ভাবে বলেন জ্যাগার, সেই ১৬৮৬ সালে:
“দূর অতীতে ককেশাস পার্বত্য এলাকায় একটি প্রাচীন ভাষা কওয়া হতো যা ভাষাভাষীদের বিভিন্ন ধাপের স্থানান্তরের মাধ্যমে ইউরোপ ও এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। এখন আর সেই ভাষা কথা কওয়া হয় না, এমনকি তার কোন ভাষাতাত্ত্বিক প্রমাণচিহ্নও নাই। কিন্তু সেই ভাষা ’মাতৃভাষা’ হিসাবে জন্ম দিয়ে গেছে অনেক ’কন্যাভাষা’। এইসব কন্যাভাষা অনেকগুলোই আবার নিজেরা মা হয়ে জন্ম দিয়েছে আরো কন্যার (কারণ ভাষা সবসময় উপভাষার জন্ম দেয় যেগুলো কালক্রমে স্বাধীন, পরস্পর দুর্বোধ্য ভাষায় রূপান্তরিত হয়)। এর মধ্যে আছে ফারসি, গ্রিক, ইতালীয় (তখন লাতিন পরে আধুনিক রোমানীয় ভাষাসমূহ) স্লাভীয়, কেলটিক, এবং সবশেষে গোথিক ও অন্যান্য জর্মন ভাষা।”৭
এখানে জ্যাগার ইউরোপে প্রচলিত ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলির উৎস হিসাবে একটি অতি প্রাচীন ভাষার কথা পরিষ্কার করে বলেন, এমনকি তিনি সেই ভাষিক অঞ্চলটিও নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করেন। একই কথা বলেন হ্যালহেডও তার Bengal Language Grammar বইয়ে। তিনি লেখেন, “ফারসি ও আরবী, এমনকি লাতিন ও গ্রীক শব্দরাজির সাথে সংস্কৃত ভাষার শব্দসমূহের মিল দেখে আমি বিস্মিত। . . . এই অসাধারণ সংযোগ তো . . . এরই অকাট্য যুক্তি যে এ সকল ভাষাই একই উৎস থেকে সৃষ্ট।”৮
বুঝাই যাচ্ছে জোনস সংস্কৃত, ফারসি, লাতিন, গ্রীক প্রভৃতি ভাষার মিল আর তাদের প্রাচীন একক উৎসের ধারণা এদের লেখা থেকেই নেন, কিন্তু ঋণগ্রহণের কথাটি বেমালুম চেপে যান। আর তার নিজস্ব ধারণা যেখানে জাহির করেছেন সেখানে দেখা দিয়েছে ভয়ংকর বিপর্যয়। এমন কয়েকটি বড় বড় ভুলভাল তথ্যযুক্ত বক্তব্য আমরা এখানে উদ্ধৃত করবো। তৃতীয় বার্ষিক বক্তৃতার এক জায়গায় তিনি লেখেন:
“হিন্দুদের বিষয়ে এই ঝড়ো পর্যবেক্ষণের ফলাফল এই যে (আমি মনে করি), বিস্মৃত দূর অতীতে হিন্দুদের সাথে ঘনিষ্ট আত্মীয়তা ছিলো পারসীয়, ইথোপীয়, মিশরীয়, ফিনিশীয়, টুসকান, স্কেথিয়ান, গোথে এন্ড কেল্টদের। চীনা, জাপানি ও পেরুভীয়রা যে ঐসব দেশের সাথে পারস্পরিক উপনিবেশের সম্পর্কে জড়িত ছিলো এমন বিশ্বাস করার কোন কারণ নাই। তাহলে বলতে হয় এরা সকলই একটি মূল দেশ থেকে উদ্ভুত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। ৯
তার নয় নম্বর বার্ষিক বক্তৃতায় লেখেন: “এমন বিশ্বাস করা অমূলক হবে না যে, এদের (ভারতীয়দের) একটা দল পুবের দ্বীপগুলো থেকে মেক্সিকো এবং পেরুতে পাড়ি জমায়। ওখানে গণসাহিত্যের চিহ্ন মিলেছে এবং মিশর ও ভারতীয় মিথ আর সাহিত্যিক বিবরণের সাথে সাদৃশ্য পাওয়া গেছে।”১০
. . . পঞ্চম বক্তৃতায় তিনি বলেন:
“সতর্ক পর্যবেক্ষণ থেকে আমার মনে হয়েছে যে, ভারতীয় ও আরবীয় ভাষাগুলি যেমন একই উৎস থেকে আলাদা আলাদাভাবে বিকশিত হয়েছে; তেমনি তাতারি ভাষার ( মধ্যএশিয়ার অন্য সকল ভাষা) বংশ-পরিচয় খুঁজলেও দেখা যাবে ঐ একই উৎসেরই ভিন্ন এক ডাল থেকে এসেছে।”১১
অন্যত্র তিনি জোর দিয়ে বলেছেন মাদাস্কার, ফিলিপাইন, সুমাত্রা প্রভৃতি অঞ্চলের ভাষাগুলিও সংস্কৃতের কন্যা। আরেক জায়গার বলেছেন তিব্বতী ভাষা আসলে সংস্কৃত।১২ রয়েল সোসাইটি অব বেঙ্গলে জোনস প্রদত্ত বার্ষিক বক্তৃতাগুলো থেকে যেসব উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে তা মনোযোগের সাথে পড়লে একটা বিষয় ধরা পড়ে। তা হচ্ছে জোনস যেসব কথা অন্যের কাছ থেকে নিয়ে নিজের বলে চালিয়ে দিয়েছেন সেগুলোর কোনোটা কোনোটা কালের বিচারে টিকে আছে; আর নিজে যেসব ব্যাখ্যা ও সিদ্ধান্ত হাজির করেছেন তার সবই আজগুবি, সম্পূর্ণ ভুল আন্দাজ। তিনি সংস্কৃত ভাষাকে সকল ভারতীয় ভাষার মা-বাপ বলেই থামেননি, সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিকভাবে সুমাত্রা অঞ্চলের অস্ট্রোলেশীয় ভাষাগুলোকেও সংস্কৃতের সন্তানাদির অন্তর্ভূক্ত করেছেন; চীনা ও জাপানিজ, পেরুভিয়ান, সেমেটিক ভাষার আরবী ও ইন্দোইউরোপীয় ভাষার সংস্কৃতকে একই গোত্রভুক্ত বলেছেন, মেক্সিকানসহ অনেক জাতি প্রাচীনকালে হিন্দু ছিলো বলে সিদ্ধাšত দিয়েছেন যার মধ্যে আছে ভারতীয়, পারসিক, ইথোপীয়, মিশরীয়, ফিনিশীয়, টুসকান, স্কেথিয়ান, গোথে ও কেল্ট। চীন, জাপান ও পেরু কোন কালে একই দেশ থেকে উদ্ভুত হয়েছে দাবী করেছেন। এবং লক্ষ্যণীয় যে রয়েল সোসাইটি অব বেঙ্গলের তৃতীয় বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হয় ১৭৮৬ সালের ফেব্রুয়ারীতে। এর অর্থ হলো সংস্কৃত ও ভারত বিষয়ে এ সমস্ত বিপুল জ্ঞান তিনি অর্জন করেন ভারতে আসার মাত্র দুই বছর পাঁচমাসের মাথায়। আজ এত বছর পর তার বক্তৃতা পড়তে গিয়ে কেন জানি মজাই লাগছে। আশ্চর্যই লাগে উইলিয়াম জোনস-এর মত একজন অতি সম্মানিত মানুষ, যিনি হাইকোর্টের বিচারপতিও, গোপনে এর ওর বই থেকে ধার করা জ্ঞানের সাথে নিজের অনুমান মিলিয়ে বক্তৃতা করছেন আর সাদা ইংরেজ বা ভারতীয় নির্বিশেষে সকলেই তা নির্দ্বিধায় গিলছে আর বাহ্ বাহ্ করছে। আজ সোয়াদুইশ বছর দেখা যাচ্ছে তার বেশির ভাগই ভুল আন্দাজ; ভাষাবিজ্ঞানের মত একটা বিষয়ে এরকম ভুলভাল কথাবার্তাকে প্রায় কান্ডজ্ঞানহীন বাচালতার সামিল বললে বেশি বলা হয় মনে করি না।
এ কালে কেউ জোনসের মত এমন আন্দাজী ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্তমূলক কথাবার্তা হাজির করলে তার কান্ডজ্ঞান সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করা হবে। কিন্তু জোনসের বিষয়ে কেউ সন্দেহ করেননি। এমনকি হ্যালহেডের রচনা হাতের কাছে থাকা সত্ত্বেও কেউ বলেনি জোনস হ্যালহেড থেকে মেরে দিয়েছেন। বরং পরবর্তী দুশো বছর ধরে তার আজগুবি জ্ঞানকে ভিত্তি ধরে বিকশিত হয়েছে আমাদের কোনো কোনো জ্ঞানভাষ্য। কোন কারণে? আমরা এখন সে বিশ্লেষণেই যাব।
বাংলাদেশে উত্তরউপনবিশেী ভাবর্চচার পথিকৃৎ ফয়েজ আলমের চিন্তার ধরণ, রোখ ও জায়গা আমাদের প্রচলিত ধারার সাহিত্যভাবনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা থেকে ভিন্ন। একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, অনুবাদক, উত্তরউপনিবেশি তাত্ত্বিক। উপনিবেশি শাসন-শোষণ আর তার পরিণাম, রাষ্ট্র ও সমধর্মী মেল কর্তৃক ব্যক্তির উপর শোষণ-নিপীড়ন ও ক্ষমতার নানামুখি প্রকাশ আর এসবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকার কৌশল নিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে লিখছেন তিনি। বিশ্বায়নের নামে পশ্চিমের নয়াউপনিবেশি আর্থ-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর রাষ্ট্র ও স্বার্থকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর শোষণচক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার লেখা আমাদের উদ্দীপ্ত আর সাহসী করে তোলে।
ফয়েজ আলমের জন্ম ১৯৬৮ সালে, বাংলাদশের নেত্রকোনা জেলার আটপাড়ার যোগীরনগুয়া গ্রামে। বাবা মরহুম শেখ আবদুস সামাদ, মা সামসুন্নাহার খানম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বিএ (সম্মান) ও এমএ পাশ করার পর প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণার জন্য এমফিল. ডিগ্রী লাভ করেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ: ব্যক্তির মৃত্যু ও খাপ-খাওয়া মানুষ (কবিতা, ১৯৯৯); প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি ( গবেষণা, ২০০৪); উত্তর-উপনিবেশি মন (প্রবন্ধ, ২০০৬); ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে (প্রবন্ধ, ২০০৮); বুদ্ধিজীবী, তার দায় ও বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব (প্রবন্ধ, ২০১২), জলছাপে লেখা (কবিতা, ২০২১), রাইতের আগে একটা গান ( কবিতা, ২০২২); ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (প্রবন্ধ, ২০২২), এডওয়ার্ড সাইদের অরিয়েন্টালিজম (অনুবাদ, ২০০৫); কাভারিং ইসলাম (অনুবাদ, ২০০৬), ।