Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,ট্রমা

ধারাবাহিক: চিন্তামণির দরবার (পর্ব-১৮) । জয়তী রায় মুনিয়া

Reading Time: 3 minutes

চিন্তা মণি র দরবারে স্বাগত বন্ধুরা।

এই পর্বের আলোচনায় আসছি জীবন দুর্বিষহ করা একটি বিষয় নিয়ে। ট্রমা। মানসিক আঘাত। ছোট থেকেই সতর্ক না থাকলে ট্রমা বা বিষন্নতা গ্রাস করে সহজেই। এই বিষন্নতা  ঘন কুয়াশার মত মনের চারদিক ঘিরে ধরে। মানুষকে আক্রান্ত করে। ঘন কুয়াশায় পথ দেখতে পায় না জীবনের গাড়ি। দুর্ঘটনা ঘটে একের পর এক।

এই কুয়াশা সরিয়ে সূর্যের আলো প্রবেশ করাতে গেলে , প্রকৃত জীবনমুখী হয়ে উঠতে গেলে কতগুলি অভ্যাস জরুরি। আলোচনার বিষয় সেইগুলি।

ট্রমা( trauma) কারণ অথবা অকারণ। কথায় কথায় এই শব্দ উচ্চারণ আজকাল অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছে। ট্রমায় ভুগছে বা ট্রমায় চলে গেছে। সত্যি বলতে কি, কথার গুরুত্ব বুঝলে শব্দ এত সহজে ব্যবহার করতাম না।

করোনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে ট্রমা বা রক্তাক্ত মানসিক আঘাত ঠিক কত প্রবল।  তাৎক্ষণিক এমন বহু ভয়ঙ্কর ঘটনা, দীর্ঘদিন মনের উপর রাজত্ব করে যায়। নিকট জনের মৃত্যু বা নিকট জনের সঙ্গে বিচ্ছেদ , দুর্ঘটনা ইত্যাদি আকস্মিক ঘটনা থেকে মানসিক আঘাত বহুদিন পঙ্গু করে রাখে মানুষকে।

  একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা থেকে সৃষ্ট ট্রমা ব্যাখ্যা করা যায়। ধীরে ধীরে চেষ্টা করা যায় ঘটনার মূল কেন্দ্রে পৌঁছে যাওয়ার। কারণ, কোনো সমস্যাই শিকড়হীন নয়। মনোবিদ চেষ্টা করেন মূল ব্যাপারটিকে বিশ্লেষণ করার নতুবা চট জলদি ওষুধ দিয়ে দেন।

কথায় আছে ট্রমার শিকার। কথাটা লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে, ট্রমা হল শিকারি আমরা শিকার। এবার শিকারির হাতে শিকার ধরা পড়ে সতর্ক থাকে না বলে। প্রতিদিন খুব অল্প পরিমাণে , ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে শিকারি। সারাদিন কি এক রকম যায়? মোটেই না। আজ সকালেই আমি কতকিছু ভেবে একটা প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, কেউ এসে ভন্ডুল করে দিল সকলের প্ল্যান। সাধারণত, এমন ঘটনায় একটা খিচ খিচ তৈয়ারী হয়। ফলত সারাদিন খারাপ যায়। সামান্য হলেও ট্রমার সৃষ্টি হয়। ছোট ছোট আঘাতে বিপর্যস্ত মন, সময় পায়না নিজেকে তৈরি করার , ফলে , বাঘের মত লাফিয়ে পড়া ভয়ঙ্কর ঘটনার চাপে তলিয়ে যায় অতলে। তাহলে কি করা উচিত? ট্রমাহীন জীবন সোনার পাথরবাটি। হয় না। অনেকে বলেন, সবকিছু ঈশ্বরে সমর্পণ করে দাও শান্তি পাবে। শেষ জীবনে বহু মানুষ ধর্মে কর্মে মেতে ওঠে। নাম জপ ধ্যান করেন। সাধুসঙ্গ করে সাধুদের অমৃত বাণী শুনে সাময়িক শান্তি লাভ করেন। মনে রাখতে হবে, ঈশ্বর কিন্তু একটি লাঠি। ইতিবাচক লাঠি। কিন্তু , সেই নির্ভরশীল হয়ে যাওয়া। সেটাও কিন্তু কাম্য নয়। অনেক ঈশ্বর বিশ্বাসীর জীবনে যেই একটা দুর্ঘটনা ঘটল, সে বলতে শুরু করবে: এত ডাকাডাকি করে কি লাভ হল?

অর্থাৎ, আমার ট্রমার সময় তুমি প্রকট হলে না কেন? এই ভেবে ভেবে নিজেকে আরও অস্থির করে তোলা। ঈশ্বর পূজার জন্য ঠাকুরঘর পঞ্চাশবার পরিষ্কার করি। ঈশ্বর বসিয়ে রাখার জন্য মনের ঘর কতবার পরিষ্কার করি? মনের ঘর প্রস্তুত করি কী? প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে মন, তাকে নিয়ে বসে মলম লাগিয়ে মজবুত করি কী?

মুশকিল হল, আমরা টাকা পয়সা ব্যাংকে রাখি অসময়ের জন্য কিন্তু এখন কখনো ভাবতে পারিনা মনের ব্যাংকে জমা করা পুঁজির কথা। আমরা ভাবতে থাকি, এই যে কাজ করছি এই যে খ্যাতি হচ্ছে অথবা হচ্ছে না … এটাই জীবন। সাফল্য হল তো খুব উপভোগ করছি, ব্যর্থতার লজ্জায় হাউ হাউ করে কাঁদছি। আরে, সাফল্য আমার ব্যর্থতাও আমার। দুটোই নেব। কেন কাঁদব? কেন ব্যর্থতার মুখোশ পরা ট্রমাকে শিকার করতে দেব আমার দুর্লভ জীবন? ছোট ছোট চোরকাঁটা বিষাদ কিন্তু মারাত্মক। জীবনের রাস্তা থেকে একটি একটি করে তুলতে হবে রোজ। রোজ। রোজ। নাহলে, এমন রাস্তা তৈরি করবে, আর হাঁটতে পারব না। জীবন হবে কণ্টকময়। 

ভুলে যাই, বার্ধক্য অবশ্যম্ভাবী। সে আসছে। বিকল হবে শরীরের যন্ত্রপাতি। হতে বাধ্য। চুল পেকে যাবে। বলিরেখা পড়বে। কেউ সেভাবে খবর নেবে না। বুড়োদের এড়িয়ে চলে লোক। অর্থাৎ উপরের শরীর আর আগের মত ঝলমল টলমল থাকবে না। তখন? কে আমাদের হাত ধরবে? কে বাঁচাবে বৃদ্ধ বয়সের মরুভূমির গ্রাস থেকে? মন। মনের চাইতে বড় বন্ধু তখন আর কেউ নেই। এবার , সেই মনকে তো জল সার মাটি কিছুই দেওয়া হয়নি। দিয়েছি , ঈর্ষা, হতাশা অবসাদ। বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করিনি। পরার্থে ব্যয় করেছি।

স্বাস্থ্যবান শক্তিশালী মনের পরিবর্তে পোকায় খাওয়া হেরে যাওয়া মন , কীকরে লড়াই করবে, বাতের ব্যথার সঙ্গে? ছেলে বউয়ের অবহেলার সঙ্গে? বার্ধক্যের আরো অনেক রকম লোকসানের সঙ্গে! এইসময় বিচ্ছেদ হতে পারে স্বামী স্ত্রীর। মৃত্যু আসবেই। কেউ থাকে কেউ চলে যায়। ওই সময় ট্রমা আসে ভয়ঙ্কর ।

ট্রমা সাইলেন্ট কিলার। নিঃশব্দ ঘাতক। এখন থেকেই মন সুন্দর রাখার ব্যায়াম শুরু করতে হবে। নেগেটিভ চিন্তা নৈব নৈব চ। কে কি করল নয়, নিজে কি করলাম সেটাই দেখতে হবে। আমিকে ভালোবাসতে হবে। এই আমি যদি সুন্দর থাকি উজ্জ্বল থাকি তবে ট্রমার মোকাবিলা করতে পারব। পারব ই।


আরো পড়ুন: চিন্তামণির দরবার (পর্ব-১৭) । জয়তী রায় মুনিয়া


 ট্রমা

 মানসিক ট্রমা দিয়ে অর্থাৎ কুয়াশা ভরা রাস্তা দিয়ে যারা যায়, তাদের অসহনীয় মানসিক অবস্থা কেউ কল্পনা করতে পারবে না। কুয়াশায় পথ দেখতে না পেয়ে গাড়ি বারবার ভুল রাস্তায় যেতে যেতে হাঁফিয়ে যায়। তেমনি, কোনো মানুষ ভালো থাকার অভিনয় করে, কাছের মানুষের থেকে দূরে চলে যেতে চেষ্টা করে।

কি চায় ট্রমা র শিকার মানুষ? শান্তি? সঙ্গ? বিশ্বাস? কি চায়?

এইটাই সমস্যা। কি চায়..নিজেই জানে না। তাই, প্রতিদিন একটু একটু করে সমস্যা আক্রান্ত হয়। এমন অবস্থা হয় যে, মানুষ খালি চোখেও ভূত দেখে। তুচ্ছ সমস্যা মনে হয় যেন বিরাট… যেন মুক্তি নেই! জীবন হয় ওঠে জটিল। মাথা ঘুরতে থাকে। বুক ধড়ফড় করে। রাগ হয়। অরুচি। অথবা বেশি খাওয়া। ঘুম হয় না। মাংস পেশি তে ব্যথা। বদ হজম। চোখের নিচে কালি।  গ্যাস। সেক্স অনীহা। ফোবিয়া বা অহেতুক ভয় গ্রাস করে। শরীর ধীরে ধীরে খারাপ হতে শুরু করে।

ট্রমা কাটানোর একটা বড় উপায় হল , পোষ্য রাখা। পোষ্য র অনুগত ভাব মন সুন্দর রাখে। বাইরে বেড়াতে যাওয়া। আর ধ্যান করা। ধ্যান করলে মানসিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। একাগ্রতা বাড়বে।

ঘরে ফুল রাখুন। স্ট্রেসের কারণ খাতায় লিখে রাখুন। সবচেয়ে বড় কথা, নিজেকে সময় দিতে হবে। নিজেকে নিয়ে বসতে হবে। নিজেকে ভালোবাসতে হবে। এটাই সবচেয়ে জরুরি।

মনে রাখতে হবে, কুয়াশা খুব ঘন হয়ে গেলে গাড়ি খাদে পড়ে যেতে বাধ্য। সাবধান হতে হবে এখন থেকেই।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>