| 20 এপ্রিল 2024
Categories
লোকসংস্কৃতি

দেবী সরস্বতী জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী । দেবলীনা রায়চৌধুরী ব্যানার্জি

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

জ্ঞানের দেবী সরস্বতী। বিদ্যা ও সুরের দেবী তিনি। সৃজনীশক্তির অধিষ্ঠাত্রী। তাকে নিয়ে জিজ্ঞাসা, কৌতূহল আবালবৃদ্ধবণিতার। সত্যি বলতে কি পৌরাণিক দেব দেবীরা বহুমাত্রিক। চরিত্র হিসেবেই হোক বা প্রতীক হিসেবে, এর গভীরতা অপরিসীম। দেশ কাল সীমারেখার গন্ডী পেরিয়ে অনেক কিছুই সঞ্চিত থাকে পৌরাণিকতার গভীরে। তিনি ‘বীণারঞ্জিত পুস্তকহস্তা’ কেন আর কেনই বা ‘নদীতমে সরস্বতী’।

বিদ্যা স্থানেভ্য নমঃ :

দেবী সরস্বতীর হাতে দেখা যায় পুস্তক বা বই। এই বই প্রতীকী। এর অর্থ হল যে তিনি জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী। পুস্তক বেদ, বেদাঙ্গ, বেদান্তের প্রতীক। অথার্ৎ তিনি বিদ্যার দেবী। অং থেকে ক্ষ এই পঞ্চাশ বর্ণের সমাহারে দেবী সরস্বতীর দেহ গঠিত। আবার কালীর মুণ্ডমালা পূজনের সময়ও উচ্চারিত হয় পঞ্চাশৎ বর্ণেভ্য় নমঃ। এখানেই সূক্ষ্মভাবে মিলিয়ে দেওয়া আছে দুই আপাত ভিন্ন শক্তির রূপকে। সরস্বত্যই নমো নিত্যং ভদ্রকাল্যেই নমো নমহ। অজ্ঞানতাকে হত্যা করে জ্ঞান। তাই একদিক দিয়ে এ কথা সত্য যে জ্ঞানের দেবী সরস্বতী ও তমোনাশকারিনী কালী মিলে মিশে এক হয়ে যায়।

বীণারঞ্জিতা :

এটি সত্য যে জ্ঞান এবং সৃজনশীল শিল্পের দেবী সর্বদা একটি বাদ্যযন্ত্র দেখা যায় এবং সেটি একটি তারের যন্ত্র।সরস্বতীর হাতে থাকে বীণা। গ্রিক সাহিত্য, রস ও নাট্যের অধিষ্ঠাত্রী মিউজদের দেখা যায় ‘লাইয়ার’ (Lyre ) বাজাতে, বেন্তেইন বাজায় একটি তারের বাদ্যযন্ত্র যা ‘বিওয়া’ (biwa) নামে পরিচিত। এই সাদৃশ্য বেশ আকর্ষণীয়। মানবদেহের স্নায়ুগুলি একটি বাদ্যযন্ত্রের তারের সাথে তুলনীয়। তারা অনেক ভাবেই সাদৃশ্যপূর্ণ। মানুষের স্নায়ুতে যেমন কম্পন হয় তেমনই একটি বাদ্যযন্ত্রের স্ট্রিং বা তারেও কম্পন হয় এবং দুটিই জিনিসই দুই বা ততোধিক বিন্দুকে যোগ করে। স্নায়ু মানবদেহের চক্র বা energy (শক্তি) পয়েন্টগুলিতে সংবেদন পাঠায় বা এক অংশ থেকে আরেক অংশে তা বহন করে নিয়ে যায় অন্যটি বাদ্যযন্ত্রের সেই সব অংশগুলিকে সংযুক্ত করে এবং সংযোগ সাধন করে। তাই তারের যন্ত্রের সাথে মানবদেহের একটা গভীর সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। সরস্বতীর বীণার সাথে মানবদেহের মস্তিস্ক, মেরুদণ্ড ও কক্সিস বা পুচ্ছাস্থির সাথে বেশ সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। গবেষক সুব্রমণিয়াম শর্মা তার বই “সন্ধ্যা বন্দনেয় তত্ত্বার্থ”-এ উল্লেখ করেছেন, যেখানে সাদৃশ্যগুলির স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। বীণার তুম্বা বা resonator-এর মতো মানব মস্তিষ্ক সমস্ত কম্পন গ্রহণ করে। স্ট্রিংগুলি মেরুদন্ডের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ এবং বীণার ফ্রেট বোর্ডে চব্বিশটি ফ্রেট বা আড়া রয়েছে যা মেরুদণ্ডের কশেরুকাগুলির মতো। কশেরুকার মতো ফ্রেটগুলির মধ্যে ক্রমান্বয়ে ক্রমবর্ধমান দূরত্ব রয়েছে। সেকেন্ডারি রেজোনেটর হল তলপেটের অংশ যেখানে মুলাধার চক্রের অবস্থান। যেখান থেকে কুলকুন্ডলিনী শক্তি উত্থিত হয় এবং সহস্রাতে পৌঁছায় । অর্থাৎ মেরুদণ্ড থেকে মস্তিষ্ক – এই পুরো structure বা গঠনটির আদলেই বীণার গঠনশৈলী। আবার স্যাক্রোকোসিক্স বা পুচ্ছাস্থি দেখতে অনেকটা বীণার মুল দণ্ডের শেষের ড্রাগনের মাথার মতো। সাধক ও বীণাবাদক এই দুইজনের মধ্যে এক অদ্ভুত সাদৃশ্য দেখা যায়। যেন বীণা বাদক কেবল যন্ত্রই বাজান না, বরং উপর থেকে নিচের energy point বা চক্রগুলিকে সংযুক্ত করেন (প্রতীকীভাবে)। স্ট্রিংগুলির কম্পন এমন তরঙ্গ তৈরি করে যা মস্তিষ্ক বা মাথার অংশকে মানুষের শরীরের নীচের অংশের সাথে সংযুক্ত করে রাখে।

অম্বিতমে সরস্বতী :

খেয়াল করেছেন কখনো যে জ্ঞানের দেবীকে প্রায়শই জলের সাথে সম্বন্ধিত? বেদে সরস্বতীকে নদীরূপে পূজিত করা হয়েছে। তাকে ঋষি ঘৃতসমিধ বর্ণনা করেছেন ‘অম্বিতমে নদীতমে দেবিতমে সরস্বতী’ অর্থাত্ মাতৃরূপে শ্রেষ্ঠ, নদীসমূহের মধ্যে সর্বশক্তিমান এবং দেবীদের মধ্যে সবচেয়ে বিশিষ্ট তিনি। উদয়পুর ও মেবারের মতো জায়গায় যে আদি সভ্যতার পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল তা বৈদিক শাস্ত্রে সরস্বতী সভ্যতা নাম পরিচিত। এই নদী শুকিয়ে যাওয়ায় গাঙ্গেয় সভ্যতা প্রাধান্য পায়। নদী বরাবরই ভারতীয় সভ্যতার মূল ভিত্তি। কৃষিকাজ, মাছ ধরা এবং পরিবহন সম্পূর্ণভাবেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ নদীর উপর ভিত্তি করে ছিল। নদীর পলি ও জল তীরসংলগ্ন অঞ্চলকে উর্বর করে জীবনকে জীবন ধারণের উপযোগী করে তোলে। প্রবাহিত জলও প্রতীকী অর্থে জ্ঞান সদৃশ। জ্ঞান যেমন বহমান নদীর জলও তাই। নিরন্তর প্রবাহিত হয় জ্ঞান; প্রগতির পথে। আবার ভূগর্ভস্থ সরস্বতী নদীর কিছু অংশ কয়েকটি ভৌগোলিক কারণে অন্তর্মুখী হয়ে যাওয়ার ফলে তা অন্তঃসলিলা হয়ে পড়লে, তার পাশের অঞ্চল জীবনধারণের পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে। এই ঘটনা, সম্ভবত, জ্ঞানের দেবী হিসাবে সরস্বতীর দেবীকরণের ধারণাকে বলবৎ করেছে। জ্ঞান, প্রজ্ঞা, প্রতিভা, বা দক্ষতা একজন মানুষের মধ্যেই নিহিত থাকে; এগুলো অদৃশ্য থেকেও বোধগম্য থাকে। এইভাবে নদী হিসাবে সরস্বতী এবং জ্ঞানের দেবতা হিসাবে সরস্বতীর মধ্যে সাদৃশ্যটি লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে। প্রকৃত প্রজ্ঞা, দক্ষতা, জ্ঞান মানুষের মধ্যে প্রবাহিত হয়, এটি অনুভব করা যায় কিন্তু অব্যক্ত, অগোচর হয়েই থেকে যায়। এটি এই সত্যকেও সঞ্চারিত করে যে, ভূগর্ভস্থ নদী যেমন ভূমির নীচ দিয়ে প্রবাহিত হয়, তেমনি প্রজ্ঞাও মানুষের মনে জোয়ার বয়ে আনে। জল প্রবাহিত হয়। এটি জীবনকেও টিকিয়ে রাখে। জল ছাড়া জীবন অসম্ভব কারণ এটি প্রতিটি জীবকে পুষ্ট করে। একইভাবে, জ্ঞানও মানুষের মস্তিষ্ককে লালন করে। জ্ঞান , চেতনা অন্তঃসলিলা থেকেও মানুষের জীবন যাপনের পথকে সুগম করে। এটা বলা যেতে পারে যে, জলের মতো জ্ঞানও প্রবাহিত হয় এবং পুষ্ট করে জীবনবোধকে। বিদ্যা , জ্ঞান অনুশীলন এবং অধ্যয়নের সাথে গতিময় ও বর্দ্ধিত হয়। এইভাবে প্রবাহের প্রকৃতির ভিত্তিতে জলের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হয়ে ওঠে বিদ্যা , জ্ঞান । তাই জল, নদী, ঝর্ণা এবং জ্ঞানের দেবীর মধ্যে সংযোগটি বেশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসেছে বিশ্বপুরাণে । গ্রিক পুরাণে বর্ণিত মাউন্ট অলিম্পাসের নিচে সরোবরের সাথে মিউজদের সংযোগ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। আবার সেল্টিক দেবী ব্রিগিডের নদী বা জলাশয়ের সাথে প্রত্যক্ষ কোনও সংযোগ না থাকলেও তার হাতে একটি জলের পাত্র দেখা যায়। এটি প্রতীকী ভাবে নদী এবং স্রোতের সাথে তার সংযোগ প্রমান করে। জলের পাত্র গর্ভের প্রতীক যার থেকে জন্ম নেয় সৃষ্টিশক্তি ও পুষ্টি। এই জলের পাত্র কেমন সরস্বতীর কমন্ডলুর কথা মনে করিয়ে দেয়। কিছু শাস্ত্রে সরস্বতীর হাতেও সৃষ্টিশীলতার গর্ভের প্রতীক হিসেবে কমণ্ডলু ধারণ করে থাকতে দেখা যায়। সকল ক্ষেত্রেই, জলের পাত্র বিশুদ্ধতা, সৃজনশীল শক্তি এবং দক্ষতা সংরক্ষণের প্রতীক।

জয় জয় দেবী চরাচর সারে :

প্যান্থিস্টিক সংস্কৃতি সম্পূর্ণভাবে প্রকৃতি নির্ভর সভ্যতা যা বিশ্বের প্রাচীতম অস্তিত্বের পরিচায়ক। প্রাচীন সভ্যতাগুলিতে যে সব উৎসব দেখা যায়, তা প্রথার চেয়ে বেশি প্রকৃতি নির্ভর । জ্ঞানের দেবীদের জন্য যে উৎসবগুলি পালিত হয় তা উল্লেখযোগ্যভাবে কিছু নির্দিষ্ট ঋতুর সাথে জড়িত। সরস্বতী পূজা বসন্তকালে অনুষ্ঠিত হয় বলে তা বসন্ত পঞ্চমী নামেও পরিচিত। এই উৎসবটি মাঘ মাসের পঞ্চম দিনে স্মরণ করা হয়। এই উৎসব হোলি বা বসন্তোৎসবের মোটামুটি চল্লিশ দিন আগে হয়। আবার Imbolc (ইম্বোলক) হল সেল্টিক বসন্ত উৎসব যা ফেব্রুয়ারির শুরুতে পালিত হয়, নভেম্বরে Samhain-এর (সামহেন) ঠিক তিন মাস পরে। ‘সামহেন’ শীতের সূচনা এবং ‘ইম্বোলক’ বসন্তের সূচনাকে চিহ্নিত করে। এইভাবে এই উত্সবটি শীতকালীন অয়নকাল এবং বসন্ত বিষুবের মধ্যবর্তী সময়ে। এটি সেন্ট ‘ব্রিগিড’স ডে’ নামেও পরিচিত, যার এ হেন নাম হয়েছিল সেল্টিক দেবী ব্রিগিডকে খ্রিস্টান সেন্ট হিসাবে চিহ্নিত করার পরে। এই উৎসবটি প্রাচীন সেল্টিক সভ্যতায় ‘ক্যান্ডেলমাস’ বা ‘ব্রিগ্যানসিয়া’ নাম পালিত হতো সেল্টিক দেবী ব্রিগিড, জ্ঞান, কারুশিল্প এবং আগুনের অধিষ্ঠাত্রী হিসেবে পরিচিত। প্রাচীন গ্রিসে, ‘প্যানাথেনিয়া’ উৎসব জ্ঞানের দেবী এথেনার জন্য পালিত হত। এই উৎসবটি Hekatombaion -এর শেষে উদযাপিত হতো যা গ্রিক lunisolar (চান্দ্র-সৌর) ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস। ঠিক যেমন আমাদের মাঘ মাস। এটি অ্যাটিক ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত। এই উৎসব হয় গ্রীষ্মের মৌসুমে আগস্ট মাসে। এই উৎসবটি দুই ভাবে অনুষ্ঠিত হতো । ‘লেসার প্যানাথেনিয়া’ প্রতি এবং ‘গ্রেটার প্যানাথেনিয়া’ প্রতি চার বছর অন্তর হতো। বুদ্ধি, জ্ঞান , ও দূরদর্শিতার দেবী এথেনার নিমিত্তে এই উৎসবে বিভিন্ন সাহিত্য ও দক্ষতামূলক কর্মকাণ্ড অনুষ্ঠিত হতো।

বিশ্বপুরাণে জ্ঞান, বিদ্যা, সুর, সৃজনীশক্তির গুরুত্ব যে অপরিসীম তা বলা বাহুল্য। তাই দেশ কালের গণ্ডী পেরিয়ে জ্ঞান, বুদ্ধি, সৃষ্টিশক্তিকে দেবত্ব আরোপ করা হয়েছে। ভিন্ন সভ্যতা , ভিন্ন ভৌগোলিকতা ভৌগলিকতা সত্ত্বেও সংস্কৃতির মূল সুরটি এক হয়ে গেছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত