Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,দ্রৌপদীর

ইরাবতী ধারাবাহিক: একাকিনী (পর্ব-৪) । রোহিণী ধর্মপাল

Reading Time: 4 minutes
তিনি ভারতসম্রাজ্ঞী। অথচ পারিবারিক কোন্দল আর ঈর্ষার কারণে সভামধ্যে পরিবারের মানুষেরাই কাপড় খুলে তাঁকে উলঙ্গ করার চেষ্টা করল। রাজকোষ পরিচালনার দক্ষতা যাঁর ছিল, তাঁকে সাজগোজ করানোর কাজ নিতে হল। যাঁকে চেয়েছিল ভারতবর্ষের তাবৎ পুরুষ, তিনি নিজের বাঞ্ছিত প্রেম পেলেন না। দুইটি পুরুষের পারস্পরিক প্রতিহিংসা সাধনের কারণে তাঁর নিজের জীবন ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল। নারী যুদ্ধের কারণ? না পুরুষের অহমের আগুনে নারী বলিপ্রদত্ত জন্ম থেকেই? একাকিনী। এক নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখব তেজে ভরপুর অথচ একা এক নারীকে। আজ থাকছে একাকিনীর পর্ব-৪।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,দ্রৌপদীর
উপরে দেওয়া প্রাচীন ভারতের ম্যাপটি লক্ষ করুন। পাঞ্চাল আর কুরু রাজ্য কতখানি কাছাকাছি। গঙ্গা আর যমুনা যেমন পাশাপাশি বয়ে যাচ্ছে, তেমন কুরু-পাঞ্চাল রাজ্য। যদিও দ্রোণ দ্রুপদের অর্ধেক রাজত্ব নিয়েই ছেড়ে দিয়েছিলেন, কারণ দ্রুপদ কোনও একসময় দ্রোণকে অর্ধ রাজ্য দেওয়ার কথাই বলেছিলেন, অথচ নিজে রাজা হওয়ার পর সেই কথা রাখেননি; কিন্তু কুরু রাজ্যকে ভরসা করার কী আছে! দুর্যোধন সিংহাসনে বসলেই তো সাম্রাজ্য বাড়ানোর জন্য সচেষ্ট হবেন। আর পাঞ্চাল রাজ্য তো সবরকমে হাতের কাছে। হাতের মুঠোয়। 
মহাভারত যত এগিয়েছে, দ্রৌপদীকে যত দেখেছি, চিনেছি, দেখেছি এক অসামান্য তেজস্বিনী মেয়েকে। বুদ্ধিমতী, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন, সংসারের রাজনীতি নিয়ে পূর্ণ সচেতন, প্রতিবাদী, দৃঢ় চরিত্রের এক মেয়ে। যদি এমন ভাবি, যে দ্রুপদ দ্রৌপদীর সঙ্গে পাঞ্চাল রাজ্যের ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা করতেন, তাহলে কি খুব ভুল ভাবনা হবে? আর রাজ্যকে বাঁচানোর উপায় একমাত্র অর্জুনকে নিজেদের দলে টানা। এখনকার ভাষায় পটানো। আর তাঁকে একেবারে জামাই করে নিতে পারলে তো কেল্লা ফতে! বাকি চার ভাইও দ্রুপদের পক্ষেই কথা বলবেন। দ্রুপদের পাশেই দাঁড়াবেন। সুতরাং জতুগৃহের লেলিহান আগুন থেকে যদি তাঁরা পালিয়ে যেতে পারেন, এবং দ্রুপদের বিশ্বাস ছিলই যে পাণ্ডুপুত্রদের এত সহজে মেরে ফেলা যাবে না, তবে এই একটিই সহজতম উপায় তাঁদের খুঁজে পাওয়ার। তাই দ্রৌপদীকেও হয়ত বলাই ছিল যে অর্জুন নয়, এমন কোন ক্ষত্রিয় যদি শর্ত পূরণের কাছাকাছিও যায়, তিনি কোনও না কোনও কারণ দেখিয়ে তাঁকে বাতিল করবেন। কারণ শুধুই সূতপুত্র বলে কর্ণ যদি প্রত্যাখ্যাত হয়ে থাকেন, তবে ধৃষ্টদ্যুম্নের পূর্ব শর্ত অনুযায়ী তাঁর তো প্রতিযোগিতায়  অংশগ্রহণ করারই অধিকার নেই। তাই যখন কর্ণ উঠলেন, মনে রাখতে হবে কর্ণ কিন্তু কোনরকম তাড়াহুড়ো করেন নি, প্রায় সকল রাজার হার দেখে তারপর ধীরেসুস্থে উঠেছেন। তখনও দ্রৌপদী না বলেন নি। যখন তিনি ধনুতে গুণ পরিয়ে ফেলে লক্ষ্যভেদে উদ্যত হয়েছেন, ‘না’ শব্দটি দ্রৌপদীর মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল। যে এই ব্যক্তি একে তো অর্জুন নন। তার উপর যে কুরুরাজ্য থেকে বাঁচার জন্য তাঁদের এই এত বড় আয়োজন,  কর্ণ তে সেই কুরুরাজ্যের বর্তমান উত্তরাধিকারী দুর্যোধনের সবথেকে কাছের বন্ধু। তাই সেই মুহূর্তে দ্রৌপদী বুঝলেন এই মানুষটিকে আটকাতেই হবে। নিজের স্বার্থে নয়। মাতৃভূমির স্বার্থে। আর ধৃষ্টদ্যুম্নের তিনটি শর্ত অর্থাৎ উচ্চবর্ণ, মনোহর রূপ আর অসাধারণ বলশালী– এই তিনটি কথার মধ্যে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শর্তটি কর্ণের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই প্রযোজ্য ছিল না। অসাধারণ বলশালী না হলে অনায়াসে ওই ধনুতে গুণ পরাতে পারতেন না, যেখানে জরাসন্ধ বা শিশুপালের মতো বীরও আগেই ধরাশায়ী হয়েছেন। রূপও নিশ্চয়ই মনোহর ছিল। দ্রৌপদীর মনের মতো না হলেও। সুতরাং ওই মুহূর্তে, কর্ণকে আটকানোর ওই একটি উপায়ই ছিল। একবার চিন্তা করে দেখুন, কতখানি ঠাণ্ডা মাথায়, একেবারে শেষ ক্ষণে, লক্ষ্য ভেদ করতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত দ্রৌপদী অপেক্ষা করেছেন। তারপর বাতিল করেছেন। আর আরও একটি কথা। দ্রৌপদীর কথার প্রতিবাদ কর্ণ যেমন করেন নি, উপস্থিত আর কেউই তো করেন নি! এমনকী, কর্ণের প্রিয়তম সখা দুর্যোধন পর্যন্ত নীরব রইলেন। নয় নিজেদের হারের লজ্জায় কথা বলার মুখ ছিল না, অথবা সকলেই মনে করেছিলেন, সত্যিই তো কর্ণ আসলে সূতপুত্র। তাই কিভাবেই বা দ্রৌপদীর কথার প্রতিবাদ করা যায়!
অথচ সেই সব রাজারা অনায়াসে  সিদ্ধান্ত নিলেন দ্রুপদ ও ধৃষ্টদ্যুম্নকে হত্যা করার। হন্মৈনং সহ পুত্রেণ দুরাচারং নৃপদ্বিষম্ (১৮৩ অধ্যায়, ৪র্থ শ্লোক,  পৃঃ১৮২২, আদিপর্ব)। এবং রে রে করে অস্ত্র নিয়ে দ্রুপদকে বধ করার জন এগোলেন।

তাঁরা তো তখনও জানতেন না অপরপক্ষটি কারা! ভীম একটি বিশাল গাছ তুলে তার ডালপাতা ছেঁটে তাকে লাঠির মত তুলে তৈরি হলেন। আর তাঁর পাশে ধনু তাক করে দাঁড়ালেন। একমাত্র সভায় উপস্থিত কৃষ্ণ চিনতে পেরেছিলেন পাণ্ডবদের আগেই। এবং সঙ্গে আসা দাদা বলরামকেও চিনিয়ে দিয়েছিলেন বামুনের ছদ্মবেশে বসে থাকা পাঁচ ভাইকে। কৃষ্ণ জানতেন পাণ্ডবরা যদি জতুগৃহের আগুন থেকে বেঁচে থাকেন, তবে এই স্বয়ংবর সভায় আসবেনই।
আর সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন আর একজন। কর্ণ। ওই সভাগৃহেই লড়াই শুরু হওয়ার পর অর্জুনের তীর চালানোর দক্ষতা দেখে, তাঁর শক্তি আর স্ফূর্তি দেখে কর্ণ বলেছিলেন, তুমি নয় ইন্দ্র। অথবা অর্জুন। কারণ আমি রেগে গেলে আমার সঙ্গে যুদ্ধে মোকাবিলার ক্ষমতা এই দুনিয়ায় কেবল এই দুজনেরই আছে। এবং শেষ পর্যন্ত অর্জুনের কাছে বারবার হেরে গিয়ে তাঁকে ব্রাহ্মণ জেনেই ব্রাহ্ম তেজকে অপরাজেয় মনে করে তিনি চলে গেলেন।
 এবারে একটু বলি, অর্জুনকে খোঁজার জন্য দ্রুপদ প্রায় অসম্ভব একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন। প্রথমেই তিনি বিশেষ অর্ডার দিয়ে এমন একটি ধনু তৈরি করালেন, যা প্রায় হরধনুতুল্য। যা সহজে কেউ নোয়াতেই পারবে না। বিরাট বলশালী  না হলে। তারপরে অনেকটা উঁচুতে একটি কৃত্রিম যন্ত্র তৈরি করালেন। তারও ওপরে রইল মূল লক্ষ্যটি। অর্থাৎ ঐ বিরাট ভারী ধনুটি তুলে, তাতে গুণ পরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে একটি যন্ত্রের ছিদ্রের মধ্যে দিয়ে লক্ষ্যভেদ করতে হবে। আর একটি বাণ নয়। পর পর পাঁচটি বাণ দিয়ে বিদ্ধ করতে হবে সেই লক্ষ্য। দ্রুপদ নিশ্চয়ই দ্রোণের সেই পাখির চোখের লক্ষ্যভেদের গল্প শুনেছিলেন। আর সেই গল্পের ভিত্তিতেই অনুমান করেছিলেন যে এমন আশ্চর্য মনঃসংযোগের ক্ষমতা অর্জুন ছাড়া আর কারুর হওয়া শক্ত।

 মজা হল এই যে পনেরো দিন ধরে অপেক্ষার পর ষোল দিনের দিন যখন স্বয়ংবর সভায় কৃষ্ণা দ্রৌপদী স্নান করে, মহার্ঘ্য বস্ত্র ও সোনার মালাটি গলায় দিয়ে সভায় প্রবেশ করলেন, এতক্ষণ চুপ করে থাকা রাজারা একেবারে পাগলা হাতির মতো আস্ফালন শুরু করলেন। সকলেই বলতে থাকলেন, দ্রৌপদী আমারই হবেন। এমনকি বন্ধু রাজারাও যেন কিছুক্ষণের জন্য পরস্পরের শত্রু হয়ে উঠলেন। এমন অসাধারণ রূপ ওই কালো মেয়ের। পদ্ম ফুলের মতো চোখদুটি, দেহের প্রতিটি অঙ্গ থেকে লালিত্য আর যৌবনমদ ঝরে পড়ছে, ক্ষীণমধ্যা অর্থাৎ কোমরটি কিন্তু এতই সরু যেন মুঠোর মধ্যে ধরা যায়, শরীরের সুগন্ধ এমন যা এক ক্রোশ থেকে পাওয়া যায়, কালো রঙে যেন নীলচে আভা বিদ্যুতের মত খেলা করছে। এমন মেয়েকে দেখে উপস্থিত সকলেই কামার্ত হয়ে উঠলেন। এমনকী পঞ্চ পাণ্ডবও। 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>