ইরাবতী ধারাবাহিক:ফুটবল (পর্ব-৯) । দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়
অষ্টম শ্রেণির দুই বন্ধু রাজ আর নির্ঝর। রাজ আর অনাথ নির্ঝরের সাথে এইগল্প এগিয়েছে ফুটবলকে কেন্দ্র করে। রাজের স্নেহময়ী মা ক্রীড়াবিদ ইরার অদম্য চেষ্টার পরও অনাদরে বড় হতে থাকা নির্ঝর বারবার ফুটবল থেকে ছিটকে যায় আবার ফিরে আসে কিন্তু নির্ঝরের সেই ফুটবল থেকে ছিটকে যাবার পেছনে কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নির্ঝরের জেঠু বঙ্কু। কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় বঙ্কু ও তার ফুটবলার বন্ধু তীর্থঙ্করের বন্ধুবিচ্ছেদ। কিন্তু কেন? সবশেষে নির্ঝর কি ফুটবলে ফিরতে পারবে? রাজ আর নির্ঝর কি একসাথে খেলতে পারবে স্কুল টিমে? এমন অনেক প্রশ্ন ও কিশোর জীবনে বড়দের উদাসীনতা ও মান অভিমানের এক অন্য রকম গল্প নিয়ে বীজমন্ত্রের জনপ্রিয়তার পরে দেবাশিস_গঙ্গোপাধ্যায়ের নতুন কিশোর উপন্যাস ফুটবল আজ থাকছে পর্ব-৯।
শৈবালচন্দ্র সেন টুর্নামেন্ট শুরু হয়ে গেছে।অঞ্চলের মোট আটটা স্কুলের টিম। চারটে দল করে দুটো গ্রুপ। প্রতি টিমকে গ্রুপে প্রথমে তিনটে করে খেলতে হবে। গ্রুপের প্রথম ও দ্বিতীয় টিম পরের রাউন্ডে উঠবে। তখন আর লিগের প্রশ্ন নেই, নকআউট হবে।এরপর দুটি খেলা। সেমিফাইনাল আর ফাইনাল। রাজ হিসেব করে দেখেছে মোট খেলা পাঁচটা।
রাজদের প্রথম খেলা পড়েছিল কানাইচন্দ্র হাই স্কুলের সঙ্গে। শুরু খারাপ হয় নি। তারা জিতেছে দুই-এক গোলে। সে খেলায় নির্ঝর সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। স্যার যদিও রাজকে ও ইমনকেও চান্স দেন নি। সাইডলাইনের ধারে বসে তারা খেলা দেখেছিল। রাজের মনখারাপ হয়েছে ঠিকই, একঈ সঙ্গে সে নির্ঝরের খেলা অবাকচোখে দেখেছে। কি দুর্দান্ত খেলছে ও! কানাইচন্দ্র স্কুলের বড় বড় ছেলেরা ওর কাছে নাস্তানাবুদ হয়ে যাচ্ছে।
পরের খেলা রামলাল স্কুলের সঙ্গে। তা এখনও পাঁচদিন বাকি আছে। স্যার রাজদের বলেছেন,মনখারাপ না করতে। ফুটবল টিমগেম। আবার তিনি দুএকজনকে সুযোগ দিয়ে দেখবেন। শোনার পর রাজের বুক ঢিপঢিপ করেছিল। সে কি টীমে থাকবে? কে জানে? চান্স পেলে সেও ভাল খেলার চেষ্টা করবে।
এ কদিন রোজই প্র্যাকটিশে যাচ্ছে রাজ। স্যার আছেন। এখন মাঝেমাঝে মিলের ধারে আলাপ হওয়া তীর্থঙ্করবাবুও তাদের খেলা দেখতে আসেন। সেদিনই মানুষটা সম্পর্কে তার একটা আগ্রহ তৈরী হয়েছিল। প্র্যাকটিস শেষ হবার পরেই সে স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিল,”স্যার ।ওই মানুষটা কে ছিলেন?
স্যার ভ্রুকুঁচকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,-“ যার সঙ্গে তুই এলি?”
“হ্যাঁ”
“কেন তুই চিনিস না?”
রাজ মাথা নাড়ে। স্যার তার দিকে চেয়ে বলেন,”তাই তো! তুই চিনবি কি করে? তোরবাবা-মা নিশ্চয় চিনবেন।তীর্থঙ্কর সেন মানে তীর্থ-দা ছিলেন এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ফুটবলার।“
রাজ অবাক হয়ে গেছিল। স্যার তার মুখ দেখে মুচকি মুচকি হাসছিলেন।বুঝতে পেরেছিলেন তীর্থবাবুর চেহারা দেখে তার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। স্যার বলেছিলেন,“তীর্থ-দা এই মাঠেই আগাগোড়া খেলতেন। এ মাঠটা কিন্তু একসময় খুব নাম ছিল।বড় বড় প্লেয়াররা সব খেলতে আসত। আমি তোদের মত বয়সে কতদিন খেলা দেখতে এসেছি।“
“কারা আসত স্যার?”
“ সুরজিত সেনগুপ্ত। কৃশানু দে। সুব্রত ভট্টাচার্য, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য কত নামকরা প্লেয়াররা এখানে আসত। এদের নাম শুনেছিস?”
ছোটমামার দৌলতে রাজ পুরান বহু খেলোয়াড়ের নাম জানে। কৃশানু দের কথা বলার সময় এখনো ছোটমামার চোখে জল চলে আসে। ওমন বল প্লেয়ার নাকি ভারতে আর আসে নি। সে বলে, “হ্যাঁ। স্যার। জানি। এরা সবাই খুব নামী প্লেয়ার।“
স্যার খুশি হলেন।রাজের দিকে চেয়ে বললেন,“ বা! তুই বেশ জানিস তো।“
“ওই আর কি!”
স্যার বললেন,“তখন আসলে এ জায়গা রমরমা ছিল। মিল খোলা ছিল। চারদিক থেকে লোক খেলা দেখতে আসত। তীর্থদারও খুব নামডাক ছিল।“
“তারপর?”
“তারপর ঠিক জানি না। তীর্থ-দা খেলা ছেড়ে দিলেন।“
রাজ অবিশ্বাস ভরে তাকিয়েছিল স্যারের দিকে। তীর্থজেঠুর জন্য সে গভীর দু;খ অনুভব করেছিল।
স্যার বলেছিলেন,“তীর্থ-দা খেলা ছাড়লেও মাঠ ছাড়েন নি। এখন এখানে তেমন খেলা হয় না। কিন্তু খেলা থাকলে তীর্থদা আসবেনই।‘
আরো পড়ুন: ধারাবাহিক:ফুটবল (পর্ব-৮) । দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়
তবে স্যার তাদের একটা বিষয়ে সাবধান করেছেন। তীর্থ-জেঠুর সাথে ঠাট্টা ইয়ার্কি না করতে বারণ করেছেন।এটা বলার উদ্দেশ্য রাজ বুঝেছে। তীর্থ-জেঠু মাঝেমাঝেই বিড়বিড় করে বকেন। রাজ দু-একবার কান পেতে শুনেছে তিনি খেলার কথাই বলছেন।অদৃশ্য কোনো প্লেয়ারকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলছেন,“বঙ্কু। হাঁদারাম। বলটা বাড়াতে পারলি না?এতদিন খেললি?তোর সেন্সই নেই। ছ্যা!”
বঙ্কুর পরিচয় জানার খুব ইচ্ছে রাজের হয়েছিল। কিন্তু স্যারের সাবধানবাণী শোনার পর সে জিজ্ঞেস করতে ভয় পেয়েছে। তবে যখনই বিড়বিড় করেন তীর্থ-জেঠু বঙ্কুর কথাই বলেন। মনে হয় বঙ্কু তাঁর বন্ধু ছিলেন। তারা দুজন মিলে খেলতেন!
গ্যালারির একপাশে রাজ সাইকেল রেখে চাবি দিল। তারা যারা খেলায় নাম দিয়েছে তাদের ছয় পিরিয়ডের পর ছুটি। তারপর মাঠ। শনিবার ও রবিবার ,দুদিন একটু বেশি প্র্যাকটিশ।রাজ তবে একটা ব্যাপারে খুশী। সে টীমে চান্স পাক বা না পাক,এখন রোজ নিয়ম করে খেলার সুযোগ পাচ্ছে।
মায়ের খেলার ব্যাপারে না নেই, পড়া ঠিক করে নিলেই তাঁর কাছে সবকিছু পাওয়া যায়। বাবাও এখন দেখেশুনে তার ও নির্ঝরের জন্য জুতো জোড়া কিনে এনেছেন।বাবা একটা কথা আরো বলেছেন, সে যদি পড়াশুনোর পাশাপাশি খেলতে চায় তিনি স্টেশনরোডে একটা ফুটবল ক্লাব আছে সেখানে ভর্তি করে দেবেন।
রাজ খুশীতে ঝলমল করে উঠেছে। সে বলেছে,“হ্যাঁ। বাবা। যাব।তুমি নির্ঝরেরও ব্যবস্থা কর।“
বাবা অস্বস্তির চোখে মায়ের দিকে তাকিয়েছিলেন। রাজ বুঝতে পারছিল নির্ঝরের ব্যাপারটা বাবা পছন্দ করছেন না। গতদিনেও বাবার গলার সুর অন্যরকম ছিল।ইদানিং যেন আর একটু পালটে গেছে। রাজের মনখারাপ হয়ে গেল। বেচারী নির্ঝরের কথা ভেবে। তাকে ভর্তি করার ব্যবস্থা বোধহয় বাবা-মা করবেন না।
ছোটমামা পরে তাকে বলেছিলেন,“তুই তো ভারি অদ্ভুত?”
“কেন?”
“কেন? মানে?তোর সবসময় নির্ঝরের কথা বলার কি দরকার? সে ও বুঝবে।“
রাজ বলে,“ওকে দেখবার কেউ নেই। ছোটমামা।“
ছোটমামা বলেছিলেন“সে আর কি করা যাবে? কতদিন আর দিদি দেখবে বল?”
রাজ বলেছিল ,“কিন্তু সবাই তো আর ওর মত খেলে না?’
“থাম! তোকে আর ওর কথা চিন্তা করতে হবে না। তুই বা ওর চেয়ে কিসে কম?”
“কি যে বল ছোটমামা। নির্ঝর যা খেলছে তার পাশে আমি?“
“নির্ঝর নিশ্চয় ভাল খেলে কিন্তু তুইও কম ভাল খেলিস না।বুঝলি।নিজের কথা ভাব।“
রাজ হেসে বলেছিল,-“ ধুর! তুমি যে কি বল! আমি এখনো চান্সই পেলাম না।“
“পাবি। পাবি।“
ছোটমামা বললেও রাজ গ্রাহ্য করে নি। সে নিজের চেয়েও নির্ঝরের জন্য চিন্তিত। এখনো পর্যন্ত ওর উদাসিনতা দেখে সে অবাক হয়ে যায়। খেলা নিয়ে ওর কোনো তাপউত্তাপ নেই।
দেড় দশক ধরে সাহিত্যচর্চা করছেন। পেশা শিক্ষকতা। নিয়মিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখেন। ‘কাঠবেড়ালি’ নামে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয়তে। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস : ‘চার অঙ্গ’, ‘তিথির মেয়ে’, গল্পগ্রন্থ : ‘গল্প পঁচিশ’, ‘পুরনো ব্রিজ ও অন্যান্য গল্প’। ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘বীজমন্ত্র’ নামে একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখেছেন।