| 1 ডিসেম্বর 2024
Categories
শারদ অর্ঘ্য ২০২৩

শারদ অর্ঘ্য গল্প: প্রথম প্রেয়সী । সংঘমিত্রা  রায়

আনুমানিক পঠনকাল: 15 মিনিট

  এক.  

    “ঋতজার আজ কালরাত্রি সন্ধ্যেবেলা  ছাদে কি করে যাবে  তিন্নি !” 

    “ কেন ছাদে গেলে কি হবে দিদিভাই শুধু ওর  তাতাইয়ের মুখ দেখা বারন  আর তো কিছু বারন নয় । তাতাই এমনিতেই  ওখানে যাবে না  আমরা সবাই মিলে  আড্ডা দেব তাতে ঋতজা থাকবে না কি করে হয় !”

    “ তিন্নি আমার ভাবতেই ভালো লাগছে  কতদিন পর সবাই মিলে জমিয়ে আড্ডা দেব ,মজা করব  ! ” 

     “ঠিক বলেছিস দিয়া  প্রায় দশ বছর হল আমরা সব ভাইবোনেরা এক জায়গায় হলাম নেহাত তাতাইয়ের বিয়ে হচ্ছে  তাই । সবাই কোথায় কোথায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দেখা হওয়া বড় কঠিন শুধু ফোনে কথা হয় এই যা ! এবার ছোটমামা যদি  সবাইকে না বলত তাতাইয়ের বিয়েতে  যারা আসবে না তার সঙ্গে তিনি সম্পর্ক রাখবেন না তাই সবাই এল ।”

  “ এই বাড়ীতে এসে পুরানো কথা মনে পড়ে যাচ্ছে জুঁই  । আমরা ভাইবোনেরা মিলে সারা ছুটে বেড়াতাম আর  ঠাম্মী শুধু বলত ওরে তোরা একটু থাম পড়ে হাত পা ভাঙ্গবি !”

  “ যা বলেছিস সত্যি কত তাড়াতাড়ি সময় চলে যায় । এখন দিদুন ,দাদু কেউ নেই ; এই তো সেদিন তাতাইয়ের জন্ম হল আমরা ওকে কত কোলে নিলাম আর এখন  তাতাইয়ের বিয়ে হচ্ছে তাও প্রেম করে ! অবশ্য এ বাড়ীতে অনেকেই প্রেম করে বিয়ে করেছে । শুধু আমারই আরেঞ্জ ম্যারেজ তাই  ভ্যাবলাচরণের গলায় মালা দিতে হল । কেন যে প্রেমটা করলাম না বুঝতেই পারি না দেখতে তো কম সুন্দরী ছিলাম না কত ছেলে আমার পিছনে ঘুরেছে তবুও যে কেন প্রেম করতে পারলাম না আজও বুঝে উঠে পারি  না !“

   “  কাকে ভ্যাবলাচরণ বলছিস   জুঁইদি   জিজুর মতো মানুষ হয় না  একেবারে শিবঠাকুর তোর এতো অত্যাচার নীরবে সহ্য করেন । প্রেম করে বিয়ে করলে এমন  কাউকে পেতি বলে আমার মনে হয় না  চল ছাদে যাই দেখ গিয়ে কেমন ব্যবস্থা হয়েছে  ।“ – তিন্নি বলল

    “ চল ।“

    ঋতজার কালরাত্রির দুপুরে সন্ধ্যের  অনুষ্টান নিয়ে আলোচনা করছিল  দিয়া ,তিন্নি ,জুঁই ।   দিয়া , তিন্নি   জুঁইয়ের মামাতো বোন ; দিয়া ,জুঁই সমবয়সী  । তিন্নির জমজ ভাই তাতাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে  সবাই এসেছে।  দিয়া জুঁইয়ের  বড় মামার মেয়ে ওরা এক ভাই এক বোন আর তিন্নি ছোট মামার মেয়ে । ওদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে শুধু তাতাই ওরফে  তুষারের  বিয়ে হচ্ছে তিন্নির ননদ  ঋতজার সঙ্গে । তাতাই, ঋতজা দুজনে একসঙ্গে   পড়ত  তখন থেকেই তাতাই – ঋতজার প্রেম আর  ঋতজার বড় ভাই ঋতমের সঙ্গে দেড়বছর আগে প্রেম করে বিয়ে হয় তিন্নির ।

     আলিপুরের লাহা বাড়ি জুঁইয়ের মামার বাড়ি । জুঁইয়ের ভালো নাম জগন্ময়ী গাঙ্গুলি । লাহা  বাড়ীটা তিনতলা  বেশ পুরানো আর   বড় । একসময়  এই বাড়ীতে অনেক লোকজন থাকত  জুঁইয়ের দাদু ,উনার ভাইদের পরিবার ।  লাহা বাড়ীর ছেলে মেয়েরা সব সময়ই পড়াশোনায় উন্নত , তাদের বিভিন্ন ধরনের প্রতিভা আছে । পড়াশোনার পাশাপাশি কেউ ভালো  গান করে  , কেউ ছবি আঁকে ,কেউ লেখালেখি করে ,কেউ নাচে ।  বাড়ীর অভিভাবকরা ওদের এগিয়ে দিয়েছেন  তাই লাহা বাড়ীর ছেলেমেয়েরা সবাই এখন প্রতিষ্ঠিত । দেশে বিদেশের নানা জায়গায়  ছড়িয়ে রয়েছেন তারা ।

