Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,জ্যাকসন হাইটস

ধারাবাহিক: দি স্টোরিজ অব জ্যাকসন হাইটস (পর্ব-৭) । আদনান সৈয়দ

Reading Time: 5 minutes

নিউইয়র্ক জ্যাকসন হাইটস এর বাঙালিদের জীবন, তাদের স্বপ্ন, তাদের ত্যাগ, তাদের মন, মনন, প্রেম, ভালোবাসা আর বুক চাপা কান্নার গল্প । সব মিলিয়ে এই ধারাবাহিক লেখায় উঠে আসবে নিউইয়র্কের বাঙালির গল্পগাথা। আজ ইরাবতীর পাঠকদের জন্য থাকছে পর্ব-৭।


 

চরণ ছুঁয়ে যাই

 

ভদ্রলোক সম্পর্কে খবরটা কানে এসেছিল অনেক আগেই। আমিও খুব তক্কে তক্কে ছিলাম। কিভাবে একেবারে  সামনা সামনি হয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলা যায়। কিন্তু কপাল খারাপ হলে সাধারনত যা হয়।  যখনই উনাকে কল দেই তখনই ওপার থেকে রিং টোনে ইংরেজিতে  ম্যাসেজ বেজে উঠে। “ আপনার গুরুত্বপূর্ণ কলটি মিস করেছি। অনুগ্রহ করে ম্যাসেজ রাখুন। সুযোগ সময়মত আমি আপনাকে কল করবো।” কিন্তু ম্যাসেজ রাখার পরেও সেই ভদ্রলোকের কাছ থেকে কখনই কোন উত্তর পাইনি। বিষয়টি সত্যি আমাকে খুব অবাক করেছিল। এমন একজন মানুষের কাছ থেকে এ ধরণের আচরণ আশাই করা যায় না!

 শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দেওয়া ছাড়া কোন উপায় ছিল না।  তাঁর কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ সেদিন মোবাইলটায় একটা অপিরিচিত নাম্বারে ঝন ঝন করে বেজে উঠল। মোবাইলের বোতাম টিপে হ্যালো বলতেই মোবাইলের অপর প্রান্ত থেকে  অত্যন্ত বিনম্র আর নীচু গলায় এক বাঙালির কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই জানা গেল তিনি সেই ভদ্রলোক যাকে আমি দিনের পর দিন আর মাসের পর মাস খুঁজছিলাম। কি আর বলব! আনন্দে বুকটা যেন ভেসে গেল। যাক!  পাওয়া গেল শেষ পর্যন্ত। ভদ্রলোক কথায় কথায় জানালেন তিনি বেশ কিছুদিন হাসপাতালে ছিলেন। নানা রকম শারীরিক সমস্যা তাঁর  আছে। সময়মত উত্তর দিতে না পারার কারণে তিনি আমার কাছে প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিলেন এবং  আমাকে তার বাসায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন।  এদিকে তাঁর অতিরিক্ত বিনয় দেখে আমি  নিজেও মনে মনে খুব  লজ্জা পাচ্ছিলাম। কারণ মনে মনে তাঁকে কত কিছুই না ভেবে বসেছিলাম! আবার এদিকে মনে মনে আনন্দিত হলাম এই মনে করে যে এমন একজন অসাধারণ মানুষের সাথে আমার দেখা হতে যাচ্ছে। ঝটপট দিন ক্ষন ঠিক করে একদিন সকালে টুক করে চলে গেলাম তাঁর জ্যাকসন হাইটস এর ৮৬তম সড়ক আর ৩৫ এভিনিউর  ছোট্ট একটা এপার্টমেন্টে।

জ্যাকসন হাইটস এর রাস্তাগুলো খুব পরিপাটি করে সাজানো। এখানে এভিনিউ আর সড়ক আলাদা আলাদা করে দাবার গুটির মত ছক কেটে বসানো হয়েছে। তাই এখানে কোন ঠিকানা খুঁজে পেতে কোন রকম ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয় না। শুধু এভিনিউ, বাড়ির নাম্বার আর সড়কের নাম্বারটা জানা থাকলেই চলে। তাঁর দেয়া ঠিকানার নির্দশনা মেনে ঠিক ঠাক পৌঁছে গেলাম তাঁর বাড়ির ঠিক সামনে। চারতলার লাল ইটের একটা এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স। সেই এপার্টমেন্টে ভদ্রলোক থাকেন ৪ তলায়। কলিং বেল চাপতেই ইন্টারকম থেকে দরজা খুলে দেয়া হল। তারপর সিড়ি দিয়ে চারতলায় উঠতে উঠতেই দেখি তিনি দরজা খুলে আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন। গায়ে সেন্টো গেঞ্জি পড়া মাঝ বয়েসি বাদামি রঙের এক বাঙালি। চোখে কালো ফ্রেমের পুরো চশমা।  আমি উনাকে আগে কখনই দেখিনি। তবে প্রথম দেখাতেই এক ধরনের ভালোলাগার অনুভুতিতে প্রাণটা যেন ছুঁয়ে গেল। ঠোঁটের এক কোনে কোথায় যেন এক চিলতে হাসি সারাক্ষণ লেগে আছে। বিনয় নামের শব্দটা যেন উনার মত মানুষদের জন্যই তৈরি হয়েছিল। ছোট্ট একটা এক বেডরুমের বাসা। বাসার সর্বত্রই ব্যাচেলর ব্যাচেলর ঘ্রাণ। চারপাশটা  খুবই এলোমেলো । ড্রয়িং রুমের নাক বরাবর একটা দড়ি ঝুলে আছে। সেই দড়িতে একটা গামছা আর গেঞ্জি ঝুলে আছে। আসবাবপত্র বলতে কিছুই নেই। ড্রয়িং রুমের মাঝ খানে প্রকান্ড গোলাকৃতি একটা টেবিল। সেই টেবিলের তিন দিক থেকে তিনটি কাঠের চেয়ার। মেঝেতে নিউইয়র্কক থেকে প্রকাশিত বাংলা পত্রিকার কিছু পুরাতন কপি এদিক সেদিক পরে আছে। জানা গেল আরো দুজন বাঙালির সাথে শেয়ার করে তিনি থাকেন। চাকরি—বাকরি করেন খুবই সামান্য। হা আপনি ঠিকই শুনেছেন।, খুবই সামান্য। কিন্তু তাতে কী? এই পাঁচ ফুট মাপের মানুষটার বুকের ভেতর পাঁচ হাজার টন পরিমান ভালোবাসা আর আদর যেন গিজ গিজ করছে। অসাধারন হৃদয়বান মানুষ বলতে যা বোঝায় তিনি হলেন আক্ষরিক অর্থেই তাই। তার চোখের তারায় শুধু দেখি নিত্য মানুষের জন্য ব্যাকুলতা আর মানুষের জন্য ভালোবাসা।


আরো পড়ুন: দি স্টোরিজ অব জ্যাকসন হাইটস (পর্ব-৬) । আদনান সৈয়দ


ভদ্রলোকের নাম ফজলুর রহমান। বাংলাদেশে তাঁর বাড়ি কুমিল্লায়। ডিবি ওয়ানে আমেরিকায় এসেছিলেন। আগে সৌদি আরবে একটা জাহাজ কোম্পানীতে কাজ করতেন। সেখানে তিনি পাচক হিসেবেও বেশ নাম কুড়িয়েছিলেন। কথার এক ফাঁকে হাজার নিষেধ সত্বেও ঝটপট চায়ের ব্যবস্থা আর দুটো টোস্ট বিস্কিট দিয়ে বাঙালির আপ্যায়নের প্রথাটি রক্ষা করলেন। লাল চায়ে টোস্ট ডুবিয়ে আমিই আসল কথায় যেতে চাইছিলাম। না, প্রথমে তিনি এই বিষয়ে একদম কথা বলবেন না। তার ভাষায়, ‘এইতা কিছু না’। কিন্তু আমার কাছে এই ‘এইতা’ যে অনেক বড় কিছু তা এই ছোট খাটো মানুষটাকে বোঝাই কী করে? শেষ পর্যন্ত অনেক টেনেটুনে কাঠখর পুড়িয়ে যতটুকু উদ্ধার করা গেল তাই আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করছি।

ফজলু ভাই আমেরিকায় এসেছেন প্রায় বছর পাঁচেক হল। কাজ করছেন বার্গার কিং নামের একটা ফাস্টফুড রেস্তোরাঁয়। খুব সামান্য কটা পয়সা তার রোজগার। কিন্তু সেই সামান্য কটা টাকা দিয়েই তিনি যেন এ যুগের স্বাক্ষাত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর! কী দয়ার হাত তাঁর! তাঁর নিজের এলাকার গরীব আর মেধাবী ছাত্র—ছাত্রীদের টাকা পয়সা দেন বই—খাতা কিনতে। খরচ যোগান দেন স্কুলের মাইনে দিতে। পাশের বাড়ির যে গরীব মানুষটি  চিকিৎসা হচ্ছে না তিনি তার জন্য টাকা পয়সা দিয়ে সাধ্যমত চেষ্টা করেন। কথায় কথায় জানতে পেলাম  এই কিছুদিন আগেই দশ হাজার টাকা খরচ করে একজন গরীব রিকশা চালকের  চোখের অপারেশন করালেন তিনি। অনেক সময় তিনি নিজে এককভাবে কিছু করতে না পারলে অন্য আরো দশজনকে বলেন। তাদের সাহায্য কামনা করেন। তখন তাঁর সাথে আরো অনেকেই এই মহান কাজে এগিয়ে আসেন। তার আফসোস। ‘ট্যাহা আমার বেশি নাই, থাকলে দেখতেন কি করতাম”। কিন্তু টাকা না থাকলে কি হবে ফজলু ভাইয়ের বিশাল একটা মন আছে। তার সেই বিশাল আত্মার কাছে আমরা সবাই খুবই তুচ্ছ, খুবই সামান্য। খুব আনন্দের সাথে জানালেন যে তাঁর সহযোগিতায় বেড়ে উঠা এক হত দরিদ্র ছেলে এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ছে। এটা তার খুব গর্বের একটি বিষয়। ফজলু ভাই সিগারেট খান না, পান খান না এমন কি জ্যাকসন হাইটস যেয়ে কোনদিন চা আর সিঙ্গারায় কামড় বসাননি।  কারণ এই টাকাটা তিনি সঞ্চয় করে বাংলাদেশে পাঠান গরীব ছোট ছোট বাচ্চাদের সাহায্য করতে। তাঁর মতে ’অযথা ট্যাহা নষ্ট করার কোন রাইট আমার নাই।’ আর সে কারনেই তিনি অযথা কোন ’অকামে’ টাকা পয়সা খরচ করেন না। তিনি যে সামান্য কটা টাকা আয় করেন সেই টাকা দিয়ে বাসা ভাড়া দিয়ে অন্যান্য আনুসঙ্গিক খরচ মিটিয়ে দিয়ে থুয়ে যা থাকে তা দিয়ে বাংলাদেশে তার নিজের সংসার চলে আর মানুষদের সাহায্য সহযোগিতা করার চেষ্টা করেন। তার কথা যতই শুনছিলাম আমি ততই যেন অবাক হচ্ছিলাম। এই ধরনের মানুষ এখনো এই পৃথিবীতে আছে তাহলে?  মনে হচ্ছে আমি যেন সাক্ষাৎ বিদ্যাসাগরের সামনে বসে আছি। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র নিজে ধনী ছিলেন। মানুষকে দান করতে পারতেন। কিন্তু আমাদের এই ফজলু ভাই? যার নুন আনতে পান্তা ফুরায় সে লোকটি কিনা তার রোজগারের এক বিশাল অংশ মানুষের উপকারে ব্যয় করেন! অথচ তাঁর না আছে কোন  সঞ্চয় আর না আছে কোন ঠিকঠাক ভবিষ্যত! অথচ সব কিছু নিয়ে এই মানুষটা কতই না সুখী ! উনার মুখটা যেন হাসি আর আদরে ভরা থাকে সারাক্ষন! কথায় কথায় অনেক কথাই বললেন। বললেন মানুষ হিসেবে আমাদের দায়বদ্ধতার কথা। বললেন আর কিছুদিন বাদেই এই নিউইয়র্কের সংগঠনগুলোর ভেতর পিকনিকের ধুম পরে যাবে। অথচ এরা খুব সহজেই পিকনিকের খাবার দাবার থেকে একটা আইটেম ছেটে দিয়ে খরচ কমিয়ে সেই টাকাটা সেই সংগঠনগুলো নিজেদের এলাকার গরীব মানুষদের সাহায্যে পাঠিয়ে দিতে পারেন। বলেলন আরো অনেক অনেক মূল্যবান কথা। পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে লোক দেখানো কোরবানীর গরু না কিনে ত্রিশ হাজার টাকায় সে গরু কিনে বাকি বিশ হাজার টাকা গরীব মানুষদের জন্য দিয়ে দিলে ক্ষতি কী? উনি এমনটাই মনে করেন। তার একটাই কথা। আমাদের সবার সাধ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব মানুষকে সাহায্য করা উচিত। কারণ মানুষকে ভালোবাসাই যে সবচেয়ে বড় ধর্ম!

জানি, এই ফজলু ভাইদের মত নিরবে নিভৃত্যে হাজারো ফজলু ভাইরা আমাদের চারপাশেই হয়তো রয়েছেন। এটাও জানি যে তারা এই দানটা খুব নীরবেই করতে ভালোবাসেন। নিউইয়র্কের এই ব্যস্ত কঠিন জীবনের মাঝেও তারা মানুষ নিয়ে ভাবেন। মানুষকে ভালোবাসেন। তাদের ছোট্টা ভালোবাসায় ভরা বাঙালি বুকে আরেক বাঙালিকে আগলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেন।

ফজলু ভাই এর কাছ থেকে যখন বিদায় নিচ্ছিলাম তখন নিউইয়র্কের বিকেলের নরম রোদ ফিকে হয়ে রাস্তায় সন্ধ্যার বাতি জ্বলতে শুরু করেছে। সিড়ি দিয়ে নামার আগে কি মনে করে যেন আবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকে আবার চোখ দিয়ে চেটে নিলাম। কি সৌম্য চেহারা! কি সুন্দর হাস্যজ্বল আর প্রাণবন্ত দুটো চোখ! সেই চোখ থেকে ভালোবাসা যেন ঠিকরে পরছে! ইচ্ছে করছিল তাকে বুকে জড়িয়ে কিছুক্ষণ ধরে রাখি। ফজলু ভাই,আপনাকে আমার এই ছোট্ট হৃদয়ে কোথায় স্থান দেই, বলেন তো? আপনার পবিত্র চরণদুটো কি একটু ছুঁয়ে দিতে পারি?

হায়! জ্যাকসন হাইটস এর বাঙালিদের গল্পের কি শেষ আছে?

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>