| 29 মার্চ 2024
Categories
এই দিনে চলচ্চিত্র ফিচার্ড পোস্ট

স্মরণ: কথাকার ঋতুপর্ণ । শকুন্তলা চৌধুরী

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

খুব ভালো কথা বলতে তুমি! প্রায়ই দেখতাম তোমাকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে — পরণে জিনস্ আর হাল্কা রঙের শার্ট, চোখে চশমা, মাথায় কোঁকড়া চুল। একদিকের কাঁধে একটা লম্বা ঝোলা ঝুলিয়ে, ব্যাচমেটদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে, দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠে আসতে চারতলায়। করিডোরে দাঁড়িয়ে সবার সঙ্গে অনর্গল গল্প করে যেতে। সত্যি বলতে কি, খুব একটা মনোযোগ দিয়ে কখনো দেখিনি তোমায়। কখনো ভাবিনি যে তোমার বলা গল্পগুলো একদিন ছবি হয়ে ফুটে উঠবে চোখের সামনে, ছড়িয়ে পড়বে দিক্-দিগন্তে। …

“দেখতে খারাপ, মাখতে ভালো”র মতো অনবদ্য একটা লাইন কি করে যে তোমার মাথায় এসেছিল জানি না — কিন্তু আগে যারা কোনদিন ঐ সাবানটা ছুঁয়েও দেখেনি, আমার মতো লোকেরা, তারাও একবার চোখ তুলে তাকিয়েছিল কথাটা শুনে। আর সেটা ছিল তোমার তৈরী সংলাপেরই সাফল্য। তুমি নিজেও জানতে সেটা। আর এ-ও জানতে যে তোমার সংলাপেরা কোনো বিজ্ঞাপন সংস্থায় চিরদিন আটকে থাকার জন্যে নয়। তোমার স্বপ্নে তৈরী হওয়া গল্পগুলো যেদিন তোমার সংলাপের হাত ধরে ছবিতে নামল, সেদিন থেকে তুমি অমর হয়ে গেলে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ, কলকাতা, ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে তুমি বেঁচে রইলে — ৩০শে মে, ২০১৩ পার করেও। প্রতি ৩১শে অগাস্টের জন্মদিনে, প্রত্যেকটি সফল গল্পের মাঝে — তুমি বেঁচে রইলে।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,তুমি


আসলে তুমি গল্প বলতে জানতে, ঋতুপর্ণ ঘোষ। তুমি জানতে কোন্ সংলাপ কোথায় ছুঁড়ে দিলে, কোন্ সঙ্গীতের আবহকে কোথায় ব্যবহার করলে, আর মানবিক সম্পর্কের টানাপোড়েনগুলোকে ঠিক কিভাবে দেখালে, নিতান্ত অনিচ্ছুক মনকেও টেনে আনা যায় গল্পের স্রোতে। তুমি ছিলে ষাট-সত্তরের অস্থির বাতাবরণের পরবর্তীকালে যৌবনে পা-দেওয়া, দক্ষিণ কলকাতার আধুনিকমনস্ক স্বচ্ছল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি আদ্যন্ত বাঙালী। আর তোমার বেশীরভাগ ছবিতে সেই পরিচিত জগতটাকেই তুমি তুলে ধরেছ অত্যন্ত মুন্সীয়ানায়। কিছু ‘ব্যতিক্রম’ অবশ্যই আছে, কিন্তু সেগুলো ‘ধারা’ হয়ে ওঠার সময় পায়নি। তুমি দেখিয়ে দিয়েছিলে যে একদম বাঙালী গল্প বাঙালী ধাঁচে বলেও, এবং ‘আঁতেল’ বদনাম না কুড়িয়েও, রুচিশীল বাঙালীর উন্নাসিক মননশীলতাকে ছোঁওয়া যায়। আবার সব উচ্চতাকে ছোঁওয়ার পরেও, উদ্ধত বৈরাগ্যে, পথ ভেঙে বেরিয়ে চলে যাওয়া যায়। আর এই সব তুমি দেখিয়ে দিয়েছিলে খুব স্বল্প পরিসরে, অতি অনায়াসে। এতো স্বচ্ছন্দ্যে তুমি মঞ্চে প্রবেশ এবং সেখান থেকে প্রস্থান করলে যে বহুদিন লেগে গেল মনের সাড় ফিরে পেতে, প্রতিক্রিয়া বুঝতে। আর আজ, পিছন ফিরে তাকিয়ে কেবলই মনে হচ্ছে যে এই নয় বছরে যেন ঠিক তেমন করে আর কেউ গল্প শোনায় নি! হয়তো সেটা ঠিক, বা ঠিক নয়; হয়তো সেটা মনের পক্ষপাতিত্ব। কিন্তু এটা ঠিক যে দুই শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, প্রায় দুই দশক ধরে, তুমি বাঙালী দর্শকদের চাহিদা বাড়িয়ে দিয়েছিলে। তুমি আমাদের একটা অন্য উচ্চতায় তুলে দিয়েছিলে, তুমি আমাদের পক্ষপাতদুষ্ট করে দিয়েছিলে।

