| 20 এপ্রিল 2024
Categories
কবিতা সাহিত্য

দ্রাঘিমালণ্ঠন সিরিজ । সাজ্জাদ সাঈফ

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
 
 
 
০১.
দেখতে দেখতে আবার সরে গেছি ভিড় থেকে, হাততালি থেকে, যেখানে ঢেউটিনে ঠোকরায় মহাজাগতিক পাখি, যেখানে পিঠ থেকে ঝরে অবুঝ পালক পাখির, যেখানে সুবর্ণবোধে হাত নেমে রপ্ত করে ইশারা; আজকে সেখানে এসে আবার খুলেছি তারাভরা টালিখাতা, মাঠভরা ঘাসফড়িং, ঘরভরা গেরস্থালি আর যেনো ভুলে গেছি তোমার কথাও।
 
দেখতে দেখতে বাংলা কবিতার মজমা ছেড়ে বহুদূর এসে গেছি। শন-খড়ি পোড়ানো জ্বালে ফুটন্ত কেতলির চায়ে, চুমুক দিচ্ছি নিখোঁজ মানুষের মত!
 
এখানে গ্ল্যামার নাই, আর নাই বহুছাপা হবার মোহ-
কেউ চেনে না যেই ভাষার ঝনন আজকে আবার সেইখান থেকে শুরু করেছি হাঁটা!
 
 
 
 
 
০২.
 
পথের অনেক রূপ, কথার অনেক পিঠ আর সব বর্ণবৃত্তান্তের শেষে বহুভাষী পথকে আপন ভেবে এই দূরযাত্রা আমাদের। যেন বৃষ্টি এসে গেছে আর মাছ ধরা টেটা বিঁধে বাঘাড়ের বুকে ধড়ফড়-ধড়ফড় শুধু;
 
জ্বরপট্টির মত নরম একটা দিঘি আমাদের পথের সামনে থামে৷ যেন হাই তোলে রোদ, আমরা আত্মপীড়ন থেকে সরে এসে একত্রে হাঁটছি আবার। এই পথে কাঁটার পত্রালি, কোনো কোনো গাছ ‘কাছে ডাকা’ বোঝে; বহুদূর ঘুরেফিরে তুমি স্মৃতির কাছেই এসে বারবার নত হউ কেনো, এইবার বোঝা গেলো!
 
কেউ শোনেনি যেসব হাওয়ার ঝর্নাধ্বনি, আজ সেই হাওয়াধর্মে এসে বসে আছি একা। ধ্বনিসুর চিরে ছুটে আসছে তেপান্তর, ঘনিষ্ঠ ছায়ারা, শ্যাওলামাখা দেয়াল ধরে উঠে আসছে অনন্তগাছ, হৃদয়ে অভ্রান্ত হেরা পর্বত ছুঁড়ছে গোধূলি!
 
 
 
০৩.
 
নিমেষে বৃষ্টির দান নরোম করছে দালানকোঠা, তীক্ষ্ম করছে কান। এভাবে তুলসীগঙ্গা নদী, এভাবে শ্লেটে আঁকা উদ্যান ছুয়ে নেমে যাচ্ছে লেক, এভাবেই বুকের ব্যথারা নিজেদের পক্ষে ব্যাখ্যা তৈরি করছে রাতভর।
 
তুমি ঝিরিলাগা রক্তকরবী, আমাকে অনুগ্রহ করো।
ঘাট পেয়ে উড়াল থামানো পাখি, পরজন্মে আলোর পেখম মেলে!
 
এরপর ফিরে যাওয়া চলে এই পুলিশ আক্রান্ত সমাজের ডেরা ছেড়ে।
 
আর হ্যাঁ প্রফুল্লতা, কতই না খুঁজেছি তোমাকে, রেললাইন পারি দিয়ে ঘুপচি ঘরের আলোরা তদ্রূপ দীর্ঘতর, দালানে চাপা পড়া ফুটবল মাঠ আর গলায় বিঁধে যাওয়া মাছের কাঁটার ফুরসতে কতই না খুঁজে হয়রান হলো মন! তুমি আজ রাত্রিদিবস গ্লানি, সমাজের নাকের সমান উঁচু সব বিলাসিতা নিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছো বোধ আর সব ভোঁতা বুদ্ধির ভারে থেঁতলে যাচ্ছে মানুষ, তোমার কি বুক কাঁপে না বলো?
 
 
 
 
৪.
 
বুক ভরে যাচ্ছে পাথরে, একটা বুক হু-হু করা দুপুর আঁছড়ে পড়ছে পাথরে, পাশেই আলতাগাঙ, সাঁকোয় বসেছো তুমি, কতকাল এই বসে থাকার ভিতর তুমি আলো, ফিনফিনে লতার নাচনে হেলে আসা ডাল-
 
এত যে পাথর ও প্রমাদের ভীড় বুক ধড়ফড় তীব্র করে!
এত যে স্মৃতির আঘাত আসে, ফেলে আসা বাইসাইকেল বেয়ে!
তার ভিতর অগোছালো তুমি, আর খুব বৃষ্টি হবে এমন দুরু হাওয়ায় মেঘ ভর করে আছে;
 
দিকবিদিকশুন্য হাওয়ার ভিতর পেঁচিয়ে যাচ্ছে হাওয়া, পেঁচিয়ে যাচ্ছে মানবজন্মের ঠাট্টা ও কৌতুক!
 
 
 
 
০৫
 
অজ্ঞাত সম্রাট তার গ্রীস্মের ছুটি পেয়ে
জীবন্ত নেমে এলো গানে ও গসপেলে
 
আর দেখো কলমে জমেছে রাত, শান্ত ও সুরভিত চোখ;
এতো ধান স্বপ্নে বেড়ে ওঠে, এতো স্মৃতি প্রশান্ত করেছে মুখ;
এত সমস্ত শিল্পসন্ন্যাসে বসে কারো মনে পড়ে আগজন্মের অভিশাপ? কারো শুধু বিদ্রূপ ভর করে অন্তরে!
 
ঘুরে আসে ডুমুর কুড়ানো বিল, মেঘনাচারিনী মেঘ, সব কথা লিখিত কিতাবে পাবে, সব ধ্বনি মন্ত্রের গুঞ্জন!
 
সারারাত্রি, বেতফল ঝরে নাকি বুকে? এমন বিধুর পথ মেলে আছে, তোমার সব অক্ষর; বনমালী বাস করে সেই পথের ধারে, রাত জেগে পালাগান বাধে কেউ।
 
এতসব প্রশ্নের মুখে চুপ থাকে একাকীত্ব, করোটি জাগিয়ে রাখি ত্রিবলিরেখায়, প্রিয় সব নামের অক্ষর খুলে সাফ করে দিই বিক্ষতদাগ!
 
 
 
 
 
০৬
 
যেতে যেতে বাংলা ভাষার ভিতর এক খরতপ্ত মাঠের সাথে দেখা, ওপরে ভ্রমণকাতর মেঘ, দুই ধারে দ্বিধার মতন ভারি সব জনপদ নিয়ে বইছে যমুনা;
 
যেতে যেতে পিছনে তাকানো ভ্রু এক জন্মে আয়ত্ত করেছে অসুখ, খুনে গর্দান আর আততায়ী নিঃশ্বাস ঘাড়ের ওপর;
 
এইদিকে আলপথ হয়ে দু-ভাগে বিভক্ত বাংলা কবিতা, এইদিকে নিধুয়া পাথার এসে নেমে গেছে গীতিছন্দে-
 
এত রঙ এত স্বর-ব্যাঞ্জন ঘিরে আছে যেন আমাদের দেখা হবে নির্ভুল পয়ারে! ঘরে বসে জানালায়, দূর ট্রেন অজগর লাগে; নগরীকে দৃশ্য লাগে সারাটি বছর যেন হাত আর হাতের ওপর হতে সরাবে না ছোঁয়া চিরকাল;
 
রোজ বুধবার, হাটের ইজারা বুঝে নিয়ে পিক ফেলে পান খাওয়া ঠোঁট; এভাবেই ব্যস্ত জনতার দিকে সাবগ্রাম হাট ছুঁড়ে দেয় খড়বর্ণ, শ্যামল দূর্বাঘাস!
 
কেউই দেখেনি আগে বিকাল সুফলা অমন
যেতে যেতে কোনো কোনোদিন কেউ
পিছুটান টের পাওয়া হৃদয় খামচে ধরে!
 
 
০৭
 
মুভির ভূতের মত আওয়াজ করে চলে গেল অনতিদূর ট্রেনের বগি, পাবে মেঘমাখানো আকাশের দেখা, কত নির্জন বুকে চলে কাঠচেরাইয়ের কল, কত বুক মহাশূন্য
 
আর নিজ বিষয় আশয় ফেলে এসে দূর মফঃস্বলে
ঘর যে বেঁধেছে হাওয়ায়, তাঁকে পাবে নিঃসম্বল
বার্ধক্যে, অথচ তাঁহার শব্দ জমানো ঝোঁক আর
বইপত্রে ঠাসা মস্তিষ্কে ছিলো শনে বাঁধা গেরস্থালি
সামান্য আলোয় ফোটা এক ফুল দুই পত্রের প্রেম
একদিন, কোনো একদিন প্রেমে!
 
মুভির ভূতেরা যেন খামচে ধরেছে গলা
শোক নেই, প্রতিরোধ নেই, শুধু কবিতার ছলে
বুনে রাখা আছে জীবনাবৃত্তি!
 
প্রেম এক সুজলা প্রার্থনা, কখনো সে পাপ।
যেন রক্তও ছাড়ে না রক্তরে পণ গুনে, প্রেমের মাশুল!
 
 
 
 
 
০৮
 
এতো যে নিস্তরঙ্গ লাগে, দাঁড়টানা মেঘ নিয়ে হাবুডুবু মস্তিষ্ক-
থামা নেই এরকম রেডিওর গান মনে করি, মনে করি সাতানব্বুই সাল পেয়ে থেমে আছে মালতীমদিরা চাঁদ, মেঘের ফাটলে উঁকি দিচ্ছে তার আলো।
 
এতো যে নীরবতা নিয়ে চেয়ে আছে বাজারের ব্যাগ, গলা উঁচা চিচিঙ্গা, ভারাক্রান্ত লাগে নাকি তোর, ধীরে ওড়া ঘুড়ির মতন সরু গলায় ডাকে নক্ষত্র নাকি সুপ্ত কোনো গ্রহ?
 
যে আজো নিজেকে দেখতে জানে না তার ঘর আলো করে আছে মুঘলবর্ণ ঝাড়; সেইদিকে চেয়ে থেকে গাঙে যে ঢেউ ওঠে তার বুকে এসে মিয়া তানসেন, জপ করে নাকি কালরাত্রি?
 
মনে হয়তো-বা ঘুড়ি ওড়াচ্ছে কেউ, আর কারো মুখস্থ জ্ঞান হতে সানাই বাজায় আহসান মঞ্জিল!
 
 
 
 
 
০৯
 
যারা প্রকৃত কবিতা লেখে তারা ভাবে কেউই শত্রু নয় এক জীবনে, তারা ভাবে তাবড় হরপ্পা এসে তাদের বুকে আয়েশ পেয়ে ঘুমায়, তিস্তাবাধের ওপর বসে দ্বন্দ্ব সমাস রৌদ্র পোহায়!
 
চোখের ভিতর মেন্দি পাতার ঝিরি, মাথার ভিতর মাঘের শুকনো খাল! গরুকে বুঝিয়ে দিয়ে ঘাসের মহাল, ঘুমিয়ে পড়েছে রাখাল;
নাকি সেও মহাকাল? মেঘ থেকে নেমে আসা সবুজ টিলার বাঁকে শুয়ে মানুষের ভান সওয়া চোখ জুড়ে তন্দ্রা এসে গেছে তার!
 
 
 
 
১০.
 
চেয়েছিলাম ছায়ার পত্রালি আর কিছু অভিমান-পিছুটান; চেয়েছিলাম কলোনির ছাল ওঠা ছাদ, হাঁসেদের সাঁতার কাটা সুর। ততোধিক চাইনি কিছুই আমি, আর এত সমস্ত চাওয়া-পাওয়ার ধারে তোমাকে অগ্নিগর্ভ লাগে, সুরমাটানা লাগে দুই চোখ, কবিতায় কতটা জেগেছো রাত?
 
হাত ফেলে ছুটে যাচ্ছে ছোঁয়া, কিছুদিন শিরিষের ডালে মেঘ।
গান থেকে আলগা হচ্ছে কথা, কিছুদিন একাকীত্বের ভীতি।
 
দেশ থেকে ছিটকে পড়েছে প্রেম, চিরদিন বিরহ বাস্তবতা যার
ঘুরপথে তার দিকে ছুটে আসে একঘেয়েমি! কোথা থেকে কান্না শিখেছো তুমি? কতটা দূর রিলকে ফোটায় গোলাপ?
 
আমার মতন ধৈর্য হারানো নাবিক, তোমার বুকে সমুদ্র পাড়ি দেবে! হৃদয়ে কাঠের সাঁকো নড়ে আর সন্ধ্যায় চাষের জমিতে হাঁটে শূকর সম্প্রদায়!
 
এই গ্রহ শৃঙ্খলিত কোনো পোপের তর্জনীতে।
সারারাত রাজ করে মগজবাগানে সাপ, বিষধর সাপ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত