আধুনিক যুগের জন্ম কাহিনি (পর্ব -১০)। হোমেন বরগোহাঞি
১৯৩২ সনে লক্ষ্মীমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’,‘বিভিন্ন নরক’,‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোট গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। ১২ মে ২০২১ সনে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ‐– বাসুদেব দাস
যে কয়েকটি আবিষ্কার মানুষের সভ্যতায় যুগান্তর এনেছে সেগুলির ভেতরে একটি হল লেখন পদ্ধতির আবিষ্কার।প্রথম অবস্থায় আদিম কিংবা অর্ধ সভ্য মানুষ কেবল ব্যবহারিক প্রয়োজনে লেখন পদ্ধতি উদ্ভাবন করে তাকে কাজে লাগিয়েছিল ।উদাহরণস্বরূপ মানুষ নিজের সম্পত্তি এবং গরু বাছুর রক্ষা করার জন্য সেগুলোতে কোনো এক ধরনের চিহ্ন দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেছিল। যে সমস্ত কথা ভুলে গেলে নানা বিপদ হতে পারে সেই সমস্ত কথা মনে রাখার জন্য মানুষ সংকেত চিহ্ন ব্যবহার করার প্রয়োজন অনুভব করেছিল। এখনও এমনকি শিক্ষিত মহিলা দরকারি কথা মনে রাখার জন্য রিহা বা চাদরে গিট বেঁধে রাখতে দেখা যায়। এই সমস্ত উদ্দেশ্য কে সামনে রেখে ব্যবহার করা কোনো এক ধরনের সংকেত চিহ্ন যখন মানুষের আয়ত্ত হল তখন মানুষ সেই সংকেত চিহ্ন গুলির সাহায্যে রণ সংগীত এবং প্রার্থনা সংগীত সংরক্ষণ করার চেষ্টা করল। মানুষের প্রাচীনতম লেখন পদ্ধতির যে নমুনা এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়েছে তা প্রায় ছয় হাজার বছরের পুরোনো। বন্যা পৃথিবী প্লাবিত করার আখ্যানপৃথিবীর অনেক জাতির মধ্যে যুগ যুগ ধরে চলে আসছিল; খ্রিস্টের জন্মের চারহাজার বছরের আগে মাটির শ্লেটে লিপিবদ্ধ করা সেরকম একটি আখ্যান মধ্যপ্রাচ্যের সালডিয়া নামের জায়গায় আবিষ্কৃত হয়েছে এবং একে এখন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা হয়েছে। তারপরে দেড় হাজার বছরে, লেখন পদ্ধতির এত বিকাশ ঘটল যে আলেকজান্ডার খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২ সনে আলেকজান্দ্রিয়ায় স্থাপন করা লাইব্রেরিতে, তারপরে ইজিপ্টে রাজত্ব করা টলেমি বংশের রাজারা প্রায় সাত লক্ষ বই সংগ্রহ করেছিল।
কালক্রমে পৃথিবীর সমস্ত সভ্য জাতি নিজের নিজের লিপি উদ্ভাবন করে এবং তার বিকাশ ঘটিয়ে উন্নত সাহিত্য সৃষ্টি করতে সমর্থ হল। কিন্তু এই লিপি ছিল হাতে লেখা লিপি। মূল বইটি যে মানুষটি লিখেছিল অন্য কেউ হয়তো তার প্রতিলিপি করেছিল; কিন্তু কেবল হাতে লিখে আর কত প্রতিলিপি করা সম্ভব? তাছাড়া প্রাচীনকালে জ্ঞান চর্চা সীমাবদ্ধ ছিল সমাজের মুষ্টিমেয় মানুষের মধ্যে। জ্ঞানের চর্চা সীমাবদ্ধ থাকার জন্য বইয়ের প্রতিলিপিও ছিল খুব কম; অন্যদিকে বইয়ের সংখ্যা কম হওয়ার জন্য জ্ঞানের চর্চা এবং প্রচার সীমাবদ্ধ হতে বাধ্য হয়েছিল। সংখ্যায় অত্যন্ত কম এই হাতে লেখা বইগুলি এত দুষ্প্রাপ্য এবং ব্যয়বহুল ছিল যে বইয়ের মালিক অন্যকে সেই বই পারতপক্ষে কখনও দিত না। মধ্যযুগের খ্রিস্টিয় মঠগুলিতে বইগুলি লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার নিয়ম ছিল যাতে অন্যেরা সেই সমস্ত সহজে চুরি করতে না পারে।
বই হল জ্ঞানের আকর, অর্থাৎ চিন্তাশীলের চিন্তা এবং জ্ঞান বইয়ের মধ্যেই সংরক্ষিত হয়ে থাকে। সেই বই যদি সমাজের মাত্র কয়েকজন মানুষ স্পর্শ করতে পারে, তাহলে জ্ঞানও মাত্র সেই কয়েকজন মানুষেরই কুক্ষিগত সম্পত্তি হয়ে থাকতে বাধ্য। প্রাচীন যুগে সমাজের মাত্র কয়েকজন মানুষ শিক্ষিত এবং বাকি প্রত্যেকেই নিরক্ষর অজ্ঞানী হওয়ার জন্য তার দুটি প্রধান কুফল দেখা গিয়েছিল। প্রথমত সমাজে দেখা দেখি দুটো শ্রেণীর সৃষ্টি হয়েছিল: বই পড়ার জন্য সুযোগ পাওয়া মুষ্টিমেয় শিক্ষিত সম্প্রদায়— যারা স্বাভাবিকভাবেই বাকিদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে পরিগণিত হয়েছিল; এবং নিরক্ষর অশিক্ষিত সম্প্রদায়—যারা শিক্ষিত সম্প্রদায় যা বলে তাই ধ্রুব সত্য বলে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। দ্বিতীয়তঃ অজ্ঞানতার জন্য সমাজের বেশিরভাগ মানুষের কোনো বিষয়েই প্রশ্ন করার যোগ্যতা বা অধিকার না থাকার জন্য একদিকে তাদের মানসিক বিকাশ যুগ যুগ ধরে ব্যাহত হয়েছিল এবং অন্যদিকে জ্ঞান বিজ্ঞানের নিত্য নব বিকাশের পথ ও রুদ্ধ হয়েছিল। প্রাচীন যুগে জ্ঞান চর্চার পরিবেশ বর্ণনা করার জন্য এইচ জি ওয়েলস একটি সুন্দর উপমা ব্যবহার করেছেন। সেই যুগের জ্ঞান চর্চার কেন্দ্র গুলি হল অত্যুজ্জ্বল দীপশিখার আলোকে আলোকিত একটি বন্ধ ঘরের মতো— যার চার পাশে সীমাহীন ঘন অন্ধকার। আলোকিত ঘরটিতে বসে আছে মাত্র কয়েকজন ভাগ্যবান মানুষ। বাকি অন্যরা চির অন্ধকারে নিমজ্জিত।
মানব সমাজের দ্রুত প্রগতির জন্য জ্ঞানের বিস্তার এবং বিনিময় কেন অতি দরকারী সে কথা ব্যাখ্যা করে জনরথেনস্টাইন নামের একজন পন্ডিত বলেছেন—কত সহজে বা কত কষ্টের সঙ্গে সমস্ত ধরনের জ্ঞানকে বিনিময় করা যায় তার ওপরেই সভ্যতার প্রগতি নির্ভর করে। অন্য কথায় বলতে গেলে ইতিহাসের যে সমস্ত যুগে সমস্ত ধরনের জ্ঞান মানুষ সহজে পেতে পারা অবস্থায় থাকে সেইসব যুগেই ইতিহাসের গতিবেগ হয় তীব্রতম।’
বলবাহুল্য যে ইতিহাসের এই নতুন যুগটি আরম্ভ হল ১৪৪০ এবং ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দের ভেতরে।
জন গুটেনবার্গ নামের একজন জার্মান মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করার দিন থেকে। অবশ্য ঐতিহাসিক বিচারে জন গুটেনবার্গ মুদ্রণ যন্ত্রের প্রথম আবিষ্কারক নন। মুদ্রণ যন্ত্র প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন চিনারা। গুটেনবার্গ মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করার প্রায় ৪০০ বছর আগে পি শ্বেঙ নামের একজন চিন দেশের মানুষ মুদ্রণ যন্ত্র তৈরি করে তাকে কাজে লাগিয়েছিলেন। কিন্তু চিনা বর্ণমালার অক্ষরের সংখ্যা এত বেশি যে চিনের মুদ্রণ যন্ত্রের ব্যবহার খুব কার্যকরী হল না ।দ্বিতীয়ত সেই সময় চিনের সঙ্গে বহির্বিশ্বের যোগাযোগ খুব কম থাকার জন্য চিনাদের দ্বারা আবিষ্কৃত মুদ্রণ যন্ত্রের খবর বাইরের পৃথিবীর কানে পৌঁছাল না। জন গুটেনবার্গ মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কার করার প্রায় অর্ধশতাব্দি আগেই কোরিয়াতেও মুদ্রণ যন্ত্রের ব্যবহার হওয়ার প্রমাণ আছে । কেবল ঐতিহাসিক তথ্য হিসেবে মনে রাখা ছাড়া এই সমস্ত তথ্যের অন্য কোনো মূল্য নেই, কারণ যে মুদ্রণযন্ত্র আধুনিক সভ্যতায় যুগান্তকারী বিপ্লব এনেছে তার আদিপুরুষ হল জন গুটেনবার্গের দ্বারা আবিষ্কৃত মুদ্রণ–যন্ত্র।
অবশ্য গুটেনবার্গের আবিষ্কারের প্রায় অর্ধশতাব্দী আগেই একজন অজ্ঞাত নামা ইউরোপীয় মুদ্রণ যন্ত্র তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি একটা কাঠের ওপরে অক্ষরের নক্সা কেটে নিয়ে পরে অক্ষরগুলির চারপাশের কাঠটা বাটালি দিয়ে চেঁচে ফেলেছিলেন। এর ফলে অক্ষরগুলি যখন গোটা গোটা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল তখন তার ওপরে কালি মেখে কাগজেরওপরে চাপ দিয়ে দিলেই একটা পৃষ্ঠা ছাপা হয়ে যেত। এই পদ্ধতিকে জাইলোগ্রাফি বলা হত। গ্রিক ভাষায় জাইলো শব্দের অর্থ হল কাঠ। গ্রাফি মানে লেখন।
কিন্তু জাইলোগ্রাফি জনপ্রিয় হল না। যেহেতু অক্ষরগুলি নাড়াচাড়া করা যায় না, সেই জন্য এভাবে অক্ষর কেটে বের করা কার্ডটা কেবলমাত্র একটি বইয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেত। দ্বিতীয় একটি বই ছাপা করতে হলে পুনরায় আলাদা একটি কাঠের নতুন করে অক্ষর কাটতে হত। হলে এই পদ্ধতিতে ছাপা করতে সময় যেরকম বেশি লাগত, অন্যদিকে খরচও হত প্রচুর। এর কিছুদিন পরে পনেরো শতকের প্রথম দিকে লরেঞ্চ কষ্টার নামের একজন হল্যান্ড দেশীয় মানুষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় অক্ষর সরিয়ে নেবার একটা নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করলেন। এই পদ্ধতির সুবিধা হল এই যে প্রতিটি নতুন বই ছাপা করার জন্য জাইলোগ্রাফির মতো নতুন নতুন অক্ষর কেটে তৈরি করার দরকার পড়ে না। যেহেতু অক্ষরগুলি ইচ্ছে মতো জায়গা পরিবর্তন করা যায়, সেই জন্য একই অক্ষরকে প্রয়োজন অনুসারে নতুন রূপে সাজিয়ে দ্বিতীয় একটি বই করা যায়।
বলতে গেলে কষ্টারের দ্বারা উদ্ভাবিত এই পদ্ধতি ছিল আধুনিক মুদ্রণ যন্ত্রের প্রথম সূচনা। সেই জন্য হল্যান্ডের মানুষ লরেঞ্চ কষ্টারই মুদ্রণ যন্ত্রের প্রথম আবিষ্কারক বলে দাবি করতে চায়। কিন্তু কষ্টারের মুদ্রণ পদ্ধতির একটি বড়ো অসুবিধা ছিল। তিনি অক্ষরগুলি কাঠ থেকে কেটে বের করেছিলেন। এই কাঠের অক্ষর বেশিদিন ব্যবহার করা সম্ভব হত না। কিছুদিন ব্যবহার করার পরে অক্ষর গুলি ক্ষয়ে গিয়ে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ত। এদিকে পুনরায় নতুন করে অক্ষর কেটে বের করতে অনেক সময় লেগে যেত।
১৪৪০ খ্রিস্টাব্দে কী তার কিছুদিন পরে জার্মানির জন গুটেনবার্গ কাঠের পরিবর্তে সিসার ধাতুর থেকে অক্ষর কেটে বের করার পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন। সিসার অক্ষর বা টাইপের সুবিধা ছিল অনেক। প্রথমত সিসা কাঠের চেয়ে অনেক বেশি শক্ত। ফলে টাইপগুলি সহজে ক্ষয়ে যায় না। দ্বিতীয়ত, সিসার টাইপের খরচও কম, কারণ টাইপগুলি ক্ষয়ে গেলে তাকে গলিয়ে একই সিসা থেকে নতুন করে টাইপ তৈরি করা যায়। গুটেনবার্গ ১৪৫৭খ্রিস্টাব্দে তার মুদ্রণযন্ত্রে লেটিন বাইবেল সাজিয়ে বের করার দিন থেকে গত পাঁচশ বছরের মুদ্রণ পদ্ধতির বিপুল এবং বিস্ময়কর উন্নতি সাধিত হয়েছে কিন্তু তার মূল পদ্ধতিটা আবিষ্কার করেছিলেন তিনি তাই মুদ্রণ যন্ত্রের আবিষ্কারকের স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
ওপরে একবার উল্লেখ করা হয়েছে যে লেখন পদ্ধতি আবিষ্কার ছিল মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি বিরাট যুগান্তকারী ঘটনা। সত্যি কথা বলতে গেলে মানুষ হওয়ার পথে সেটা ছিল প্রথম প্রকাণ্ড পদক্ষেপ। লক্ষণ পদ্ধতি আবিষ্কৃত হওয়ার ফলেই মানুষের সমস্ত চিন্তা কল্পনা এবং অভিজ্ঞতা লিখিত রূপে উত্তর পুরুষের জন্য সংরক্ষিত করে রাখা সম্ভব হল; অর্থাৎ মানুষ যুগ যুগ ধরে অর্জন করা জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা বিস্মৃতির গর্ভে হারিয়ে না গিয়ে ক্রমান্বয়ে জমা হতে লাগল। কিন্তু এই পুঞ্জীভূত জ্ঞান সীমাবদ্ধ হয়ে রইল সমাজের সৌভাগ্যবান মুষ্টিমেয় মানুষের মধ্যে। তার কারন এবং পরিণাম ওপরে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
প্রায় ছয় হাজার বছর আগে আবিষ্কৃত হওয়া লেখন পদ্ধতি মানব সভ্যতায় যে বিপ্লবের সূচনা করেছিল সেই বিপ্লবের দ্বিতীয় অধ্যায় আরম্ভ হলপনেরো শতকে মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কৃত হওয়ার মুহূর্ত থেকে।মানব সভ্যতার ইতিহাসে মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কার একটি বিরাট যুগান্তকারী ঘটনা। এক কথায় বলতে গেলে এটা মানুষের চিন্তা প্রক্রিয়া জীবনধারা এবং সংস্কৃতিকে চিনতে না পারার মতো করে পরিবর্তিত করে ফেলল। প্রথমত মুদ্রণ যন্ত্রের সাহায্যে যেকোনো একটি বইয়ের লক্ষ লক্ষ বা কোটি কোটি প্রতিলিপি (কপি) ছাপিয়ে ফেলা সম্ভব হওয়ার ফলে আগে যে বইটি মাত্র কয়েকজন ভাগ্যবান মানুষ পড়ার সুযোগ পেয়েছিল, এখন সেই বই পড়তে পারে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষ। তাছাড়া একসঙ্গে অনেক বই ছাপানো সম্ভব হওয়ার ফলে বইয়ের দামও এত কমে গেল যে ধনী-দরিদ্ররা প্রত্যেকেই বই কিনতে সক্ষম হল। ফলে অতীতে যে জ্ঞান বিজ্ঞান ছিল মাত্র মুষ্টিমেয় লোকের একচেটিয়া সম্পত্তি,এখন তা হয়ে পড়ল সমাজের সমস্ত মানুষের সামাজিক সম্পত্তি। দ্বিতীয়ত, বই সুলভ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা সার্বজনীন করাও সম্ভব হল। শিক্ষিতের সংখ্যা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেতে লাগল। মানুষের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠল।এর ফলে সাহিত্য বাণিজ্যিক রূপ নিতে শুরু করল। তৃতীয়ত, মুদ্রণ যন্ত্র হয়ে উঠল বিরাট সামাজিক পরিবর্তনের একটি পরম শক্তিশালী সরঞ্জাম। আগে কেউ যদি প্রচলিত মত বা আদর্শের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চাইত, তাকে সেটা করতে হত সীমিত সংখ্যক মানুষের সামনে কথা বলে বা বক্তৃতা দিয়ে। একটা নতুন মত প্রচার করতে চাইলেও তাকে ঠিক সেটাই করতে হত। এর ফলে যে কোনো নতুন মত বা আদর্শ প্রচার করতে স্বাভাবিকভাবেই দীর্ঘ সময় লাগত। এমনিতে মানুষের পদে পদে আক্রান্ত হওয়ার ভয় ছিল। মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার হওয়ার ফলে এই সমস্ত অসুবিধা এবং বিপদ নাই হয়ে গেল। কেউ যদি একটা নতুন কথা বা বৈপ্লবিক মত প্রচার করতে চায় তাহলে একটা বই লিখে ছাপিয়ে দিলেই বা খবরের কাগজে প্রবন্ধ লিখলেই হল। লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে তাঁর বাণী ছড়িয়ে পড়বে। এই সমস্ত কারণে মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার হওয়ার পাঁচশো বছরের ভেতরে মানুষ সমস্ত ক্ষেত্রে যে প্রগতি লাভ করেছে, তার আগের পাঁচ হাজার বছরেও ততটুকু লাভ করতে পারেনি। মানুষের প্রগতি এবং মুক্তির ক্ষেত্রে যে কয়েকটি জিনিস সবচেয়ে বেশি অবদান জুগিয়েছে সেইসবের মধ্যে সর্বপ্রথমে নাম করতে হবে মুদ্রণযন্ত্রের।
আমরা আগেই বলেছি যে ইউরোপের নব-জাগরণই মানব সভ্যতার ইতিহাসে আধুনিক যুগের সূচনা করেছে। দুটি প্রধান ঘটনা এই নবজাগরণ সম্ভব করে তুলেছিল। প্রথমটি ছিল ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে কনস্টান্টিনোপলের পতন — যার ফলে সেখানে সংরক্ষিত হয়ে থাকা প্রাচীন গ্রিসের জ্ঞান ভান্ডারের সঙ্গে ইউরোপের প্রথম ব্যাপক পরিচয় ঘটল এবং তার পরিণামে মানুষের চিন্তায় একটা নতুন বিপ্লব শুরু হল ।
দ্বিতীয় ঘটনাটা ছিল ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দে মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এর বৈপ্লবিক ভূমিকা ইঙ্গিতে ব্যাখ্যা করে হেণ্ড্ৰিক উইলেম ভেন লুন লিখেছেন—’ মুদ্রণ যন্ত্রের আবিষ্কারের ফলে জ্ঞানের চর্চা কয়েকজন সুবিধাভোগী মানুষের একচেটিয়া অধিকার হয়ে থাকার যুগের অন্ত পড়ল। ছাপা বই প্রত্যেকের জন্য সুলভ হওয়ার ফলে পৃথিবীর থেকে মানুষ অজ্ঞ এবং অশিক্ষিত হয়ে থাকার শেষ অজুহাতটুকুও অন্তর্হিত হল। ‘এরিস্টটল এবং প্লেটো’, ভার্জিন এবং হোরেস আর প্লিনি— এই সমস্ত লোকের সংগ সুখ পেতঅতীতকালে কেবল মুষ্টিমেয় কিছু পন্ডিত, দার্শনিক এবং বিজ্ঞানীরা। কিন্তু এখন মাত্র নগণ্য কয়েকটি মুদ্রার বিনিময়ে প্রত্যেকেই তাদের সংগ সুখ লাভ করতে সমৰ্থ হয়েছে । মুদ্রিত শব্দের সামনে সমস্ত মানুষকেই মুক্ত এবং সমান করে তুলল মানবতাবাদ। ‘
অনুবাদক