তোমার ছবিতে কোনো উগ্র ঝাঁঝ ছিল না — কোনো কোনোটায় হয়তো বা একটা ‘মেসেজ’ ছিল, কোনোটায় হয়তো বা শুধুই গল্প। শিরদাঁড়া সোজা করে, খুব জটিল কিছু বোঝার মতো করে, দেখতে হত না তোমার ছবি। তাই মনে হত যেন গল্প শুনছি — ‘অডিও বুক’-এর মতো, ‘ভিডিও বুক’। আর পর্দা কালো হয়ে গেলে মনে হত – “শেষ হয়ে হইল না শেষ।”

অনেকে হয়তো আমার সঙ্গে একমত হবেন না — কারুর কারুর মনে হতে পারে যে তোমার ছবিকে আমি খুব সাধারণ, জোলো, করে দিচ্ছি। না, একেবারেই নয়। তোমার ছবি সাধারণ নয় — ঠিক তাইজন্যই আজ নয় বছরেও বাঙালী আরেকটা ঋতুপর্ণ পেল না। তুমি সহজ এবং অ-সাধারণকে মিলিয়ে মিশিয়ে এমন একটা বর্ণালী বানিয়েছিলে যাতে যে যার মতো করে মন রাঙিয়ে নিতে পারে — কেউ নিয়েছে সাদা, কেউ নিয়েছে গাঢ়, আবার কেউ বা রামধনুর থেকে আলাদা আলাদা করে বেছেছে সাতটা রঙ। সেই বর্ণালী বানানোর কাজটা আর যাই হোক্ না কেন, সাধারণ নয়।

বাংলা ছবিতে, নব্বইয়ের দশক ছিল ঋতুপর্ণর দশক। বাংলা ছবির মরা গাঙে বান এসেছিল তোমার হাত ধরে।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্পের ওপর বানানো ‘হীরের আংটি’ (১৯৯২) ছবি দিয়ে গা গরম করে, খুব দ্রুত তুমি চলে এসেছিলে তারকা-খচিত পরের ছবিতে।

তোমার ‘উনিশে এপ্রিল’ (১৯৯৪) দেখে চমকে উঠেছিলাম। মা-মেয়ের দ্বন্দ্ব এবং ভুল বোঝাবুঝি — এইরকম একটা পুরোনো বিষয়হীন বিষয়কে নিয়ে যে এতো ভালো একটা লম্বা টানটান ছবি করা যায়, সেটা জানিয়ে তুমি বাঙালীর হৃদয়মঞ্চে প্রবেশ করেছিলে। এই ছবির সংলাপ এবং ঘটনাবিন্যাস এতো স্বাভাবিক, অথচ উপস্থাপনা এতো অসাধারণ, যে মনে হল সহজ কথা সহজে বলার আর্টটা তোমার সহজাত। বেস্ট ফিচার ফিল্ম ক্যাটাগরিতে ন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড পেল এই ছবি, আমরা পেলাম অসাধারণ এক গল্পকারকে।

তারপর এল ‘দহন’ (১৯৯৭)। তুমি যখন ‘দহন’ বানিয়েছিলে, তখনও এই বিষয়ের ওপর এতো ছবি হয়নি। তোমার ছবির ‘মেসেজ’টা আমাদের ভাবিয়েছিল। দ্রৌপদীদের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু ধৃতরাষ্ট্ররা নিশ্চুপ। কোন্ কুরুক্ষেত্রে কবে হবে কৌরবের নিধন তা জানা নেই, শুধু দ্রৌপদীরাই মাথা নীচু করে লুকিয়ে পড়ছে কোণে-বনে-পরবাসে। বাংলা বেস্ট ফিচার ফিল্ম ক্যাটাগরিতে ন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড পেল ‘দহন’। এবার শুধু কলকাতা নয়, ফিরে তাকাল সারা দেশ।

পরবর্তী ছবি ‘অসুখ’ও (১৯৯৯) বাংলা বেস্ট ফিচার ফিল্ম ক্যাটাগরিতে ন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড পেল — যাকে বলে ‘হ্যাটট্রিক’, তাই করলে তুমি। সম্পর্কের টানাপোড়েন এই ছবিতেও ছিল, যেমন ছিলো ‘উনিশে এপ্রিল’-এ। মেয়ের সঙ্গে বাবার দ্বন্দ্ব ও অপত্যস্নেহ, এই ছবিতে অন্যমাত্রায় উপস্থিত। এছাড়াও ‘অসুখ’-এ ছিল একবিংশ শতাব্দীর মুখে দাঁড়িয়ে কিছু আগাম সূচনা — এইডস্ নামক দুরারোগ্য শারীরিক ব্যাধির সম্পর্কে সতর্কীকরণ, সম্পর্কের ভঙ্গুরতা ও অবিশ্বাস নামক দুরারোগ্য মানসিক ব্যাধির সম্পর্কে সতর্কীকরণ……অসুখ তো শুধু একটা নয়!


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,তুমি


২০০০ সালে তুমি আমাদের দুটো সুন্দর ঘরোয়া বাঙালী গল্প শোনালে — ‘বাড়ীওয়ালী’ আর ‘উৎসব’। একদম বাঙালী পরিবেশ, বাঙালী পরিবার, বাঙালী পার্বণ। স্বপ্নের মতো ঘোর লাগা একটা মফস্বলী জগত থেকে, নাগরিকজীবনের হাত-ধরে-আসা বাস্তব সমস্যাগুলোকে ছোঁওয়া। পুরোনো বাড়ী রাখার অর্থনৈতিক চাপ এবং আনুষঙ্গিক যাবতীয় ওঠা-পড়াটা ছিল বাঙালীর চেনা জগত, দুটো ছবিতেই। দুটো ছবিই জাতীয় পুরস্কার পেল, ভিন্ন ভিন্ন বিভাগে।

‘উনিশে এপ্রিল’, ‘দহন’ এবং ‘অসুখ’ — এই তিনটি ছবির গল্প সম্পূর্ণ আলাদা হলেও, তিনটি ছবিই ছিল দ্রুতগতি নাগরিক জীবনের পটভূমিকায় তোলা, সমসাময়িক নাগরিক সমস্যার চিন্তামূলক দলিল। উল্টোদিকে ‘বাড়ীওয়ালী‘ এবং ‘উৎসব’ ছবিদুটি ছিল নগরের কোলাহল থেকে একটু দূরে বসে, বিলম্বিত লয়ে, সমস্যাযুক্ত জীবনকে নিয়ে নাড়াচাড়া করা। বাঙালী মজে গেল তোমার গল্পে — শেষ হল একটি দশক তথা শতাব্দী। রয়ে গেল তার রেশ। নব্বইয়ের দশক বাংলা ছবির দিশা পাল্টে দিল, তোমার হাত ধরে।

এরপর থেকে তোমার প্রায় সবকটি ছবিই কোনো না কোনো ক্যাটাগরিতে ন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড পেয়েছে, আন্তর্জাতিক পুরস্কারও আছে কিছু। কিন্তু সেটাই তোমার ছবির সম্বন্ধে শেষ কথা নয়। তোমার ছবি মানুষের ভালো লেগেছিল — বহুদিন পর শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালী সিনেমা হলে যাওয়ার একটা কারণ খুঁজে পেয়েছিল। আর আমার মতো বিশ্বনাগরিকেরা, বৎসারান্তে কলকাতায় গিয়েই তোমার নতুন ছবির ক্যাসেট খুঁজতে শুরু করেছিল। পরপর, প্রায় প্রতিবছরই, তুমি আমাদের নতুন কিছু দিচ্ছিলে। এমন কিছু, যা আমাদের বাঙালীয়ানাকে, মননকে, আবেগকে, হৃদয়ের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোকে উজ্জীবিত করে তুলছিল।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,তুমি


নতুন শতকে নানা পথ ধরে এসেছিল তোমার আলাদা আলাদা রঙের উজ্জ্বল একঝাঁক গল্প — নিজের লেখার ওপর বানানো প্রতিদিনের সম্পর্কের গল্প ‘তিতলি’ (২০০২), রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে বানানো আরেকটি জটিল সম্পর্কের ছবি ‘চোখের বালি’ (২০০৩), আগাথা ক্রিস্টির মিস্ মার্পল সিরিজের একটি গল্পের ছায়া অবলম্বনে বানানো গোয়েন্দা ছবি ‘শুভ মহরত’ (২০০৩), ও’ হেনরীর আরেকটি বিখ্যাত বিদেশী গল্পের ছায়ায় বানানো মানবিক সম্পর্কের হিন্দী ছবি ‘রেইনকোট’ (২০০৪), তারাশঙ্করের গল্পের ওপর বানানো পুরোনোদিনের জমিদারবাড়ীর ছবি ‘অন্তরমহল’ (২০০৫), শীর্ষেন্দুর গল্প নিয়ে বানানো ত্রিকোণ সম্পর্কের ছবি ‘দোসর’ (২০০৬), উৎপল দত্তের নাটকের ছায়া অবলম্বনে মঞ্চ ও সিনেমার দ্বন্দ্বে আটক এক মঞ্চাভিনেতার গল্প নিয়ে বানানো ইংরেজী ছবি ‘দ্য লাস্ট লিয়র’(২০০৭), একটি বালককে কেন্দ্র করে নিজের গল্পের ওপর বানানো অনুভূতিশীল ছবি ‘খেলা’ (২০০৮), জীবন থেকে তোলা গল্পের ওপর ত্রিকোণ প্রেমের জটিলতার ছবি ‘আবহমান’ (২০০৯), নিজের লেখার ওপর বানানো জটিল সম্পর্কের আরেকটি ছবি ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’ (২০০৯), রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে বানানো জীবননাট্যের ছবি ‘নৌকাডুবি’(২০১০)। তারকা-খচিত, পুরস্কারপ্রাপ্ত, ছবির মিছিল শুরু হয়েছিল সেই দশকে। কলকাতার বাইরের প্রযোজকরা বহুদিন পরে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন কলকাতায় তৈরী ছবিতে লগ্নি করতে।

একপথ থেকে আরেক পথে হেঁটে, নানা বিষয় নিয়ে, অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্যে এবং নিপুণতায়, তুমি পরপর বানিয়ে গেছ এই ছবিগুলো — শুধু পুরস্কার বা বাণিজ্যিক সফলতার মাপকাঠি দিয়ে যাদের মাপা যায় না। কখনো মানবিক সম্পর্কের টানাপোড়েনে, কখনো থ্রিলারে, কখনো বিদেশী গল্পের আকাশে, কখনো রবীন্দ্রনাথের গভীরতায় ডুব দিয়েছিলে তুমি — আর সঙ্গে নিয়েছিলে অগণিত দর্শককে। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং তার সূক্ষ্ম টানাপোড়েন ছিল নিঃসন্দেহে তোমার প্রিয় বিষয়, কিন্তু তুমি আরও অনেক কিছু নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছিলে। ‘শুভ মহরত’ দেখে মনে হয়েছিল যে তুমি আরও কিছু সফল থ্রিলার বানাতে পারতে। ‘রেইনকোট’ দেখে মনে হয়েছিল যে আরও কিছু বিদেশী গল্পকে স্বদেশী কাঠামোয় ফেলে তুমি অন্যধরণের ছবি বানাতে পারতে। ‘দ্য লাস্ট লিয়র’ দেখে মনে হয়েছিল এইরকম আরও কিছু বিশেষ চরিত্ররা হয়তো বা তোমার ছবির ‘ক্যারেকটার রোল’-এ নতুন করে ফুটে উঠতে পারত। ‘খেলা’ দেখে আশা হয়েছিল যে নাবালক চরিত্র নিয়ে তুমি আরও কিছু ছবি বানাবে — হয়তো বা নাবালকদের জন্যই বানাবে। অপেক্ষায় ছিলাম বঙ্কিমচন্দ্রের গল্পের ওপর তোমার বানানো ‘দেবী চৌধুরাণী’ দেখব বলে — ভেবেছিলাম হয়তো এবার বঙ্কিম-শরদিন্দুর ঐতিহাসিক উপন্যাসেরা প্রাণ পাবে তোমার হাতের যাদুকাঠির ছোঁওয়ায়। তুমি ঠিক সেইদিকেই যাচ্ছিলে, যেই পথ ধরে আরও কিছুদূর হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছলে আমরা হয়তো এক পরিপূর্ণ নতুন ঋতুপর্ণকে পেতাম। হয়তো বা আমরা তোমার ছবির আরও বহুমুখিতা দেখতে পেতাম। কিন্তু সেই আলোচনা করে আজ আর কোনো লাভ নেই, কারণ তুমি থেমে গেলে — তুমি আর হাঁটলে না। নব্বইয়ের দশকের সেই অপ্রতিহত ঋতুপর্ণ যেন পথ চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল।


আরো পড়ুন: ঋতুপর্ণ ঘোষের একটি সাক্ষাৎকার


মনে হয় যেন খুব দ্রুত শেষ হল ‘মেমোরিজ ইন্ মার্চ’ (২০১০) ছবির স্ক্রীন-প্লে লেখা এবং ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’ (২০১০) ও ‘চিত্রাঙ্গদা’ (২০১২) ছবিদু’টির পরিচালনার দায়িত্ব। এই ছবিগুলোতে রইল তোমার নতুন ভূমিকা — অভিনয়। ব্যক্তি ঋতুপর্ণ আর পরিচালক ঋতুপর্ণর মধ্যে দূরত্বের অবকাশ রইল না। দেখে মনে হল কি যেন বলার চেষ্টায়, নিজেকে পুরো ব্যক্ত করতে না পারার চাপা অস্থিরতায়, তুমি ছটফট করেছিলে।
তারপর এল ঝড়ের আগের স্থিরতা। তোমার শেষ দু’টি ছবি, হাসির ছবি ‘সানগ্লাস’ (২০১৩) আর রবীন্দ্রনাথের জীবন নিয়ে বানানো ‘জীবনস্মৃতি’ (২০১৩), মুক্তি পেল তুমি চলে যাওয়ার পর।

পঠন-পাঠনে তোমার চিরকালের আগ্রহ ছিল — শুধু বাংলা সাহিত্য নয়, ইংরেজী সাহিত্যও। রবীন্দ্রনাথ আর সত্যজিৎ ছিলেন তোমার চিন্তায় মেশা। তার সঙ্গে ছিল তোমার অনুভূতিশীল মন। এইসবকিছুর সংমিশ্রণেই তৈরী হয়েছিল পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ — বাংলা, হিন্দী এবং ইংরেজী ভাষাতে বানানো তোমার প্রায় প্রতিটি ছবিতেই ধরা আছে সেই পরিশীলিত স্বাক্ষর। অল্প সময়ে, মাত্র কুড়ি বছরে, উনিশটি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলে তুমি বা তোমার ছবিরা। আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছিলে। দর্শকের ভালোবাসা পেয়েছিলে। প্রযোজকদের বিশ্বাস পেয়েছিলে। তারকাদের সম্মান পেয়েছিলে। বদলে দিয়েছিলে বাংলা সিনেমার ধারা। আমাদের দিয়েছিলে অপূর্ব সব গল্প, অসাধারণ পরিচালনা, যথাযথ সংলাপ এবং গান। আর্টফিল্ম আর কমার্শিয়াল ফিল্মের মধ্যবর্তী ধূসর জায়গাটায় দাঁড়িয়ে, তুমি সত্যজিৎ এবং তাঁর পরবর্তী ঘরানার এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলে।

তুমি কি এগিয়ে ছিলে সময়ের থেকে, না তোমারই তাড়া ছিল সময়কে পিছনে ফেলে পালিয়ে যেতে? তুমি কি পথ হারালে, না পথই তোমায় হারাল? জানি না, বুঝতে পারিনা। …. বড্ড সম্পর্কবিধুর, সংবেদনশীল ছিলে তুমি। খুব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল তোমার গল্প বলা। ঠিক করে হাততালি দেওয়ারও যেন অবকাশ পাওয়া গেল না। তুমি চলে গেলে — চলে গেলে ‘মনখারাপের দিস্তা’ নিয়ে, চলে গেলে তোমার না-বলা গল্পদের ঝোলা কাঁধে নিয়ে। তবু, অনেকটা যেন কাদম্বিনীর ‘মিরর্ ইমেজ’-এর মতো, হারিয়ে গিয়ে তুমি বেঁচে রইলে। তাই তোমার জন্মদিনে, তোমার না-বলা গল্পগুলো শুনতে না পাওয়ার আক্ষেপ নিয়ে, পাঠালাম একরাশ শুভেচ্ছা — এইভাবেই বেঁচে থাক তুমি, আমাদের স্মরণে মননে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত