ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-৩২) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
দিনদরিদ্র ঢাকিটি তার ছেলে,ভাই বন্ধুদের নিয়ে পুজোর কদিন সবটুকু সামর্থ্য খরচ করে ঢাক বাজায়।এমনকী পুজো মিটে গেলেও রাতে উদ্যোক্তাদের বায়না মেটাতে তাদের নাচের তালে তালে সঙ্গত করে।আর পুজো শেষে ঢাক বাজিয়ে পুরনো কাপড়ের পুঁটলি বেঁধে মজুরির সামান্য টাকাটুকু সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফেরে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কতকিছুই তো পাল্টায়।শুধু এক থেকে যায় প্রতিদিনের বৈভব আর জাঁকজমকের মাঝে তাদের মলিন উপস্থিতিটুকু।ওই মানুষগুলোর ফিরে যাওয়া আর ফিরে আসার বাঁকগুলোয় গ্রামবাংলার পথঘাটের কতই না পরিবর্তন ঘটেছে।শুধু এক থেকে গিয়েছে তাদের দারিদ্রলাঞ্ছিত জীবনটি।কালোমুখের হাসিতে যা ধরা দিলেও আমরা অগ্রাহ্য করি।
এভাবেই তাকালে হয়ত মনে পড়বে পুজোর জন্য একশো আটটা স্থল পদ্ম জোগাড় করে যে ছেলেটা তার কথা।মনে আসবে সেই বুড়ির কথা যে পুজো বাড়ির এককোনে বসে পুরুতমশায়ের কথামত পিদিমের সলতে পাকায়,নৈবেদ্যর চাল বাছে,বড় বড় কাঁসার বগিথালা ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে।পুজোর দিনে ভোর ভোর ফুল তুলে আনে।তার সঙ্গে আসা নাতিটার হয়ত নতুন জামা হয়নি।পুজো দালানের এককোণে বসে সে কলাপাতার প্রসাদ খুঁটে খুঁটে খায়।তার দিকে তাকানোর অবসর আগেও হতনা,এখনও হয়না।ওই বুড়ি,ওই ফুলতোলা ছেলেটার দিনযাপনের কষ্ট একই থেকে যাবে বরাবর।
ঢাকের রকমফের হবে,প্যান্ডেলে আলোতে কায়দাকানুনের বাজেট বাড়বে।শুধু এক স্রোতে বইবে ওইসব মানুষদের জীবন।আর আমরা তাদের দিকে তাকালেও আমাদের দৃষ্টি বরাবর আধবোজা থেকে যাবে। আমরা দেখব তাদের, যাদের আমরা দেখতে চাই।আর এদের দিকে কজন তাকায়?কেমন যেন মনে হয় ওই চাকচিক্যের বাড়াবাড়ি না ঘটিয়ে আসুন খোলা হাওয়ায় এদের দিকে একবার তাকাই।অনেক কিছুই তো পাল্টাল, সবগুলো হাতের দাক্ষিণ্যে এদের জীবনটাকে একটু উলটে পালটে দিলে হয়না? হয়ত তখন শরৎ এর কাশফুলের দোলা এসে লাগবে আমাদের জীবনেও।
আরো পড়ুন: খোলা দরজা (পর্ব-৩১) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
এসব তো গেল পুজোর একটা দিক।আর একটা দিকও আছে। সে হল পুজোর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।সাধারণতঃ পুজোর পঞ্চমীর দিনে সেসবের জোরদার আয়োজন আগেও হত এখনও হয়।
ছোটবেলায় পুজোর পঞ্চমীর দিনটি ছিল বিশেষ একটি দিন। ছোটখাটো অনুষ্ঠান হত পাড়ায় মঞ্চ বেঁধে।তাতে দর্শক আর অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল সমান সমান।পাড়ার মেয়েরা সবাই দলবেঁধে উদ্বোধন সঙ্গীত গাইত।সবে কথা বলতে শেখা বাচ্চার আবৃত্তি দিয়ে শুরু হত অনুষ্ঠান, আর শেষ হত পাড়ার বড়দের নাটক দিয়ে।ফলে পাড়ার সবাই পুজোর আগে থেকেই ব্যস্ত থাকত রিহার্স্যালে।তাছাড়া বিভিন্ন কন্ঠীদের গানে জমজমাট জলসাও খুবই উপভোগ্য হয়ে উঠত।কেউ সন্ধ্যাকন্ঠী, কেউ হেমন্ত কন্ঠী।গান গেয়ে তারা আসর মাত করে দিত।
জগদ্ধাত্রী পুজোয় আবার বড় শিল্পীদেরই নিয়ে আসা হত।সারারাত ধরে তাদের গা্নের জলসা বসত।এখনও সে আসা বন্ধ হয়নি।এ প্রসঙ্গে একটা মজার কথা বলা যেতেই পারে। সে বছর ‘ডিস্কো ড্যান্সার’ এর গানগুলো খুব পপুলার হয়েছে।সব পুজো প্যান্ডেলেই বাজছে হই হই করে।ঠিক হল ডিস্কো নাচের প্রতিযোগিতা হবে।পুজোর পঞ্চমীর দিনে পাড়ার প্যান্ডেলে মঞ্চ বেঁধে শুরু হল প্রতিযোগিতা। চেনাশোনা ছেলেমেয়েদের অচেনা ভূমিকা দেখে সবাই অবাক!কবে এরা ডিস্কো নাচতে শিখল, কে জানে?
বয়স্ক মানুষরা বললেন, “এবার যা হয়েছে হয়েছে, এর পরের বছর থেকে নাচের প্রতিযোগিতা বন্ধ।কে জানে বাবা,ভারতনাট্যমের নামে ওই ডিস্কো নাচে যদি!”
তবে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ধুনুচি নাচের প্রতিযোগিতা ছোটবেলা থেকেই দেখা।সব প্যান্ডেলেই ধুনুচি নিয়ে নাচের ধূম হত অষ্টমীর বিকেলে।খুব দক্ষ কেউ হয়ত প্রতিবছরই নাচতেন।আর সবাই অপেক্ষা করে থাকত তার জন্য।আমাদের পাড়ায় তেমন একজন ছিল। মঞ্জুলিকা তার নাম।প্রতি বছরই সে এপাড়া ওপাড়ায় নাচের
ডাক পেত।
সব মিলিয়ে জমজমাট সেই পুজোর আসর সন্ধিপুজোর পর থেকেই উৎসাহ হারাত। তারপর দশমীর বিকেলে মাথায় সিঁদুর আর মুখে পান নিয়ে মা তার ছেলেমেয়ে সমেত কৈলাসে রওয়ানা দিতেন।মহাদেবের অপেক্ষা মিটত আর আমাদের পরের বছরের পুজোর জন্য অপেক্ষা শুরু হত।

ঐতিহ্যময় শহর চন্দননগরের স্থায়ী বাসিন্দা সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতক।১৯৯৬ সালে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়’দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকায়।২০০১ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।‘আনন্দবাজার’, ‘বর্তমান’, ‘আজকাল’, ‘প্রতিদিন’, ‘তথ্যকেন্দ্র’, ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’ ছাড়াও, ‘অনুষ্টুপ’, ‘কুঠার’, ‘এবং মুশায়ারা’-র মতো বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনেও তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রকাশের ধারা অব্যাহত। প্রকাশিত উপন্যাস পাঁচটি, গল্পগ্রন্থ চারটি, এবং কবিতার বই একটি।