| 25 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: অমৃতস্য পুত্রা (পর্ব-১৪) । অনিন্দিতা মণ্ডল

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

কিসসা ৫

এই এলোমেলো স্মৃতিচারণার মধ্যে ঘুরে ঘুরে আসে বহু এমন কথা যা পড়তে গিয়ে মনে হতেই পারে, এ কেমন? এক কথা এতবার কেন? আসলে ওই সব স্মৃতি হয়তো যেমন লিখছি তেমনটি ঘটেনি। ঘটেছে সময়কে কুণ্ডলী পাকিয়ে। চাকার মতন একই জায়গায় ঘুরে ঘুরে এসেছে সেসব। নিজের অবাক লেগেছে। মনে হয়েছে, এমনই ভরা ঘরে এমনই মানুষজনের মাঝে এভাবেই কি একদিন এই এই কথাই হয়নি? এই কথাই কি বাবা সেদিন বলেনি? আমিও অভিমানে চোখ নামিয়ে নিইনি?

একদিন যেমন একটি লেখা পড়তে গিয়ে হঠাত মনে হল, এমনই শীতের এক কাকভোরে, তখনও দিগন্ত জুড়ে আঁধার, আমরা যেন কোথায় গিয়েছিলাম…সেখানে উঁচুনিচু মেঠো পথের শেষে যেন অজানা ফুলের তীব্র সুবাস ছিল…অধীর আগ্রহে যেন অপেক্ষা করছিলাম কিছুর জন্য…সে যে কীসের অপেক্ষা সে আর মনে পড়ল না। শুধু মনের মধ্যে উথালপাথাল। কিসের অপেক্ষা কার অপেক্ষায় কিছুই মনে পড়ল না, শুধু সেই অদ্ভুত আকুতিটুকু জেগে রইল।

সেই তীব্র আবেগ এখনও অনুভব করি, আর মনে হয়, এই একটি ঘটনা হয়ত বা বাস্তব নয়। হয়তো স্বপ্নে দেখেছি। স্বপ্নের সেই অনুভূতি তাড়া করছে আমায়।

যে কথা আগে বলেছি, ভাস্করদার সেই বাড়ির কথা। তার ছবিটা এখন পরিস্কার দেখতে পাই। ভাস্করদার বাড়ি ছিল উড়িষ্যা আর অন্ধ্রের সীমানায় এক গ্রামে। সমুদ্র থেকে দূরে। বরং নরম নরম ঢালের পাহাড় ছিল। ছিল জঙ্গল। নদী ছিল ছোট। ভাস্করদা বলেছিল ওদের গ্রামে সবাই চাষি। ওরাও তাই। ভাস্করদাদের ঘর ছিল জঙ্গলের ধারে এক অমনি নরম ঢালে। ওদের ঘরের পাশেই একটা ঘাসে ভরা মাঠ ছিল। সেই মাঠে কেউ কখনও চাষ করেনি। মাঠে দাঁড়ালে সবসময় গোড়ালি ভেজা জল। আমরা অবাক হয়েছি। তাহলে কি ওখানে সবসময় বৃষ্টি পড়ে? ভাস্করদা আমাদের অজ্ঞতা দেখে বলেছে, না না। ওই জল থেকেই তো নদী গো। জল ঢাল বেয়ে চুয়ে চুয়ে পড়ে নদী হয়। আরও দূরে গিয়ে দেখবে কত বড় ঝরনা! ও নদীর জল আমাদের চাষের জল যোগাত সারা বছর। আমাদের দেবতা ও। সেই দেবতা খেপে গিয়ে ওদের ঘরছাড়া করত, তবু ওদের দুঃখ ছিল না। পাপের শাস্তি যে। আবার জল সরে গেলে নেমে আসত ওরা। কিন্তু নদীর বাঁধ ওদের পেটে হাত দিলো।   

ভাস্করদার বাড়ি আমরা কখনও যাইনি। কিন্তু মনে মনে ওরকম একটা নদীর ধারে যে কতবার দাঁড়িয়েছি! কতবার ওই গোড়ালি ডোবা জলে পা ডুবিয়ে ওই মাঠে দাঁড়িয়েছি! ঢালের উল্টো দিকে চেয়ে ভেবেছি, ওই ঢালে আমাদের কুঁড়ে হবে বেশ। এই তো জল। আমরা ধান চাষ করব। ভাস্করদা আমাদের কাছেই থাকবে। আর ভাস্করদা থাকলেই মাও থাকবে। নিশ্চিন্ত জীবন।

কিন্তু স্বভাব যাযাবর আমাদের বাবা মা। মফস্বলের সেই বাড়ি ঘর ছেড়ে আমরা চলে এলাম শহরে। অন্যান্য সব কিছুর মতো ভুলোকাকা ভাস্করদা আর পাগলা গারদ রয়ে গেলো মনে।

সে বাড়ির পেছনে সেই যে একতলা ছায়ায় ঘেরা বাড়িটি, খুকুমণিদিদের বাড়ি, তার জন্য আমার মন কেমন করত। নিজে বুঝিনি। শহরের ঘরে, চারিদিকে গমগমে বাজারের আওয়াজ, রাতে এ রাস্তা ঘুমোয় না, সেখানে আমার স্বপ্নে আসত এক অষ্টাদশী। তার মোটা বিনুনি আর ডুরে তাঁতের শাড়ির খসখস আওয়াজ। সে কলেজ থেকে সন্ধ্যের শুরুতে ফিরছে। খুকুমণিদি। ‘গুগুল, আসবি নাকি? আয় তবে। একটু পরেই চলে যাস।’ আমি তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে শুনতে পেতাম খুকুমণিদির বাবার গলা।

মাও সে তুং লাল সেলাম

তোমার জ্বালায় জ্বলে গেলাম

বাপের নাম ভুলে গেলাম…

পেছনে পাড়ার ছেলেদের হাসির আওয়াজ। আমি সেই অকালবৃদ্ধের হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেতাম ছায়ায় শান্ত ঘরের দিকে।

এমন জীবন, যা শুরু হয়েছে মাত্র কয়েক বছর আগে, সেই জীবনের গতি স্তব্ধ হয় শুধু রাতে। ঘুমের ভেতর। যেন এক অন্য জীবন তার পর্দা সরিয়ে হাজির হয়। আমি অপেক্ষা করি সেই জীবনের। এই জেগে থাকা দিনগুলোকে আমার অলীক লাগে। যুক্তি খুঁজে পাই না এর। কিন্তু স্বপ্নের জীবন? সে যে সমস্ত দেওয়াল পাঁচিল ঘরদোর উপড়ে হাজির হয়! যুক্তি তার কোন কাজে লাগে! 

ভোরের কুয়াশা ভেদ করে ছুটে চলেছে মেল ট্রেন।  আবছা নীল আলোয় ভেসে উঠছে চরাচর। দূরের খেজুর গাছ থেকে রসের হাঁড়ি নামছে। একটা ভুলো কুকুর ছুটছে হাঁড়ির পেছনে। ধান কাটা শুকনো মাঠে জাঁকিয়ে বসছে শীত। গায়ে তার ধূসর চাদর। হঠাৎ ঝাঁকড়াচুলো গাছ ছুটে আসে জানলার কাছে। ভয় পেয়ে সরে আসি। চোখে উড়ে আসে কয়লার গুঁড়ো।  পাশের লোকটি কাঁধ ছোঁয়। চা খাবেন? অবাক হই। কুয়াশা মোড়া এই যাত্রায় চায়ের স্টেশন কোথায় ? ভাবতে ভাবতে গতি কমে আসে।  রেলিং দেওয়া লাল কাঁকরের প্ল্যাটফর্ম।  দু একটা একলা গাছ। কিচ্ছু নেই আর। কাঁধে বাক্স নিয়ে একটি খাটো ধুতি পরা লোক।  দূর থেকে দৌড়ে আসছে পেতলের সামোভার নিয়ে একটি লোক।  সঙ্গে ঝুড়িতে মাটির ভাঁড়।

