| 29 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক

ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-২৯) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট

দুর্গাপুজো মানেই ছোটবেলায় ছিল নতুন জামা,নতুন জুতো ইত্যাদি, ইত্যাদি।আমাদের বাড়িতে পোশাক–আশাকের দিকে তেমন নজর দেওয়া হত না। বলা ভালো সাজগোজ নিয়ে মাথাঘামানোটাকে খুবই তুচ্ছ চোখে দেখা হত।কিন্তু স্কুল,পাড়া সর্বত্র পুজোর আগে বন্ধুদের মধ্যে একটিই আলোচনা চলত,কটা জামা হল, সেগুলো কিরকম দেখতে আর কে কে সেসব দিল। আমাদের বাইরের কেউ তেমন কিছু দিত না।বাড়িতেই বাবা কাকাদের এনে দেওয়া ছিটকাপড়ে জামা তৈরি হত।আর সেসব বানাতেন আমার ঠাকুমা তার সেলাই মেসিনে।পুজোর মাসখানেক আগে থেকেই তার পা মেসিন চলত গড় গড়িয়ে।        

                তিন বোনের দুটো তিনটে জামা ওই একটা মেসিনে বানানো মোটেই সহজ কাজ ছিলনা।খুব টেনশানে থাকতাম আমরা,জামাগুলো পুজোর আগে শেষ হবে তো?তখনও নানা রকমের  সিন্থেটিক জামা পাওয়া যেত দোকানে।হাকোবা, টুইঙ্কিল,এসব বিচিত্র নামের জামা আমাদের বন্ধুরা কিনত দোকান থেকে।আমাদের অভিভাবকদের সেসব জামা কিনে দেওয়ার সাধ বা সাধ্য কোনটাই  ছিল না।আমরাও জানতাম আমাদের ওসব হতে নেই।ছিটের নানারকম বাহারি জামা,তাতে লেস লাগানোর কায়দা ছাড়াও আধুনিক কাটিংএর সবরকম প্রয়োগের কারিকুরি চলত।ব্যাস্‌ ওইটুকুই ।সব জামা মোটেই গায়ে ফিট করত না।কিংবা একটু বড় করেই বানানো হত  যাতে আরো কিছু বছর পরা যায়।তবে বাড়িতে বানানো জামা পরার রেওয়াজ আরো অন্য বাড়িতেও ছিল।তখন আমরা অত বুঝতাম না।এখন বুঝতে পারি অভিভাবকদের অর্থের টানাটানি আর ইচ্ছের বাহুল্য দুটোই ছিল প্রায় সমান মাপের।সুতির দুটো আর হাফ সিল্কের একটা জামা, তারই ফাঁক দিয়ে গলে এসে আমাদের অঙ্গে  উঠত।প্রতিবছর কিনে দেওয়া হত থ্যাবড়ানো মুখের ফুটকি দেওয়া  কালো বাটার জুতো।তার সঙ্গে একজোড়া মোজা।

যখন তখন নিজেদের জিম্মায় থাকা নতুন জামা জুতোর বাক্স খুলে গন্ধ শুঁকতাম আমরা। নিজস্ব সম্পত্তির মালিকানার বোধ হয়ত ওভাবেই গড়ে উঠেছিল। মাথার কাছে জুতোর বাক্স নিয়ে ঘুমোতে যাওয়ার ঘটনা ঘরে ঘরেই ঘটত।জুতোর মাপ বেড়ে ওঠা পায়ের কথা ভেবে একটু বড়ই কেনা হত।সামনে তুলো গুঁজে পুজোর সময় কাদা ডিঙিয়ে ঠাকুর দেখতে যেতাম আমরা।মাথায় লাল নীল ফিতের ফুল অথবা সিন্থেটিক হেয়ারব্যান্ড্‌ ,গায়ে ঢলেঢলে জামা আর পায়ে কালো বুলডগের মুখের মত মাথাওলা  জুতো,যার গভীর অন্দরে আর গোড়ালীর ফোসকার আগায় তুলো গোঁজা। আমরা চলেছি ঠাকুর দেখতে,আমাদের আশেপাশের বন্ধুদের সাজও একইরকম।ছবিটা এত স্পষ্ট, এখনও ভেসে ওঠে চোখের সামনে।নির্দিষ্ট একটা জায়গা অবধি আমাদের স্বাধীনতার সীমানা।মানে অনেকটা সেই লক্ষণের গন্ডির মত,তার বাইরে পা রাখতে মানা।


আরো পড়ুন: খোলা দরজা (পর্ব-২৮) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়


আমি জানিনা সবাই একমত হবেন কিনা,ওইবয়সের ওইটুকু পাওয়ার তৃপ্তির মাঝেই লুকিয়ে থাকত দুর্গা পুজোর জন্য ঘুম না হওয়া প্রতীক্ষা।বড় হবার পর কত জামদানী, বেনারসী পরা হল।কত রঙ মেলানো জুতোর বাহার এলো গেলো,ছোটবেলার ওই অসাধারণ প্রাপ্তিকে কেউ ডিঙোতে পারল না।পুজোর জন্য কেনা কান্তা সেণ্টের ছোট্ট শিশি ,লাল কুমকুমের ডিব্বা আর হিমানীর বাক্স এখনো পুজো এলেই চোখের সামনে নাচে।সেজো কাকার চাকরি প্রাপ্তির কারণে পাওয়া অতিরিক্ত সবুজ চটিটিকে এ জীবনে আর   ভোলা গেলো না।

চন্দননগরের মানুষ,আজীবন এখানেই বসবাস। দুর্গাপুজো-র একমাস পরে আমাদের চন্দননগরে আবার নতুন করে ঢাক বাজে, প্রতিমার আবাহন হয়।ঠিক দুর্গাপুজো-র মত করেই জগদ্ধাত্রী পুজোয় চারদিন আনন্দে মাতোয়ারা হয় সবাই।ভুল বললাম আনন্দের মাপ করা যাবেনা,কিন্তু আমাদের শহরে জগদ্ধাত্রী পুজোর ধুমধাম একটু বেশিই হয়।আলো,থিমের প্যান্ডেল,শোলার সাজ পরা দোতলা বাড়ির সমান উঁচু প্রতিমা,বিসর্জনের আলোকিত শোভাযাত্রা, সবকিছু মিলিয়ে এক জমজমাট উপস্থাপন।অন্য শহর থেকে আসা অতিথিদের জন্য পথে ঘাটে উপচে পড়া এমন ভিড়,দুর্গাপুজোয় দেখা যায়না।

চন্দননগরের লাইটের কাজ পৃথিবী বিখ্যাত।জগদ্ধাত্রী পুজোয় সেসবের খোলামেলা প্রদর্শণী চলে।পুজো প্যান্ডেলের আলোকিত সাজসজ্জার সঙ্গে বিসর্জনের শোভাযাত্রার নিত্যনতুন আলোকসজ্জার কারিকুরিতে শিল্পের মাধুরী কোন দ্বিধা রাখেনা।আকাশে ডানা মেলা শিল্পীর ভাবনা,আমাদের কল্পনাকেও হার মানায়।

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত