Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,জ্যোতিপ্রসাদ

ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-২৮) । বাসুদেব দাস

Reading Time: 3 minutes

জ্যোতিপ্রসাদের সুরের বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে হেমাঙ্গ বিশ্বাস আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেছিলেনঃ’ জ্যোতিপ্রসাদ মাঠের সুর নেননি।নিয়েছিলেন উঠোনের সুর।’ জ্যোতিপ্রসাদের‘জয়মতী’কে তিনি অসমের জাতীয় আন্দোলনের জয়ঢৌল আখ্যা দিয়েছেন।বলেছেন’… পরীক্ষা-নিরীক্ষা, কষ্ট সহিষ্ণুতা, আত্মত্যাগ এবং দুর্বার প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যে দিন’ জয়মতী’ ভূমিষ্ঠ হল সেই দিনটি অসমের একটি মহাদিন।’ জয়মতী করতে গিয়েজ্যোতিপ্রসাদ তার সতীর্থ রাজনৈতিক কর্মীদের থেকে যে সমালোচনার সম্মুখীনহয়েছিলেনসেকথা বিবৃত করে জ্যোতিপ্রসাদ হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে বলা কথাগুলি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। প্রতিনিধিতে প্রকাশিত প্রবন্ধে জ্যোতিপ্রসাদের  সেই উক্তি রয়েছে–’ সেদিন অনেকে  ভেবেছিল আমি রাজনৈতিক সংগ্রাম থেকে অবসর নিয়ে সিনেমা জগতের রঙ্গিণ আর্ট বিলাসিতার পথকেই বেছে নিয়েছি।কিন্তু আমি আর্টকে সংগ্রাম থেকে কোনোদিনই পৃথক করে দেখিনি।জেলে থাকার সময় আমার উপলব্ধি হয়েছে যে আমাদের জাতীয় নেতৃত্ব আর্টের বৈপ্লবিক ভূমিকা সম্পর্কে অজ্ঞ এবং অচেতন আর সেখান থেকেই সৃষ্টি হয়েছে এঁদের প্রতি অবজ্ঞা।অশিক্ষিত ভারতের গণমানসের রূপান্তরে আর্টের একটি প্রধান ভূমিকা রয়েছে। সেই প্রেরণাই আমাকে সিনেমার পথে নামিয়েছে।’

দেশের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ক্ষেত্রে জ্যোতিপ্রসাদকেমায়াকোভস্কির সঙ্গে তুলনা করে হেমাঙ্গ বিশ্বাস দু’জনকেই একই নৌকার যাত্রী বলেছেন। অন্যদিকে জ্যোতির ব্যক্তিত্বে উঁকি দিয়ে তিনি বলতে চান ‘ প্রতিভার দ্যুতির  চেয়ে  ব্যক্তিত্বের ব্যাপ্তিতে জ্যোতিপ্রসাদচিরজ্যোতিস্মান।ব্যক্তি জীবনের সততা, সাহস, সত্যনিষ্ঠাএবং সংগ্রামশীলতার সঙ্গে সাহিত্য, শিল্প এবং সঙ্গীতের এই ধরনের সুসংগত এই যুগের সংস্কৃতি জগতে দুর্লভ।’

জ্যোতিপ্রসাদের সামগ্রিক মূল্যায়নে অনিবার্যভাবেই হেমাঙ্গ বিশ্বাস আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ভূমিকার যথাযথ মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে জ্যোতিপ্রসাদের  সঠিক মূল্যায়নও সম্ভব। জ্যোতিপ্রসাদ সম্পর্কে হেমাঙ্গ  বিশ্বাসের ছিল সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ। সংকীর্ণ বামপন্থী দৃষ্টিকোণ দিয়ে তিনি  কখনও জ্যোতিপ্রসাদকে দেখেননি অথবা তথাকথিত বিদ্যায়তনিক আলোচনায় জ্যোতিপ্রসাদকে দেখেননি– যেখানে মানুষ জ্যোতিপ্রসাদ অনুপস্থিত। প্রেক্ষাপটের সমস্ত দিকই তাঁর আলোচনায় মূর্ত হয়ে উঠেছে– তাই জ্যোতিপ্রসাদও তাঁর বিচার-বিশ্লেষণে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

হেমাঙ্গ বিশ্বাসের উদ্যোগে সাংগঠনিক ভাবে জ্যোতিপ্রসাদের মৃত্যু দিবসের  আয়োজন করা হয়েছিল ১৯৫৩ সনে। ১৯৫৩ সনে ভারতীয়গণনাট্য সংঘের অসম শাখা প্রথমবারের জন্য ‘ ‘রূপকোঁয়র  দিবস’ পালন করেছিল। ১৭  জানুয়ারির দিন এই অনুষ্ঠান হয়েছিল গুয়াহাটির নবীন চন্দ্র বরদলৈ হলে। অনুষ্ঠানে ভূপেন হাজরিকা এবং রমেনবরুয়ার পরিচালনায় গণনাট্যের শিল্পীরা জ্যোতি -সংগীত পরিবেশন করেছিল। হেমাঙ্গ বিশ্বাস এই উপলক্ষে লেখা ‘ জ্যোতিপ্রসাদ’ শীর্ষক কবিতাটি অনুষ্ঠানে পাঠ করেছিলেন। অন্যান্য অনুষ্ঠানের সঙ্গে সেদিন মঞ্চে জ্যোতিপ্রসাদের বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন নলিনীবালা দেবী, ভবানন্দ দত্তের মতো কবি- দার্শনিক। এই সভায় জ্যোতি সংগীত প্রচার না করার জন্য গুয়াহাটি বেতার কেন্দ্রকে ধিক্কার দেওয়া হয়েছিল। একই দিনে অন্য একটি অনুষ্ঠান হয়েছিল বরপেটায়, যেখানে দিলীপ শর্মা অংশগ্রহণ করেছিলেন।

নিচে একটি ঘটনার কথা বলা   হল যেখানে আমরা জ্যোতিপ্রসাদের উদার মানসিকতার পরিচয় পাই।

১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে ডিব্রুগড়ে অসম ছাত্র সম্মিলনীর কৃষ্টি শাখার উদ্বোধন করেছিলেন জ্যোতিপ্রসাদ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী গীতটি ছিল রবীন্দ্রনাথের’ হবে জয় হবে জয় হবে জয় রে, ওহে  বীর, হে নির্ভয়।’ হেমাঙ্গ বিশ্বাসের পরিচালনায়গীতটির পরিবেশনের সময় দর্শকদের এক কোণ থেকে ভেসে এল–’ আমাদের বাংলা গান চাই না।’ হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাড়াতাড়ি গানটির শেষ করলেন এবং পরের দিনের অনুষ্ঠান থেকে বাংলা গান বাদ দিলেন।অনুষ্ঠানের শেষে এ কথা জানতে পেরে জ্যোতিপ্রসাদ হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে বললেন–’ বিশ্বাস, আপনি আজকের প্রোগ্রাম থেকে রবীন্দ্র-সংগীত বাদ দিলেন কেন? গোলমালের ভয়ে  নাকি? আমরা অসমিয়ারা যদি রবীন্দ্র-সংগীতকে বাংলা গান বলে বাদ দিতে বলি, তাহলে বুঝতে হবে যে এটা অসমিয়া সংস্কৃতির দুর্দিন, বাংলা সংস্কৃতির নয়।’

জ্যোতিপ্রসাদ সমস্ত কথাই জনতার কল্যাণের কষ্টিপাথরেঘষে  নিয়ে তা আসল সোনা না পিতল পরীক্ষা করে দেখার জন্য শিল্পীদের  কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন যে জনতাকে খাইয়ে-দাইয়ে সুস্থ সবল হয়েশিল্পীরূপে প্রকাশ হওয়ার জন্য সমস্ত বাস্তব সুযোগ-সুবিধা দেওয়াই শিল্পীর অর্থনীতি। তাই জাতি, ধর্ম এবং ভাষাকে নিয়ে যারা জনতাকে বিভক্ত করে, জনতার ওপরে নির্যাতন চাপিয়ে দেয় অথবা জনতাকে  সংঘর্ষমুখীহওয়ার পথ রচনা করে সে কখনও শিল্পী হতে পারে না । তা সংস্কৃতির রূপ নয়– তাহলদুষ্কৃতির প্রতিরূপ– শিল্পীর আসলে  তার বিরুদ্ধে অভিযান চালানো উচিত।

জ্যোতিপ্রসাদ সংকীর্ণ প্রাদেশিকতাকে জাতি গঠন এবং বিকাশের প্রতিবন্ধক হিসেবে উল্লেখ করে গেছেন। অসমিয়া জাতি গঠনের বৈচিত্র্যপূর্ণ রূপ রঙকে অবহেলা করলে যে নানা ধরনের অহেতুক সংঘাত জাতিটাকেছিন্নভিন্ন করবে সে কথাও তিনি বারবার বলে গেছেন । তিনি বলে গেছেন যে কোনো একটা জাতি আলাদা ভাবে গড়ে উঠবে না এবং বিকশিতও হয় না। তাঁর ধারণা পৃথিবীর- ভারতের- অসমের ভবিষ্যতের সভ্যতা হল সমন্বয়ের সভ্যতা । অসমের  জাতি গঠনের কথা বলতে গিয়ে তিনি একটি রচনায় লিখেছেন – ‘অসমের ইতিহাস দেখিয়েছে যে অসমিয়া জাতি ভারতের অন্যান্য প্রদেশ থেকে আসা নানা ভারতবাসী  মানুষের স্রোত এবং অসমের স্থানীয় মানুষের নানা উপজাতি যুক্ত হয়ে বর্তমানের এই অসমিয়া জাতি হয়েছে। অসমিয়া জাতি একটা সংমিশ্রণ থেকে হওয়া জাতি। সেজন্যই আমরা চেষ্টা করি সেই সংমিশ্রণে অসমিয়াজাতিটির কলেবর বর্তমানে আসা অন্যান্য জাতির মানুষকে নিজেদের সঙ্গে সাঙ্গীকরন করে নিয়েবৃদ্ধি করতে পারি। এটা ইতিহাস সিদ্ধ। 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>