   লাহা বাড়ীতে এখন থাকেন জুঁইয়ের ছোটমামা  তপন কুমার  লাহা । তিনি কলেজের প্রফেসার ছিলেন মেদিনীপুর কলেজে । উনার স্ত্রী তপতী আলীপুরের হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন তাই  তিনি ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাড়ীতেই থাকতেন । তপনবাবুর বাবা ,মা ওখানেই থাকতেন তিনি  ছুটিতে  বাড়ি আসতেন । এখন তপনবাবু , তপতীদেবী দুজনেই রিটায়ার। তাতাই ইঞ্জিনিয়ার , ঋতজাও ইঞ্জিনিয়ার দুজনে এক অফিসেই চাকরি করে । ঋতম ডাক্তার তিন্নি চাকরী করে না  সে এম এ পাশ  তার একটা নাচের স্কুল আছে সেখানে অনেক ছাত্র , সারা বছরই ওদের নানা জায়গায় অনুষ্টান থাকে । তিন্নির শ্বশুর বাড়ি কলকাতায় ।

   দিয়ার ভালো নাম দীপমালা তার  বাবা  তাপস  কুমার লাহা পুলিশ অফিসার ছিলেন তিনি কলকাতায় বাড়ি করেছন । তার ভাই   তমোজিৎ পুলিশে চাকরি করে বিয়ে করেছে তার  কলিগ সোমজা  লাহিড়ীকে   । দিয়ার বর  প্রনবেন্দু    ইঞ্জিনিয়ার ওরা আমেরিকায় থাকে দিয়া খুব ভালো গান করে । জুঁইয়ের মা জবা লাহা  স্কুল টিচার তার বাবা মনোময় গাঙ্গুলিও স্কুল টিচার । জবা দেবী আর মনোময় বাবু একই স্কুলে চাকরি করতেন ভালোবেসে বিয়ে করেছেন । তাদের বাড়ি বর্ধমানে জুঁইয়ের ভাই মানব সাইন্টিস্ট সে জার্মানিতে থাকে বিয়ে করেছে এক গুজরাটি মেয়েকে সেও সাইন্টিস্ট । আর জুঁই এম ,এস ,সি পাশ খুব ভালো গান করে সুন্দরী চটপটে মেয়ে কত ছেলেই তার পিছনে ঘুরেছে কিন্তু তবুও তার প্রেম করা হল না ।শেষে সম্মন্ধ  করে বিয়ে হয় সব্যসাচী সেনের সাথে । সব্যসাচী দিল্লি  ইউনিভার্সিটিতে সাইকোলজির প্রফেসার । বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে  আগে ওদের বাড়ি  কলকাতায় ছিল এখন তারা দিল্লীতেই থাকেন ।  সব্যসাচী শান্ত শিষ্ট ,নম্র স্বভাবের ছেলে ,খুব কম কথা বলে আর বই পড়তে খুব ভালোবাসে । তাছাড়া সে মাঝে মাঝে ছোট গল্প লিখে বাংলা, ইংরেজি দুই ভাষাতেই । অনেক প্রথম সারির কাগজে তার লেখা ছাপা হয় । চটপটে স্বভাবের জুঁই  সব্যসাচীর এত কম কথা বলা পছন্দ করে না  তাই  সব্যসাচীকে সে ভ্যাবলাচরণ বলেই ডাকে।  জুঁই এখন দিল্লির একটা প্রাইভেট  কলেজে পড়ায় ওদের একটা চার বছরের ছেলে  আছে ।

   তাতাইয়ের কালরাত্রির সন্ধ্যায়  তিন্নি ,তাতাই   ওদের ভাইবোন সবাইকে নিয়ে একটা ছোট  অনুষ্টানের  আয়োজন করেছে ছাদে । সারা বাড়ীতে একটুও জায়গা নেই কারন লাহা বাড়ীর সব অনুষ্টানের আয়োজন বাড়িতেই হয় জায়গা প্রচুর আছে । খাবারের প্যান্ডেল , রিসিপশন, লোকজন বসার জায়গা সব নীচেই হয়েছে ।  প্রতিটা ঘর জুড়ে রয়েছেন আত্মীয় স্বজনরা  তাতাইয়ের  বিয়েতে কেউ বাদ পড়েনি দূর দুরান্ত থেকে আত্মীয় স্বজনরা এসেছেন ।  বয়স্করা নিজেদের মতো করে গল্পের আসর জমিয়েছেন , মাঝবয়সীরা তাদের মতো করে  বাচ্চাদের খেলার জন্যও একটা জায়গা বরাদ্দ আছে ওখানে তাদের দেখাশোনার জন্য লোকও র‍য়েছে । তারা ওখানে নিজেদের মতো করে আনন্দ করছে ।

   ছাদে প্রচুর ফুল গাছ তা বাড়ি শুরু থেকেই কিছু না কিছু ছিল । কিন্তু তপন বাবু রিটায়ারমেন্টের  পর ফল ফুলে সুন্দর করে সাজিয়েছেন ছাদের উপর । বাগান করার তার বরাবরই শখ ছিল এখন সারাদিনই গাছগুলো নিয়ে পড়ে থাকেন ।   

     তিন্নি ,তাতাই  কাজের লোকের সহযোগিতায়  ছাদের  গাছগুলোকে একটু সরিয়ে মাঝখানে বড় জায়গা বের করে ফেলেছে এসব ব্যবস্থা আগেই করে রাখা হয়েছে  । ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিক  চারপাশ শুকনো , ঠাণ্ডাও অনেকটা  কমে গেছে । খোলা আকাশের নীচে আসর  বসানো হয়েছে ।  নরম গদি ফেলে তার উপর দামী মখমলের চাদর বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে , কয়েকটা বড় বড় কোলবালিশ রাখা  হয়েছে । সবাইকে নরম  গদিতেই গোল হয়ে  বসতে হবে চেয়ারে বসার কোন ব্যবস্থা নেই । সন্ধ্যার পর আসর তাই চারপাশে ঝলমলে আলোর ব্যবস্থা রয়েছে । সবার জন্য কফি ,চা , নোনতা  , মিষ্টির ব্যবস্থা করা হয়েছে ।  আসরের মাঝখানটা খালি রয়েছে  ওখানে সবাইকে কিছু না কিছু পারফর্ম করতে হবে । তিন্নি ,তাতাই দুজনে মিলে এরকম স্পেশাল আয়োজন করেছে লাহা বাড়ীর মেয়ে ,জামাই ,ছেলে ,বৌমাদের জন্য । 

 

দুই.

   যাইহোক সবাই আসরে চলে এসেছে শুধু তাতাই আসেনি তার কালরাত্রি সে পাশের বাড়ীতে আছে । যদি আসে তাহলে বাড়ীর বড়রা দেখলেই রেগে যাবে । তাই সে অনুষ্টানের  ভিডিও দেখে নেবে সেটাই ঠিক হয়েছে । পুরো  অনুষ্টান  ভিডিও করার ব্যবস্থা করা হয়েছে ।   চারপাশে গোল হয়ে বসেছে ঋতজা , দিয়া ,ঋতম , প্রনবেন্দু  , জুঁই, সব্যসাচী , তমোজিৎ ,  সোমজা , মানব ,মানবের  স্ত্রী  সোনাল আরও  ওদের মামাতো ভাই,বোন , ভাই ,ভাইয়ের  বৌরা এসে বসেছে । পুরো অনুষ্টান সঞ্চালনা   করছে  তিন্নি।

    সবাই খুব সুন্দর করে সেজেছে । মেয়েরা সবাই চওড়া পাড়ের তাঁতের শাড়ি সঙ্গে ম্যাচিং গয়না , কারো চুলে গোলাপ কারো চুলে রজনীগন্ধা   লাগানো , সোনালও  বাকীদের মতো সেজেছে  । ছেলেরা  সবাই পাঞ্জাবী ধুতি  পড়েছে ।  

   তিন্নি বরাবরই সুন্দরী চওড়া পাড়ের হ্লুদ তাঁতের শাড়ীতে দারুন লাগছিল ওকে । ঋতম  বারবার ওর দিকে তাকাচ্ছিল তা দেখে জুঁই বলল, ” বাবা ঋতম এমনভাবে বউয়ের দিকে তাকাচ্ছ মনে হচ্ছে ওকে প্রথমবার দেখছ !”

   “বউ কি কক্ষনো পুরানো  হয় জুঁইদি !  প্রতি মুহূর্তে তাকে নূতন করে আবিষ্কার করতে হয়। এই যেমন তিন্নিকে বিয়ের পর একবারও ওকে শাড়ি পড়তে দেখিনি সবসময় জিন্স ,টপ ,চুড়িদার  এসব পড়েই থাকে। তাতাইয়ের বিয়েতেও লেহেঙ্গা পড়েছে আমাদের রিসিপসনেও তাই ! কিন্তু আজ চওড়া পাড়ের তাতের শাড়ি,হাল্কা পাটের গয়না , খোলা চুলে রজনীগন্ধা   ফুলের মালা , কপালে বড় টিপ ,সিঁথিতে সিঁদুর , কড়া রঙের  লিপস্টিক   আমার ওকে দেখে মনে হচ্ছে কবিতা লিখতে। বউকে নিয়ে   বেড়াতে যাব সমুদ্র, পাহাড় বা কোন নির্জন জায়গায় ! “

  “ ও নাটক দেখে আর পাড়া যায় না । সারাদিন উনি ডাক্তারি নিয়ে থাকেন বউয়ের দিকে তাকানোর সময় নেই। ঋতজা  সবই জানে ওর দাদার স্বভাব হঠাৎ  করে রোম্যান্টিক হয়ে গেলেন উনি !  দেখব কি পারফ্রমেন্স  করে ডাক্তারবাবু ।”

  “ আমার ভাই  অলরাউন্ডার  তিন্নি দেখিস যা করতে হবে ভালোই করবে। “ –  ঋতজা বলল । ঋতজা কোন পারফরমেন্স করবে না সে শুধু দর্শক এখানে ।   

  “ আরে এভাবে বলিস না তিন্নি ঋতম তো ভালোবেসে তোকে কি সুন্দর সুন্দর রোম্যান্টিক কথা বলছে আমার ভ্যাবলাচরণকে দেখ  এতো সুন্দর করে সাজলাম একবার তাকাচ্ছেও না । আমরা এতজন বসে ও চুপচাপ বসে বসে ফোন টিপছে !” – জুঁই বলল ।

  “   শুধু সব্যসাচী নয় জুঁই  প্রনবেন্দুও  ফোন  টিপছে  । শুধু মানব সোনালের  দিকে বারবার তাকাচ্ছে। আর  তমোজিৎ  তো বউকে নিয়ে এখানে বসেও সেলফি তুলতে ব্যস্ত ।“ – দিয়া বলল।

   “ কি করব বল গুজরাটি মেয়ে বাঙালি সাজে সেজেছে প্রথমবার তাই বারবার ওকে দেখছিলাম।“ – মানব বলল ।

  “ পুলিশে চাকরি করি বউয়ের সঙ্গে সময় কাটাতে পারি না তাই একটু   সেলফি  তুলছিলাম ।“ – তমোজিৎ বলল ।

  “ হয়েছে অনেক কথা ছবি ভিডিও সবই হচ্ছে পরে দেখতে পারবি । এবার  অনুষ্টানে আসি এই কাঁচের বাক্সে অনেকগুলো চিপ লেখা আছে । একেকজন একেকটা তুলবে যার ভাগে যা আসবে তাকে তাই করতে হবে প্রথমে  সোনাল বউদি তুলুক ।”

  “ বেশ আমি তুলছি কিন্তু তার আগে তোমার একটা নাচ দেখব আমি কোনদিন তোমার নাচ দেখিনি  ।“ – সোনাল  খুব ভালো বাংলা বলতে শিখে গেছে আর কিছু কিছু পড়তে পারে  মানব ওকে শিখিয়ে দিয়েছে ।

  “ হু আগে তোমার নাচ দেখি  শ্যালিকা !” – প্রনবেন্দু বলল ।

   তিন্নি “বধূ কোন আলো লাগল চোখে “ নাচল  । সবাই ওর নাচ দেখে মুগ্ধ হয়ে হাততালি দিল ।

   সোনাল চিপ তুলল ওর চিপে লেখা আছে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে হবে । সবাই ভাবল সোনাল কি করে রবীন্দ্র সংগীত গাইবে !  কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে গুজরাটি মেয়ে “ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে”  গেয়ে দিল । সোনালের গলা খারাপ নয় মানব ওকে দুটো রবীন্দ্র সঙ্গীত  শিখিয়েছিল একটা গেয়ে দিল ।  

  সবাই হাততালি দিল এরপর  সোমজার পালা তার ভাগে পড়ল গরবা করতে হবে । সোনাল হাসল ,”  যাও আমারটা তুমি করে নাও দেখি কেমন পার ! “

   সোমজা  টিভি  দেখে দেখে কিছুটা শিখেছে সেই মতো ক্যাসেট চালিয়ে নাচল মন্দ হয়নি । তারপর প্রনবেন্দুর  তার ভাগে পড়েছে রবীন্দ্র নৃত্য । দিয়া হেসে লুটোপুটি  প্রনবেন্দু  নাচ করবে শুনে ।

   প্রনবেন্দু  বলল ,” পারব না ভাই নাচ করতে আমি বরং একটা রবি ঠাকুরের কবিতা বলি ।“

   “ না না জিজু তা হবে না তোমাকে নাচতেই হবে !”  – তিন্নি বলল ।

  সবাই মিলে বলল নাচতে হবে  নাচতে হবে । বেচারা  প্রনবেন্দু  কি আর করবে সবার অনুরোধে  রবীন্দ্র সঙ্গীতের ক্যাসেট চালিয়ে একটু হাত পা ছুঁড়ল যেন সে  কুস্তি  করছে ।  সবাই হাসতে হাসতে হাততালি দিল ।

   এরপর ঋতম তার ভাগে পড়েছে  কবিতা আবৃত্তি করতে হবে । এটা তার কাছে জল ভাতের  মতো সেই ছোট থেকে সে আবৃত্তি করে আসছে।  ঋতম  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ কেউ কথা রাখেনি’  কবিতাটি সুন্দর করে আবৃত্তি করল ।  যদিও  অনুষ্ঠানে  কিছু লোকদের আসা জন্য কিন্তু এটা তো বিয়েবাড়ি খবর পেয়ে কিছু আত্মীয়রা এসে বসেছে । তারা নিজেরাই চেয়ারের ব্যবস্থা করে নিয়েছে । যাক ওদের অনুষ্ঠান  বেশ জমে উঠেছে তিন্নির মামাতো ভাইয়ের বউ কত্থক  নেচেছে , আরেকজন নেচেছে হিন্দি সিনেমার নাচ।   তবে কেউ পোশাক পরিবর্তন করেনি যা পরা আছে তাই পড়ে তাই পড়ে পারফর্ম করছে ।

   সব্যসাচী চুপচাপ বসে সবকিছু উপভোগ করছিল ,ও  হাততালি দিয়েছে,  হেসেছে এই যা ! এবার তার পালা তিন্নি বলল ,” জিজু এবার তোমার পালা একটা চিপ তুল ।“

   সব্যসাচী হাত বাড়িয়ে একটা চিপ নিল । ওটাতে লেখা আছে প্রথম প্রেয়সী সম্পর্কে কিছু বলতে হবে ।

   “ না না তিন্নি এটা আমি পারব না তুমি আমাকে অন্য কিছু করতে বল।“

   জুঁই বলল ,” ওকে  বদলে দে তিন্নি  যে নিজের বউয়ের সঙ্গে ঠিকমতো প্রেম করতে পারল না  সে নাকি প্রথম প্রেয়সীকে নিয়ে বলবে। জীবনে বই ছাড়া এই ভ্যাবলাচরণ অন্য কোন দিকে তাকিয়েছে কিনা আমার সন্দেহ আছে !”

   “ আহা জুঁই তুমি চুপ কর সব্যসাচী যথেষ্ট  রোম্যান্টিক । কম কথা বলে সেজন্য কি ওর চোখে কেউ প্রথম প্রেয়সী নেই । সব্যসাচী তুমি বল টিন এজে যদি তেমন কিছু থেকে থাকে । তিন্নি এটা ভালো বিষয়  নিয়েছে আমরাও নূতন কিছু শুনি ।“  – প্রনবেন্দু  বলল ।

    সব্যসাচী  জুঁইয়ের  দিকে একবার তাকিয়ে বলল ,” হু আমার টিন এজে একজনকে খুব ভালো লেগেছিল বলতে পার সেই আমার প্রথম প্রেয়সী।“

    “ তাই নাকি তিনি এখন কোথায় তার সঙ্গে তোমার যোগাযোগ আছে জিজু তিনি নিশ্চয়ই অন্য কোথাও বিয়ে করে ঘর সংসার করছেন ।“- তিন্নি বলল ।

   “ তা জানি না তাকে আমি অনেক দিন আগে হারিয়ে ফেলেছি সে আমার জীবনে এসেছিল দমকা হাওয়ার মতো আবার হঠাৎ করে হারিয়ে গেল।“

  “ তোমার যা অবস্থা এত চুপচাপ থাক তাই তাকে ধরে রাখতে পারনি চলে গেছে ।“  – জুঁই বলল ।
   “ হবে হয়ত ! কিন্তু তখন এত চুপচাপ ছিলাম না ।“

  “ আহা জুঁই তুই চুপ করতো ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং লাগছে সব্যসাচী তুমি বল ।“ – দিয়া বলল ।


আরো পড়ুন: শারদ সংখ্যা সাক্ষাৎকার: ইরাবতীর মুখোমুখি কবি চৈতালী চট্টোপাধ্যায়


 তিন.

    “ উচ্চ  মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবার পর আমি দার্জিলিং  এর ঘুম স্টেশনে দাদুর বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম । দাদু মানে মায়ের মামা অমিয়কুমার দত্ত  ওখানে চাকরি করতেন আমার অনেক দিন থেকে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু পড়াশোনার চাপে যেতে পারিনি । উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পর যাওয়ার জন্য জেদ ধরলাম বাবা ,মা দুজনে গিয়ে আমাকে দিয়ে এলেন । যাইহোক তিন মাস পর রেজাল্ট আউট  হবে তাই মাস দুই থাকার অনুমতি পেলাম। আমাকে পেয়ে দাদু দিদা খুব খুশী উনাদের একমাত্র ছেলে দিল্লিতে চাকরি  করত । আমি দাদুকে বললাম ,” দাদু যে কদিন আমি তোমাদের এখানে  আছি তার মধ্যে পুরো দার্জিলিং ঘুরে দেখব । এরপর পড়াশোনা শুরু হয়ে যাবে এত সময় পাব না ঘোরার জন্য !’

  “ বেশ তোমার যখন যেখানে খুশী যেও আমি তোমার সঙ্গে একজন গাইড দিয়ে দেব ।“

  “ কে গাইড ?”

  “ তার নাম লুই নেপালি ছেলে পুরো দার্জিলিং তার নখেদর্পণে তাছাড়া খুব ভালো বাংলা বলতে পারে তোমার কোন অসুবিধা হবে না । শুধু ঠাণ্ডার কাপড় ঠিকমতো পড়ে যেও । “

  “ ঠিক আছে দাদু । “

   লুইয়ের বয়স পচিশ ছাব্বিশ বছর হবে চটপটে ছেলে সুন্দর বাংলা বলতে পারে । প্রথমদিন বলল ,” আজ টাইগার হিল যাব চল নাতিবাবু ।“

   “ বেশ চল ।“

     লুই দাদুকে বড়বাবু আর  দাদুর নাতি হিসেবে আমাকে  নাতিবাবু  বলে ডাকত ।  আমি প্রথমদিন টাইগার হিলে সূর্যোদয়  খুব উপভোগ করলাম ।অবশ্য আমরা দাদুর গাড়ি নিয়ে আগের দিন বিকেলে চলে গিয়েছিলাম । লুই নিজেই গাড়ি চালাতে পারে তাই ঘুরে বেড়াতে অসুবিধা ছিল না । টাইগার হিল থেকে পরদিন বাতালিয়া লুপ ওখানে দুদিন থাকলাম খুব ভালো লাগল ।

  “এসব ঠিক আছে ভাই  প্রথম প্রেয়সীর সঙ্গে কোথায় দেখা হল সেটা বল আমার আর তর সইছে না !”- প্রনবেন্দু  বলল ।

  “ তারিখটা ছিল বারো এপ্রিল ।লুই বলল ,” চল আজ ঘুম মনেস্ট্রি থেকে ঘুরে আসি ।“

  “ঠিক আছে চল। ওখানে যেতে বেলা প্রায় নটা বেজে গেল। বেশ ভিড় দূর দূর থেকে পর্যটকরা এসেছে । লুই ওর পরিচিত একজনকে পেয়ে গল্প জুড়ে দিল । আমি চারপাশটা ঘুরে দেখতে লাগলাম খুব সুন্দর  বৌদ্ধ মন্দির মনটা জুরিয়ে গেল  । দেখলাম একটা মেয়ে  একা একা  কাঠের বেঞ্চে চুপচাপ বসে আছে কাঞ্চনজঙ্ঘার  দিকে তাকিয়ে ছবি আঁকছে  । এত লোকজন কোনদিকে তাকাচ্ছে না ওর পাশে জায়গা খালি আছে  । আমার কেন জানি না মনে হল ওর পাশে  একটু বসি কিন্তু বাঙালি কিনা তা বুঝতে না পেরে বললাম ,” ক্যায়া মে আপকে পাশ বৈঠ শকতা  হু ।“  

   মেয়েটি  মাথা তুলে  তাকাল তার চাউনিতেই  এক ধরনের   মাদকতা ছিল ।  অসাধারণ সুন্দরী আমি প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম  । আমি তখন আঠারো বছরের আর মেয়েটি হয়ত পনেরো ষোল  বছরের কিশোরী  হবে । আগাগোড়া শীতের কাপড়ে মোড়া  শুধু মুখটা দেখা যাচ্ছে । প্যান্ট , সোয়েটার , সু জুতো গলায় মাফলার ,  টুকটুকে ফর্সা গায়ের রং চোখ দুটো নীল ,  নাক , মুখ ,ঠোঁট  এত সুন্দর যেন মনে হচ্ছিল  কোন শিল্পী খুব যত্ন করে ওকে তৈরি করেছে  । শুধু মাথায় চুল একটু কম বয়কাট অনেকটা বিদেশীদের মতো !

   পরিষ্কার বাংলায় বলল ,” বস আমি বাঙালি হিন্দি না বললেও চলবে ।“

  “ বেশ তাহলে তো ভালোই হল আপনি  ছবি আঁকছেন বুঝি , একা এসেছেন নাকি !“

   “ আপনি করে বলার মতো বয়স আমাদের কারোর নয় তুমি বললেই ভালো লাগবে আমার । আমি এখানে একাই আসি একটু শান্তি পাবার জন্য আর যতক্ষণ থাকি বসে বসে ছবি আঁকি  ।“

   “ খুব ভালো  আমিও একাই সঙ্গে একজন গাইড এসেছে ।“

  “ কেন একা চলতে পার না মানুষ সবসময় একাই থাকে যাবার সময় কেউ তাকে ধরে রাখতে পারে না ।“

   কিশোরী হলেও চটপটে , প্রানোচ্ছল  নয় বরং বয়সের তুলনায় একটু বেশী গম্ভীর মনে হল  । গলার স্বরটা একটু ভাঙ্গা ভাঙ্গা । আমি বললাম , ”তোমার নাম কি ? “

  “ আমার নাম  তপোময়ী  তোমার নাম কি ? বাড়ি কোথায় ?”

 “ আমার নাম সব্যসাচী কলকাতায় বাড়ি ।এখানে দাদুর বাড়ি বেড়াতে এসেছি । তোমার  বাড়ি কোথায় ?”

  “ কলকাতার আশেপাশেই আমিও বেড়াতেই এসেছি সময় ফুরালেই চলে যাব !”

   ওর ভারী ভারী কথা আমার ভালো লাগছিল না । এক ভুট্টাওয়ালা এসেছে আমি বললাম ,” ভুট্টা খাবে ? ”

  “ না আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না একটু শান্তির জন্য এখানে আসি আর কিছু নয় ।“

   মেয়েটির হয়ত কোন বড়  অশান্তি ছিল আমি আর কথা বাড়ালাম না। ভুট্টা কিনে নিয়ে এলাম ওকে বারবার অনুরোধ করলাম কিন্তু খেল না । বেশ কিছুক্ষণ ওর সঙ্গে কাটানোর পর লুই এল । বলল ,” সব দেখে নিয়েছ  নাতিবাবু চল এবার যাই ।“

   “ আমি কিছুই দেখিনি আরেকটু  বসতে চেয়েছিলাম কিন্তু তপোময়ী এর মধ্যে উঠে গেল যাবার জন্য তাই আমিও চলে এলাম ।“

   সবাই গম্ভীর হয়ে গেছে সব্যসাচীর প্রথম প্রেয়সীর কথা শুনে । এখন কেউ আর হাসছে না  ওকে থামতে দেখে দিয়া বলল ,” তারপর কি হল ?’

  “ ঘরে ফিরে সারাক্ষণ তপোময়ীর   কথাই ভেবেছি আমি ওর প্রেমে পড়ে যাই । পরদিন লুই আমাকে বলল  অন্য কোথাও যাওয়ার জন্য কিন্তু আমি বললাম আমি ঘুম মনেস্ট্রি তে যাব ওর যাবার দরকার নেই আমি একাই যেতে পারব। “

   পরদিন গিয়ে দেখি তপোময়ী একই জায়গায় বসে আছে ,ছবি আঁকছে। আজ মাথায় টুপি রয়েছে  আমি গিয়ে ওর পাশে বসলাম । ও আমাকে দেখে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলল ,” আমার মতো তোমারও দেখছি এই জায়গাটা খুব প্রিয় হয়ে  গেছে !” ওর একটা গেজ দাঁত ছিল তাতে হাসিটা আরও সুন্দর লাগল ।   

   “ তা বলতে পার তবে তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্য চলে এলাম তুমি কাল বলছিলে না রোজ এখানে আস তাই !”

  “ তুমি আরও আগে এলে না কেন তাহলে তো আর আমাকে একা একা বসে থাকতে হত না সব্যসাচী ।“

  “  আগে তোমার মতো মিষ্টি মেয়ের খোঁজ পাইনি এখন পেলাম রোজ আসব । চল চারপাশটা একটু ঘুরে দেখি ভিতরে গিয়ে প্রার্থনা করি ।“

  “ কি প্রার্থনা করবে ?’

  “ তুমি যাতে খুব ভালো থাক তাই ।“

     তপোময়ী আস্তে আস্তে আমার সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল । আমি ভুট্টা কিনেছি খেয়েছে  পরদিন থেকে বেশ হাসিখুশি । কত গল্প করত আমার সঙ্গে আমি কি পড়ছি ,কি কি করতে ভালোবাসি ,বাড়ীতে কে কে আছে আরও কত কি ,আমিও ওর সম্পর্কে কিছু কিছু জানতে চাইতাম কিন্তু ও কোন কিছু পরিষ্কার করে বলত না কেমন যেন হেঁয়ালি করে উত্তর দিত।  কিছু সময় দুজনে একসঙ্গে কাটানোর পর যার যার গন্তব্য স্থলে চলে যাই আর শুধু ওর কথাই ভাবতে থাকি । টানা পাঁচদিন লুই ,দাদু ,দিদার বলা  সত্ত্বেও আমি তপোময়ীর  জন্য ঘুম মনেস্ট্রিই গেছি । টিন এজের ভালোবাসা মনে হয় এমনটাই হয় ।  ও আমার পাশ ঘেঁষে বসত কথা বলতে বলতেই ছবি আঁকত ।  আমি একদিন ওর  হাতে হাত রেখেছিলাম তখন ও আমাকে বলেছিল  ,” কলকাতায় গিয়ে আমার কথা ভুলে যাবে না সব্যসাচী ?”

  “ একদম না তোমার ঠিকানা দাও আমি তোমার সঙ্গে গিয়ে দেখা করব।“

  “ বেশ যাওয়ার আগে দিয়ে যাব ।“

    ভাবছিলাম কিছুদিন যাক ওকে আমার ভালোবাসার কথা বলব । তপোময়ী  মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে এসেছিল ওর নাকি রবীন্দ্র সঙ্গীত খুব প্রিয় । বললাম ,’ একটা শোনাও না !”

    আমার অনুরোধে  ভাঙ্গা গলাতেই শুনিয়েছিল  ” দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না সে যে আমার নানা রঙের দিনগুলি !”  – এই দুই লাইন।

   ওকে সেদিন বলেছিলাম ,” তুমি খুব সুন্দর ছবি আঁক আমার একটা ছবি এঁকে দেবে ।“

  “ অবশ্যই দেব আমরা দুজনের একসঙ্গে ।“

  “ ও ছবি এঁকেছিল , তাকে তোমার ভালোবাসার কথা বলতে পেরেছিলে?” –  মানব  বলল ।

  “ না বলতে পারিনি । ছয় নম্বর দিন থেকে আর তাকে দেখতে পাইনি যে জায়গায় বসত ওখানে একটা অর্ধসমাপ্ত ছবি পড়ে আছে । একটা হাল্কা স্কেচ আঁকা একটা বেঞ্চে একটা ছেলে মেয়ে পাশাপাশি বসে আছে একদিকে পাহাড় অন্যদিকে মন্দিরের মতো ব্যস এইটুকুই । আমি ওটা নিলাম ওটা এখনও আমার কাছে আছে । ও প্রতিদিন আমি যাবার আগেই আসত ।  আমি পরপর দুদিন যাওয়ার পর ওকে না পেয়ে ভুট্টা ওয়ালার কাছে জানতে চাইলাম সে বাংলা জানত । বললাম  ,” এখানে  যে মেয়েটি বসত সে আর আসে না ।“

    “ এসেছিল  হঠাৎ  অসুস্থ হয়ে পড়ায় ওকে কলকাতা নিয়ে যাওয়া হয়।“ আর কিছু বলেনি ।  আমি ঘরে এসে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম কলকাতা ফেরার জন্য দাদু দিদা বার বার বলা সত্ত্বেও আর ওখানে থাকিনি , কাউকে কিছু বলিনি  । শেষে লুই আমাকে নিয়ে আসে তপোময়ীকে অনেক খুঁজেছি কিন্তু ওর কোন ঠিকানা না থাকায় ওকে আর কোনদিন খুঁজে পাইনি !”

   সবাই গম্ভীর হয়ে সব্যসাচীর প্রথম প্রেয়সীর কথা শুনল । প্রনবেন্দু  বলল ,” বিয়োগান্তক স্টোরি  ভাই অবশ্য টিন এজের ভালোবাসা অনেকটা এমনই হয় যার সুর , তাল এভাবেই হারিয়ে যায় ।“

    ছয়ত্রিশ বছরের  সব্যসাচীর  প্রথম প্রেয়সীর কথা শুনার পর  অনুষ্টান  আর বেশী এগোল না  সবাই যেন কেমন চুপ হয়ে গেলেন ।  এরপর আর দু একটা পারফরমেন্সের  পর ওদের  অনুষ্টান  শেষ হয়ে গেল ।  জুঁই টিন এজের ভালোবাসা  নিয়ে কিছু বলল না সব্যসাচীকে । তাকেও তো কত ছেলে প্রপোজ করেছে তাই এসব নিয়ে মিছিমিছি কথা বাড়িয়ে লাভ কি !

চার.

   পরদিন  বউভাত  সকাল থেকেই সাজগোজ হৈ চৈ ,হাসি তামাশা চলছে। সব্যসাচীরা রাতে  নীচতলার একটা ঘরে শুয়েছিল , সব্যসাচী  ভুল করে ওখানে তার ফোনটা ফেলে আসে ।  ফোন খুঁজতে গিয়ে দেখে  ওদের শোবার ঘরের পাশে একটা ঘরে তপনবাবু , তপতীদেবী  দুজনে ঢুকছেন হাতে ধুপকাটি  নিয়ে । সব্যসাচী অনিচ্ছাস্বত্ত্বেও  একবার ঘরে উঁকি মারল দেখল উনারা কারো ছবিতে মালা দিচ্ছেন ,ধুপকাটি  জ্বালিয়ে দিচ্ছেন। সব্যসাচী এগিয়ে গিয়ে যার ছবি দেখল তার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল !  এতো তপোময়ীর ছবি এ এখানে কি করে এল ! তার মানে তপোময়ী  আর বেচে নেই ! ছবিটার নিচে লেখা তপোময়ী লাহা !  

   তাকে দেখে তপনবাবু বললেন  ,” এসো সব্যসাচী এ হচ্ছে আমার বড় মেয়ে তপা । অনেকদিন আগে আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে । আজ তার জন্মদিন ছাব্বিশ ফেব্রুয়ারি  মৃত্যুবার্ষিকী  তেইশ এপ্রিল ! “

  সব্যসাচী  নিজেকে সামলে নিয়ে বলল ,” কি হয়েছিল তার ?”

  “ ব্লাড ক্যান্সার । খুব ভালো মেয়ে ছিল আমার যেমন পড়াশোনায় তেমনি  সুন্দর ছবি আঁকত ,গান করত। কিন্তু ক্লাস টেনে   উঠার পর ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ে অনেক চেষ্টা করেও আমরা ওকে বাঁচাতে পারিনি।“

    এরমধ্যে তিন্নি আর তাতাই এসে গেছে । তপতীদেবী  বললেন ,” এত ব্যস্ততার মধ্যে  তোদের  আর ডাকিনি  !  “

  “ যত ব্যস্ত থাকি না কেন দিদিয়ার জন্মদিন কি ভুলতে পারি । জিজু এই আমাদের দিদিয়া যে আজ আমাদের মধ্যে নেই ।“ – তাতাই বলল ।

    সব্যসাচীর  আর বুঝতে বাকি রইল না তার প্রথম প্রেয়সীকে কেন সে খুঁজে পায়নি । সে অনেকদিন আগে না ফেরার দেশে চলে গেছে অসুস্থ ছিল তাই এত হেঁয়ালি করে কথা বলত  তপোময়ী । জুঁইয়ের মুখে সে অনেকবার তপার কথা  শুনেছে । তপা তপন বাবুর বড় মেয়ে ছিল দেখতে খুব সুন্দরী ,পড়াশোনায় ভালো তেমনি ভালো গান করত ,ছবি আঁকত । তপার দশবছর বয়সের সময় জমজ সন্তানের জন্ম দেন তপতী দেবী  ।  তিন্নির ভালোনাম তন্ময়ী কিন্তু তপার ভালোনাম  তপোময়ী জুঁই তা বলেনি । জুঁই প্রায়ই বলে ,”  তপা বড় অসময়ে চলে গেল । ভাগ্যিস তিন্নি , তাতাইয়ের জন্ম হয়েছিল এতদিন পর না হলে ছোটমামাকে এখন নিঃসন্তান থাকতে হত ! জানো  তপা  খুব ভালো ছিল ওর মনটা খুব নরম ছিল কারো কষ্ট সহ্য করতে পারত না । স্কুলে টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে  ভিখারিদের খেতে দিত !”

   সব্যসাচী চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে । তপতী দেবী বলতে থাকেন,” জানো সব্যসাচী  তপার  খুব ইচ্ছে ছিল দার্জিলিং বেড়াতে যাবে । যখন   জানতে পারল তার লাস্ট ষ্টেজ আর কদিন মাত্র বাঁচবে ওর বাবাকে বলল  ওর শেষ ইচ্ছে একবার ঘুম মনেস্ট্রি গিয়ে কিছু সময় কাটাবে ।  আমি যেতে পারিনি দুটো যমজ বাচ্চা নিয়ে ওর বাবা গিয়েছিলেন ওখানে আমার দাদার বাড়ি থাকায় ওরা ওখানেই উঠলেন । তপার মাথার চুল খুব সুন্দর ছিল কিন্তু ক্যামো দিতে দিতে সব চুল পড়ে যায় পরে  সামান্য চুল উঠেছিল ।অসুস্থতা নিয়ে পরীক্ষা দিয়েও  মাধ্যমিকে  দুটো  লেটার পেয়েছিল কিন্তু তপা তা জানতেও পারল না ।“

 “ তারপর ?”

  “ আমি ওকে নিয়ে ঘুম মনেস্ট্রি যাই কিন্তু তপা বলল ও একা থাকতে চায় ওখানে কিছুক্ষণ তাই আমি ওকে দিয়ে এসে নিচে কোথাও বসে থাকতাম । কিছুক্ষণ  পর তপা  নিজেই চলে আসত । আমরা দশ দিনের জন্য গেছিলাম কিন্তু সাত নম্বর দিনে তপা বলল ,” বাবা আজ আমাকে উপরে দিয়ে তুমি একটু ওখানে থাকবে আমার শরীরটা কেমন লাগছে !”

 “ আমি ওকে দিয়ে  ঘুরে দেখছিলাম । ও ছবি আঁকতে আঁকতে হঠাৎ অঞ্জান হয়ে যায় ভুট্টাওয়ালা এসে আমাকে খবর দেয় আমি কয়েকজনের সাহায্যে  ওকে গাড়ীতে এনে তুলি ভুট্টাওয়ালা ওর ছবি আঁকার ব্যাগটা  এনে দিয়েছিল । তপাকে  হাসপাতালে আনার পর আর চোখ খুলেনি । অজ্ঞান অবস্থায় কয়েকদিন থাকার পর তেইশ এপ্রিল তপা পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে যায় । আজ তপা  থাকলে ওর বিয়ে হত ভাইয়ের বিয়েতে খুব আনন্দ করত ,খুব ভালবাসত তিন্নি ,তাতাইকে।“  – কথাগুলো বলে দুজনে কেঁদে ফেললেন তপনবাবু ।

    তাতাই চলে গেছে  সব্যসাচী চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে তার প্রথম প্রেয়সীকে এভাবে খুঁজে পাবে এটা তার চিন্তার বাইরে ছিল।  তিন্নি   বাবা মায়ের পাশে গিয়ে বলল ,” আর কেঁদো না বাবা দিদিয়া যেখানে আছে আমাদের দেখছে প্রান ভরে আশীর্বাদ করছে। তোমরা এখন যাও সারা বাড়ীতে এত লোকজন ! “

  “ হু যাচ্ছি রে মা ।“ দুজনে চলে গেলেন ।  সব্যসাচী  তখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে   তপোময়ীর ছবির দিকে তাকিয়ে। তিন্নি তার পাশে গিয়ে বলল, ”জিজু আমি বুঝতে পেরেছি দিদিয়াই  ছিল তোমার প্রথম প্রেয়সী  । কি করবে বল দুজনের দুর্ভাগ্য !  সবই ভগবানের ইচ্ছে ! কিন্তু তোমাদের পাঁচদিনের ভালোবাসার কথা শুনে মনে হয় ওটা ছিল জন্ম জন্মান্তরের ভালোবাসা শুধু দিদিয়া তা জানল না ।“

 “ আমিও তাই বিশ্বাস করি  তিন্নি !”

    তাতাইয়ের বউভাতে  সবাই খুব আনন্দ করছে কিন্তু সব্যসাচীকে কি বিষণ্ণতায় পেয়েছে সে প্রান খুলে আনন্দ করতে পারছে না তা শুধু তিন্নিই জানে ! তিন্নিও কথাটা কাউকে বলতে পারছে না পাছে তার মৃত দিদিয়াকে নিয়ে সব্যসাচী জুঁইয়ের সম্পর্ক না  নষ্ট হয়ে  যায় !

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত