Categories
শারদ সংখ্যা মনিপুরী অনুবাদ গল্প: লোহিত-লহরী । নেপ্রম মায়া দেবী
আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট
অনুবাদক: পূর্বা দাস
মূল লেখক – ডক্টর নেপ্রম মায়া দেবীর জন্ম ১৯৬০ সালে। বর্তমানে মণিপুরের প্রভাবতী কলেজে মণিপুরী সাহিত্যের অধ্যাপিকা। প্রকাশিত বই – Wakat (২০০৪) এবং Ngangleinaba Ethak Epom(২০১০) (ছোটগল্পের সংকলন), Leikanglaga Shak- Khangnaba (ভ্রমনকাহিনী)। নেপ্রম মায়া দেবী বহু পুরস্কার পেয়েছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – মনিপুর স্টেট কলা একাডেমি অ্যাওয়ার্ড ফর লিটারেচার – ক্রিয়েটিভ (২০১৫), খাইদেম প্রমোদিনী সনাগী মেডেল (২০১১), যামিনী সুন্দর গুহ গোল্ড মেডেল(২০১৪) ইত্যাদি।
অনুবাদক – পূর্বা দাস। জন্ম – ১৯৭৫ এ হুগলি জেলার কোন্নগর এ। জীববিজ্ঞানের স্নাতক। স্নাতকোত্তরে কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন। কর্মজীবন – একটি বহুজাতিক সংস্থায় জুনিয়র প্রোগ্রামার হিসেবে। বর্তমানে নিজের তৈরি একাডেমিক ইনস্টিটিউশনে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে তৃপ্ত। লেখালেখির চর্চা ছোটবেলা থেকে হলেও প্রকাশ্যে আসা মাত্র বছর পাঁচেক আগে। প্রকাশিত বই – ‘মেটামরফসিস’ (কবিতা), ‘মণিপুরের আট কাহন ‘ ( অনুবাদ গল্প)।
তনটম্বি হঠাৎই নৌকো বাওয়া বন্ধ করল। একদম লেকের মাঝখানে এসে ও বৈঠা তুলে নিল। চুপচাপ নৌকোর মধ্যে বসে অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে রইল লেকের বিশাল বিস্তারের দিকে। সবুজাভ জলের উপর বিচ্ছিন্নভাবে ভাসমান অসংখ্য ফুমদির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বিগত দিনের সাথে জড়িয়ে থাকা ঘটনাগুলোর কথা মনে পড়ল। তার দগ্ধ হৃদয় কান্নায় গলে যায় বারবার। ও তাকিয়ে রইল যেখানে নীল আকাশ আর এই বিশাল সবুজ লেক মিশে গেছে। সত্যিই কি ওরা মিশেছে? না, ওরা আদৌ কখনো একত্রিত হয়নি। এটা শুধুমাত্র একটা বিভ্রান্তিকর মিলন দৃশ্য।
বিকেলের পড়ন্ত আলো যখন খুব কম সময়ের জন্য মেঘেদের লাল ও কমলা রঙে রাঙিয়ে তোলে আর সেই মেঘের প্রতিবিম্ব জলের ওপর পড়ে, তখন মুগ্ধ না হয়ে থাকা যায় না। তনটম্বির স্মৃতিতে এই রং অন্য বার্তা নিয়ে আসে। কখনো কি ভুলবে ও সেদিন রক্তমেশা জল কেমন ফুলে ফুলে উঠছিল প্রতিটা ঢেউয়ের আগায়। বহুদিন ধরে ও ওর ফেটে যাওয়া হৃদয়ের অবাধ্য আবেগগুলো চেপে রেখেছে। এমনকি ও কখনো ওর নৌকো এদিকে নিয়ে আসে না। কঠিন প্রতিজ্ঞা ওর, যদি দারিদ্র্য ওকে মাথা অব্দি ডুবিয়ে দেয় তাও এই জায়গা থেকে কোনদিন মাছ ধরবে না। তাহলে আজ কেন ও এই দিকেই নৌকো চালাল? সর্বস্ব হারানো এক মানুষের মত ও নিঝুম বসে রইলো নৌকোতে। নৌকো হাওয়ার তাড়নায় ইতস্তত লেকের জলে ভেসে চলল। একসময় যখন নৌকোর সূচালো সামনের অংশ সেই ভাসমান ফুমদির তীরে আঘাত করল, ও জেগে উঠলো দিবাস্বপ্ন থেকে।
ধীরে ধীরে ও নৌকা থেকে ফুমদিতে নেমে এল। যেভাবে জলের ঢেউ ফুমদির কিনারায় আঘাত করছিল আবার ফিরে যাচ্ছিল, তনটম্বির হৃদয়ও তরঙ্গায়িত হচ্ছিল বিচ্ছেদবেদনা আর নিষ্ঠুর ঘটনার অভিঘাতে। দুঃখগুলো আবার ওকে ঘিরে ধরল। বর্তমান আবার অতীতের সাথে মিশে গেল। ওর অতীত এই ফুমদির মধ্যে ঘুমিয়ে আছে, যাকে এই মুহূর্তে বিচ্ছিন্ন এবং আপাতভাবে জনপ্রাণীহীন মনে হচ্ছে। তনটম্বির স্নায়ু ধীরে ধীরে অবশ হয়ে এল। ও জেগে জেগেই এক দীর্ঘ দুঃস্বপ্নে ডুবে গেল।
– উফ! এভাবে কি করে যে তুমি ঘুমোও কে জানে! কম্বলটা একধারে দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে। কি যে ভাগ্য আমার! এমন একটা লোকের সাথে আমায় ঘুমোতে হয় যে কিনা সব সময় ঘরদোর অগোছালো করে রাখবে। এই ঠান্ডায়…
তনটম্বি ক্রমাগত এপাশ-ওপাশ করছিল, শরীর মোচরাচ্ছিল। ওদের নিজের হাতে তৈরি বাঁশের খাঁচাটা, যেটা বিছানা হিসেবে সেবা দিচ্ছে, এখন কঁক কঁক করে আওয়াজ ছাড়ছে ওর নড়াচড়ার সাথে সাথে। টমচউ মোটেই গুরুত্ব দেয় না এসব অভিযোগের। জড়ানো গলায় শুধোয়,
– আ্যই! তোমার কাছে কি একটাও বিড়ি আছে লুকোনো?
– আধ খাওয়া টুকরোগুলো খালি পড়ে আছে। একটাও কি আস্ত রাখো তুমি?
– একটা টান অন্তত দিই। উঃ! যা ঠান্ডা…
শব্দ করে একটা লম্বা টান দেয় তারপর নাকমুখ দিয়ে ধোঁয়াটা বের করে টমচউ। তারপর বাকি টুকরোটা বিছানার পাশে মেঝেতে ছুড়ে ফেলে। কিছুক্ষণ পরে তনটম্বির ফিসফিসে গলা শোনা যায়।
– কাল ওরা আসবে। ওরা যে সময় দিয়েছিল সেটা পেরিয়ে গেছে। এবার ওরা আমাদের চলে যেতে বলবে।
– কেন যাব আমরা? ওরা বললেই যেতে হবে? মরতে তো এক সময় হবেই। আর এখনই বা মরা মানুষের চেয়ে কি বা ভালোভাবে বেঁচে আছি? এবার সময় এসেছে যা প্রাণে চায় করার, যার সাথে মন চায় কথা বলার। দেখবো, ওরা বাঁচে কি আমি মরি।
– হায় ভগবান! কি সব বলছ! সব যাবে। ওদের বিরুদ্ধে যাবার চেষ্টাও করো না। ওদের থাকতে দাও এখানে। ওই নরপশুদের মোকাবিলা করা চূড়ান্ত বোকামি।
– জানোয়ারের দল। শুধু ওদের হাতে ক্ষমতা আছে, তাই। যখন আমাদের কিছু ছিল না, আমরা এত কষ্ট করছিলাম, তখন একবারও ওরা জিজ্ঞাসা করেছে আমাদের কি দরকার… কোন সাহায্য লাগবে কিনা… করেছে? আর এখন বলছে, ওরা নাকি মানুষের জন্য লড়ছ এই মাটির জন্য লড়ছে। বিশ্বাস কর ওদের কথা?
– যদি নাও করি, সে কথা কি বলার সাহস আছে কারও? সেজন্যই বলছি, ওদের সাথে লড়তে যেও না।
– তনটম্বি, সত্যি বলছি, এর থেকে ভাল হত যদি আমরা না জন্মাতাম।
তনটম্বি সাড়া দেয় না। ওর মনে পড়ে কি অসম্ভব পরিশ্রম করেছে ওরা এই ফুমদি, তার ওপর এই ছোট্ট কুঁড়ে গড়ে তোলার জন্য। কতদিন হয়েছে ওদের খাওয়া হয়নি। এক অলীক স্বপ্নকে ওরা গড়ে তুলছিল সেসময়, যখন ওদের হাড়সর্বস্ব দেহ ক্লান্ত হতেও ভুলে যেত। ওরা ওদের ছোট্ট নৌকাতে বাঁশ আর নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিস বয়ে আনত। রোদ বৃষ্টি কোন কিছুকেই গ্রাহ্য করত না। শুধু চাইত, ছোট্ট কুড়েতে যেন মাথাটুকু বাঁচানো যায়। ঝোড়ো হাওয়াতেও যাতে ওটা দাঁড়িয়ে থাকে। আর আজ ঐ মানুষেরা আসছে মাথায় চাঁটি মেরে ওদের উচ্ছেদ করতে। এটা কি মানুষের কাজ? ঘৃণা হয়, কিন্তু সাথে প্রবল ভয় ওকে চুপ করিয়ে রাখে। যদি মুখ দিয়ে একটুও বেরিয়ে যায় ওর মনোভাব!যারা দীর্ঘ জীবনকে ভয় পায় এবং যারা পায় না তারা কেউই বুঝবে না ওদের ওপর কি আসতে চলেছে। আজ হোক বা কাল। কেউই কোন কথা বলবে না ওদের হয়ে। শুধু মিথ্যে সহানুভূতি দেখানো ছাড়া। সবার হাত-পা ক্ষমতার বাঁধনে বাধা। মুখ আটকানো ভয়ে। মানুষের মূল্য তার মৃত্যুর পরে নির্ধারিত হবে। মানুষ খুব দ্রুত অমানুষ হয়ে উঠছে। ওরা ভুলে গেছে যে সহমর্মিতা যত তাড়াতাড়ি মানুষকে কাছে টানতে পারে, ক্ষমতার আস্ফালন তার কিছুই নয়। ওদের লোভ ওদের পারস্পরিক বিশ্বাসকে নষ্ট করেছে।
আবেগকে আর চেপে রাখতে পারল না তনটম্বি। চিৎকার করে কেঁদে ওঠে ও।
– কঠিন সময়ে কেউ আমাদের পাশে থাকেনি। আর এখন, যখন আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে একটা ঘর বানালাম সেখান থেকেও আমাদের তাড়িয়ে দিচ্ছে ওরা।
– কি বলছ তুমি? তুমি কি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কথা বলছ?
– না আমি ঘুমোইনি। আমি শুধু ভাবছি, আমাদের কি সত্যিই চলে যেতে হবে?
– কি হয়, যদি না যাই? যাব তো, যাব কোথায়?
তনটম্বি আবার ওর ভাবনায় ডুবে গেল। স্বামীর প্রতিটি অসম্পূর্ণ কথা ওর অন্তরাত্মায় ভয় ডেকে আনছিল। ওর মনে পড়ল, কিভাবে ওদের কাঁপা কাঁপা হাতগুলো ভারী নৌকোটাকে জল ঠেলে নিয়ে আসত এখানে। ঘাম ঝরে ঝরে অবসন্ন শরীরে ওরা বায়োমাস কেটে কেটে ফুমদিটা তৈরি করেছিল। ওদের সেসময়ের অমানুষিক পরিশ্রমের দিনগুলোর কথা ভাবতে থাকে ও। একদিনের কথা মনে পড়ে। ওর স্বামী হাসিমুখে ওকে বলেছিল,
– তনটম্বি, আমি ফুমদিটাকে কয়েকটা বড় পাথর আর বাঁশের সাথে বেঁধে দিয়েছি। এটা এবার স্থির থাকবে। পেমা, সোনা মেয়ে, দ্যাখো, এটা পুরো তৈরি হয়ে গেছে। আমাদের আর অন্য কারো ঘরে আশ্রয় চাইতে হবে না। কাল কিছু কামবং এর পাতা আনব ঘরটার চালা তৈরি করতে।
একটু হেসে আবার বলেছিল,
– দ্যাখো, এই লোকটাক হ্রদ আমাদের মা। এ যদি না থাকত, আমাদের মত গরিবরা বেঁচেই থাকত না। এই মায়ের জন্যই আমাদের পরিশ্রম আজ সার্থক হল।
টমচউ’র উগ্র আকাঙ্ক্ষা ছিল, ও নিজে থেকে কখনো হেরে যাবে না। ও মনে করত, জীবন সবসময় সেদিকেই যাবে যেভাবে তুমি তাকে নিয়ে যেতে চাও। হারা- জেতা সবই তোমার ইচ্ছে আর পরিশ্রমের ওপর নির্ভর করে। টমচউ পরিশ্রম করেছে, জীবনকে স্পর্ধা দেখিয়ে জয় করেছে। ও কামবং পাতা দিয়ে ঘরের দেয়াল আর ছাদ তৈরি করল। চরম দারিদ্র্য সত্ত্বেও ও এখন জীবনের সঠিক মূল্য বুঝতে পারল। যেদিন থেকে ওরা ঘরটায় বাস করতে শুরু করল, মনের অনেক সুপ্ত ইচ্ছাকে ও নতুন করে জেগে উঠতে দেখল। শীতের সকালে যখন লেকের নীলাভ সবুজ জল কুয়াশায় ঢাকা থাকত, পাশে দাঁড়ানো মানুষকেও দেখতে পাওয়া যেত না – দূরের সুতোর কারখানা থেকে শ্রমিকদের গান ভেসে আসত, সেসময় ওর মন অদ্ভুত আনন্দে ভরে যেত। যখন ও মাছ ধরে ফিরত, ওর সরল সাদাসিধে হৃদয় থেকে সেই গান বেরিয়ে আসত। তনটম্বি কিছু ভোলেনি। ও এখনো সব মনে করতে পারে।
– ওঃ! তুমি না! এমন একটা গান গাইছো, যেটার মানেই তুমি জানো না। ইস! কেমন যে দেখাচ্ছে তোমায়! পাশ দিয়ে যেসব নৌকো মাছ ধরে ফিরল ওরা নিশ্চয়ই তোমাকে নিয়ে মজা করছিল।
– পেমা, আমি কি একটা গানও মনের আনন্দে গাইতে পারব না? ভাবুক গে ওরা যা খুশি। আমি আমার নিজের খুশিতে গাইব।
এবং সে গাইত –
” Sabi Ine Macha Pamubi nangbu tarabra…lamlei ngabu talluba…”
– আবার! থামো থামো। যথেষ্ট হয়েছে…
হেসে গড়িয়ে পড়ত দুজনে। সেসব হাসি-গান – তনটম্বির মনে হয়, এখনো এখানকার বাতাসে ভেসে আছে। সেই আনন্দে কোন ভয়ের ছায়া ছিল না। শুধুই তৃপ্তি। ঠিক যে মুহূর্তে ওরা ভাবতে শুরু করেছে ওরা আরো অনেক সুখস্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকবে আরো অনেকদিন ঠিক সে সময়ই সেই অপ্রত্যাশিত দুঃসময় এসে দাঁড়াল। ছোট ছোট মুখগুলো থেকে যেসব বড় বড় কথা বেরিয়ে আসছিল, তা ভীষণই অপমানজনক। তনটম্বি আর ওর স্বামীকে ওদের ফুমদি থেকে কিছু দূরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল নৌকো করে। তনটম্বি ভাবছিল, ছেলেগুলো এখানেই কেন ডুবে মরে না! এই দম্পতি এত কষ্ট করেছে, এত দুর্ভোগ সয়েছে, তারপরেও এই লেকের মধ্যে তাদের এসব সহ্য করতে হচ্ছে। চুপচাপ ওরা বসে রইল নৌকাতে। ছোট ছোট ছেলেগুলো কোনরকম সৌজন্য, মান্যতা না রেখেই ওদের সামনে কথা বলতে থাকল। বাবা -মা’র বয়সী দুজন মানুষকে শুধুমাত্র ক্ষমতার জোরে ওরা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করতে পারল।
কিরকম স্বাধীনতা ওরা চাইছে! কোন ন্যায়পরায়ণতার পথে এরা ভেসে চলেছে! ভেতরে ভেতরে ফুঁসছিল তনটোম্বি। হঠাৎ ওর মুখ থেকে বেরিয়ে আসে,
– এসব ছেলে মেয়ে মরলে কি ওদের বাবা-মা একদিনের জন্যও শোকার্ত হবে?
– কি! কি বলছো তুমি? কাদের সম্বন্ধে কি বলছ খেয়াল আছে? ভুলে গেছ নাকি যে আমরা ঠিক লেকের মাঝখানে রয়েছি? নিশ্চয়ই চাও না এখানে ডুবে মরতে? একবারও ভাবেনা এই মহিলা মুখ খোলার আগে।
তনটম্বি ওর স্বামীর রাগতঃ কথায় একটু হতচকিত হয়ে যায়। গলার স্বর নিচু করে বলে,
– যদি আমরা একসাথে কাজ করতাম, তবে ওরা বুঝত ঘামের দাম। ওরা সব ক্ষমতা নিজেদের হাতে রাখতে চায়। যদি আমরা ওদের কাঁধে তুলে নিই ওদের অভীষ্ট সাধনের জন্য, তাহলেও এই অর্বাচিনের দল চিরকাল আমাদের পায়ের নিচেই রাখতে চাইবে।
টমচউ উত্তর দিল না। ক্ষয়াটে চাঁদের আলো-আঁধারিতে ও নৌকো বেয়ে ঘরের দিকে চলে আনমনা ভাবে। নৌকো ধীর গতিতে এগোয়। ফুমদিতে পৌঁছতেই হঠাৎ কেউ একজন নৌকোর সরু মুখের দিকটা চেপে ধরে টেনে আনে কাছে। অন্য একটা হাত টমচউকে হিঁচড়ে নামায় নৌকো থেকে। ছোট্ট নৌকোটা দুলে ওঠে ভয়ংকরভাবে। তনটম্বী আহত হয়। শক্ত হাতে নৌকার গলুই চেপে ধরে। সে শুনতে পায়, ওর স্বামীকে মারধোর করা হচ্ছে।
– বল্, ওরা কোথায় গেল? কি নিয়ে আসছিল ওরা? বন্দুক? নাকি তোরাই ওদের খাবার দাবার দিয়ে আসিস? চল্ আমাদের নিয়ে চল্ ওদের কাছে।
টমচউ উত্তর দিল কিনা শুনতে পায়না তনটম্বি। শুধু আর্তনাদ ভেসে আসে। ও আর থাকতে না পেরে ওদের কাছে নতজানু হয়ে প্রার্থনা করে,
– দয়া করে ছেড়ে দাও ওকে। আমরা সত্যিই কিছু জানি না।
ভীষণ রূঢ় এক কণ্ঠস্বর জবাব দেয় –
– এই বয়সেও তোদের লোভ যায় না। কত টাকা পাস ওদের থেকে, বল্। নিয়ে চল্ ওদের কাছে। নইলে মেরে ফেলব তোদের, বুঝলি বুদ্ধুরা?
মরা চাঁদের আলোয় ওরা ওর স্বামীকে তার নিজের নৌকোতে বসিয়েই নিয়ে চলল। আরো কিছু এদিক ওদিক লুকিয়ে থাকা ধূসর উর্দি ওদের পেছনে চলতে শুরু করল। তনটোম্বি একলা পড়ে রইল ফুমদিতে। ক্ষীয়মান চেহারাগুলির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ডুকরে কেঁদে উঠল ও।
সূর্য ওঠার সাথে সাথে পুরো লোকটাক লেক ঘিরে ফেলল উর্দিধারীরা। কেউ আর এখানে আসতে বা বেরোতে পারবে না। কিছু মানুষ যারা মাছ ধরতে এসেছিল, তাদের মেরে ফেলা হল। সমস্ত জায়গা এখন আর্মির লোকেরা তাদের ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাহারা দিচ্ছে। জানা অথবা না জানা এখন সবটাই নির্ভর করছে একমাত্র টমচউ এর ওপর। দুপক্ষের কেউই জানে না টমচউ’র মন এখন কি কথা বলবে। তনটম্বি হতাশায় আচ্ছন্ন। দমিত ক্রোধ ওকে পাগল বলে তুলল। কার কাছে যাবে ও? কার কাছে ওর স্বামীর প্রাণভিক্ষা করবে? সময় এগিয়ে চলল গুড়ি গুড়ি পায়ে।
প্রচন্ড অত্যাচারের পর যখন ওরা টমচউকে নিয়ে গেল, সেটাই তনটম্বি-র সাথে ওর স্বামীর শেষ দেখা। রাতের অন্ধকারে ওরা হত্যা করেছিল টমচউকে। যারা ওদের ফুমদি ছেড়ে চলে যেতে বলেছিল, তাদের জন্যই প্রাণ দিল ও। সৈনিকদের ও অন্য রাস্তায় নিয়ে গিয়েছিল ইচ্ছা করেই। বিভ্রান্ত করেছিল, ভুল পথে চালনা করেছিল ওদের। তাদের জন্যই এটা করেছিল, যারা ওদের শেষ আশ্রয়টুকু কেড়ে নিতে চেয়েছিল।
লাল কমলা মেঘেরা সমস্ত দিক থেকে লেকের ওপর ভেসে আসছিল। নীলাভ সবুজ লেকের জল রং বদলেছিল সেদিন। টমচউ শান্তভাবে শুয়েছিল নিজের নৌকার মধ্যে। যেন গভীর ঘুমে মগ্ন। ওর ‘লৌখাউ’ শার্ট আর ‘খুদেই’ সম্পূর্ণ লাল হয়ে ছিল নিজের রক্তে। তনটম্বি বিহ্বলভাবে তাকিয়ে ছিল সেদিকে। ওর আনমনা চোখ দেখতে পায়নি কখন ওরা ওর স্বামীকে এখানে রেখে গেল। ওর চিন্তাগুলো ছুটে বেড়াচ্ছিল উন্মত্তের মত। দুপক্ষের কেউই ঠিক বেঠিক নির্মাণ করতে পারে না, অথচ সাধারণ মানুষকে মৃত্যু উপহার দিয়ে চলে ক্রমাগত। ও চিৎকার করে জানতে চাইল,
– ওর কি দোষ ছিল…
যে কুঁড়েঘর ওরা এত পরিশ্রমে তৈরি করেছিল তাকে ওরা ছাইয়ের গাদায় রূপান্তর ঘটাল। লেকের জলে এখনো লাল রক্তের ঢেউ উঠছে, ভাঙ্গছে।
শব্দপঞ্জী
ফুমদি – লোকটাক লেকে ভেসে থাকা বায়োমাসের ওপর তৈরি ছোট ছোট অসংখ্য কুঁড়েঘর অথবা বেশ কয়েকটি ঘর নিয়ে তৈরি ছোট গ্রাম।
লৌখাউ – মাঠে কাজ করার অথবা মাছ ধরার সময় পড়ার শার্ট।
খুদেই – গামছা