Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,ঝুলন

পরম্পরা ও ঐতিহ্যে বাংলা ঝুলন । পৃথ্বীশ মজুমদার

Reading Time: 4 minutes

কুলবতীগৌরব বাম চরণে ঠেলি কুঞ্জে কইলু অভিসার।।’ অতএব শ্রাবণের প্রবল ঝঞ্ঝাতার সাথে লোকলাজকে উপেক্ষা করে শ্রীমতী রাধিকা কুঞ্জে অভিসার করলেন। তিনি জানেন তথায় তাঁর প্রানবল্লভ কৃষ্ণ অপেক্ষামান। তাই তিনি তাঁর একমাত্র সখীকে নিয়েই প্রবেশ করলেন রাসমঞ্চে। দীর্ঘপথের ক্লান্তি ম্লান হল প্রিয়তমের আদরে– ‘আদরে আগুসরি রাই হৃদয়ে ধরিজানু উপরে পুন রাখি।নিজ করকমলে চরণযুগ মোছইহেরইতে চির থির আঁখি।।’ কৃষ্ণের চর্চিতা রাধা শুধু কৃষ্ণের প্রাণধন নয় বরং বাংলার রাধা বাংলার প্রাণের ধন। ভক্তির আতিশয্যে নয় সাধনায় নয়বাঙ্গালির কল্পনায় রাখালবালক কৃষ্ণের পাশে স্থান পেয়েছে রাধা। রাধার সেই ক্রমবিকাশ সাহিত্যের আঙ্গিনা পেরিয়ে বৈষ্ণব তাত্ত্বিকদের হাত ধরে স্বীকৃতি পেয়েছে ধর্মে। কিন্তু তারপরেও বাংলার মানুষের মন থেকে সম্পূর্ণ রূপে মুছে যায়নি রাধার মানবীরূপটি। পদাবলিতে তার প্রভাব আছে।

চৈতন্য পূর্ববর্তী সাহিত্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের গীতিকারের হাতে রাধার গ্রাম্য রূপটি পেয়েছে বাংলার জনগণ। জনজীবনের সুখ দুঃখের কাহিনীর বর্ণনা দিতে গিয়ে বাংলায় লোকজ সাহিত্যে বিশেষ চরিত্রের উপস্থাপন নতুন কিছু নয়। জসীমঊদ্দিনের সংগৃহীত পল্লিগীতিতে রূপাই সাজুর জীবনের আলেখ্য এমনই গ্রাম্য প্রেমকথার নিদর্শন। গ্রাম্য মেয়েলি গীত হিসেবে চিহ্নিত গান ও বিয়ের গানের উপস্থিতিতেও দেখা গেছে চরিত্র নির্বাচনের সমধর্মীতা। বীরভূম ও বাঁকুড়ার ভাদুকে ঘিরেও প্রচলন ঘটেছে ভাদুর বিয়ের প্রসঙ্গ – বাংলায় জহরব্রত না থাকলেও বাংলার প্রতিবাদী এই কন্যার জীবনের আত্মত্যাগ ঢাকা পড়ে গেছে তাঁর বাল্য আর কৈশোরের প্রেমের কাহিনি কল্পনাতে। বাঙালি লোকগীতিকাররাও জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ বর্ণনাতে সেই ত্যাগের স্থান কোথাও দেননি। পূর্ববঙ্গ ঘেষা সিলেটের জনজীবনে কৃষ্ণপ্রেম নতুন কিছু নয়। মনিপুরের রাস উৎসবও তাদের অজানা নয়। আর নামদেব শঙ্করদেবের সূত্র ধরে সারা অসম জুড়ে ছড়িয়ে গেছে কীর্তন। এই শিলেটের লোকচর্চা জন্ম দিয়েছে ধামাইল। রাধাকৃষ্ণের রাস সেই গানের অন্যতম অলোচ্য একটি বিষয়। উৎসবের আঙ্গিকে গাওয়া সেই গানের আর একটি দিক নৃত্য। গোলাকারে বৃন্দনৃত্যের ধরণে বয়ে চলা ছন্দের পরিবর্তনে সখীবেশি তরুণীদের আনন্দ হিল্লোলে সেইগানে প্রকাশ পায় রাধার মিলনানন্দ।

রাধাকৃষ্ণ বাংলারই। গোপীপ্রেমের সাধনাও চৈতন্যদেবের হাত ধরেই সর্বাধিক চর্চিত হয়েছে। চৈতন্য পূর্ববর্তী সময়ে দক্ষিণ ভারতের আড়বার গোষ্ঠির উপাস্য কৃষ্ণবিষ্ণু হলেও তার পাশে স্থান পায়নি রাধা। রাধাতত্ত্ব বৈষ্ণব গোস্বামীদের হাত ধরে চৈতন্যপরবর্তী সময়েই স্থান পেয়েছে নানা সাহিত্যেজন্ম নিয়েছে ‘উজ্জ্বলনীলমণি’র মত গ্রন্থ। মহাপ্রভু আর আতিবড়ি জগন্নাথের বিতর্কিত ভাগবততত্ত্ব চর্চার সেই প্রসঙ্গের দিকে দেখলেও দেখা যাবে নীলাচললীলাতেও ভাগবতে রাধাতত্ত্বের স্থান নিয়ে মতানৈক্যের দিকটি। ‘চৈতন্য চকড়া’তে জানা যাচ্ছে মহাপ্রভুর নির্দেশে স্বরূপ দামোদর জগন্নাথকে জিজ্ঞেস করেন ‘পচার সে রাধা নাম ভাগবতে কাহিঁ নাহিঁ’। উত্তরে জগন্নাথ জানান ‘ সাধ্য বস্তু শ্রীকৃষ্ণ। আর এ জীব নিরন্তর সাধক’। বৃন্দাবনের অবস্থান সাধকের হৃদয়ের অনাহূত চক্রে। ভক্তি আর মুক্তি প্রদায়িকা রাধার অবস্থানও তাই সাধকের মনেই। রাধা তাই কৃষ্ণের প্রকৃতি স্বরূপা হলেও বাহ্যত তাঁর কোনো রূপ নেই। খুব আশ্চর্যের বিষয় এই বাংলায় বৌদ্ধধর্মকে ব্যতিরেকে অন্য দুই মুখ্যধর্ম শাক্ত আর বৈষ্ণবের প্রথমটিতে উপাস্য দেবী কালির পদতলে পুরূষরূপা শিবের সংযোজনও ঘটেছে পরবর্তীতে আর বৈষ্ণবের রাধার ইতিহাসসেও মানুষেরই প্রেম কল্পনাজাত। আর বাঙালির এই দুই যৌথ দেবতার স্ত্রীদ্বয় পুরুষের দ্বারা বিশেষভাবে আরাধিত। শুধু পুরুষের প্রকৃতি বা শক্তি হিসেবে নয় তারা পুরুষের প্রেমিকা হিসেবেই বাঙালির কাছে অধিক জনপ্রিয়যদিও কালির ক্ষেত্রে তন্ত্রের প্রভাবই মুখ্য। কৃষ্ণের প্রেমিক সত্তার প্রকাশ ও সর্বাধিক পরিচিতি ঘটেছে গীতগোবিন্দের ‘দেহি পদপল্লব’ পদটিতে। সংস্কৃতে রচিত হলেও উল্ল্যেখ্য এই পদের রচয়িতাও একজন বাঙালি।


আরো পড়ুন: তেত্রো দি সান কারলো অপেরা হাউজ । আরফাতুন নাবিলা


আসুন তত্ত্বকথার কচঅকচানি ছেড়ে এবার মানবলোকে সেই কিংবদন্তি নায়কনায়িকার প্রেমপ্রবাহের উৎসবের আচরিত দিকে অবলোকন করি। এবং তার অন্যতম একটি লীলা ঝুলন বিষয়ে কিঞ্চিত আলোচনায় রত হই। কৃষ্ণের অষ্টকালীন লীলা আর রাসের উপর নির্ভর করে চল রয়েছে বঙ্গদেশে কৃষ্ণ আরাধনার বিশেষ উৎসবের। ভাগবতে শ্রীকৃষ্ণের শারদ আর শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে বসন্তকালীন রাসের উল্লেখ পাওয়া যায়। বঙ্গদেশে শারদকালীন রাস সারা ভারতের সাথে পালিত হয় ঝুলনযাত্রা নামে। ঝুলনের উপজীব্য বিষয় কৃষ্ণরাধার বৃন্দাবনের কুঞ্জে কুঞ্জলতায় নির্মিত দোলনায় উপবেশন ও প্রেমানূভূতি। লীলাবতারের এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বৈষ্ণব মঠ মিশনে থেকে শুরু করে অভিজাতবর্গের কুলদেবতাকে দোলনায় স্থাপন করতে দেখা যায় শ্রাবণ পূর্ণিমার পূর্ববর্তী একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত। কোথাও কোথাও বালগোপালকেও দোলনায় চড়াতে দেখা যায়। কিন্তু এ তো গেল ঝুলনকিন্তু শব্দটিতে আছে যাত্রা নামক আরও একটি শব্দ। বাংলাতে পালিত হয় দোলযাত্রাচন্দন দোলযাত্রা। যাত্রার মধ্য দিয়ে দেবতাকে নিয়ে নগর পরিক্রমা প্রাচীন সভ্যতাতেও দেখা গেছে। কিন্তু ঝুলনের ক্ষেত্রে এই নগরযাত্রা সম্ভব নয়। অন্তত তার নমুনাও কোথাও পাওয়া যায় না। ঝুলনের ক্ষেত্রে এই যাত্রাকে দুটিভাবে দেখা যেতে পারে এককৃষ্ণের উদ্দেশ্যে রাধার অভিসার কল্পনাতে উদ্দিষ্টস্থানে যাত্রাকে বোঝাতেদুইকৃষ্ণের এই লীলার স্মরণে রাধাকৃষ্ণবিষয়ক যাত্রা বা নাট্যলীলার চল। পরবর্তীতে যা কীর্তনের সাথে মিশে গেছে। বাংলায় সেই যাত্রা শুধুই কৃষ্ণবিষয়ক ছিল কিন্তু তার কোন প্রাচীন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে কীর্তন প্রসঙ্গ বাদ দিলে বিংশ শতাব্দী থেকে বাংলায় ঝুলন বাংলার উৎসবের অঙ্গ হিসেবেই পরিগণিত হতে থাকে। জমিদার ও রাজবংশের ঝুলনকে কেন্দ্র করে দেখা যায় মেলার উপস্থিতি। পাশাপাশি এর হাত ধরেই জন্ম নেয় ঝুলনের পুতুল। বৃন্দাবনে গোপিদের মূর্তি স্থান পায় ঝুলনের সময়। বাংলাতেও বেশিরভাগ মন্দিরে স্থান পায় এই গোপিগণ। কিন্তু এর পাশাপাশি বাংলার কোথাও কোথাও স্থান পায় মানবায়িত পুতুল। বাংলার ঝুলন এই দিক দিয়েই সকলের থেকে আলাদা হয়ে উঠেছে। খ্রিষ্টের জন্মোৎসব পালনের সময় ক্যাথলিক পন্থিরা মাটির বিভিন্ন পুতুল দিয়ে জন্মোমূহুর্তের সেই সময় ও পরিবেশটিকে তুলে ধরেন। যিশু মাতা মেরির পাশে সেখানে স্থান পায় গোপালক কর্মরর পুরুষ ও মহিলা। বাংলায় এই বিষয়টি খ্রিষ্টানধর্মের এই বিষয়ের অনুকরণ কখনোই নয়কিন্তু মুর্শিদাবাদ নদিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের ঝুলনে দেখা মেলে সাধারণ মানব পুতুলের কৃষ্ণরাধার দোলুল্যমান মূর্তির পাশেই স্থান পায় কৃষকজেলেরন্ধনরতা মহিলার মূর্তি। রাধাকৃষ্ণের মতই ঝুলনের আর একটি অপরিহার্য পুতুল হল বুড়োর পুতুল। হুকোহাতে এক ঘাঁড় কুজো বুড়োর পুতুলেরকোনো কোনো ক্ষেত্রে বুড়োর পাশে দেখা যায় এক মহিলাকে পদমর্দন করতে। এই পুতুলের গঠনটিও অদ্ভুত বুড়োর মাথা অংশটিকে আলাদাভাবে জোড়া থাকে এবং ঘাড়ের পিছনদিকে থাকে একটি সুতো যেটিকে ধরে নাড়ানো যায়। আসলে এই সুতোটি ধরে নাড়ানোর সময় বুড়োর প্রতি শারীরিক কুশল বার্তা জিজ্ঞেস করে মুর্শিদাবাদের বালকবালিকারা এবং পেছনে দড়ির নাড়ানোর মধ্য দিয়ে সম্মতিসূচক হ্যাঁ প্রকাশে আনন্দ লাভ করে শিশুকুল। বুড়োর এই মূর্তির চলের সালতারিখ জানা যায় না। কিন্ত সময়ের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে ঝুলনের পুতুলে সংযোজন ঘটেছে বিভিন্ন সময়ে। ঝুলনের পুতুল সাজানোর জন্য বেছে নেওয়া হয় একটিস্থানকে। তারপর কাঠের গুড়িতে বিভিন্ন রঙমিশিয়ে সেই গুড়ি দিয়ে নির্মিত হয় মাঠকৃষিভূমিদুদিকে তৈরি করা হয় দুটি পাহাড় সাজানো হয় সৈন্য দ্বারা। কার্গিলের যুদ্ধের পরের ঝুলনে একটি পাহাড়কে পাকিস্তান অপরটিকে ভারত বলেও চিহ্নিত করতে দেখা গেছে। একইভাবে বিভিন্নসময়ের ফিল্মজগম থেকে শুরু করে সমাজজীবনের ঘটনার প্রতিফলন দেখা গেছে ঝুলনের পুতুলে। উঠে এসেছে বিক্রম বেতালের পুতুলকিংকং গর্জিলা, ‘সরগম’ ফিল্মের ‘ডাফলি বালে’ গানে নৃত্যরতা পুতুলকৃষস্পাইডার ম্যানব্যাটম্যান প্রভৃতিলাদেনের আমেরিকা হামলা কিংবা ধনঞ্জয়ের ফাঁসির পর তার পুতুলও ঝুলনের আঙ্গিনায় স্থান পেয়েছে। সাপুড়েঁজেলের পাশাপাশি তারকনাথ ধামের উদ্দ্যশ্যে গমনরত পুণ্যার্থীদের পুতুল। পুতুল ঝুলনের মতই শান্তিপুর ও মুর্শিদাবাদের নশিপুরে চল আছে মানুষ ঝুলনের। নশিপুরের ঝুলন নসিপুরের মহারাজা রঞ্জিত সিংহের সময় থেকে শুরু হয়। প্রায় দুশো বছরের পুরোনো এই ঝুলনের সম্য একটা হাতিকে পুরো রুপোর সাজে সাজিয়ে বের করা হত। নবাব আমলে এই রাজবাড়িকে ঘিরে দুটি স্থানে যাত্রা হত – নিকটবর্তী আখরায় ও রাজবাড়িতে। আখড়ায় একইসঙ্গে আলকাপও হোত। সেই উপলক্ষ্যে লোকসমাগম ঘটত আশেপাশের গ্রাম থেকে। নশিপুর রাজারা ছিলেন রামভক্তমূল্যবান ধাতু্র কুলদেবতা সহ অন্যান্য দেবতাদের আনা হোত গর্ভগৃহের বাইরে। বর্তমানেও সেই নিয়মের চল আছে। কিন্তু নশিপুরের রাজবাড়ির ঝুলন বললে মানুষ ঝুলনের কথা মনে হয়। এর সূত্রপাত কবে জানা না গেলেও মানুষদের বিভিন্ন চরিত্রে সাজিয়ে তাদের উপস্থাপন করা হয় দর্শকদের সামনে। অনুরূপ ঝুলনের চল শান্তিপুরেও আছে। বিচিত্র চরিত্রের উপস্থাপনে হুতুমের নকশার মতো চলমান চরিত্রের এক যাত্রা যেন ঝুলন। রথযাত্রার মেলায় ঝুলনের এই মূর্তি বা পুতুল বিক্রি হতে দেখা যায়। যদিও কালস্রোতে ভাঁটা পড়েছে ঝুলন পালনে। বিভিন্ন স্থানে এখন ঝুলন হলেও ব্যক্তিগত উদ্যোগ কম। ফলে ঝুলনের সাথে জড়িত পুতুল বিক্রেতাদের ও বহুরূপী পেশাদারদের সংকট ও তাদের বিকল্প জীবিকের সন্ধানের দিকটি আজ স্পষ্ট। কালের গতিপথে ঝুলনের এই হারিয়ে যাওয়া দিকটি শুধু বেদনারই নয় স্থানিক উৎসবের বৈচিত্র্যের অবলুপ্তির দিকটিও সুখের আভাস দিতে অক্ষম।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>