গরম ধোঁয়াওঠা চা হাতে নিয়ে ভাবছি, মিরাকল !  এমন নিস্তব্ধ শীতের ভোরে কি করে এমন উষ্ণতা জুটলো? মাটির ভাঁড়ের সোঁদা স্বাদ নিতে নিতে চোখ তুলে দেখলাম। পাশের লোকটা দূরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চা খাচ্ছে। পি সি সরকারের মতো লাগলো না একটুও।

চিরকাল রাতের রেলগাড়ি আমাকে টানে। বিছানায় গভীর ঘুমে অচেতন থেকেও ছুটন্ত রেলগাড়ির আওয়াজ পাই। ঝিকঝিক শব্দে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে চলেছে গাড়ি। ইঞ্জিন কামরার বয়লারে বিশাল হাতা বেলচা করে কয়লা তুলে গনগনে আগুনে ঢালছে এক আদিম মানব। সে রাত জাগতে ভালোবাসে। দিনের সঙ্গে তার যোগ বড় কম। সে কমলা আগুনকে ঘিরে থাকা চাপ অন্ধকারের মানুষ। আমি ঘুমের মধ্যে কামরা বরাবর হাঁটতে থাকি। গাড়ির দুলুনিতে দুলতে দুলতে হাঁটি। পৌঁছে যাই বয়লারের কাছে। একদৃষ্টে দেখতে থাকি ধ্বকধ্বকে আগুন। ওই শিখা কি পৃথিবীর জঠরে জ্বলতে থাকা সেই তেজ? কি জানি! তবে এর আকর্ষণ ওই মাধ্যাকর্ষণের চেয়ে কম নয়! এর আকর্ষণেই আমি রেলগাড়ির কামরায় ঢুকে পড়ি। ঘুম আমাকে পৌঁছে দেয় ছুটন্ত রেলগাড়িতে। সে শুধু দৌড়তে থাকে। আহ্নিক গতির ধারা নিয়ে।

ঘুমের মধ্যেই আমি আশায় থাকি। ভোরের স্টেশন আসবে।

এক ভাঁড় চায়ের উষ্ণতা মেখে আমি টলতে টলতে ইঞ্জিন কামরার দিকে যাই। ওকে উষ্ণতা দিতে হবে।

আমাকে অবাক চোখে দেখতে থাকে সেই কয়লা মাখা লোক। যেন লন্ঠন হাতে লেভেল ক্রসিংএ দাঁড়িয়ে থাকা ওর আপনজন। আমি বলি, চা খাবেন? লোকটার চোখের পলক পড়ে না। ভাঁড়টা নিয়ে তৃপ্তির চুমুক দেয়। তারপর বলে, ওঃ কী অদ্ভুত কাণ্ড। আমি আমার হাতের যাদুদণ্ড খুঁজি। কোথায় যে হারিয়ে যায় মাঝে মাঝে!

চিঠি এসেছে।

“স্নেহের বুবু

আগামী ষোলোয় মানুর বিবাহ স্থির হইয়াছে।  মাঝে (২) যদিও ভাবি, পাত্রী দেখিবার সময় তপুকে সংবাদ দেওয়া হয় নাই। সে বিলক্ষণ অপমানিত বোধ করিতে পারে, তবু আমি কর্তব্য জ্ঞানে জানাইলাম। আমরা ভালো আছি। আশা করি তোমাদের সব কুশল।

                                       আঃ মা”

মায়ের দু’চোখ ভরে জল। দাদার বিয়ের সংবাদ পায়নি। বাবার অসম্মানের কথা ভেবেছে দিদিমা। আমরা দাদি বলি। আঃ অর্থ আশীর্বাদ সহ। আঃ কোনও বিরক্তিসূচক ধ্বনি নয়। আমরা অতশত বুঝছি না। বেশ কিছুদিন আমরা মামার বাড়ি যাই না। এই সুযোগ। যাবো নিশ্চয়। রান্নাঘরে মায়ের পিঠে দুলতে থাকি—আঃ লিখেছে কেন দাদি? তোমার ওপরে রাগ করেছে? মা মাথা নাড়ে। বুঝতে পারি না ‘হ্যাঁ’ বলছে, না ‘না’ বলছে। দুলতে থাকি, সেই আনন্দেই মগ্ন তখন।

অবশেষে সেই রাতের রেলগাড়ি। এক ষাটেই থুত্থুরে বুড়ি, মাথায় লম্বা একঢাল সাদা চুল নিয়ে সাদা থানে ঢাকা আমার দাদি। বাবা ভীষণ ভালোবাসে। শীতের খেজুর গুড়, পাটালি, ভালো জর্দা, তসরের চাদর নিয়ে আমরা চললাম মামার বাড়ি। বিয়ের কি বুঝি? বুঝি দাদির আদর। মামার সাইকেল চেপে রেলকলোনির রাস্তায় রাস্তায় পাক দেওয়া। দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকা। সন্ধ্যে হলেই স্টেশনে যাওয়া। চুপ করে শীত পোহাতে পোহাতে লাইনের দিকে তাকিয়ে থাকা। কখনো লাল কখনো সবুজ লন্ঠনের দুলুনি। পাশে বেহারির কালাকাঁদ।

রাতের রেলগাড়ির মধ্যে সঙ্গী হত চাঁদ। যতদূর যাই সেও সঙ্গে যায়। একটুও ছাড়ে না। আমি একদৃষ্টে দেখতে থাকি। চোখে কুয়াশা জন্মায়। চাঁদের ঘরবাড়ি দেখতে পাই।  হঠাৎ কুঊঊ শব্দে ঘোর কেটে যায়। দেখি বাবা হোল্ড অল বিছিয়ে ফেলেছে। আমি শুয়ে শুয়ে ভাবি ঘুমোব না। কিছুতেই না। রেলগাড়ির সঙ্গে ছুটব। কিন্তু নিজের অজান্তে ঘুমিয়ে পড়ি। ভোর হবার আগেই গার্ড কাকু এসে ডাকে। তপু মেয়েটাকে তোল। একটু আদা দিয়ে চা খেয়ে নিক। বাবা না বলতে পারেনা। বিহারের যা ঠাণ্ডা ! মেয়েটা বড্ড শীতকাতুরে।

চায়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব মামার বাড়ি গেলেই হয়। যেমন মামার বাড়ির মৌসুমী বন্ধুরা।

  কখনো স্বপ্নে দেখি মামার বিয়েটা হলো না। সবাই দুঃখ করছে। মামার বিষন্ন মুখ। দাদির মুখে তেমনি শান্তির ছাপ। আমি খুশি হই। বারবার বিয়ের ঠিক হবে। বারবার রেলগাড়ি চাপবো। চাঁদের সঙ্গে মামার বাড়ি যাবো। গার্ড কাকুর দেওয়া আদা চা খাবো। জীবনে কত কিছুই ত হয়। কত সাধ পূর্ণ হয়। তবে এইটুকুই বা হবে না কেন? যাদু দণ্ডের ছোঁয়াটা কেবল চাই।


আরো পড়ুন: অমৃতস্য পুত্রা (পর্ব-১৩) । অনিন্দিতা মণ্ডল


 

কথা ৬          

    ডাক্তার কাকা জোর করে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন রেলের চাকরিতে। ডাক্তার অমরনাথ মুখার্জি। ‘তপু ডাক্তারি পড়বি?’ তিনি উত্তর দেননি। যখন পালিয়ে জাহাজে খালাসির চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিলেন তখন তাঁর মাত্র চোদ্দ বছর বয়স। বাড়িতে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠছিল। একটা রোজগারের চেষ্টা না করলেই নয়। মেজদির টিবি ধরা পড়েছে। ডাক্তার কাকা যাদবপুরের হাসপাতালে কথা বলেছেন। নিয়ে যাবেন। এক বিকেলে সদর থেকেই উঁচু গলার তরজা শুনতে পেলেন। মেজবাবু, বাবাবু আর ডাক্তার কাকার গলা। বাবাবু বলছেন, প্রকৃতিকে বাড়িতে রাখলে সকলের মরার সম্ভাবনা। ডাক্তার কাকার গলা শুনতে পাচ্ছেন উনি। ‘এ বাড়ির মেয়ে, ধীরুদাদার মেয়ের টিবি হয় কি করে? হীরু? তোমাদের লজ্জা করে না?’ উনি মায়ের গলা শুনতে পাচ্ছেন। হতবাক হয়ে গেছেন। মা বৈঠকখানায়? ‘ডাক্তার ঠাকুরপো, এসব কথায় কাজ কি? তুমি প্রকৃতির হাসপাতালের ব্যবস্থা করো।’ উনি পায়ে পায়ে গলি দিয়ে ঢুকে পড়তে গেলেন। কিন্তু পর্দা উড়তেই চোখে পড়ে গেলেন। ‘ওই দেখো তোমার ধীরুদাদার ছেলে। পড়াশুনোর নামগন্ধ নেই। যত আজেবাজে ছেলেপুলের সঙ্গে মেলামেশা’। সেদিন ডাক্তার কাকা না থাকলে বেতের দাগে পিঠ লাল হয়ে যেত তাঁর। ডাক্তার কাকা ডেকে বললেন – তপু, বাবার নাম উজ্জ্বল কোরো বাবা। কাকাদের ওপরে অসম্ভব রাগ জন্মেছিল। পালিয়ে গেলেন জাহাজে।

জাহাজ বললেই আমার সেই অলৌকিক জলযানের কথা মনে হয়। কেমন ছিল সেই জাহাজ? আর কেমন থাকবে। মালবাহী জাহাজ যেমন হয়। খুব কম লোক থাকে তাতে। দেশী জাহাজ ছিল না। তখনও দেশ স্বাধীন হয়নি। জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন এক রাশিয়ান। এটুকুই মনে পড়ে। এর বেশি বলেন না। তবে পোর্ট সইদ ছুঁয়েছিল সে জাহাজ। সেখানে খুব বড় চিংড়ি মাছ গোল গোল চাকা চাকা করে কেটে ভেজে দেওয়া হয়েছিল। বন্দরে জাহাজ ভিড়লে এরকম সুস্বাদু কিছু খাবার খাওয়া হয়েছিল। প্রথম কালো দেশের বিরাট মানুষদের দেখা হয়েছিল। সেই স্মৃতি তাঁকে আনন্দ দিতো। পৃথিবীর যে কোণে শখ করে তখন কেউ যেত না, দেখা হত না সেই সব বন্দর ও মানুষ, তাদের সঙ্গে পরিচয় হল। বন্দর থেকে বন্দরে ওই একটি মাত্র সমুদ্রসফর তাঁকে যাযাবর করেছিল। লোনাজলের স্বাদ, মরুভূমির হাওয়া তাঁকে আর থিতু হতে দেয়নি।

জাহাজে একদিন মাংস দেওয়া হয়েছে খেতে। জানতে পারলেন ওটি গরুর মাংস। গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে। মাত্র চোদ্দ কি পনেরো বছর বয়স। বড়ঠাকুরদার সব নিয়মনিষ্ঠা মেনেছেন এতকাল। চুপিচুপি এক সন্ধ্যেয় গুটিকতক টাকা হাতে বাড়িতে ঢোকার অগত্যা জলের মায়া ত্যাগ করতে হল। মায়ের মুখ মনে পড়লেই তখন চোখের পাতা ভারী হয়ে যাচ্ছে। অবশেষে এ বন্দরে জাহাজ ভিড়লে নেমে পড়লেন ডাঙায়। চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন চাকরির কথা। কিন্তু ফিরে আসার কথা জানানো হয়নি।

 তখন সন্ধ্যেবেলা। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়িতে ঢুকছেন। বৈঠকখানা ঘরে শুনতে পেলেন সঙ্গীতের সুর। বাবাবুর তবলার সঙ্গে গাইছেন ভারতবিখ্যাত এক শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গায়ক। অন্দরের দালানে অনেকে চুপ করে বসে। তিনি ভাবলেন, গান শোনার ভিড়। কিন্তু ভেতরে যেতেই মা জড়িয়ে ধরলেন। চিঠি মারফত জেনেছিলেন ছেলে জাহাজে। হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন ছেলে আর ফিরবে না। কিন্তু মা তো এত বিহ্বল হন না! মা সরে দাঁড়াতে তিনি দেখলেন খাটে শোয়ানো আছে মেজদির শরীর। একটুও জল পড়ল না চোখ দিয়ে। এ মৃত্যু মুক্তির। সংসারের শতকোটি লাঞ্ছনা গঞ্জনার হাত থেকে মুক্তি। হাজরা রোডের বাড়ি থেকে অনাথকাকারা এসেছেন। এ বাড়ির সকলে শোক নয়, লজ্জা ঢাকতে ব্যস্ত। বাবার পিসিমা প্রচুর আয়োজন করেছেন অতিথি সৎকারের। স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। অনাথকাকার মনে হয়েছিল, এই আয়োজনের খরচে প্রকৃতির টিবি হওয়া এড়ানো যেত। কিন্তু পূর্বনির্ধারিত আসর বসে গেছে। সে আসর ভাঙলে তবেই শব সৎকারের ব্যবস্থা হবে। 

বাবা চাকরির কথাই বলেছিলেন ডাক্তার কাকাকে। ডাক্তারি পড়ে পাশ করতে অনেক বছর লেগে যাবে। ততদিন পড়ার খরচ নয় ডাক্তার কাকা চালালেন, কিন্তু সংসারের ভার? বাবাবু স্পষ্ট বলেছেন। ‘রিটায়ার করেছি, আর ভুতের খরচ চালাতে পারব না’। ডাক্তারকাকা জানতে চেয়েছিলেন – ধীরুদাদার টাকা? ‘ওসব কিছু নেই’, সোজা বলেছিলেন বাবাবু। সঙ্গে বলেছিলেন – অমর, আমি অবাক হচ্ছি! তুমি আমাকে অবিশ্বাস করো? তাই যদি হয়, তুমি আর এ বাড়িতে এসো না। ডাক্তার কাকা আসেননি আর। কিন্তু তিনি যোগাযোগ রেখেছেন। অবশেষে সেই চাকরিও বাবা রাখতে পারলেন না। নিজের ওপরেই বাবার আজকাল বড় রাগ হয়, অভিমান হয়। কেন যে জীবনটাকে সাজিয়ে নিতে পারেননি!

লেখাটা আবার শুরু করেন। ‘গাঁয়ের পথ। দুটি সমবয়সী মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ঝোপের আড়াল থেকে দুটো চোখ লক্ষ করছে…’ 

       সন ১৯৭০। ‘আমরা’ ক্লাব। এক ঝাঁক উজ্জ্বল ছেলে জড় হয় সেখানে। এদের সান্নিধ্য তাঁকে উজ্জীবিত করে। স্বপ্ন ছোঁয়ার সঙ্কল্প দৃঢ় হয়। ‘তপেনদা, নাটকই আমাদের প্রতিবাদ। আমরা হাতে আর কোনও অস্ত্র ধরব না। আমরা জোতদার মারব না। আমরা খুনের নীতিতে বিশ্বাসী নই।  আমাদের অস্ত্র নাটক।’ কথাগুলো বলছিল অলোকেশ নামের এক বছর চব্বিশের সুদর্শন যুবক। পাশে বসে ক্রমাগত চারমিনার আর চা খেয়ে বেঁচে থাকা স্বপন গাঙ্গুলি বলল – তাইতো। তোর সরকারী চাকরি। বিপ্লব টিপ্লব সব ঢুকে যাবে ভাই। ওই নাটকটাই কর। গলায় শ্লেষ ঝরে পড়ছে। অলোকেশের দিকে তেড়ে এলো পুলক উদয় বেনু আর রুনু – কি বলতে চাইছিস কি? বিপ্লব টিপ্লব মানে? এই পচে যাওয়া ঘুণধরা সমাজকে বদলাতে গেলে আগে একে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। সেই ধ্বংসস্তুপের ওপর নতুন সমাজ গড়ে উঠবে। ছেলেগুলোর গলা স্বপ্নালু হয়ে যায়। সেই সমাজে মানুষে মানুষে কোনও ভেদ থাকবে না। শ্রেণীহীন সমাজে মেহনতী মানুষ নতুন করে বাঁচবে। তপেন্দুর দৃষ্টি স্থির হয়ে যায়, বলে ওঠেন – ফ্রিজ। হ্যাঁ, এবার পঞ্চু বুঝে নে। আলোর সার্কেলটার মধ্যে ওই ছেলে ক’টা। ওরা আগামীর স্বপ্ন দেখছে। উজ্জ্বল হলুদ আলো ফেলবি। পঞ্চু ঘাড় নাড়ে। হঠাৎ দরজায় মৃদু কড়া নাড়ার শব্দ। পুলক খুলে দেয় দরজা। দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে পুলকের বাবা। ‘নাটক করে পেট ভরবে তো? বুড়ো বাবা এখনও জোয়াল টেনে চলেছে। আর লবাবপুত্তুর লাটক করছেন! সমাজ বদলাচ্ছেন! এদিকে বাপ মা না খেয়ে মরার জোগাড়।’ তপেন্দু ধীরে ধীরে ঘরের অন্ধকার কোণে সেঁধিয়ে যান। ‘আঃ, সেই লজ্জা, সেই ভয়, বাবাবু!’ পুলক উত্তর দিতে যায়, তপেন্দুর নির্দেশ ভেসে আসে – স্টিল। একটা কম্পোজিশন। এখন আলো শুধু পুলক আর পুলকের বাবার ওপরে। দরজার দুই পার। আর অন্ধকার থেকে নিস্তব্ধতা ভেঙে শোনা যায় অলোকেশের কণ্ঠস্বর – কেন রে বিধাতা পাষাণ হেন, চারিদিকে তার বাঁধন কেন, ভাঙ রে হৃদয় ভাঙ রে বাঁধন…। স্ক্রিপ্টের ওপরে মোটা কালো হরফে ভেসে ওঠে ‘শ্লোগান’।  

       ‘আচ্ছা বুবু, বলো তো কোন নাটকটা নিয়ে যাই? শ্লোগান না ক্রৌঞ্চ নিষাদ কথা?’ ভারতী এক মুহূর্ত সময় নেন। ‘ক্রৌঞ্চ নিষাদ কথা। দেখছ না কি হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে? শোনোনি বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বর? তোমরা আমাকে দাবায়ে রাখতে পারবা না!’ তপেন্দুর দৃষ্টি সুদুরে চলে যায় – বুবু জানো, আমি বড্ড মিডিওকার। তোমার মনে আছে ফেয়ারওয়েল টু আর্মস? সেই সব হারিয়ে নিঃস্ব গ্রেগরি পেকের হেঁটে যাওয়া? বুবু ঘাড় নাড়েন। মনে আছে। তপেন্দু স্বীকারোক্তি দেওয়ার ভঙ্গিতে বলেন – ওই সিনটাই আমাকে এই নাটকটা লিখিয়ে নিয়েছে। কোনও অরিজিনালিটি নেই। ভারতী প্রতিবাদ করেন – কক্ষনো না। তুমি তো আমাদের ছেলেগুলোর মুক্তিযুদ্ধের কথা লিখেছ। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলো কেমন প্রাণপনে লড়েছে বলো! এখানে হতাশার কথা কি দেখলে? ওরা প্রাণ দিলো বটে, কিন্তু লক্ষ লক্ষ মানুষ বাঁচল। একটা গোটা দেশ স্বাধীন হয়ে গেলো। তপেন্দু থামিয়ে দেন – না বুবু। ওইযে অলোকেশের চরিত্রটা, নতুন বিয়ে হয়েছে। পরের দিনই তাকে ফিল্ডে চলে যেতে হচ্ছে। রেডিওতে ঘোষণা হচ্ছে। তার নতুন বউ, এতদিনের প্রেমিকা, কাঁদছে। ওয়ারফিল্ডে লড়তে লড়তে চার বন্ধু গল্প করছে। সকলেই জানে আজ আর কেউ বেঁচে ফিরবে না। তাই প্রিয় স্মৃতি নাড়াচাড়া করছে। এবং শেষ দৃশ্যে চারবন্ধু লাশ হয়ে শুয়ে আছে। রেডিওতে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হচ্ছে। এ কষ্টের নয় বুবু? হতাশার নয়? ভারতী কষ্টের হাসি হাসতে হাসতে বলেন – সে তো হলো। কিন্তু দিল্লীর শীত। এতোগুলো ছেলেমেয়ের সোয়েটার কম্বল। কি যে করি!

       মায়ের বাপের বাড়ির দেশ উত্তরবঙ্গ। জলপাইগুড়ি, ফালাকাটা, দোমোহনী থেকে রাজশাহী। মায়ের মামার বাড়ির দেশ পাবনা। বাপের বাড়ির কেউ সেভাবে দেশভাগের কষ্ট ভোগ করেনি। কিন্তু মামার বাড়ির অনেকেই এপারে চলে এসেছে। মায়ের মামারা বিখ্যাত মানুষ। কিন্তু আমার মামার বাড়ির লোকজন তাদের এড়িয়ে চলেন। কি দরকার? বিখ্যাত লোকেদের সঙ্গে আত্মীয়তা তাঁরা স্বীকার না করলে যেচেপড়ে আত্মীয়তা করতে নেই। তার চেয়ে নিজেদের মতন থাকাই ভালো। তবু দেশভাগে যে তাঁদের ভিটে ছাড়তে হয়েছে এ কষ্ট হয়ত অবচেতনে মায়ের মনে খেলা করত। বাবার নাটকে সেই স্বদেশকে যেন ফিরে পাচ্ছিল মা।  

       মায়ের হাতের চুড়িগুলো না থাকলে আজ শোকেসে ওই ব্রোঞ্জের ট্রফিটা শোভা পেত না। ভরা হলে সেদিন যখন অমিয় কিস্কুর হাত থেকে যখন ট্রফি আর মানপত্র নিচ্ছিলেন তখন কি তাঁর আর কোনও মুখ মনে পড়ছিল? নাহ। আত্মগর্বে সব্বাইকে ভুলেছিলেন। শ্রেষ্ঠ নাট্যকার শ্রেষ্ঠ পরিচালক। সব ভারতীয় ভাষার মধ্যে শ্রেষ্ঠ তিনি। মাটিতে পা পড়েনি সেদিন। রেলের চাকরি, সন্তানের মুখ, সব ভুলেছিলেন।

       এখন আশির দশকের শেষ দিক। কমার্শিয়াল সিনেমার চিত্রনাট্য, যাত্রার স্ক্রিপ্ট, এইই লিখতে হয়। তেমন করে কারোর সঙ্গে আর মেশেন না। টিভিটা রাত্রে একটু দেখেন। খবরের চ্যানেল। ওরই মাঝে কখনও একটু ঘোরাতে থাকেন। এখনও বিদেশী ছবি তাঁকে খুব টানে। হঠাৎ একটা হিন্দি চ্যানেলে এসে থমকে যান। এই ছবিটার কথাই সেদিন শুনছিলেন। খুব নাকি হিট করেছে। ভালো ছবি। দেশপ্রেমের। তিনি দেখতে শুরু করেন। পর্দায় ভেসে ওঠে একটি নবপরিনীত দম্পতির ফুলশয্যার দৃশ্য। একটি গান। ‘অ্যায় যাতে হুয়ে লমহে, জরা ঠেহরো, জরা ঠেহরো…’। ছেলেটি উৎসবের পোশাক ছেড়ে সেনার পোশাক পড়ছে। মেয়েটি কাঁদছে। তিনি দেখে চলেছেন। যুদ্ধক্ষেত্র। ছেলেটি মারা যাচ্ছে। চার বন্ধু। দেশের জন্য প্রাণ দেওয়া। তিনি আর সামলাতে পারলেন না। আর্ত চিৎকার করে ওঠেন – বুবু! ওরা আমার ক্রৌঞ্চ নিষাদ কথা চুরি করেছে! ভারতী ঘরে এসে দাঁড়ান। টিভিতে চলছে ‘সন্দেশ’। বিখ্যাত দেশপ্রেমের ছবি। বিষণ্ণ গলায় বলেন – আমি আগে দেখেছি। এতে দুঃখ পাওয়ার কি আছে? এর চেয়ে বেশি আমরা আর কবে কি পেয়েছি?

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত