ইয়োহান অফিস থেকে ফিরেই সোফায় গা এলিয়ে টেলিভিশানের রিমোটটা হাতে নেয়। এ সময় গত দু’বছর যা হচ্ছে তা হয়, চাইলাই এসে হাসিমুখে তার জুতো খুলে দেয়, মোজা খুলে দেয়। জুতো মোজা নিয়ে জুতোর র্যাকে সাজিয়ে রাখে। তারপর শর্টস আর একখানা টিশার্ট নিয়ে এসে দাঁড়ায়, ইয়োহান টিভিতে চোখ রেখেই শার্ট খোলে, প্যান্ট খোলে, আন্ডারওয়্যার খোলে, চাইলাই সার্ট আর প্যান্ট হ্যাঙ্গারে রাখে, আর আন্ডারওয়্যার রেখে দেয় লন্ড্রির ঝুড়িতে। উলঙ্গ ইয়োহান এরপর সোফায় সোজা হয়ে বসে, আর পেছনে দাঁড়িয়ে চাইলাই মাসাজ করে দেয় তার ঘাড়, তার পিঠ, তার দু’বাহু। তারপর আবার গা এলিয়ে দেয় ইয়োহান, তখন পা দুটো কোলে নিয়ে বসে চাইলাই, পায়ের আঙুল, পা, হাত, হাতের আঙুল মাসাজ করে দেয়। হয়ে গেলে মাথার পেছনে একটি চেয়ার টেনে বসে চুলে চিরুনির মতো আঙুল চালায়। ইয়োহান সুইডিশ টিভিতে মূলত ফুটবল দেখে, নয় ইউরোভিশান জাতীয় গানের প্রতিযোগিতা, নয় অন্য কোনও এন্টারমেইন্ট। চাইলাই চুলে এমন চমৎকার আঙুল বুলিয়ে দেয় যে ইয়োহানের ঘুম পেয়ে যায়।
–চাইলাই, তুমি এত সুন্দর মাসাজ জানো কী করে?
চাইলাই হাসে, কিছু বলে না।
–পারলারে কাজ করতে?
চাইলাই হাসতে হাসতে বলে, পারলারের কাজ শিখেছি। ভেবেছিলাম করবো।
–তো করলে না কেন?
চাইলাই মধুর হেসে বলে–বিয়ে হয়ে গেল তো!
তা ঠিক, ইয়োহানের সঙ্গে তো ওর বিয়ে হয়ে গেল। চাইলাই এখনও সুইডিস ভাষাটা ভালো রপ্ত করতে পারেনি। কুলাপ আর কুলাপের বান্ধবীরা মুখে মুখে যেটুকু শিখিয়েছে, সেটুকুই শিখেছে। প্রতিবারই ও যখন সুইডিশ বলে, ইয়োহানের বুঝতে কিছুক্ষণ সময় লাগে। দু’তিনবার একটি বাক্য বলার পর ইয়োহান বোঝে কী বলতে চাইছে চাইলাই। তার চেয়ে চাইলাইয়ের ভাঙা ইংরেজি বুঝতে সুবিধে হয় ইয়োহানের। কিন্তু চাইলাই ইংরেজির চেয়ে সুইডিশ বলতেই আগ্রহী। চাইলাই ভাবে সে খুব চমৎকার সুইডিশ বলে। ইয়োহানের ভালো লাগবে সে সুইডিশ বললে, এই ভেবেই সে বলে ভাষাটি।
এরপর প্রতিদিনের মতো চাইলাই জিজ্ঞেস করে ডিনার সার্ভ করবে কিনা। ইয়োহান টেলিভিশান দেখতে দেখতেই মাথা নাড়ে –হ্যাঁ।
ঝকঝকে বাড়ি, ধুয়ে মুছে সাফ রাখে চাইলাই। বাড়িটি আগে এত ধুলোহীন কখনও ছিল না। ইয়োহান যা যা পছন্দ করে, ঠিক সেসবই রান্না করে চাইলাই। ইয়োহানকে রান্নাঘরেই যেতে হয় না। একবার পুরোনো অভ্যেসে রাতের খাবারের পর নিজের থালা ধুতে নিচ্ছিল, হাত থেকে থালাটি ছিনিয়ে নিয়ে চাইলাই সেটি নিজে ধুয়ে দেয়। চাইলাই কী রান্না করছে, কিছু সাহায্য করতে হবে কিনা, জিজ্ঞেস করতে এলে ইয়োহানকে দু’হাতে ঠেলে সরিয়ে দেয় চাইলাই, বলে তুমি তোমার কাজ করো, বই পড়ো, বা গান শোনো, বা কম্পিউটারে গেম খেলো, রান্নাবান্না আমি করছি। চাইলাই থাই খাবারই বেশি রান্না করে। চায়নিজ, জাপানিজ, ভিয়েতনামিজও করে। ইদানীং শিখেছে ফ্রেঞ্চ আর ইতালিয়ান। ইয়োহান বেশ সময় নিয়ে খায়, টম ইয়াম কুং, কেং খিয়াও ওয়ান, মাসামান কারি, সম টাম। চাইলাইকে বিয়ে করার পর থেকে নতুন খাবার যেমন উপভোগ করছে, নতুন নতুন নামও সে শিখছে খাবারের। প্রথম প্রথম এই খাবারগুলো সে ছুরি কাঁটাচামচ দিয়েই খেত, কিন্তু চাইলাই চপস্টিক হাতে ধরে কী করে খেতে হয় শিখিয়ে দিয়েছে। খাওয়ার সময় ইয়োহান চাইলাইয়ের কাছে জানতে চায় কোন খাবার কী করে বানানো হলো। ডিনারের এই সময়টা চাইলাই-এর সবচেয়ে প্রিয় সময়। চাইলাই কোথায় গিয়ে বাজার করলো বলে। কোথায় কী কী দেখলো বলে। কোন রান্না কী করে করলো বলে। ইয়োহান শোনে। ইয়োহান তার কথা মন দিয়ে শুনছে, এ ব্যাপারটি চাইলাইকে অপার শান্তি দেয়। তার বোনের তো বিয়ে হয়েছে এক থাই লোকের সঙ্গে , কোনওদিন কি বোনের বর মংকুত তার বোনের কথা শুনেছে এমন মন দিয়ে! কখনও কখনও চপস্টিকে তুলে কিছু খাবার চাইলাইয়ের মুখে ঢুকিয়ে দেয় ইয়োহান।
–দেখ দেখ এ তো ভীষণ টেস্টি বানিয়েছো, খেয়ে দেখ।এত অল্প বয়সে এত ভালো রান্না কোত্থেকে শিখেছো মেয়ে!
লজ্জার হাসি হেসে মুখ লুকোয় চাইলাই। এরপর রাঙা মুখে বলে– এর চেয়ে আরও ভালো রাঁধবো, দেখে নিও।
এর চেয়ে বড় প্রেম কোথাও দেখেনি চাইলাই। এত ভালোবেসে কি মংকুত তার বোনের মুখে খাবার তুলে দেয়! চাইলাই ভাবে, প্রেম করে বিয়ে হয়নি বটে, তবে বিয়ের পর একটু একটু করে প্রেমই হচ্ছে। যে স্বামী অফিস শেষ হওয়ার পর বন্ধুদের সঙ্গে গভীর রাত অব্দি কোথাও আড্ডা দিতে চলে যায় না, সোজা বাড়ি চলে আসে, শনি রবিবার দুটো দিনই সে বাড়িতে কাটায়, অন্য কোনও মেয়ের সঙ্গে লুকিয়ে প্রেম করছে না সে, লুকিয়ে কারও সঙ্গে শুচ্ছেও না – এমন সৎ স্বামী ভাগ্যবতী স্ত্রীদেরই মেলে। আজ ইয়োহান বললো, যেহেতু একটাই গাড়ি তাদের, জরুরি কাজে বেরোতে হলে, বিশেষ করে বাজার করতে চাইলাইকে হেঁটে যেতে হয়। অথবা বাসে যেতে হয়, সে বরং আরেকটি সস্তা দেখে গাড়ি কিনে নেবে রাফ ইউজের জন্য। চাইলাইকে গাড়ি চালানো শিখিয়ে দেবে। চাইলাই না না করে ওঠে। বলে, কেন শুধু শুধু টাকা খরচ করবে, আমাদের একটা গাড়িই বেশ চলছে। এখানকার বাস এত ভালো, আমার বেশ লাগে চড়তে। আর হাঁটতেও তো ভালো লাগে। রাস্তা গুলো এত ফাঁকা। ইয়োহান এই যে আরেকটি গাড়ি কেনার কথা ভাবছে চাইলাইকে ভেবে, মঙ্কুত কোনওদিন তো এমন কল্পনাও করবে না। ইয়োহান তাকে ভালোবাসে, এ চাইলাইয়ের জন্য পরম পাওয়া। কালাসিন গ্রামের কেউ বিশ্বাস করবে না চাইলাই যে এত বড় দেবতুল্য বর পেয়েছে। প্রতিমাসে পাঁচ হাজার ক্রোনোর দিচ্ছে দেশে তার মা-বাবাকে পাঠানোর জন্য। মংকুত ওদিকে শ্বশুর শাশুড়ির কাছে যখন তখন হাত পাতে, টাকা দেওয়া তো দূরের কথা।
–কী চাইলাই, তু্মি সুখী তো?
–ভীষণ সুখী।
ইয়োহান অফিস থেকে সোজা বাড়ি ফেরে। যাবে কোথায় সে! কোনও সুইডিশ মেয়ের জন্য তার কোনও আকর্ষণ নেই। ষোলো থেকে পয়ত্রিশ বছর বয়স অব্দি সে অসংখ্য সুইডিশ মেয়ের সঙ্গে প্রেম করেছে, লিভ-ইন করেছে। শেষ লিভ-ইনটাই তো ছিল টানা চার বছরের। বিয়ে করার ইচ্ছে ছিল খুব ইয়োহানের, কিন্তু ক্রিস্টিনা রাজি ছিল না, সন্তানেও রাজি ছিল না। বলতো, দুনিয়ায় কি কাচ্চাবাচ্চা কিছু কম? ক্যাচর ম্যাচর ভালো লাগে তো থার্ড ওয়ার্ল্ড থেকে একটা অ্যাডপ্ট করে নিয়ে এসো। বিয়ের ব্যাপারে চার বছর পরও বলেছে তার নাকি সিদ্ধান্ত নিতে আরও সময় চাই। এ কথা বলার দিন পনেরো পর স্যুটকেসে নিজের জিনিসপত্র নিয়ে কানাডার নোভাস্কোসিয়ায় কিছুদিন একা কাটাতে চলে গেল ক্রিস্টিনা। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে গিয়েছে। কবে ফিরবে, আদৌ ফিরবে কিনা ইয়োহানের কাছে, কিছু বলে যায়নি। মাস খানিক পর ইমেইল এল ক্রিস্টিনার, সে আর ইয়োহানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায় না। বলে দেয়, ইটস ওভার। ক্রিস্টিনার সঙ্গে অনেকদিন থেকেই খিটিমিটি বাধছিল ইয়োহানের। খুব বড় কিছু নিয়ে যে লড়াই হতো তা নয়।
ক্রিস্টিনা তার স্টকহোমে অ্যাপার্ট্মেন্ট তালাবন্ধ করে ইয়োহানের চিস্তার বাড়িতে উঠেছিল। চিস্তাতে যেহেতু ক্রিস্টিনারও অফিস, এতে সুবিধে হয়েছিল বৈকি। স্টকহোম চিস্তা যাওয়া আসার পনেরো পনেরো তিরিশ কিলোমিটারের ঝামেলা পোহাতে হতো না। ক্রিস্টিনা ধারালো মেয়ে। তার সঙ্গে এমন কোনও প্রসঙ্গ নেই জগতে যা নিয়ে আলোচনা করা যেত না। যে কোনও প্রসঙ্গেই বুদ্ধিদীপ্ত পর্যবেক্ষণ তার ছিল। ইয়োহানের যা পছন্দ ছিল না, তা হলো ক্রিস্টিনার ওই আমি রান্না করছি, তুমি বাসন মাজো, অথবা তুমি ভ্যাকুয়াম করো, আমি মপ করবো, আমি কাপড় কাচবো, তুমি ইস্ত্রি করবে—এই জাতীয় নারী-পুরুষ সমতা। যদিও বাড়িটা ইয়োহানের কেনা, ক্রিস্টিনা সংসারে যা খরচ হতো, তার অর্ধেক দিত। কিন্তু প্রতিটি কাজই দু’জনের করা চাই। একবার টানা দু’দিন ক্রিস্টিনা রান্না করলো, বাড়ি সাফ করলো, কাপড় কাচলো। আর ইয়োহান শুয়ে শুয়ে ম্যাগাজিন পড়লো, টিভি দেখলো, কম্পিউটারে গেম খেললো, গান শুনলো, ওয়াইন খেলো, বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে গল্প করলো।
ক্রিস্টিনা ফুঁসে উঠলো– বললো, কী ব্যাপার, আমাকে কি দাসি পেয়েছো?
–এসব কেন বলছো?
–ঘরের সব কাজ একা আমাকে করতে হচ্ছে কেন?
— তুমি কাজগুলো আমার চেয়ে ভালো জানো।
–আরাম করতেও কিন্তু আমি তোমার চেয়ে ভালো জানি।
–তা আরাম করো, না করেছে কে?
–আরাম করলে ঘর দোর নোংরা হয়ে থাকতো, না খেয়ে থাকতে হতো।
–না খেয়ে কেন, রেস্তোরাঁয় গিয়ে খেতাম।
–তা খেতে। কিন্তু তারপর তো তোমার ঘ্যানঘ্যানই আমাকে শুনতে হতো, রেস্তোরাঁয় খেয়ে খেয়ে ওজন বাড়ছে, ঘরের খাবার মাচ বেটার।
–ঠিকই তো, ঘরের খাবার তো মাচ বেটার, তো ঘরেই রান্না করো।
–সে তো করছিই।
–মিটে গেল।
–না, মিটে যায়নি। আমি একা রান্না করবো না, তোমাকেও করতে হবে।
–ঠিক আছে তোমাকে হেল্প করবো। আমি তো করিই হেল্প, করি না?
–করো। কিন্তু কাজটা আমার নয় যে তুমি হেল্প করবে। কাজটা যতটুকু আমার, ততটুকু তোমার। রান্না তুমি আমার চেয়ে কম ভালো জানো না। যদি কিছু না জানো, শিখে নাও। আমি যেমন শিখে নিই।
ক্রিস্টিনা ইয়োহানের বয়সী। নিজেও ইয়োহানের মতোই ইঞ্জিনিয়ার, তবে সে এরিকসনে চাকরি করতো না, করতো আলফোনিকে। দু’জনের পরিচয় স্টকহোমের একটি বারে। যখন প্রেম করছিল দু’জন, চিস্তার অফিস থেকে বেরিয়ে চিস্তারই কোনও রেস্তোরাঁ থেকে ডিনার সেরে চিস্তাতেই ইয়োহানের বাড়িতে আসতো ক্রিস্টিনা। যেদিন প্রথম ইয়োহানের বাড়িতে রাত কাটালো, দেখলো ফের ভোরবেলায় তাকে স্টকহোমে চলে যেতে হচ্ছে, স্নান করে জামা কাপড় পাল্টে ফের অফিসের জন্য চিস্তায় আসতে হচ্ছে। এ ভাবে ক’দিন চলার পর সে তার টয়লেট কিট, তার অফিসের দু’তিনটে পোশাক একটি ছোট ব্যাগে ভরে ইয়োহানের বাড়িতে রেখে দিল। এরপর কখনও ইয়োহানের বাড়িতে রাতে থেকে গেলে যেন সে এখান থেকেই সোজা অফিসে চলে যেতে পারে।
আরো পড়ুন: হাতে হাতে পাথর । তসলিমা নাসরিন
এরপর পরস্পরের মন এবং শরীর যখন জড়াজড়ি করে দীর্ঘদিন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলো, দুজনই বুঝলো তাদের এখন জীবন ভাগ করে নেওয়ার সময়, লিভ-ইন করার সময়।স্টকহোমের অ্যাপার্ট্মেন্ট থেকে প্রয়োজনীয় কাপড় চোপড় বড় একটি স্যুটকেসে নিয়ে দরজা তালাবন্ধ করে চলে এলো ক্রিস্টিনা। অফিস থেকে দুজনই ডিনারের জন্য বাজার করে সেদিন বাড়িতে এসেছিল। ইয়োহান স্বভাববশত সোফায় শুয়ে রিমোট হাতে নিল। ক্রিস্টিনা বলে উঠলো, কী ব্যাপার, শুলে যে? কিচেনে চলো, ডিনারে আজ সালমন বেক করা হচ্ছে। সালমন আমি ওভেনে দিচ্ছি। তুমি সাইড ডিশগুলো বানিয়ে ফেলো। ইয়োহান পটেটো সালাদ আর জিঞ্জার গার্লিক ব্রকলি বানালো। গান চালিয়ে দিয়ে গানের তালে কয়েক পাক নেচে দু’জনে মিলে ডিনার তৈরি করলো। ইয়োহানকে মুহুর্মুহু চুমু খেলো ক্রিস্টিনা, ইয়োহানও ক্রিস্টিনাকে। মাছ হলে সাদা ওয়াইন, মাংস হলে রেড ওয়াইনের বোতল ক্রিস্টিনাই খুলতো। ডিনারের আগে এক গ্লাস দুজনেরই পান করা চাই, ডিনারের সময় এক গ্লাস। ডিনার দীর্ঘক্ষণ সময় নিয়ে করতো দু’জন। ক্রিস্টিনা বলতো কী কী ঘটেছে অফিসে, কী কী কাজ সে করেছে, ইয়োহানও বলতো। বাসনগুলোকে ডিশ ওয়াশারে ঢুকিয়ে কেক আর কফি নিয়ে আসতো ইয়োহান। মাঝে মাঝে পিকনিকে চলে যেতো দু’জন, ক্যনু বাইতে বাইতে আর্কিপেলাগোর এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে চলে যেত, গরম কালে পাহাড়ের চূড়োয় ক’দিন ক্যাম্প করে থাকতো, অরোরা বরিয়ালিস দেখে তবে ফিরতো, পিঠে ব্যাকপ্যাক নিয়ে হাইকিং করতো, বরফে স্কি করতে চলে যেত দূরে। সেইসব দিন ছিল চমৎকার। তারপর ঘরের কাজ নিয়েই অসন্তোষ দেখা দিল। ক্রিস্টিনার অভিযোগ ছিল তাকে একা অনেক কাজ করতে হয়, ইয়োহান শেয়ার করলে সেও কিছু ফিল্ম দেখতে পারতো, অথবা লাইব্রেরি থেকে আনা বই কিছু পড়তে পারতো। একবার তো বলেই ফেললো, ইয়োহান, কী কারণে তুমি মনে করো আমাকে এ বাড়িতে বেশি কাজ করতে হবে, তোমাকে কম? ইয়োহানের মুখ ফসকে তখন এমন কথা বেরিয়ে যায় যে সে তক্ষুণি বোঝে এ কথা বলা তার উচিত হয়নি। ইয়োহান বলেছিল, তোমার তো স্টকহোম চিস্তা যাওয়া আসার পেট্রোল খরচটা বাঁচছে।
ধপাস করে ক্রিস্টিনা বিছানায় শুয়ে পড়ে বললো — কী বললে আবার বলো।
ইয়োহান আর বলেনি যা বলেছিল। কিন্তু ক্রিস্টিনা বললো—আমার খরচ যেহেতু বাঁচছে, তুমি চাইছো যে টাকাটা বাঁচছে সে টাকা তোমাকে দিতে হবে, অথবা ঘরের কাজকর্ম তোমার চেয়ে আমাকে বেশি করতে হবে। তাই না?
ইয়োহান বললো –না, আমি তো বলিনি আমাকে টাকা দিতে হবে।
ক্রিস্টিনা বললো — তাহলে খরচটা বাঁচছে বলে তুমি কী বোঝাতে চাইছো? তোমার ঘরের কাজগুলো আমাকে বেশি করতে হবে?
ইয়োহান কোনও উত্তর দেয় না। শুধু টেলিভিশনের শব্দ বাড়িয়ে দেয়। এরপর ক্রিস্টিনা স্টকহোমে নিজের অ্যাপার্ট্মেন্টে ফিরে গিয়েছিল। ওর কিছু কাপড় চোপড় অবশ্য ইয়োহানের বাড়িতেই রয়ে গিয়েছিল। অফিস থেকে আসতো সে ইয়োহানের বাড়িতে শুক্রবার বিকেলে। শনিবার কাটিয়ে রবিবার রাতে ফিরে যেত স্টকহোমে। ইয়োহান শত ক্ষমা চেয়েও আর শত অনুরোধ করেও আর ক্রিস্টিনাকে লিভ- ইন সম্পর্কে ফেরাতে পারেনি। তারপর তো একদিন যা কিছু তার ছিল ইয়োহানের বাড়িতে, সব স্যুটকেসে ভরে নিয়ে চলে গেল নোভাস্কোশিয়ায়।
নোভাস্কোশিয়া থেকে একা একা ছুটি কাটিয়ে সে ফিরে এসেছে। ইয়োহানের সঙ্গে বছর তিনেক পর এক সন্ধ্যেয় দেখা হয়েছিল চিস্তা মলে। চাইলাইকে নিয়েই ইয়োহান গিয়েছিল মলে কেনাকাটা করতে, মূল উদ্দেশ্য অবশ্য নিজের জন্য ভালো একজোড়া জুতো কেনা। চাইলাই স্যুপের বাটি কিনবে, কিছু বাসন কোসন, ওয়াশিং পাউডার, টয়লেট সাফ করার লিকুইড। চাইলাই যখন কেনাকাটায় ঝুঁকে আছে, ইয়োহান তখনই দেখে ক্রিস্টিনাকে, কারও সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাঁটছে। সোনালী চুলের ছিপছিপে সুন্দরী। ইয়োহান ছ’ফুট, ক্রিস্টিনা পাঁচ ফুট দশ। দু’জনকে পাশাপাশি খুব মানাতো। চাইলাই চার ফুট সাত। এই চাইলাইকে পাশে নিয়ে হাঁটলে লোকে ঘুরে তাকায়। জুটিকে মানালে লোকে যেমন তাকায়, না মানালেও তাকায়। ক্রিস্টিনা ইয়োহানকে দেখে নিজেই এগিয়ে এল।
কুশল সুধোনোর পর বললো –শুনলাম বিয়ে করেছো!
ইয়োহান হেসে বলে– করেছি।
ক্রিস্টিনা হাসতে হাসতে বলে– অভিনন্দন।
ক্রিস্টিনার মুখে চোখে এক তিল বিষাদ বা ঈর্ষা নেই, বরং আগের চেয়ে উজ্জ্বল সে মুখ। ইয়োহানের সুখ শান্তি বেশ অন্তর থেকেই কামনা করল।
–তোমার খবর কী? বিয়ে টিয়ে করেছো? ইয়োহান জিজ্ঞেস করে।
ক্রিস্টিনা জোরে হেসে ওঠে। বলে– পাগল হয়েছো?
হাসতে হাসতে আরও যা বলে, তা হলো কারও সঙ্গে সে প্রেম বা ডেট করছে না। একাই বেশ আছে।
–আলফোনিকেই আছো?
–আলফোনিকেই।
ক্রিস্টিনা জানালো তার কাজের চাপ অনেক। পাশের লোকটি কলিগ, দু’জন কফি খাবে, ক্লাস ওলসন থেকে ইউএসবি ড্রাইভ কিনবে, তারপর ফিল্ম দেখবে। ইয়োহান আর ক্রিস্টিনা আরও কিছুক্ষণ অজরুরি কিছু কথা বলে পরস্পরের কাছ থেকে বিদেয় নিল।
ক্রিস্টিনাকে দেখে মনে হয়নি এক সময় ইয়োহানের সঙ্গে সে প্রেম করতো, মনে হয়নি এক সঙ্গে চার বছর ছিল তারা। চিস্তার এই সিনেমায় তারা অনেকবার এসেছে ছবি দেখতে। ক্রিস্টিনার ছিল প্যারালাল ছবি আর সায়েন্স ফিকশান পছন্দ, আর ইয়োহানের অ্যাকশন। ক্রাইম স্টোরি ছাড়া ইয়োহান বই-ই পড়ে না, ক্রিস্টিনার পছন্দ নন-ফিকশান। দুজনের দু’রকম পছন্দে কোনও অসুবিধে হয়নি। কেউ কাউকে সে কারণে কম ভালোবাসেনি।
বার বার সুইডিশ মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর ইয়োহান নতুন সম্পর্কে যেতে আর চাইছিল না। ক্রিস্টিনা তাকে ছেড়ে যাওয়ার পর সে একাই ছিল। তখনই দীর্ঘদিনের সহকর্মী মিকেলে সুয়েনসনের বাড়িতে তার থাই বউ কুলাপের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেদিন মিকেলের বাড়িতে কমপক্ষে দু’ ডজন থাই-সুইডিশ দম্পতি এসেছিল, কারও সঙ্গে আগে পরিচয় ছিল না ইয়োহানের। থাই মেয়েগুলো কুলাপের বান্ধবী। এই মেয়েরাই তাদের সুইডিশ স্বামী নিয়ে এসেছে। এভাবেই প্রতি পাঁচ ছ’মাস অন্তর অন্তর একেকজনের বাড়িতে তাদের গেট টুগেদার হয়। থাই মেয়েদের স্বামীরাই এখন মিকেলের বন্ধু। বাড়িটির পেছনের বারান্দায় বসে সুইডিশ পুরুষগুলো বিয়ার খেতে খেতে আড্ডা দিল, সঙ্গে সিঙ্গল একজনই ছিল, ইয়োহান। ভেতর ঘরে কুলাপ আর তার থাই বান্ধবীদের কিচির মিচিরের শব্দ ভেসে আসছিল। যতই কিচির মিচির করুক, বারান্দায় কিন্তু বিয়ার আর সুস্বাদু থাই স্ন্যাক্স সময় মতোই পৌঁছে দিচ্ছিল কুলাপ আর তার বান্ধবীরা। থাই মেয়েদের বিয়ে করে আনা সুইডিশ পুরুষগুলো প্রাণ খুলে হাসছে, হৈ হল্লা করছে, কৌতুকে মাতিয়ে রাখছে। এদের শরীর বলছে, হাসিমুখ বলছে, এরা সুখী। এদের কারও সন্তান আছে, কারও নেই। এদের মতো প্রাণ খুলে হাসতে ইয়োহানেরও ইচ্ছে হয়।
এরপর ক্রমে ক্রমে অগ্রসর হয় প্রক্রিয়াটি। মিকেল আর কুপালকে একদিন নিজের বাড়িতে নেমন্তন্ন করে ইয়োহান। কুপালকে বলে সে ভালো একটি থাই মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। কুপাল খুশিতে লাফিয়ে ওঠে। তার এক কাজিন আছে, নাম চাইলাই। থাইল্যান্ডের ইসান প্রদেশেরই মেয়ে। কালাসিন ওর গ্রামের নাম, পাশের গ্রামটিই কুপালের গ্রাম, সাকোন নাখোন। কুপাল বলে ইয়োহানের জন্য চাইলাই-ই হবে পারফেক্ট ম্যাচ। কুপাল খানিকটা আড়াল হলেই মিকেল বলে যে থাই মেয়ে নিয়ে সে যত সুখে আছে, তত সুখে আগে কখনও ছিল না। হাউজ ওয়াইফ, তাতে কী? দুজনে মানিয়ে নিলেই হলো। মিকেল এবার ইয়োহানের কানের কাছে মুখ এনে বলে– আমাদের পূর্ব পুরুষ ভাইকিংদের বউরা তো হাউজ ওয়াইফই ছিল। আর থাই মেয়েরা, খাসা। সেক্সে কিন্তু কোনও ইনহিবিশান নেই। এরা দিতে জানে। চোখ বুজে শুধু নেবে।
ইয়োহান ওয়াইনে চুমুক দিয়ে বলে–সুইডিশ বিচদের মতো নয় তো! বিচদের যারাই বিয়ে করেছে, তাদেরই ডিভোর্স হয়ে গেছে। ইক্যুয়ালিটি ইক্যুয়ালিটি করতে করতেই এরা ধ্বংস হবে, কেউ এই বিচদের বিয়ে করবে না। এদের জীবনভর সিঙ্গলই থাকতে হবে।
–কচি শরীর, ইয়োহান, মনে হবে শিশুর সঙ্গে করছো। আমার তো এরকমই একটা অনুভূতি হয়।
–হুম।
–এরা লয়্যাল খুব। মারো ধরো, পেটাও, পায়ের কাছে পড়ে থাকবে। তুমি অন্যায় করবে, তোমার কাছেই ক্ষমা চাইবে। স্বামীদের এরা দেবতা মানে। কুলাপের কাছে তো তার বুদ্ধ যা, আমিও তা। তুমি বাইরে প্রেম করো, সেক্স করো, এদের কিছু যায় আসে না। এরা কোনওদিন তোমাকে ছেড়ে যাবে না। এ অন্য এক জগত ইয়োহান।
মিকেল এর আগে দুটো বিয়ে করেছিল। দুটোই ডিভোর্সে শেষ হয়েছে। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে দুটো সন্তান, ওরা মায়ের কাছে থাকে। দ্বিতীয়বার ডিভোর্সের পর মিকেল প্রায়ই থাইল্যাণ্ড যেতো, সেক্স ট্যুরিজমই ছিল কারণ। তারপর বিয়ের বিজ্ঞাপন দেখেই কুলাপকে বিয়ে করে নিয়ে আসে। মিকেলও বেজায় স্ফূর্তিবাজ। দুঃখ শোক বলে কিছু তার ধারে কাছে ঘেঁষে না। মিকেল গ্লাসে আরও খানিকটা ওয়াইন নিয়ে এক চুমুকে শেষ করে বলে–অত মরালিটি দেখতে বয়েই গেছে আমার। আনন্দ করে দু’দিনের জীবন কাটিয়ে দেব, ব্যস। বাচ্চাকাচ্চাতে একেবারেই যাবে না, ইয়োহান। এরা চাইবে, কায়দা করে এড়িয়ে যাবে। ওসব এসে গেলেই জীবন আর এঞ্জয় করতে পারবে না।
চাইলাই চাইনিজ স্টোর থেকেও কিছু আনাজপাতি কিনবে। শিগরি পার্টি হচ্ছে থাই মেয়ে প্রিদার বাড়িতে, তার সুইডিশ স্বামী অ্যান্ডার্স মিউজিয়ামের কিউরেটর। সে বাড়ির পার্টিতে চাইলাই প্যাড থাই রান্না করে নিয়ে যাবে। খুবই উত্তেজিত সে। প্রাণ ভরে মেয়েদের সঙ্গে নিজের ভাষায় কথা বলতে পারবে। এর পরেই চাইলাইয়ের পালা। তার বাড়িতেও এমন গেট টুগেদার হবে। ভালো যে একজনের ওপর রান্নার চাপ পড়ে না, সবাই একটি করে অন্তত খাবার রেঁধে নিয়ে আসে। কেনাকেটা শেষ হলে সেদিন ইয়োহানের ইচ্ছে ছিল কফি খাবে কোথাও বসে। কিন্তু ক্রিস্টিনার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে আবার, বিশেষ করে চাইলাইকে ক্রিস্টিনা দেখুক ইয়োহান চায় না, দ্রুত সে বাড়ি ফেরে। ক্রিস্টিনা চোখ টিপে বলেছিল, কী ব্যাপার মোটা হচ্ছো কেন, খাওয়া আর ঘুমোনো শুধু, তাই না?
শুধু খাওয়া আর ঘুমোনো হবে কেন, ক্রিস্টিনা, সেক্সও তো আছে, ইয়োহান মনে মনে বলে। সেক্সে তো প্রচুর এনার্জি খরচ হয়, সে তো তোমার জানার কথা।
ক্রিস্টিনার শরীর সহজে তৃপ্ত হতো না। তার ছিল অনেকক্ষণ চাই, অনেকগুলো আসন চাই-এর আবদার। কখনও ফস করে ইয়োহানের হয়ে গেলে, তাকে আরেকবার তৈরি হয়ে ক্রিস্টিনাকে অরগাজম দিতে হতো। আর চাইলাই নিজের অরগাজমের কথা ভাবেই না। ইয়োহান যেভাবে চায়, সেভাবেই সে বিছানায় চিৎ হয়, উপুড় হয়। উলঙ্গ হও চাইলাই গায়ে যেন একটি সুতোও না থাকে বলার সঙ্গে সঙ্গে চাইলাই উলঙ্গ হয়, গায়ে কোনও সুতোও থাকে না। ইয়োহানের ইচ্ছে করে আদি পুরুষ ভাইকিং হতে। ওরাল করো বললে চাইলাই ততক্ষণ করে যতক্ষণ না ইয়োহান থামতে বলে। এ কাজটা ক্রিস্টিনা করতেই চাইতো না, বলতো ও জিনিসটা তো আমি চাই, তুমি করো, ওরাল করেই আমাকে অরগাজম দাও। ইয়োহানের মনে হতো অনন্তকাল ওরাল চাইছে সে। চাইলাই তো চায় না। একদিনও বলেনি আমারও চাই। চাইলাইয়ের খাই খাই নেই। রাইড করো, রাইড করবে। এই আসন, সেই আসন কত আসনেই যে চাইলাইয়ের ছোটখাটো শরীরটাকে প্লাস্টিকের মতো বাঁকিয়ে কতভাবে আনন্দ নিয়েছে ইয়োহান। প্রতিবারই মনে হয় সে বোধহয় ভার্জিনের সঙ্গে সেক্স করছে।
ইয়োহান কি সুখী? খুব সুখী।
চাইলাই তো একবারও বলে না তার অরগাজম চাই! প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে অরগাজম কী জিনিস হয়তো জানেই না। বিয়ের সময় ভার্জিন ছিল। বয়স ছিল আঠারো বা উনিশ। ইয়োহানের চেয়ে অন্তত পঁচিশ বছরের ছোট চাইলাই। কচি মেয়ের কচি শরীর ভোগ করতে যে কী আনন্দ, তা ওই থাই-সুইডিশ কমিউনিটির পুরুষগুলো, তার নতুন বন্ধুগুলোই, জানে। প্রতিরাতে সেক্সের সময় ইয়োহান কন্ডমের প্যাকেট বালিশের নিচে রাখে। নিজের অরগাজমের ঠিক আগে আগে কন্ডম পরে নেয়। প্রতিবারই চাইলাই বলে, চলো বাচ্চা নিই, কন্ডম পরো না। ইয়োহান হেসে চাইলাইয়ের ছোট ছোট স্তন মুঠোর মধ্যে নিয়ে চাপ দিতে দিতে বলে, এদুটো আরও বড় হোক, না হলে বাচ্চাকে দুধ খাওয়াবে কী করে। ক্রিস্টিনার সঙ্গে কন্ডম পরতে চাইতো না ইয়োহান, সত্যি সত্যি সন্তান চাইতো সে। ক্রিস্টিনা কন্ডম ছাড়া রাজিই হতো না সেক্সে।
–কী গো ইয়োহান তুমি কি সুখী ছিলে না ক্রিস্টিনার সঙ্গে?
–ছিলাম, কিন্তু
–তুমি কি চাইলাইয়ের সঙ্গে সুখী?
–ভীষণ সুখী, কিন্তু
এই প্রশ্ন দুটো ইয়োহানই মনে মনে নিজেকে করে, উত্তরও নিজেকে সে দেয়।
চাইলাইয়ের দেশের বাড়িতে প্রতিমাসে পাঁচ হাজার ক্রোনোর পাঠাতে হয়। ইয়োহানের মাসের বেতন পঞ্চাশ হাজার। আগে একা থাকাকালীন তার যা খরচ হতো, এখন তার চেয়ে কম হয় খরচ। আগে রেস্তোরাঁয় বেশি খেতো, বারে যেত ঘন ঘন। এখন ঘরেই সে ওয়াইন খায়, ঘরেই খাবার খায়। খরচ যা বাঁচে তা পাঁচ হাজারের চেয়েও ঢের বেশি। নিজের শ্বশুর শাশুড়িকে পাঠাচ্ছে টাকা, এ না ভেবে ইয়োহান ভেবে নেয় গরিব দেশে সে ডোনেশান দিচ্ছে। কত লোকই তো দান করে, সে কেন দান করবে না!
ইয়োহান নিজেকে প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছে সে কেন চাইলাইয়ের সঙ্গে সন্তান চায় না। সে কি মিকেলের উপদেশের কারণে নাকি অন্য কোনও কারণে! ভেবে সে যে কারণটি খুঁজে পেয়েছে, তা হলো, সে চায় না একটা নাক বোঁচা ফর্সা থাই বাচ্চাকে নিয়ে চাইলাই ব্যস্ত হয়ে পরুক। ইয়োহান চায় চাইলাই ইয়োহানকে নিয়ে দিনভর রাতভর ব্যস্ত থাকুক। ইয়োহানকে ঘন ঘন সেক্সুয়াল প্লেজার দিক, ইয়োহানকে চমৎকার মাসাজ দিক, বাড়িঘর ঝকঝকে রাখুক, জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখুক, ঘর সংসার যত্নে রাখুক, বাড়ির বাগান ফুল ফলে ভরিয়ে রাখুক, কাপড় চোপড় কেচে ইস্ত্রি করে আলমারিতে সাজিয়ে রাখুক, সুস্বাদু সব খাবার রান্না করে রাখুক। তার মনোযোগ যেন ইয়োহান থেকে এক চুলও কোথাও না সরে।
২
চারটে বছর চলে যায়। ইয়োহানও সুইডিশ স্বামীদের আড্ডায় এখন প্রাণ খুলে হাসে। পরিপূর্ণ পরিতৃপ্ত পুরুষ সে। এই আড্ডায় সুইডিশ মেয়েদের প্রতি অভিযোগ ঘৃণা বিতৃষ্ণা অন্যদের মতো সেও ছুঁড়ে দেয়।
এমন সুখে টইটম্বুর ঝলমলে জীবনে একদিন এক থোকা কালো মেঘ নিয়ে আসে চাইলাই। ইয়োহানকে বলে– আমি পারলারে চাকরি করবো।
–মানে?
–পারলারে চাকরি করবো। পারলারের কাজ আমার জানা আছে। চিস্তাতেই পারলার। বাজার করতে গিয়ে পারলারের মেয়েদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। ওরা বললো কাজে নেবে আমাকে।
ইয়োহান তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। — এসব বাজে কথা বন্ধ করো।
চাইলাই তার স্বভাব সুলভ নরম স্বরে বলে –আমি কাজ করলে সংসারে টাকাপয়সা আসবে। দেশে পাঁচ হাজার করে ক্রোনোর আমিই পাঠাতে পারবো। তোমার বোঝা কমবে।
–কে বলেছে আমি বোঝা কমাতে চাই? আমার টাকায় তোমার হচ্ছে না? ঠিক করে বলোতো।
–আমি তো বলিনি হচ্ছে না! এত টাকা কি আমি এ জন্মে দেখেছি! এত সুখে কি আমি কোনওদিন ছিলাম! তুমি ভুল বুঝো না। প্রচুর টাকা চাই বলে আমি কাজ করতে চাইছি না, আমি কাজ করতে চাই বলে কাজ করতে চাইছি।
–শখের কাজ করতে গিয়ে ঘর সংসারের বারোটা বাজাবে, বুঝেছি।
চাইলাই আকর্ণ বিস্তৃত হাসি হেসে বলে– একটুও বাজাবো না। তুমি দেখে নিও।
–তোমাকে এসব বুদ্ধি কে দিচ্ছে শুনি। কুলাপ দিচ্ছে?
–কুলাপ দিচ্ছে না। কেউ দিচ্ছে না। বুদ্ধিটা আমার। ট্রাস্ট মী।
চাইলাই পারলারে কাজ করে, ঘর সংসারের কাজও আগের মতোই নিখুঁত করে। রাতে রাতে সেক্সও নিখুঁত।
এর মধ্যেই একদিন রোববারে স্যুটকেস গুছিয়ে চাইলাই তৈরী। যাবে সে। বাড়ির দরজার চাবিটা ইয়োহানের হাতে দিয়ে বললো — ভালো থেকো ইয়োহান, নিজের যত্ন নিও।
বলেই ডুকরে কেঁদে উঠলো।
–কেন, কী ব্যাপার, কোথায় যাচ্ছো?
ইয়োহান বুঝে পেলো না, এ কি কোনও নাটক করছে চাইলাই। পারলারে কাজ করার অনুমতি দিয়েছে সে। কিন্তু উদ্ভট কোনও নাটকের অনুমতি তো সে দেয়নি!
চাইলাই চোখের জল ফেলতে ফেলতে যা বলে তা হলো পারলারে তার পরিচয় হয়েছে সুয়েন নামে এক সুইডিশ লোকের সঙ্গে। লোকটি তাকে বিয়ে করতে চায়।
—তুমি বলোনি তুমি বিবাহিতা?
–বলেছি। কিন্তু সে বলে তোমাকে ডিভোর্স দিতে।
–চাইলাই, তুমি আমাকে ডিভোর্স দিতে চাইছো?
বিস্ময়ে ইয়োহান এমনই নড়ে ওঠে যে হাত থেকে টিভির রিমোট পড়ে যায়।
চাইলাই আবারও হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো–হ্যাঁ। সুয়েন তার কাছে আমাকে চলে যেতে বললো, বললো ডিভোর্সের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
ইয়োহানের ইচ্ছে হয় কষে মেয়েটির গালে দুটো চড় কষাতে। কোমরে লাথি লাগাতেও ইচ্ছে করে। কিন্তু নিজের ইচ্ছেকে সে নিয়ন্ত্রণ করে। বোঝে মেয়েটির পাখা গজিয়েছে।
দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করে– সুয়েনের কাছে কী পাবে যা আমার কাছে পাচ্ছো না?
চাইলাই চোখের জল মুছে বললো — ও আমাকে বাচ্চা দেবে।
–ও আই সি। বাচ্চার জন্য তুমি সুয়েনের কাছে যাবে? চলো বাচ্চা আমি তোমাকে দেব।
চাইলাই এবার মাথা নাড়ে সে ইয়োহানের বাচ্চা নেবে না, সে সুয়েনের বাচ্চা নেবে।
–সুয়েনকে তুমি ভালোবাসো?
সজোরে মাথা নেড়ে চাইলাই বললো– হ্যাঁ
ধপাস করে ইয়োহান সোফায় শুয়ে পড়লো। সুয়েন রাস্তায় গাড়িতে অপেক্ষা করছিল। চাইলাই বেরিয়ে গেল।
দরজা বাইরে থেকে অল্প একটু টেনে যায় চাইলাই। ইয়োহান উঠে সেই আধখোলা দরজাটি লাথি মেরে বন্ধ করে বলে ওঠে, বিচ।
জন্ম: ২৫ আগস্ট, ১৯৬২ বাংলাদেশের একজন সাহিত্যিক ও চিকিৎসক। বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে একজন উদীয়মান কবি হিসেবে সাহিত্যজগতে প্রবেশ করে তসলিমা এই শতকের শেষের দিকে নারীবাদী ও ধর্মীয় সমালোচনামূলক রচনার কারণে আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেন।