Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,জয়দীপ

ইরাবতী ধারাবাহিক: কদমতলি (পর্ব-৩) । শ্যামলী আচার্য

Reading Time: 4 minutes

“কদমতলি” শহর আর মফঃস্বল। প্রবাস আর স্বদেশ। কাঁটাতার আর নো ম্যানস ল্যাণ্ড। অপেক্ষা থাকেই। কখনও ঘরে ফেরার প্রতীক্ষা, কখনও ঘর ছাড়ার আকুলতা। কিশোরী থেকে বৃদ্ধা, শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্ক। সকলের মনের মধ্যে কোথায় এক কুঞ্জবন। সেখানে ঘর ছাড়া বাঁশির ডাক। সমাজ বদলের ডাক। পথের মাঝেই পথ হারিয়ে যায়। দিক ভুল হয়। আর সেই কদমতলা থেকে ভেসে আসে মধুর বাঁশি। বিবাগী হিয়ার নিরন্তর খুঁজে ফেরা কদমতলি। শ্যামলী আচার্যর নতুন উপন্যাস। আজ থাকছে কদমতলি পর্ব- ৩।


 

“এবার নতুন কাউকে দাঁড় করানো দরকার।”

       জয়দীপের কথায় হঠাৎ চুপ করে গেল সবাই। ঘরের মধ্যে সেই মুহূর্তে আলপিন পড়লেও যেন দুম করে শব্দ হবে।

       “নতুন মানে?”

       সুশান্তর গলাটাই আগে শোনা গেল। গম্ভীর। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আরও চার-পাঁচজন।

       “কী বলতে চাইছেন কমরেড? একটু খোলসা হোক।”

       উত্তমের ‘কমরেড’ শব্দটার মধ্যেকার হালকা খোঁচাটা একঝটকায় সরিয়ে দিল জয়দীপ। উত্তমকে পুরো উপেক্ষা করে এবার তার চোখ সুশান্তর দিকে।  

       “নতুন মানে, যে রাজনীতিতে নতুন না’ও হতে পারে, কিন্তু রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে তার মুখটা একদম নতুন।”

       হাঁ হাঁ করে ওঠে কয়েকজন। তাদের সম্মিলিত কথার মধ্যে ডুবে যেতে থাকে তাদের নিজেদের প্রশ্ন সংশয় আপত্তি আর পালটা যুক্তি। জয়দীপ একটু চুপ করে থাকে। হট্টগোল থামুক। তারপর ও ওর কথা বলবে। তার আগে থিতিয়ে দিতে হবে সকলের উষ্মা। ও সময় নেয়। ও ধীর স্থির। এই শান্ত স্বভাব ওর সহজাত। ছাত্র রাজনীতির মধ্যে সে পুরোপুরি নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছে। চট করে মাথা গরম না করে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষমতা তার আছে। এই কারণে কলেজের ইউনিটের বাইরেও পার্টিতে তার গ্রহণযোগ্যতা এই বয়সেই সামান্য বেশি। আবার সমসাময়িক একজন গুরুত্ব পেলে তার সঙ্গে জুড়ে যায় কাছাকাছি অন্য অনেকের ঈর্ষা আর গুরুত্বহীন অক্ষমের আক্ষেপের জলকাদামাখা গ্লানি। ওটুকুও আজকাল জয়দীপ সামলে নিতে শিখেছে। কেউ কেউ কিছু স্কিল নিজে থেকে শিখে ফেলে। জয়দীপ সেইরকম। অনীকদা বলেন, জয়দীপ ইজ ডিফারেন্ট। কুল অ্যান্ড কনফিডেন্ট।

যেটা প্রকাশ্যে কখনওই বলেন না, সেটা হল, ও কিন্তু বর্ন লীডার।

       নেতারা প্রকাশ্যে কবেই বা সব কথা স্বীকার করেছেন?

       কলেজের ইউনিয়ন রুমে বিকেলের দিকটা বেশ ভিড় থাকে। ক্লাস ফেরত, বাড়ি যাওয়ার আগে বা বাড়ি না গিয়ে আড্ডা গুলতানি চলতে থাকে। অধিকাংশ ছেলেমেয়ে যারা গটগট করে ইউনিয়ন রুমে ঢুকে পড়ে, তারা সবাই ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী না’ও হতে পারে। কেউ সমর্থক। কেউ ছাতার তলায় থাকতে চায়। নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে। আমি তোমাদেরই লোক জাতীয় একটা বার্তা রাখতে চায় আলগোছে। সন্ধে গড়ালে ভিড়ের চরিত্র বদলে যায়। কলেজটার একটা সুবিধে আছে। মর্নিং, ডে, নাইট তিনটে শিফটে ক্লাস হয়। প্রচুর ছাত্র-ছাত্রীর ভিড়। এমনিতেই মফঃস্বলের সীমানা শেষ হয়ে যে শহরের শুরু, সেই শহরের প্রান্তেই কলেজটি দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ষাট বছর ধরে। সব ধরনের ছাত্রের ভিড়। মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত, মেধাবী থেকে ঘষটে পাশ করা ছাত্র, সানগ্লাস পরা মাচো হিরো থেকে ধূলিধূসর প্যান্টে সাইকেলের কালি লাগা গুড বয়, ঝাঁ চকচকে সুন্দরী থেকে তেলচিটে বিনুনি ঝোলানো পড়ুয়ার সহাবস্থান। মোটামুটি শান্তিপূর্ণ। মর্নিং কলেজ আর্টসের পড়ুয়াদের জন্য। সেই সময় মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। দুপুরে সায়েন্স, আর্টস, কমার্সে ভরপুর ভিড়। নাইট কলেজ শুধু কমার্স স্ট্রিমের জন্য। সেই সময় ছাত্রদের জন্য নির্দিষ্ট। নাইট কলেজে মেয়েরা ভর্তি হতে পারে না।


আরো পড়ুন: ইরাবতী ধারাবাহিক: কদমতলি (পর্ব-২) । শ্যামলী আচার্য


       ইউনিয়ন রুমে সন্ধেবেলার আলোচনায় একটু অন্যরকম সব বিষয় উঠে আসে। সারাদিন দেশ বিদেশ অর্থনীতি সমাজনীতির টেবিল চাপড়ানো চেঁচামেচির পর সন্ধে হলেই রাজনৈতিক সংগঠনের জরুরি কিছু বিষয় অ্যাজেণ্ডায় থাকে। অলিখিত অ্যাজেণ্ডা। আলোচনা একটু একটু করে গম্ভীর হয়। কে কে আছে দেখে নিয়ে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যে সিদ্ধান্ত শুধু অঞ্চলে নয়, হয়ত রাজ্য রাজনীতিতেও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে। অন্তত দলীয় ব্যবস্থায় ধাপে ধাপে সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনার পথ খোলাই থাকে।

       এইরকম আলোচনাই চলছিল। সামনে পুরসভার ভোট। প্রার্থী নিয়ে কথাবার্তা চলছে। সবাই জানে এবারেও সুবল কর্মকার প্রার্থী হবে। অঞ্চলে বিধানসভায় মানস প্রামাণিক তিনবার জেতা বিধায়ক। কলেজটির ওপর তাঁর প্রভাব রয়েছে। প্রভাব বললে হয়ত একটু কমিয়ে বলা হয়। একে দখল বলাই ভালো। অর্থ স্পষ্ট হয়। এমনকী কলেজের ফোর্থ ক্লাস স্টাফ হিসেবে নিজের স্ত্রী মিলিকে তিনি বেশ কয়েক বছর আগেই এখানে পাকা চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আর তা’ নিয়ে কেউ কোনও আপত্তি করেছে বলে শোনা যায়নি। করার কথাও নয়। দীর্ঘদিন সংসদীয় রাজনীতি আর একই দলের বিরোধীহীন হয়ে ক্ষমতায় থাকার ফলে এইরকম কিছু ঘটনা ঘটতেই থাকে। কিন্তু কর্পোরেশন ইলেকশনে এবার তিনি মিলিকে দাঁড় করাতে চাইছেন। ঘনিষ্ঠ মহলে মিলির নাম উঠেছে বেশ কয়েকবার। যদিও শীর্ষস্তর অবধি আলোচনা হয়নি।

       কলেজের ইউনিয়ন রুমে কাউন্সিলর সুবল কর্মকারের আবার টিকিট পাওয়ার চান্স আর মিলি প্রামাণিককে প্রার্থী করার চেষ্টা নিয়েই খুব হালকাভাবে আলোচনা শুরু হয়েছিল। চট করে কঠিন দিকে গড়িয়ে গেল জয়দীপের মন্তব্যে।

       জয়দীপ পরিষ্কার বলে, “এবার একদম নতুন মুখ দরকার।” 

       হইচই ততক্ষণে থিতিয়ে পড়েছে। কিন্তু উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে যে যার তীর শাণিয়ে নিয়েছে। পালটা প্রশ্নের নামই গণতন্ত্র।

       প্রত্যেকের চোখের দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে জয়দীপ বলতে থাকে, “আমি জানি, তোমরা প্রত্যেকে অবাক হচ্ছ, আশ্চর্য হচ্ছ এবং বিরক্তও হচ্ছ। আগে তোমাদের কারণটা এক্সপ্লেন করি, তারপর তোমাদের যুক্তিগুলো শুনব বরং,” গলাটা ঝেড়ে নেয় একবার, বলে, “সুবলদারই তো টিকিট পাওয়ার কথা, এতদিনের পার্টি কর্মী, পুরসভায় কাজও করেছেন, এলাকায় পরিচিত মুখ। আবার এদিকে কানাঘুষোয় শুনছি মিলিদিকে দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু দুটো বিষয় ভাবতে হবে। এক, সুবলদা কিন্তু স্যাচুরেটেড। যা কাজ করেছেন, আর যা বাকি রয়েছে, তা’ নিয়ে বিক্ষোভ আছে। এলাকায় কান পাতলেই শোনা যাবে, জলের ট্যাঙ্ক আর পাইপলাইন নিয়ে প্রচুর অভিযোগ। এবার দাঁড়ালে ওই ফ্যাক্টরগুলো ওনার বিরুদ্ধে যেতে পারে। মিলিদি দাঁড়ালে তিনি কিন্তু হয়ে যাবেন মানস প্রামাণিকের মুখ। নিজের সিদ্ধান্তে যতটুকু কাজ করা দরকার, ততটুকু তাকে করতে দেওয়া হবে বলে আমার মনে হয় না। পার্টির সিদ্ধান্ত বলে যেগুলো করতে হবে, সেগুলো তো আসলে মানস প্রামাণিক মারফত আসবে। এলাকার বিধায়ক বলে কথা…”

       জয়দীপকে থামিয়ে উত্তম বলে ওঠে, “এসব অসাংবিধানিক কথা। বললেই হল নাকি? আমাদের পার্টি রীতিমতো রেজিমেন্টেড পার্টি। এখানে ব্যক্তির চেয়ে দল বড়। কখনওই অঞ্চলের বিধায়ক তার স্ত্রীর ওপর মতামত চাপিয়ে দেবেন না। যা হবে, আইন মেনেই হবে। দলের রুল মেনেই হবে। আপনি ভুলে যাচ্ছেন কমরেড, আমাদের পার্টি আর সরকার কিন্তু আলাদা।”  

       উত্তমকে উত্তেজিত ভাবে কথা বলতে দেখে জয়দীপ হালকা একটা হাসি ঝুলিয়ে দেয় ঠোঁটের ওপর। এই সময় রেগে যাওয়া বা পালটা তর্ক করা বোকামি। তার চেয়ে বিপক্ষ কিছুক্ষণ বলুক। তার যুক্তির ফাঁক খুঁজে তার অস্ত্রেই তাকে ঘায়েল করা যাবে।

       জয়দীপ টেবিলের ওপর থেকে উইলস ফ্লেকের সাদা প্যাকেটটা হালকা করে টেনে নেয়। ভেতরে সিগারেট নেই একটাও। রুপোলি রাংতা কাগজটা বড় নিষ্প্রভ। সেটা ভেতর থেকে টেনে বের করে নিতে থাকে জয়দীপ। ওর চোখ দুটো কিন্তু উত্তমের দিক থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও সরে না। বাঁহাতে রূপোলি কাগজের সাদা দিকটা সমান করতে করতে বলে, “তোর সাইকেলের ক্যারিয়ার থেকে ডায়েরিটা পড়ে গেছে, পেয়েছিলি?”

       আচমকা প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় উত্তম।

       তার ডায়েরি হারিয়ে গেছে, এটা তো জয়দীপের জানার কথা নয়। দুজনে আলাদা ডিপার্টমেন্ট, বয়সেও উত্তম এক বছরের সিনিয়র। উত্তম রোজই কলেজে ঢোকে বেলা দুটোর পরে। জয়দীপ সকালেই চলে আসে। তাহলে সে জানল কী করে, সকালে তার ক্যারিয়ার থেকে ডায়েরিটা পড়ে গিয়ে হারিয়ে গেছে?

       ওই ডায়েরিতে তার পার্টির প্রচুর নোটস নেওয়া ছিল। অনেক ফোন নম্বর। চট করে যেগুলো পাওয়া মুশকিল।    

       ডায়েরিটা যে হারিয়ে গেছে, এটা উত্তম এখনও অবধি কাউকেই বলেনি।        

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>