| 19 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক

ইরাবতী ধারাবাহিক: একাকিনী (পর্ব-১২) । রোহিণী ধর্মপাল

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
 
কাল পাঞ্চালী যাত্রা শুরু করবেন হস্তিনাপুরের উদ্দেশ্যে। শাশুড়িমা আর পাঁচ স্বামীর সঙ্গে। এই প্রথম বার, সম্পূর্ণ অজানা পরিবেশে। একা। যতই পাঁচ স্বামী সঙ্গে থাকুন। তাঁরা তো ফিরছেন পরিচিত পরিবেশে। তিনি তো একাই। মেয়েরা একাই যায়। অচেনা, নতুন পরিবেশে। তাদের প্রথম থেকেই মানসিক ভাবে প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। তবু, পাঞ্চালীর পরিস্থিতি একেবারে অন্যরকম। তিনি জানেন, শুরু থেকেই জানেন, তিনি চলেছেন শত্রু রাজ্যে। বাবার শত্রু তো বটেই। তাঁর নিজের শত্রুও। দুর্যোধন দুঃশাসন এবং…এবং কর্ণ। একটি মানুষকে ভালোবাসা অর্জনের জন্য যোগ্য হতে হয়। ভালোবাসা পাওয়ার জন্যও। একটি মেয়ের কাছে প্রেমে ব্যর্থ হলে অধিকাংশ পুরুষ অভিযোগের আঙুল তোলে মেয়েটির দিকেই। আর এখানে, দ্রৌপদীর স্বয়ংবরে, দ্রৌপদীর মন নিয়ে তো কেউ ভাবেনই নি! সেখানে তো দ্রৌপদী বীর্যশুক্লা, অর্থাৎ যিনি লক্ষ্যভেদ করবেন, তিনিই দ্রৌপদীকে পাবেন। অর্থাৎ এখানে তো মনের লড়াই ছিলই না। ছিল শুধু শরীরী আর অস্ত্রজ্ঞানের লড়াই। সেখানেও ধনু তুলতে পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছেন সবাই। বৃথা পুরুষত্বের অহংকারে আরও তীব্র আঘাত লেগেছে। তার ওপর কর্ণ শুনেছেন দ্রৌপদীর “না”। সেই ক্ষত তো দগদগে ঘায়ের মতো হয়ে আছে। না, পাঞ্চালী অবশ্য ভাবছেন না এত কিছু। তিনি তো অর্জুনের গন্ধে বিভোর হয়ে আছেন। তিনি ভুলে গেছেন আগের কথা। ভবিষ্যত কেমন হবে, তাই নিয়েও চিন্তা করছেন না। শুধু ভাবছেন তৃতীয় পার্থকে কবে পাবেন!
ভাবছেন শুধু দ্রুপদ।
 ভাবছেন। কারণ তাঁর এত বছরের ধৈর্য্য ধরে থাকার, ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা করার, সমস্ত কিছু গোপন করে রাখতে পারার ফল পেতে তিনি শুরু করেছেন। সহজ ছিল না কোনও কিছুই। শুরু থেকেই। তিনি দুঃস্বপ্নেও কখনও ভাবেন নি চালচুলোহীন এক ব্রাহ্মণ তাঁকে, পাঞ্চালের রাজাকে এইভাবে অপমানিত করতে পারবে! হ্যাঁ। তিনি ঠিক কাজ করেন নি। নিজের ভুল নিজের কাছে অন্তত তিনি স্বীকার করেন। সহপাঠী দ্রোণকে গুরুগৃহে তিনি বলেছিলেন, “আমি বাবার প্রিয়তম পুত্র। আমি রাজা হলে সেই রাজ্য আমার মতোই তোমারও হবে”। তবে তা ছিল এক কিশোরের তখনকার আবেগমাত্র।  সেই কথাকেই যে দ্রোণ এমনভাবে মনে রেখে দেবেন আর সোজা চলে আসবেন দ্রুপদের রাজসভায়, স্ত্রী-পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে, একথা দ্রুপদ ভাবতেই পারেন নি। সত্যি বলতে কী, তিনি কৈশোরের  এ সব কথা ভুলেই গেছিলেন! তাও যদি দ্রোণ আলাদা ভাবে তাঁর কাছে আশ্রয় চাইতেন, তিনি না করতেন না হয়ত। কিন্তু একেবারে সবার সামনে দ্রোণ সেই অদ্ভুত দাবীটি করতে এলেন! জরাজীর্ণ কাপড়ে “বন্ধু” বলে জড়িয়ে ধরতে গেলেন! দ্রুপদ দেখলেন সভার সমস্ত মানুষ অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে। কী করতেন তখন তিনি! সেই বন্ধুত্ব মেনে নিলে বাকি সব কিছুই মেনে নিতে হতো। রাজপুত্র হয়ে যে কাজ করা যায়, রাজা হয়ে সবসময় তা করা যায় না। তবে তিনিও বড় বেশি রুক্ষ ব্যবহার করেছিলেন। আসলে, দ্রোণকে দেখেই তাঁর মনে পড়ে গেছিল সেই সব কথা– যা তিনি কখনও পালন করবেন না। তাই মনের অপরাধবোধ ঢাকা এবং সদ্য সদ্য রাজা হওয়ার গরিমা আর ক্ষমতা হাতে আসার দম্ভ; সব মিলিয়ে অতিরিক্ত কঠোর হয়ে গেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, “ন শূরস্য সখা ক্লীবঃ সখিপূর্বং কিমিষ্যিতে। নহি রাজ্ঞামুদীর্ণানামেবম্ভুতৈর্নরৈঃ ক্কচিৎ ।। ক্লীব কখনও রাজার বন্ধু হতে পারে না। আর এমন শ্রীহীন মানুষ কী করে এইরকম রাজার বন্ধু হয়!! তোমাকে এমন কখনও বলেছি নাকি যে আমি তোমার সখা! কী মতলবে তুমি এসেছ এখানে! বড়জোর আমি তোমার একবেলার খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারি! তার বেশি কিছুই না”!এই কথা শোনামাত্র দ্রোণ সভা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। অস্বীকার করে লাভ নেই, বেশ কয়েকদিন মনের মধ্যে একটু খচখচ করেছিল বটে। তারপর দ্রুত আবার তিনি সব ভুলে গেলেন। রাজার দায়িত্ব কী সোজা নাকি! তার ওপর পাঞ্চালের মতো শক্তিশালী এক রাজ্যের রাজা তিনি! কিন্তু দ্রোণ যে সেই অপমান ভুলবেন না, এইভাবে ফিরে আসবেন আর এমন প্রতিশোধ নেবেন, তার একটুও আঁচ যদি পেতেন আগে! আর অর্জুন! এমন ক্ষুরধার হাতিয়ার যার সঙ্গে থাকে, সে তো যুদ্ধ জিতবেই।

আরো পড়ুন: ইরাবতী ধারাবাহিক: একাকিনী (পর্ব-১১)


হ্যাঁ। অর্জুনকেই তিনি অস্ত্র বলছেন। যে অস্ত্রের হাতে পড়লে সাধারণ ধনুর্বাণও অসাধারণ হয়ে যায়। দ্রুপদ পরে জেনেছিলেন যে তাঁর কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে দ্রোণ চলে গেছিলেন হস্তিনাপুরে। সেখানে কৃপ আর ভীষ্মের আগ্রহে রাজি হয়েছিলেন কৌরবদের অস্ত্রগুরু হতে। তিনি চাইছিলেন স্বপক্ষে একদল অতুলনীয় যোদ্ধা আর রাজশক্তি। অপরদিকে, ভীষ্ম চাইছিলেন এমন এক শিক্ষক, যিনি কৌরবদের অপারেজয় করে তুলবেন। ধার্তরাষ্ট্র আর পাণ্ডব, সবাইকেই শেখাতে শুরু করলেও প্রথম থেকেই দ্রোণের নজর পড়েছিল অর্জুনের দিকে। তিনি বুঝেছিলেন, এই সেই ছেলে, যে একাই শত সহস্র পারঙ্গম যোদ্ধার মোকাবিলা করতে পারবে। রাজপুত্রদের শিক্ষা সম্পূর্ণ হতে তাই তিনি দক্ষিণারূপে চেয়েছিলেন দ্রুপদকে। পাঞ্চালরাজকে অক্ষত অবস্থায় তাঁর সামনে নিয়ে আসতে হবে। এইই ছিল তাঁর ইচ্ছা।
 কিশোর অর্জুন যখন তীর ছুঁড়ছিল, একের পর, ঘন অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিল আকাশ। কারণ দুটি তীরের মাঝে যেন কোনও ফাঁক থাকছিল না। ওইটুকু এক ছেলে দ্রুপদের সেরা সব যোদ্ধা, এমনকী, সখা সত্যজিতের মতো নিপুণ যোদ্ধাকেও হার মানালো। দ্রুপদের সৈন্যদের পর্যুদস্ত করে দ্রুপদের নিজের ধনু তীর দিয়ে ভেঙে, সারথি আর ঘোড়াদেরও অকেজো করে রথে লাফিয়ে উঠে দ্রুপদকে ধরে দ্রোণের কাছে নিয়ে গেল! মিষ্টি হেসে দ্রোণ দ্রুপদকে অর্ধেক রাজ্য আর বিপুল অপমান সহস্রগুণ বেশি করে ফিরিয়ে চলে গেলেন। সেই দিন থেকে দ্রুপদের মনে দুটি চিন্তা খোদিত হয়ে গেল। অর্জুনকে পাশে পেতে হবে আর অর্জুনের মাধ্যমেই দ্রোণকে জবাব দিতে হবে। কিন্তু কিভাবে?? অর্জুন তাঁকে মানবে কেন? গুরুর শত্রুকে সে কখনও মন থেকে মেনে নেবে কী! সে গুরু যতোই ক্ষমা করুন না কেন!! আর এমন এক উপযুক্ত সন্তানের জন্ম দিতে হবে, যে দ্রুপদের দুই হাতকে আরও শক্তিশালী করে তুলবে।
কারণ আগের যে সব ছেলেপুলে তাঁর ছিল, কেউই এই কাজের উপযুক্ত ছিল না। নাস্তি শ্রেষ্ঠমপত্যং মে ইতি!! পুত্র হোক বা কন্যা, এমন সন্তান, এমন অপত্য তাঁর চাই। দ্রুপদ মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। কিভাবে পাবেন এমন সন্তান, যাকে নিজের অপমানের বদলা নিতে কাজে লাগাতে পারবেন!
 তিনি খোঁজ করতে শুরু করলেন। অত্যন্ত গোপনে। একেবারে বিশ্বস্ত চরেদের দিয়ে। তাঁর ইচ্ছেমতো তো সন্তান জন্মাবে না!   আবার যে জন্মাবে, সে যদি আগের মতোই অপদার্থ হয়! তিনি কোনও ঝুঁকি নিতে চান না। তাহলে? কেমন ভাবে তাঁর মনোবাসনা পূর্ণ হবে? কেমন ভাবে তিনি এমন কাউকে পাবেন, যাকে তিনি তাঁর মতো করে তৈরি করতে পারবেন? যে হবে অর্জুনের মতোই ধারালো? ঝাঁঝালো? চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে যার অস্ত্রে ঘায়েল হবে শত বীর?

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত