অনুবাদ গল্প: বাড়ির ভেতর বাঘ । রাস্কিন বন্ড
রাস্কিন বন্ড
জন্মঃ ১৯শে মে, ১৯৩৪। জন্মসূত্রে রাস্কিন বন্ড যদিও বৃটিশ কিন্তু কর্মসূত্রে এবং চিন্তা ভাবনায় তিনি আদ্যোপান্ত ভারতীয়। তাঁর ছোটবেলার অনেকটা সময় কেটেছে দেরাদুনে। পরবর্তীকালে অল্প কিছুদিন ইংল্যান্ডে থেকেছেন কিন্তু আবার ফিরে এসেছেন দেরাদুন ও মুসৌরির টানে এবং আজ পর্যন্ত মুসৌরিতেই রয়ে গেছেন। তাঁর মরমী লেখায় গাড়োয়াল হিমালয় সহ গোটা ভারতের সামাজিক ও প্রাকৃতিক চিত্র যেভাবে প্রকাশ পেয়েছে ভারতীয় সাহিত্যে তেমনটি বিরল। তিনি যেমনটি দেখেছেন যেমনটি অনুভব করেছেন হৃদয় নিংড়ে ঠিক তেমনটিই লিখেছেন। তাঁর সোনার কলমের ছোঁয়ায় সেইসব গল্প হয়ে উঠেছে হৃদয়স্পর্শী। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই তাঁর লেখা পাঠক সমালোচকদের নজর কাড়ে। ১৯৯২ সালে সাহিত্য অ্যাকাডেমি, ১৯৯৯ সালে পদ্মশ্রী ও ২০১৪ সালে পেয়েছেন পদ্মভূষণ পুরস্কার।
অনুবাদক: অনন্যা দাশ
টিমথি নামের বাঘছানাটাকে আমার দাদু দেহরার কাছের তেরাইয়ের জঙ্গলে শিকার করার সময় পেয়েছিলেন। দাদু মোটেই শিকারি-টিকারি ছিলেন না। কিন্তু শিবালিকের জঙ্গলগুলো ওনার দারুণ ভালো চেনা ছিল আর সেই জন্যেই ওনাকে দলে নেওয়া হয়েছিল। দাদু ছাড়া দলে ছিলেন দিল্লির বেশ কিছু বিশিষ্ট লোকজন। দাদুর কাজ ছিল রাস্তা দেখানো আর বাঘ দেখা দিলে বিটাররা কোনদিকে যাবে সেটা বলে দেওয়া।
বিশাল ক্যাম্প পাতা হয়েছিল। সাতটা বড়ো বড়ো তাঁবু, এক একজন শিকারির জন্যে এক একটা, তাছাড়া একটা খাবার জন্যে আর সাথে আসা কাজের লোকেদের থাকার জন্যে বেশ কয়েকটা। রাতের খাওয়াদাওয়া ভালোই হয়েছিল, দাদু পরে বলেছিলেন। জঙ্গলের মধ্যে থালায় গরম গরম সাত-আট পদ রান্না, হাত ধোওয়ার জন্যে ফিঙ্গার বোল তো আর সচরাচর দেখা যায় না। কিন্তু ভাইসরয়দের জমানায় ওরকম বিলাসবহুলভাবেই সবকিছু করা হত। দলের সঙ্গে পনেরোটা হাতিও ছিল – তার মধ্যে চারটে শিকারিদের জন্যে আর বাকিগুলো নাকি বিশেষভাবে ট্রেনিং পাওয়া, তারা বাঘ বেরোলে বিটে সাহায্য করতে পারে।
শেষমেশ শিকারিরা অবশ্য কেউ বাঘ দেখতে পায়নি, কোনও কিছু শিকারও করতে পারেনি। শুধু বেশ কিছু হরিণ, ময়ূর আর জংলি শুয়োর দেখেছিল। বাঘ দেখার সব আশা ছেড়ে তারা একসময় কয়েকটা শেয়ালকে গুলি করতে শুরু করেছিল। দাদু তখন জঙ্গলের পথে হাঁটতে হাঁটতে অন্যদের থেকে কিছুটা আলাদা হয়ে পড়ে একটা আঠেরো ইঞ্চি লম্বা ছোট বাঘছানাকে দেখতে পেলেন। বেচারা ভয়ে একটা অশ্বত্থগাছের শেকড়ের মধ্যে গুঁড়ি মেরে লুকিয়ে বসেছিল। দাদু তাকে তুলে নিয়ে বাড়িতে নিয়ে এলেন ক্যাম্প ভেঙ্গে যাওয়ার পর। সেই অভিযানে দাদুই একমাত্র লোক যিনি জীবিত বা মৃত কোনও প্রাণী বাড়িতে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন।
প্রথম প্রথম বাঘছানাটা (দাদু ওর নাম টিমথি রেখেছিলেন) শুধুই বোতলে করে দুধ খেত আমাদের রান্নার লোক মাহমুদের কাছে। যদিও দুধ তার ঠিক সহ্য হচ্ছিল না, তাই তাকে পাঁঠার কাঁচা মাংস আর কড লিভার অয়েল দেওয়া হল কিছুদিন। তারপর ক্রমে তার পছন্দের খাবার পায়রা আর খরগোশের মাংসতে গিয়ে ঠেকল।
টিমথির জন্যে দু’জন বন্ধুর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সাহসী বাঁদরছানা টোটো, যে টিমথির লেজ ধরে টান মারত আর সে রেগে গেলেই ছুটে পর্দা বেয়ে ওপরে উঠে নাগালের বাইরে পালিয়ে যেত। আর একটা ছোট কুকুরছানা যাকে দাদু রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছিলেন।
প্রথম প্রথম টিমথি কুকুরছানাটাকে বেশ ভয় পেত আর সে কাছে এলেই লাফ মেরে দূরে সরে যেত। মাঝে মাঝে আবার থাবা দিয়ে এক থাবড়া মেরেই দূরে পালাত। পরে অবশ্য দেখা গেল কুকুরছানা ওর ঘাড়ে চড়ে দিব্যি ঘুমোচ্ছে। টিমথির সবচেয়ে পছন্দের খেলা ছিল যে ওর সঙ্গে খেলতে আসবে তাকে তাড়া করা। তাই আমি যখন দাদুর বাড়ি থাকতে গেলাম তখন আমি ওর প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠলাম। চোখে একটা ধূর্ত চাহনির ঝিলিক খেলিয়ে সে আমার খুব কাছে এসে আমার পায়ে থাবা মেরে, পা কামড়ে দেওয়ার ভান করত।
এতদিনে সে একটা বড়ো রিট্রিভারের সাইজের হয়ে গিয়েছিল আর আমি যখন ওকে নিয়ে হাঁটতে বেরোতাম তখন লোকজন আমাদের ধারে কাছে খুব একটা ঘেঁষত না। মাঝে মাঝে ও নিজের শেকল ধরে এমন টান দিত যে আমার পক্ষে ওর সঙ্গে তাল রাখা কঠিন হয়ে পড়ত। বসবার ঘরটা ছিল ওর সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। সেখানে রাখা লম্বা সোফাটায় আরাম করে শুয়ে থাকত সে। আর কেউ তাকে সেখান থেকে সরাতে গেলেই রেগে গিয়ে গর্জন করত।
বেশ পরিষ্কার পরিছন্ন থাকার স্বভাব ছিল ওর। বেড়ালদের মতন মুখ আর পা ঘষে ঘষে পরিষ্কার করত। রাতে সে রান্নার লোকেদের সঙ্গে শুত আর সকালে ছাড়া পেয়ে দারুণ খুশি হত।
দাদু ভবিষ্যদ্বাণী করতেন, “কোনওদিন হয়তো ঘুম থেকে উঠে দেখব যে টিমথি মাহমুদের বিছানার ওপর বসে আছে আর মাহমুদের দেখা নেই। তার জায়গায় শুধু তার জামা আর জুতো পড়ে রয়েছে!”
বলা বাহুল্য, সেরকমটা কোনওদিন ঘটেনি। কিন্তু টিমথির যখন ছ’মাস বয়স হল তখন সে কেমন যেন বদলে গেল। কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাইত না আর। হাঁটতে যখন বেরোতাম তখন সে পাড়ার কোনও বেড়াল বা কারও পোষা কুকুরের পেছনে তাড়া করতে চেষ্টা করত। কখনও কখনও আমরা রাতে মুরগিদের খামার থেকে জোরে জোরে কোঁক কোঁক শব্দ শুনতে পেতাম আর সকালে বারান্দায় এক রাশ পালক পড়ে থাকত। এরপর থেকে টিমথিকে তাই বেশিরভাগ সময় বেঁধেই রাখা হত। শেষে যখন একদিন ছাড়া পেয়ে মাহমুদকে বাড়িময় তাড়া করে বেড়ালো মনে অশুভ পরিকল্পনা নিয়ে তখন দাদু ঠিক করলেন যে ওকে চিড়িয়াখানায় দিয়ে আসার সময় হয়েছে।
আরো পড়ুন: রাসকিন বন্ডের অনুবাদ গল্প কুশল স্যার
সবথেকে কাছের চিড়িয়াখানাটাও ছিল লখনউতে, আমাদের ওখান থেকে দু’শো মাইল দূরে। একটা গোটা ফার্স্ট ক্লাস কমপার্টমেন্ট রিজার্ভ করে দাদু টিমথিকে নিয়ে লখনউ চললেন (অন্য কেউ সেখানে বসতেও চায়নি অবশ্য!)। চিড়িয়াখানার কর্তৃপক্ষ তো একটা হৃষ্টপুষ্ট মোটামুটি বাধ্য বাঘ উপহার পেয়ে বেজায় খুশি।
ছ’মাস পরে দাদুরা যখন কোনও এক আত্মীয়র সঙ্গে দেখা করতে লখনউ গেলেন তখন দাদু টিমথিকে দেখতে সেই চিড়িয়াখানায় গিয়ে হাজির হলেন। আমি তখন ওনাদের সঙ্গে ছিলাম না। কিন্তু দাদু দেহরা ফিরে এসে আমাকে সব গল্প করেছিলেন।
চিড়িয়াখানা পৌঁছে দাদু সোজা টিমথিকে যে খাঁচাটায় রাখা হয়েছিল সেটার দিকে এগিয়ে গেলেন। বাঘটা খাঁচারই এককোণে বসেছিল। বিশাল চেহারা, চকচকে ডোরাকাটা গায়ের লোম।
“হ্যালো টিমথি!” বলে দাদু রেলিং ধরে কিছুটা উঠে খাঁচার মধ্যে দু’হাত ঢুকিয়ে দিলেন।
বাঘটা দাদুর কাছে এসে ওনাকে ওর মাথার দু’দিকে হাত রাখতে দিল। দাদু ওর মাথায় হাত বুলিয়ে, কান চুলকে দিতে লাগলেন। সে গর্জন করলেই তাকে চুপ করানোর জন্যে তার মুখে ফটাস করে এক-আধটা চড়ও মেরে দিচ্ছিলেন সেই আগেকার মতন। বাঘটা আনন্দে দাদুর হাত চেটে দিচ্ছিল। শুধু পাশের খাঁচাটার চিতাবাঘটা গর্জন করলে একটু বিরক্ত হয়ে উঠে গিয়ে খাঁচার অন্যকোণের দিকে চলে যাচ্ছিল। দাদু চিতাবাঘটাকে শু শু করে তাড়াতে আবার ফিরে এসে ওনার হাত চাটছিল। তবে চিতাবাঘটা বেশ বদ, মাঝে মাঝেই তেড়ে আসছিল আর ওকে দেখেই বাঘ বাবাজি ঘরের কোণে সেঁধোচ্ছিল। চিড়িয়াখানায় বেড়াতে আসা বেশ কিছু লোক আশপাশে জড়ো হয়ে মজা দেখছিল। এমন সময় চিড়িয়াখানার একজন কর্মচারী ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে দাদুকে জিজ্ঞেস করল, উনি কী করছেন।
দাদু বললেন, “আমি টিমথির সঙ্গে কথা বলছি। ছ’মাস আগে যখন ওকে নিয়ে এসেছিলাম তখন তুমি এখানে ছিলে না বুঝি?”
লোকটা খুব আশ্চর্য হয়ে বলল, “না, আমার এখানে বেশিদিন হয়নি। তা আপনি চালিয়ে যান। আমি তো ওকে কোনওদিন ছুঁতেই পারিনি। ও খুব বদমেজাজি হয়ে থাকে সব সময়!”
“ওকে অন্য কোথাও রাখো না কেন তোমরা, বল তো? ওই চিতাবাঘটা ওকে ভয় দেখায়। দেখি আমি তোমাদের সুপারিন্টেন্ডেন্টের সঙ্গে কথা বলব এই ব্যাপারটা নিয়ে,” বলে দাদু সুপারিন্টেন্ডেন্টকে খুঁজতে গিয়ে দেখলেন যে তিনি সেদিন তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে গেছেন।
কিছুক্ষণ চিড়িয়াখানায় ঘুরে দাদু যখন টিমথির কাছে বিদায় নিতে ফিরে এলেন তখন অন্ধকার নেমে আসছে। মিনিট পাঁচেক ধরে টিমথির গায়ে হাত বুলোনো আর থাপ্পড় মারার পর দাদুর হঠাৎ খেয়াল হল যে চিড়িয়াখানার আরেক কর্মচারী খুব ভয়ে ভয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। দাদু তাকে চিনতে পারলেন। টিমথিকে যখন এনেছিলেন তখন ওই লোকটা ছিল।
“তুমি তো আমাকে চিনতে পেরেছ দেখছি!” দাদু বললেন, “শোন, তোমরা টিমথিকে অন্য খাঁচায় রাখছ না কেন, ওই বজ্জাত চিতাবাঘটার থেকে দূরে?”
“কিন্তু স্যার,” লোকটা আমতা আমতা করে বলল, “এটা তো আপনার বাঘ নয়!”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি জানি,” দাদুর গলায় শ্লেষ, “আমি জানি ও এখন আর আমার বাঘ নয়। কিন্তু আমার কথাটা তো শুনবে তোমরা?”
“আমার আপনার বাঘটাকে ভালোই মনে আছে,” লোকটা বলল, “ও তো দু’মাস আগে মারা গেছে!”
“মারা গেছে!” দাদু ভীষণ আশ্চর্য হলেন।
“আজ্ঞে হ্যাঁ। ওর নিমোনিয়া হয়ে গিয়েছিল। এই বাঘটাকে পাহাড়ি অঞ্চল থেকে গত মাসে ধরে আনা হয়েছে। ও খুব ভয়ংকর প্রাণী!”
দাদু আর কী বলবেন ভেবে পেলেন না। বাঘটা তখনও ওনার হাতটা চেটে চলেছে মনের সুখে। দাদু বেশ কিছুক্ষণ পরে নিজের হাতটা খাঁচা থেকে বার করলেন, তারপর নিজের মুখটাকে বাঘটার মুখের খুব কাছে নিয়ে গিয়ে, “শুভরাত্রি টিমথি!” বলে ওই কর্মচারীটির দিকে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হন হন করে হেঁটে চিড়িয়াখানা থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন।