Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,তপেন্দু

ধারাবাহিক: অমৃতস্য পুত্রা (পর্ব-১১) । অনিন্দিতা মণ্ডল

Reading Time: 5 minutes

ছোট এক বৈঠকখানায় বসে গল্প হতো। অসমবয়সী দুটি মানুষের গল্প। বলছি—জেঠু, আমি তোমার মঞ্জরী আমের মঞ্জরী দেখিনি। শুনেছি তোমার একটা স্বগতোক্তি আছে। কিন্তু ছোট ছিলাম বলে বাবা নিয়ে যায়নি। জেঠু খাট থেকে নেমে মাটিতে বসে পড়ল। এক পা মুড়ে আর এক পা হাঁটু পর্যন্ত তুলে মাথাটা হাতে ভর দিয়ে শুরু করে দিলো সেই সংলাপ। সৌভাগ্য আমার। কিন্তু সেদিন ধরতে পারিনি। জেঠু অ্যালবাম খুলে থিয়েটারের স্টিল ছবি দেখাত। আমি অবাক চোখে দেখতাম। একদিন জিজ্ঞেস করল—আচ্ছা মামনি বল তো, তোকে যে এত শোনাই, কী তোর সবচেয়ে ভালো লাগে? স্কুল থেকে ক্লাস টেনে আমাদের ছুটি দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমি অবলীলায় বললাম, তোমাকে আমার ‘ছুটি’তে সবচেয়ে ভালো লেগেছে। জেঠুর চোখের দৃষ্টি নরম হয়ে এসেছে। যেন এখনই কেঁদে ফেলবে। হঠাৎ গলা তুলে বলল, ওর রসগোল্লার ভাঁড়টা দিবি রে?

জেঠুর সঙ্গে অনেকটা সময় কাটাতে পারিনি। সে অপরাধ মনের মধ্যে এমন গাঢ় হয়ে আছে যে শত চেষ্টাতেও তা সরে না। মনে আছে সেই দিন। বাবাকে কথা দিয়েছিল জেঠু, তোমার নাটক আমি করব। কমার্শিয়াল থিয়েটার হলেও করব। অন্ধকার ক্রমে ঘন হয়। মাথার মধ্যে তৃতীয় কণ্ঠস্বর নড়াচড়া করে।   

এখন তপন সাহা স্টুডিওতে তিন চারটে ফ্লোরে একসঙ্গে শ্যুট করছে। একই অভিনেতা অভিনেত্রী। একই রকমের চরিত্র। একই গল্পের আদল। শুধু একটু আধটু রকমফের। একটু মেক আপের অদল বদল। এক ফ্লোরের থেকে অন্য ফ্লোরে অনায়াস বিচরণ। পাবলিক খাচ্ছে। টাকা উঠছে। তপন সাহা এখন বাংলা ছবির মেসায়া। তপেন্দুর বরাতে দশ হাজার টাকা, দুটো সিডি, তামিল বা তেলুগু। লিখতে ইচ্ছে করে না। চুপ করে বসে থাকেন। পায়ে পায়ে কখন ভারতী এসে দাঁড়িয়েছেন – কি হলো? লিখছ না? নিভে যাওয়া গলায় বলেন – লিখবো। একটু সময় চাই। – কিন্তু দেরি হলে তো টাকা পেতেও দেরি হবে! সংসার চলবে কি করে যে। সত্যিই! এখন তো আর অজিতদা নেই, যে বলবে, তপেন্দু লেখো। মনের মতো করে একটা লিখে ফেলো। রাখো এই টাকাটা। একদিন আমরা নিজেরাই করব এটা। তিনি এই প্রসঙ্গটা যত পারেন এড়িয়ে যান।

বছর পাঁচেক আগের কথা। সেদিন সুজাতা সদন থেকে একসঙ্গে ফিরছিলেন। একজন প্রযোজক সুজাতা সদনে অজিতদাকে মুখ্য ভুমিকায় নিয়ে নাটক করতে চান। চারিদিকে পেশাদার মঞ্চগুলোর ঝাঁপ পড়ে গেছে। যেগুলোতে এখনও নাটক চলছে সেসব নাটক অতি নিম্নমানের। এই সময়ে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে মুখ্য ভুমিকায় নামিয়ে নাটক? কিন্তু অজিতদা বললেন – তপেন্দু, নাটকটা লিখে ফেলো। শো পিছু একটা রয়্যালটি তো পাবে, নিশ্চিন্ত আয়। হেসেছিলেন – আপনি সত্যিই নাটকটা করবেন? অজিতদা একটু থেমে বলেছিলেন – তপেন্দু, যা ছুঁতে চাও তার জন্য শক্ত মাটির ওপর দাঁড়াতে হবে। তবে হাত দুটো আকাশে মেলা সম্ভব। তপেন্দু চাপা স্বরে উচ্চারণ করেন – আমি কি আর পারব? বয়স তো অনেক হলো। অজিতদা পিঠে হাত রাখেন – পারবে পারবে। তোমার আগুনের তাত আমি টের পাই। তপেন্দু ভাবেন। ‘তাহলে আপনি কথা দিন?’ ‘কি কথা?’ ‘আপনার সঙ্গে যা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল সেদিন।’ স্বভাবসিদ্ধ অট্টহাসিতে গাড়ির চালক চমকে উঠেছিল। বলেছিলেন – আরে হ্যাঁ রে বাবা। চলো এর মধ্যেই ওয়ার্কশপ হোক। মহাভারত নিয়ে কাজ করার আমারও বহুদিনের ইচ্ছে। এটাই নয় নান্দীমুখের নেক্সট প্রোজেক্ট হবে। কাল বিকেলে কিন্তু ভারতীকে নিয়ে নাটকটা দেখতে এসো। তপেন্দুর বুক ভরে ওঠে। অজিতদা যে কতখানি! কত বন্ধু! এমন বন্ধু আর কে আছে তাঁর!

 প্রেক্ষাগৃহ পরিপূর্ণ। তপেন্দু লক্ষ করছিলেন অজিতদা যখন ওই বিশাল শরীরটা নিয়ে স্টেজে গড়াগড়ি দিচ্ছেন, আর্তস্বরে সংলাপ বলছেন, পাশে বসা ভারতীর দুচোখ বেয়ে জল নামছে। চরিত্রটা নিজের অপরাধের বোঝা বইতে অপারগ। তাঁর মতো? বাড়ি ফেরার সময়ে ভারতী বললেন – অজিতদাকে অত বড় শরীরটা নিয়ে ওরকম গড়াগড়ি দিতে বারণ কোরো। ভয় করে কেমন। তপেন্দু জানতে চান – পাপপুণ্য কেমন লাগল বলো। অজিতদা ওটাই জানতে চাইবেন তো। ভারতী মুগ্ধস্বরে বলেন – অপূর্ব! অজিতদার সত্যিই তুলনা নেই।

সুজাতা সদনে নাটক নেমেছে। আজ দুদিন হলো। ‘এই অরণ্যে’। নাটক শেষে অজিতদার সঙ্গে একসঙ্গে ফেরা। লেকটাউনের ফ্ল্যাটবাড়ির দরজায় তাঁকে নামানোর সময় কত আলোচনা। কত স্বপ্ন। মহাকাব্যের পুনর্নির্মাণ! অজিতদা তাঁকে ভরসা করেছেন। পারতে তাঁকে হবেই। পরিতৃপ্ত দুটি মানুষ। রাত হয়ে যাচ্ছে। কাল অষ্টমী। দুটো শো। তিনি বিদায় জানালেন।

তখনও ভালো করে ভোর হয়নি। দরজায় প্রবল কড়া নাড়ার শব্দ। ভারতী তাড়াতাড়ি দরজা খুললেন। কে এসময়ে? খোলা দরজা দিয়ে হুমড়ি খেয়ে ঢুকে এলো দুটি ছেলে। নান্দীমুখের ছেলে এরা। তপেন্দু চেনেন। দুজনে একযোগে ভাঙা স্বরে বলে উঠল – অজিতদা আর নেই। সেই তিনটি শব্দ যেন কোন সুদূর থেকে এসে তাঁর চেতনায় আঘাত করল। তীব্র আঘাত। জীবনে প্রথম কোনও মৃত্যু সংবাদে তিনি চেতনা হারালেন। ডুবে যেতে যেতে তিনি শুনতে পেলেন ভারতীর কান্না – শুনছ? শুনছ?

নিমেষে জগতটা অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে তিনি আর ফরমায়েশি লেখা ছাড়া লেখেন না। পয়সার জন্য। পেট ভরানোর জন্য লেখা। কত যে লিখেছেন তার হিসেব রাখেননি। নিজের কপি রাখেননি। কি করে রাখবেন? প্রযোজক যে লেখার কাগজ কালি কিনে দিতেও বেজার! ‘আপনি লিখে নিন না, পেমেন্ট করে দেবো’। অগত্যা গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে ওই এক কপি। তারপর বহু সাফল্য এসেছে। টাকা তেমন আসেনি। ইন্ডাস্ট্রিতে এখন বানিয়ারাজ। এরা সূক্ষ্ম চারুকলা বোঝে না। বোঝে টাকা কামানোর সহজ ফন্দি। সূক্ষ্ম লিখে ফেললে বলে – ওসব ছবির পয়সা উঠবে না। বন্ধুত্বের সুযোগও নিয়েছে বহু লোক। বিষয়ী তিনি নন। নিজেরটা বুঝে নেবার মতো বুদ্ধি তাঁর নেই। কর্তব্যে অবহেলা ছাড়া বড় কোনও অপরাধের বোঝা তাঁকে বইতে হয়নি কখনও। এখন ক্লান্ত লাগে।


আরো পড়ুন: অমৃতস্য পুত্রা (পর্ব-১০) । অনিন্দিতা মণ্ডল


অথচ পাঁচটি মাত্র শরত আগে। এক অন্য জীবন। তখনও স্কুলের গণ্ডি। শরতের আকাশের মতো নির্মল আর কিইবা আছে! তুলো তুলো মেঘের ময়ূরপঙ্খী উড়িয়ে আকাশ ডাক দেয়। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে বসি। বিছানার পাশে রাখা চায়ের পেয়ালা। সেই গাঢ় বাদামী রঙের ননীর অমৃতবিন্দু দেওয়া চা। মা দার্জিলিং চা ছাড়া খেতে ভালোবাসেনা। আমি খুঁজে খুঁজে আনি। গ্রে স্ট্রীটের বীণা টি হাউস থেকে প্রথমে। তারপর স্কুলের পথে অরফ্যান টি থেকে। দোকানের মধ্যে জমাট অন্ধকার। বাইরে সর্পিল কিউ। অন্ধকারে ভেসে ভেসে আছে অগুণতি বিস্কুট রঙের পেটি। ওপাশের ভদ্রলোক আমার হাতের তেলোয় ঢেলে ঢেলে রাখছেন বিভিন্ন ধরণের চা পাতা। আমি গম্ভীর মুখে শুঁকে শুঁকে দেখছি। শেষে বলছি, ওই প্রথমে যেটা দিয়েছিলেন ওটাই। ভদ্রলোক প্রশ্রয়ের হাসি হাসছেন। হুঁ, তবে ? আমি ত প্রথমেই সেরাটা দিয়েছি। পেছনের লোকে বিরক্ত হচ্ছে। এই খুকি, হলো ? ভদ্রলোক ধীরে সুস্থে আমাকে চা পাতা দিচ্ছেন। ওমা ! সঙ্গে আবার ছোট্ট একটা প্যাকেট ! ও কাকু ! আমার কাছে আর পয়সা নেই ত! ভদ্রলোক হাসছেন। একটু বিব্রত। ওটা নতুন এসেছে। এমনিই দিলাম। মা খেয়ে কি বলেন জানিও ত। আমি সংকোচে পা ফেলি। বেরিয়ে আসতে আসতে শুনতে পাই। আপনার কেউ হয় নাকি? নাঃ, কেউ না। ওর মা চা ভালোবাসে বলে কেমন বেছে বেছে চা কেনে। কিচ্ছু জানেনা। তবু।

স্টপেজ এসে গেছে। আমি নেমে যাই। ফুটপাত এখন নির্জন। এখনো স্কুল কলেজ অফিসের ভিড় নামেনি রাস্তায়। বেশ হাওয়া খেতে খেতে এসেছি। চওড়া ফুটপাত বেঁকে গিয়েছে ভেতরে। রাস্তার মুখে বাঁশের খাঁচা বানানো প্রায় শেষ। ঠাকুর আসবে কতক্ষণ। ঠাকুর যাবে বিসর্জন। আমি মনে মনে আওড়াতে থাকি। উৎসব আমার ভালো লাগে না। মা এমনি দিনে ভালো থাকে। উৎসব এলে মুখ ভার।

মোড় ঘুরতেই ডান দিকের ফুটপাতে চার নম্বর বাড়ির চারতলার বারান্দা থেকে গমগমে কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। মামনি এসো এসো এসো। আমি কুঁকড়ে যেতে থাকি। লোকে দেখছে আমাকে ?

নীচের তলায় নাটকের মহড়া চলছে। আমি পাশ কাটিয়ে উঠে যাই। সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আছে সেই জাদুকর। দীর্ঘদেহী।  মুখে হাসি। চোখে অপার স্নেহ। সেই স্নেহ যেন গলে গলে নামছে। আমি ভেতরে ঢুকি। এইটুকু হেঁটে আসার পরিশ্রমেই ঘাম হচ্ছে। বড় বড় শ্বাস। জাদুকর এক গ্লাস জল আনে। একটা গামছা এগিয়ে দেয়। নাও, মুখটা মুছে ফেলো দেখি। জল খাও। পাখাটা চালিয়ে দিই।

ধীরে ধীরে আমি শামুকের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসি।

জাদুকর বলে, আচ্ছা, তোকে যে সকলে বলে তুই খুব খোলা মনের, তা ত নয় ! তুই মনটাকে খোল রে মামনি। আমি হাসি। কেমন ? তোমার হাসির মতো ? জাদুকর হা হা করে হেসে ওঠে। আমি দেখতে পাই। রাণুর প্রথম ভাগ বইগুলো ছিঁড়ে যাওয়া সত্ত্বেও ছোটকাকা রাগ করেনি। এমন হেসেছিল। মনে মনে বলি। ছোটকা, তুমি আমার ছোটকা হবে ? আমি ত মুখ ফুটে বলিনি ? তবে জাদুকর কি করে যেন বুঝে ফেলেছে। আমার মাথায় একটা বিরাট হাত। হাতের তেলো মাথা ঢেকে ফেলছে। জাদুকর বলছে, মামনি আমি তোর জেঠু। তোকে আমি উত্তরাধিকার দিয়ে যাবো।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>