| 18 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: অমৃতস্য পুত্রা (পর্ব-৪) । অনিন্দিতা মণ্ডল

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

কথা ১ 

নীচু মাথাটা টেবিল ছুঁয়ে ফেলেছে প্রায়। কলমের গতি যেন চিন্তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলেছে। আশেপাশের জগত আর চেতনায় নেই। বিচ্ছিন্ন একা এক স্রষ্টা। সৃষ্টি নিমগ্ন। স্রষ্টা তো একাই হয়!

       এ ঠিক কলকাতা নয়। খাল পেরোলে কলকাতা থাকেনা আর। আগে ত এসব জায়গায় লোকে বাস করার কথা ভাবতই না। এখন, মানে আশির দশকের শুরুতে এখানে জমজমাট শহর। চোখ ধাঁধানো আলোয় সাজানো দোকানপাট। অবাঙালি মিষ্টির দোকান। নিরামিষ রেস্টুরেন্ট। লেকের পার জুড়ে একতলা দোতলা বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট উঠছে। পুরনো বাঙালিরা বাড়ি বেচে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। শুধু বি ব্লকে ঢোকার মুখে বনফুলের একতলা বাড়িটা রয়ে গিয়েছে। নামটাকে সম্মান দিতে সরকারি আবাসনের নাম হয়েছে ‘বনফুল আবাসন’। অবশ্য লোকের মুখে ওটা হাউজিং বা গার্ড হাউজ। ঈশ্বর জানেন, বনফুল কক্ষনো এক আবাসন ভর্তি মানুষকে পাহারা দেবার কথা ভাবেননি।

       সময় চেতনায় গোল গোল তরঙ্গ তোলে। আমরা এখন অন্য সময়সারণীতে। প্রায় বারো বছর পরে অন্য এক বাসাবাড়ি। জাহাজবাড়ি। বাড়ি করেছিলেন এক জাহাজী। আমরা দাদু বলি। রেঙ্গুন শহরে জন্ম তাঁর। ভারি রসিক বৃদ্ধ। স্নেহময়ও। আবার মেজাজও টনটনে। নিজের বিরাট একতলায় আমাদের ভাড়া থাকতে দিলেন। দাদু আর দিদার সংসারে আমরা যেন আমূল জুড়ে গেলাম। কেউ কখনও বলল না, তোরা কে? কোথায় ছিলি এদ্দিন? দাদু দিদা আমাদের আপন ঠাকুরদা ঠাকুমার স্মৃতি ফিরিয়ে আনল। আমাদের না দেখা ঠাকুরদা ঠাকুমা।

       আমাদের এ বাড়ির সদর দরজাটা রাত এগারোটা না বাজলে বন্ধ হয়না। সকাল থেকে খোলা। সামনে একটা উদলো রোয়াক। চওড়া। সারাদিন লোকের আনাগোনা। সকাল শুরু হতো দিদার চারমিনারের গন্ধে। সামনে খোলা থাকত দেশ বা আনন্দবাজার, কিংবা হয়ত মনে পড়েছে কিছু, তাই হুইটম্যান বা বৈষ্ণব পদাবলী। পড়তে পড়তে ডাক দিতো, গুগুল শুনে যা। চা নিয়ে বোস।

       তখন দেশে ধারাবাহিক ‘দেখি নাই ফিরে’ বের হচ্ছে। দিদা বলল, এটা কিঙ্করদার এক একটা দিক মাত্র। কিঙ্করদার আরও অজস্র দিক ছিল। বললাম, বড্ড মদ খেয়েছে সারাজীবন। দিদা বিরক্ত—তাতে কী? মদ খেয়েছে তো খেয়েছে! ঋত্বিকও তো মদ খেয়েছেন! কী তপেন্দু? বাবা ঘাড় নাড়ছে। সে তো বটেই। লোকে ওই মদ খাওয়াটা মনে রেখেছে, বাকিটা ঝেড়ে ফেলেছে। আমার মনে অবশ্য অন্য ছবি। বহু মানুষকে দেখে ফেলেছি যারা মাতাল হয়ে অসভ্যতা করে। তাই মাতাল হওয়াটা স্বাভাবিক নয় বলে মনে হয়। ইতিমধ্যে রান্নাঘর থেকে মা কাপড়ে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে এসেছে। মায়ের মামা, মামার বাড়ি সম্পর্কে ধারণা ভালো নয়। একটা মানুষ, তার স্বভাবচরিত্র ভালো না হলে, সৎ না হলে, শুধু শিক্ষিত বলে, সৃষ্টিশীল বলে তাকে মেনে নেওয়া তখন নিয়ম ছিল না। মা বলল—মাসিমা, ওনাদের এই মাতলামির জন্য বাবা কোনোদিন আমাদের মামার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে দেননি। দিদা কষ্ট পেয়েছে। ভারতী তো এমন কড়া করে কথা বলে না? দিদার মন খারাপ হলে আমার কষ্ট হয়। তাড়াতাড়ি বললাম—এসব কথা ছেড়ে দাও। তুমি শান্তিনিকেতনের গল্প বলো।

 রোগাসোগা ছোট্ট দিদা শরীরটাকে সোফার মধ্যে গুটিয়ে নিয়ে বলত—কি শুনবি? আমার দাদু চারুচন্দ্র দত্ত ছিলেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য। রবীন্দ্রনাথের বন্ধু, ওদিকে আবার অরবিন্দের বন্ধু লোক। সশস্ত্র সংগ্রাম তো রবীন্দ্রনাথ সমর্থন করতেন না। দাদু কিন্তু বিপ্লব করতেন। তবে সিভিল সার্ভিসের চাকরি ছেড়ে যখন বাংলায় এলেন তখন রাজনীতি থেকে সরে গেছেন। অরবিন্দ যখন সব ছেড়ে পন্ডিচেরী চলে যাবেন সেই সময় আবার দাদুর সঙ্গে যোগাযোগ হয়। ততদিনে অরবিন্দ স্বদেশী ছেড়ে সাধু হয়ে গেছেন। অবসরের পরে দাদু আর দিদা চলে গেলেন পন্ডিচেরী। তখন তো আর স্বাধীনতার লড়াই অরবিন্দ লড়ছেন না। তাই দাদুর অসুবিধে নেই। অরবিন্দ কলকাতা ছাড়ার আগে তাঁর বাড়িতে যে কয়েকজন বন্ধুদের নেমন্তন্ন করেছিলেন তার মধ্যে দাদু দিদাও ছিল। এবার অবসরের পরে নাকি চিঠি এসেছে। চলে এসো। শান্তিতে থাকবে। শরণাগতিই লক্ষ। আমাদের ব্রাহ্ম বাড়ির রীতনীত ছেড়ে দাদু দিদা এক অদৃশ্য ভগবানের কাছে চলে গেল। আমি তখন কলেজে পড়ি। মা মরা মেয়ে। মামার বাড়িতে মানুষ। দাদু দিদা যখন চলে যাবে বলল, পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। একমাত্র মামা তখন আর্মিতে। বসরায়। মামি আর আমি সেই পদ্মপুকুরের বাড়িতে একা। মামি আমার চেয়ে খুব বড় ছিল না। দুজনে বন্ধুর মতো থাকতুম। মামী ভাবত মামা কবে ফিরবে, ভালো করে সংসার করবে। তারপর একদিন টেলিগ্রাম এলো, মামা শহীদ হয়েছে। বুঝতে পারছিস ফার্সটা? ব্রিটিশের হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে এক পরাধীন ভারতবাসী মারা পড়েছে। সে শহীদ। মামির একটা সন্তান পর্যন্ত ছিল না। সংবাদ গেল পন্ডিচেরীতে। দাদু দিদা এই সময়েও কেউ এলো না কলকাতায়। উল্টে দিদা এক ডজন দামি সাদা জর্জেটে সাদা সুতোর ফুল তুলে মামিকে পাঠিয়ে দিলো। আহা বিধবা পুত্রবধু! তাকে কে এখন বিধবার উপযুক্ত কাপড় দেবে? সেদিন স্থির করলাম এখানে আর থাকব না। বাবাকে জানালাম। নানু আর দাগোর কি নিঃসহায় বউমার কাছে এসে দাঁড়ানো একবার উচিত ছিল না? আমি চিঠি দেওয়া বন্ধ করে দিলাম। কিন্তু নানু দাগো আমাকে মাদারের আশীর্বাদী ফুল পাঠানো বন্ধ করল না।

       দিদা নিজের দিদিমাকে নানু আর দাদুকে দাগো বলে ডাকত।  

       দাদু ফোড়ন কাটল, ‘এ একেবারে মেরেছ কলসীর কানা তা বলে কি প্রেম দেব না স্টাইল, বুঝলি ছোটি। ব্রহ্ম কৃষ্ণ মিলেমিশে একাকার একেবারে’। দিদা ধোঁয়ার সঙ্গে উড়িয়ে দেয় সেসব কথা।


আরো পড়ুন: অমৃতস্য পুত্রা (পর্ব-৩) । অনিন্দিতা মণ্ডল


আবার বলতে শুরু করে, বাবা নিয়ে চলে এলো বউবাজারের বাড়িতে। বাবা তখন প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রিন্সিপাল। আমাকে এম এ ক্লাসে ভর্তি করে দিলেন। আমার মেজ কাকিমা পাত্র খুঁজতে শুরু করে দিলেন।

       দিদা’র বর্ণময় সেই জীবন শুনে মুগ্ধ হতাম। ছোট কাকিমা রানী চন্দের জন্যই দু বছর শান্তিনিকেতনে থাকা হয়েছিল। বাবা অপূর্ব চন্দ তখন বাংলা বিহার ওড়িশার ডায়েরেকটার অফ পাব্লিক ইন্সট্রাকশান। ঘুরে ঘুরে বেড়াতে হয়। দিদাকে তাই ছোট কাকিমার কাছে পাঠালেন। দিদার বোন রইল দিল্লিতে, মেজকাকা অশোক চন্দের কাছে। 

দিদা দাদু বাবাকে মাকে খুব স্নেহ করেন। ‘কত বড় বাড়ির ছেলে তপেন! ভারতীই বা কম কিসে?’ আমি বুঝতে পারি, অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়, আরো এক বিপন্ন বিস্ময় এদের রক্তের মধ্যে খেলা করেছিল। সেই উত্তরাধিকার বহন করছি মাত্র।

বাবা লিখছেন। এই টেবিল আর তার সঙ্গের স্টিলের চেয়ারটা প্রযোজক গণেশ পাইক দিয়েছিলেন তাঁকে। লেখার টেবিল ছিলোনা কোনোদিন। বিছানায় বসে বালিশের ওপরে ফাইল রেখে লেখা অভ্যেস। কাঁধের যন্ত্রণা এত বেড়েছে যে ডাক্তারের পরামর্শে টেবিলে লেখা শুরু। এই টেবিল চেয়ার উপহার না পেলে সে পরামর্শ উপেক্ষা করা ছাড়া গতি ছিলোনা। মোটা কালো ফ্রেমের চশমা বড় বড় দুটো চোখকে ঢেকে রেখেছে। অবিন্যস্ত এক মাথা চুল। এখনও পাক ধরেনি সে চুলে। পঞ্চাশ বছর বয়স হলো তাঁর। শুরু করেছিলেন সেই  তিরিশে। যৌবন বয়সে বড়ই স্বেচ্ছাচারী ছিলেন। নিজের খেয়ালে নিজের উচ্চাশায় সংসারকে উপেক্ষা করেছেন। মধ্যবিত্তের ছাপোষা নিত্যনৈমিত্তিক জীবন তাঁকে কোনদিনও টানেনি। ফলও পেতে হয়েছে জীবনভোর। আত্মীয়স্বজনের কাছে কম অবহেলা অসম্মান পোহাতে হয়নি। এত যে কাছের বুবু, তাঁর সব দোষকে আড়াল করেছে, সংসারকে পাখির ডানার ছায়া দিয়ে আগলেছে, সেও কি কখনও তাঁকে মনে মনে দোষী করেনি? তাও কি হয়? মাঝেমাঝে চোখে মুখে সেই সব কষ্টের ছাপ ফুটে বেরিয়ে আসে, তিনি দেখতে পান।

সামনেই সদর দরজাটা হাট করে খোলা। সারাদিন ওটা খোলাই থাকে। গতকাল ভিসিডি ভাড়া করে দুটো তামিল ও একটা হিন্দি ছবি দেখতে হয়েছে। মাথাটা ব্যাথায় ছিঁড়ে যাচ্ছিল। কি যে যন্ত্রণা! বসে দেখা দুস্কর। তবু দেখতে হয়েছে। প্রযোজকের অর্ডার। ওই তিনটে মিলে একটা খাড়া করে দিন। তপেন্দুর হাতে নাকি অসম্ভব গতি। তিনদিনে একটা স্ক্রিপ্ট করে দেওয়া নাকি কোনও ব্যাপার নয়। এসব শুনতে শুনতে গর্ব নয়, একটা জ্বালা ধরে তাঁর। এই আপোষ যে কি দুঃখের! তিনি লিখে চলেছেন। আর লেখার মাঝেই ভেসে ওঠে স্মৃতি। স্মৃতির অলিতে গলিতে ঘুরতে থাকেন তিনি। মনের স্পষ্ট দুটো ভাগ টের পান। একভাগ বিরামহীন লিখে চলে, আরেক ভাগ অতীতচারী। এই এখন যেমন শুনতে পাচ্ছেন প্রিয় কণ্ঠ। অজিতদা বলছেন – তুমি দুটোকে এক করছ কেন? একটা তোমার মনের খিদে, আরেকটা তোমার ও তোমার পরিবারের পেটের খিদে। তারপর গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। আচ্ছা তপেন্দু, মনের খিদে মেটাতে তুমিই কি আপোষ করনি কখনও? হ্যাঁ করেছেন। সেই সব অসম্মান বেদনা এক লহমায় ভিড় করে আসে। অজিতদা বুঝতে পেরে হাত ধরেন। দেখো, মানুষ ভুল করে। ও তোমার একটা ভুল। একটা দায়িত্বহীনতা। ভুলে যাও। খেসারত তো কম দিলে না। এবার মাথা উঁচু করে লেখো। অন্ধকারে ডুবতে ডুবতে তিনি অনুভব করেন একটা শক্ত হাত তাঁর পিঠে। আশ্বাসের হাত, ভরসার হাত। সত্যিই অজিতদা বলেই নিজের ভুল, নিজের অপরাধের কথা স্বীকার করা সম্ভব হয়েছিল।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত