আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিটতিনি ভারতসম্রাজ্ঞী। অথচ পারিবারিক কোন্দল আর ঈর্ষার কারণে সভামধ্যে পরিবারের মানুষেরাই কাপড় খুলে তাঁকে উলঙ্গ করার চেষ্টা করল। রাজকোষ পরিচালনার দক্ষতা যাঁর ছিল, তাঁকে সাজগোজ করানোর কাজ নিতে হল। যাঁকে চেয়েছিল ভারতবর্ষের তাবৎ পুরুষ, তিনি নিজের বাঞ্ছিত প্রেম পেলেন না। দুইটি পুরুষের পারস্পরিক প্রতিহিংসা সাধনের কারণে তাঁর নিজের জীবন ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল। নারী যুদ্ধের কারণ? না পুরুষের অহমের আগুনে নারী বলিপ্রদত্ত জন্ম থেকেই? একাকিনী। এক নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখব তেজে ভরপুর অথচ একা এক নারীকে। আজ থাকছে একাকিনীর পর্ব-২।
মহাপ্রস্থানের পথে, ঠাণ্ডা কঠিন সেই পাথরে শুয়ে দ্রৌপদীর মনে হল, তিনি উত্তেজিত হয়ে থাকলেও অর্জুনের দেহ বোধহয় এমন পাথরের মতোই কঠিন আর ঠাণ্ডা ছিল। মনটাও। তাই, রাজধানীর কাছে এসে তাঁকে নামিয়ে দেওয়ার সময়, কই, একবারও তো তাঁকালেন না! একটি কথাও বললেন না। বরং ব্যস্ত হয়ে পড়লেন অস্ত্রশস্ত্রের কী ব্যবস্থা করা যায়, তাই নিয়ে। যুধিষ্ঠিরও সঙ্গে সঙ্গেই জিজ্ঞেস করলেন অর্জুনকে, “তুমিই বলো অর্জুন! এইসব কিছু কোথায় লুকিয়ে রাখা যায়”?
অর্জুন তৎক্ষণাৎ বললেন, “আর একটু এগোলেই শুরু হচ্ছে হিংস্র শ্বাপদে ভরা এক বন। হয়ত ইচ্ছা করেই এই বনকে একপাশে রেখে রাজধানী নির্বাচন করেছিলেন ভূয়োদর্শী রাজা বিরাট। রাজধানী এই দিক থেকে নিরাপদ থাকবে, এই ভেবে। তার কাছেই আবার রয়েছে একটি শ্মশান। সুতরাং, সহজে এই পথে মানুষজন আসবে না। শ্মশানের কাছে রয়েছে একটি বিরাট শাঁইগাছ, ঘন ডালপালা সমেত। এই গাছের ওপরেই সব অস্ত্র লুকিয়ে রাখলে বেশ নিরাপদে থাকবে বলেই আমার বিশ্বাস”।
অর্জুনের কথা শুনে বাকি চার ভাই উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। শুধু দ্রৌপদী বুঝলেন, এতটা রাস্তা তাঁকে বয়ে নিয়ে আসার সময়ে অর্জুনের মনে একটাই চিন্তা কাজ করে গেছে। কোথায় তাঁদের অস্ত্রশস্ত্র নিরাপদে থাকবে। হ্যাঁ, তিনি নিজেও জানেন এর গুরুত্ব। তিনিও চান, যাতে দুর্যোধনের অনুচরেরা তাঁদের চিনতে না পারে। যাতে পঞ্চ স্বামীর সকল অস্ত্র, অর্জুনের গাণ্ডীবসহ বাকি
চারজনের মহাধনুসকল ও বাকি যা কিছু অস্ত্র নিরাপদ থাকে। কিন্তু তাই বলে দ্রৌপদীর প্রতি কোনও রকম মনোযোগ দেবেন না অর্জুন! দ্রৌপদীর এত প্রেম কী অর্জুনের মনে দোলা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে! তা কী শুধুই অজ্ঞাতবাস পর্বের আর তার শেষে কি হবে, তাই নিয়ে উদ্বেগ? নাকি ভালোবাসার অভাব?? অর্জুনের জীবনে অন্য নারী কি দ্রৌপদীর প্রতি উদাসীন করে দিয়েছে অর্জুনকে? নাকি কোনও স্ত্রীলোক নয়, অন্য কোনও কারণে অর্জুন সংবরণ করে রেখেছেন নিজেকে?
অর্জুনের বাকি স্ত্রীদের নিয়ে অবশ্য দ্রৌপদী কখনোই খুব বেশি ভাবেন নি। তার একটি কারণ ছিল উলুপী আর চিত্রাঙ্গদা, দুজনের কথাই তিনি জেনেছিলেন অনেকটা পরে। আর এই দুই নারীর কেউই অর্জুনের সঙ্গে ফেরেন নি। যদিও অন্য কোনও নারীর দেহের সঙ্গে অর্জুনের শরীর মিলে যাচ্ছে, অর্জুনের নিষ্পেষণে শীৎকার উঠছে কোনও নারীর কন্ঠে, অর্জুনের বলিষ্ঠ হাতে পিষ্ট হচ্ছে কোনও নারীর বক্ষ, অর্জুনের দৃঢ় পুরুষাঙ্গটি ভেদ করে প্রবেশ করছে কোনও নারীর উষ্ণ যোনিতে– এসব কথা যখনই ভেবেছেন, তখনই সমস্ত শরীরে মনে জ্বালা ধরেছে তাঁর। উলুপী চিত্রাঙ্গদা সম্পর্কে জানার আগেই তিনি এমন কল্পনা করেছেন আসলে। কখনও কল্পনা করেছেন একা একাই অর্জুনের সঙ্গে নিজের মিলন। আবার কখনও বা ভেবেছেন একা একা বারো বছর অর্জুন কি কোনও রমণীর সঙ্গ ছাড়াই কাটাতে পারবেন? তা কি সম্ভব একজন পুরুষের পক্ষে? তখন কল্পনা করেছেন কোনও এক অচেনা নারীর শরীরের সঙ্গে মিশে যাওয়া অর্জুনের কালো শরীরটি। কতদিন অর্জুন একা কাটাবেন! দ্রৌপদীকে তো পাওয়ার পালা আসার আগেই চলে যেতে হল দূরে! এক বছর দু বছর নয়। বারো বছরের জন্য। হাহাকার করে উঠেছিলন তিনি মনে মনে! এ কী ভীষণ অন্যায়! তীব্র প্রতিবাদ করতে গিয়েও থেমে গেছিলেন তিনি। তাঁর চোখে গভীর শূন্যতা টের পেয়েই বুঝি যুধিষ্ঠির বারণ করেছিলেন অর্জুনকে।
বলেছিলেন, “অর্জুন! কনিষ্ঠ জ্যেষ্ঠের ঘরে ঢুকলে নিয়ম ভঙ্গ হয় না। বরং জ্যেষ্ঠ যদি কনিষ্ঠের ঘরে ঢুকে পড়ত তবে এই নিয়ম প্রযুক্ত হতো। তাছাড়াও, তুমি বিনা কারণে আসো নি। এক আর্তকে রক্ষা করার জন্য এসে পড়েছ। আর আমি আর দ্রৌপদী অস্ত্রের ঘরে হঠাৎই আলোচনাতে মগ্ন হয়ে পড়েছিলাম। আমি আমার ভল্ল দেখাচ্ছিলাম। তোমার গাণ্ডীব, ভীমের গদা দেখাচ্ছিলাম। সুতরাং কোনও ভাবেই তোমার কোনও ভুল হয় নি। তুমি যেও না”।
কাতর চোখে দেখছিলেন পাঞ্চালী অর্জুনের দিকে। প্রাণপণে বলার চেষ্টা করছিলেন, তাঁর দুটি চোখে ফুটে উঠছিল অনন্যা, “যেও না, অর্জুন। যেও না। আর দুটি মাত্র বছর। তারপরেই তোমাকে পাব আমি। নিবিড় ভাবে। স্বামী রূপে। প্রেমে তোমাকে ভরিয়ে দেব। সেই জোয়ার ভেসে যাব দুজনে। বারোটি মাস, ছয়টি ঋতু আমাদের জন্য বসন্ত হয়ে যাবে। আমি তো আসলে তোমারই। তুমিও আমার। তোমাকে পাওয়ার জন্য আমার সমস্ত অপেক্ষা। তুমি যেও না। তুমি যেতে পার না”।
কিন্তু তাঁর সমস্ত আকুলতাকে দমিয়ে দিল অর্জুনের কথা। অর্জুনের গলার স্বর। সেই কন্ঠে কোথাও দ্রৌপদীর থেকে দূরে সরে যেতে হবে বলে কোনও আক্ষেপের চিহ্ন নেই। নেই বারো বছরের অদর্শনের যন্ত্রণা। বরং কঠিন হয়ে প্রতিজ্ঞাপালন করতে পারছেন, নিজের খানিক বিচলনকে জয় করে শরণার্থীকে রক্ষা করার জন্য যা যা করা দরকার ছিল, তা করতে পেরেছেন, তার জন্য রয়েছে প্রচ্ছন্ন একটা গর্ব। সেই গর্বের সুরেই তিনি বললেন, “মহারাজ, আপনিই শিখিয়েছেন ধর্ম পালনের সময়, নীতি রক্ষার সময় কোনও রকম ছলনার আশ্রয় করবে না। এখন আপনিই অন্যরকম বলছেন? আমাকে কোনও ভাবেই সত্যি থেকে সরাতে পারবেন না। যখন প্রতিজ্ঞাভঙ্গ হয়েছে, তখন তার জন্য যা শাস্তি, তা আমাকে পেতেই হবে। আপনি আমাকে আশীর্বাদ করুন। যেন বারো বছর পর আবার আপনাকে এসে প্রণাম করতে পারি”।
রাগ হচ্ছিল দ্রৌপদীর। অসম্ভব রাগ। অর্জুনের ওপর। আর দেবর্ষি নারদের ওপর। নিজের ওপরেও। সবচেয়ে বেশি বোধ হয় নিজের ওপরেই। কারণ তিনি না চাইলে জোর করে পঞ্চ স্বামীর সঙ্গে বিয়ে করতে তাঁকে কেউ বাধ্য করতে পারত না। পাঁচ স্বামী না হলে নারদ এসে অমন পরামর্শও দিতেন না।
দ্রৌপদীর সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর কুন্তীর সঙ্গে সস্ত্রীক পঞ্চ পাণ্ডব হস্তিনাপুরে গিয়ে ধৃতরাষ্ট্র আর গান্ধারীর কাছে গেলেন। বারাণাবতের সেই সচেতন হত্যার পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পর এই প্রথম দেখা। না, দুর্যোধন, দুঃশাসন, কর্ণ প্রভৃতির সঙ্গে দ্রৌপদীর স্বয়ংবরসভাতে অবশ্য আগেই দেখা হয়ে গেছিল পঞ্চ পাণ্ডবের। পঞ্চ পাণ্ডব কিভাবে বেঁচে ফিরেছেন, তাও জেনে গেছিলেন দুর্যোধন। বারাণাবতে পুরোচনের সাহায্য যে জতুগৃহে তৈরি করা হয়েছিল পাঁচ ভাইকে পুড়িয়ে মারার জন্য, সেই গৃহেই পুড়ে মরল পুরোচন। কিন্তু সেই সঙ্গেই পুড়ে মারা গেলেন এক ব্যাধপত্নী, তার পাঁচ পুত্রের সঙ্গে। অদ্ভুত কারণ কুন্তী পালানোর আগে ব্রাহ্মণ ভোজনের আয়োজন করেছিলেন। সেখানে ব্যাধপত্নী কীভাবে এলেন? তবে কি পরিকল্পনা করেই তাঁদের ডেকে আনা হয়েছিল? যাতে ছাই হয়ে যাওয়া মৃতদেহও ভুল বার্তা পাঠাতে পারে দুর্যোধনের কাছে? যে কুন্তীসহ পাঁচ ভাই মৃত! দুর্যোধন শত্রুশূন্য হয়েছে! এমনকী জতুগৃহটি বানানোর মূল কাণ্ডারী, একমাত্র সাক্ষী পুরোচনও সেই আগুনেই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে! দুর্যোধনের পাপকাজের আর কোনও সাক্ষীও রইল না অথচ কাজটিও সুচারুভাবে হাসিল হলো।
হবে নাই বা কেন! সেই দিন পুরোচন ওই বাড়িরই একটি ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সে তো কল্পনাই করেনি যুধিষ্ঠির সব জেনে শুনে, প্রথম দিন থেকেই পালানোর ব্যবস্থা আরম্ভ করে দিয়েছেন। এখানে আসার সময়েই বিদুর যুধিষ্ঠির ছাড়া আর কেউ বুঝবেন না, এমন ভাষায় সাবধান করে পালিয়ে যাওয়ার উপায়ও সংকেতে বলে দিয়েছিলেন। পরে খননকাজে নিপুণ এক ব্যক্তিকেও বারাণাবতে পাঠিয়ে দেন আর যুধিষ্ঠির বিদুরের উপদেশ মতো বাড়ির ঠিক মাঝখান থেকে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ শুরু করিয়ে দিয়েছিলেন।
অনেক পরে দ্রৌপদী যখন জেনেছিলেন এই ঘটনা, নিশ্চিত বুঝেছিলেন এই সমস্ত বুদ্ধিই যুধিষ্ঠিরের। কারণ ভীম আবেগপ্রবণ মানুষ। পাগলের মতো ভালো বাসতে জানেন, ভালোবাসা না পেলেও। আর জানেন যুদ্ধ করতে। অর্জুন জানেন কিভাবে নতুন অস্ত্র পেতে হয়, তার চালনা শিখতে হয়। আর জানেন নারীর হৃদয়কে পোড়াতে। অস্ত্রহীন নিরীহ মানুষকে মেরে ফেলা তাঁর চরিত্র নয়। নকুল সহদেব চিরকালই অনভিজ্ঞ যেন। দাদাদের ওপরেই সমস্ত ভুবনের ভাবনার ভার দিয়ে রেখেছেন। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বুদ্ধিমান যুধিষ্ঠির। বাইরে আপাত-শান্ত, কিন্তু প্রয়োজনে ক্রুর হতে তাঁর সময় লাগে না, যদিও বাইরেটা তখনও শান্তই থাকে। তাই সেই ব্রাহ্মণ ভোজনে মাসহ পাঁচ ব্যাধভাইকে ডেকে আনা, তাদের অতিরিক্ত মদ খাইয়ে অজ্ঞান করে দেওয়ার পেছনে যুধিষ্ঠিরের মস্তিষ্কই ছিল। যদিও আগুনটা লাগিয়েছিলেন ভীম। প্রথমে পুরোচন যে ঘরে শুয়েছিল, সেই ঘরে। তারপরে জতুগৃহের মূল দরজায়। তারপর বাড়ির সকল দিকেই। হু হু করে জ্বলে উঠেছিল পুরো বাড়িটি। যখনই দ্রৌপদী ভীমের কাছে এই ঘটনাটি শুনতেন, শিউরে উঠতেন। ভীম ভাবতেন দ্রৌপদী নিশ্চয়ই তাঁদের কথা ভেবেই শিউরে উঠতেন। তবে তিনি শিউরে উঠতেন যুধিষ্ঠিরের নিষ্ঠুরতার কথা ভেবে!! তাঁর অনেকবার মনে হয়েছে ভীমকে জিজ্ঞেস করেন, তাঁরাও এই ষড়যন্ত্রের কথা জানতেন কিনা। কিন্তু করেননি। কারণ তিনি বুঝে গেছিলেন, যুধিষ্ঠির যা বোঝাবেন, বাকি চার ভাই তাইই বুঝবেন।
এই বারাণাবতের জতুগৃহ থেকে বাঁচার কিছু দিন পরেই দ্রৌপদী-র স্বয়ংবরে দ্রৌপদীর সঙ্গে দেখা হল পাঁচ ভাইয়ের। সেই সভায় অপরূপ সজ্জায় সেজে সুগন্ধী জুঁইয়ের মালা হাতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষমান দ্রৌপদী কি কখনও ভেবেছিলেন এমন দিন আসবে তাঁর জীবনে? দুকূলে সোনার পাড় বসানো মহার্ঘ্য বস্ত্রের বদলে একখানি সাধারণ কৃষ্ণবর্ণের কাপড় পরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবেন কাজের সন্ধানে? ইন্দ্রপ্রস্থের মায়াবী রাজপ্রাসাদ থেকে অন্য এক রাজার রাজ্যে এইভাবে ঘুরতে থাকা! দ্রুপদ রাজার আদরিণী মেয়েটিকে, ধৃষ্টদ্যুম্নের স্নেহের দিদিটিকে ভাগ্য বিপর্যয়ে এতখানি লাঞ্ছনা সইতে হবে!
বিরাটরাজ্যে সবার আগে পাঁচ পাণ্ডব যে যার দক্ষতা অনুযায়ী রাজার প্রাসাদে কাজে ঢুকে গেলেন। যুধিষ্ঠির সোজা চলে গেলেন বিরাটরাজার সভায়। “আমি বৈয়াঘ্রপদ্য গোত্রের ব্রাহ্মণ। আগে যুধিষ্ঠিরের সখা ছিলাম। আমি পাশাখেলায় দক্ষ। কঙ্ক আমার নাম। জীবিকার্জনের আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করি”।
একইভাবে ভীম এলেন বিরাট রাজার কাছে। তাঁর পক্ষে যথাসম্ভব নরম গলায় পরিচয় দিলেন নিজের, “মহারাজ, আমি রাঁধুনী। আমি পাণ্ডবদের পাকশালাতে ছিলাম। মহারাজ যুধিষ্ঠির আমার রান্না খেতে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তাছাড়াও আমি যে বেশ বলশালী, তা তো দেখতেই পাচ্ছেন। আমি বাহুযুদ্ধেও দক্ষ। হাতি আর সিংহের সঙ্গে আমিও আপনার পক্ষে যুদ্ধ করতে পারব। আমার নাম বল্লব”। এই বলে আভূমি প্রণাম করলেন।
এইভাবে নকুল গ্রন্থিক নাম নিয়ে বিরাট রাজার ঘোড়াশালের ভার নিলেন। সহদেব অরিষ্টনেমি ছদ্মনাম নিয়ে গোশালার দায়িত্ব নিলেন। বিরাটরাজা মনে মনে খুশিও হলেন। দক্ষ কর্মচারী পেলে কেই বা খুশি না হন্! তার ওপর এরা সবাই সম্রাট যুধিষ্ঠিরের কাছে কাজ করে প্রশংসা পেয়েছেন।
এরপর অর্জুন একদিন বৃহন্নলার বেশে দিব্যি গয়নাগাঁটি পরে, মস্ত বড় চুল খুলে বিরাটরাজার সভার এক ধারে এসে দাঁড়ালেন। তাঁকে দেখে সভাশুদ্ধু সকলেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। আরও অবাক হলেন যখন এই দীর্ঘদেহী মানুষটি বললেন, “আমি নাচ গান, বাজনা বাজানো খুব ভালো পারি। আমি জানি আপনার একটি কন্যা আছে। উত্তরা। আমাকে আপনি রাজকন্যার শিক্ষকরূপে কাজ দেবেন? বড় দুঃখজনক একটি ঘটনার মধ্যে দিয়ে আমি ক্লীব হয়েছি। আপনাকে সব বলব। কিন্তু এখন কাজের বড্ড দরকার। ধরে নিন, আমি অনাথ। আমি আপনারই পুত্র বা কন্যা, যেভাবে খুশি দেখুন আমাকে। বৃহন্নলাই আমার নাম। আমাকে অন্তঃপুরে আপনার কন্যার নাচগানের গুরু করে দিন। কথা দিচ্ছি, হতাশ হবেন না”।
বিরাটরাজ্যে যাওয়ার আগে যখন যুধিষ্ঠির সবাইকে নিয়ে বসেছিলেন, কে কোন বেশে কি কাজে ঢুকবে, তখনই অর্জুন বলেছিলেন তিনি বৃহন্নলার বেশ ধরবেন। দ্রৌপদীর এবং বাকিদের মনে পড়ে গেছিল অর্জুনের শাপগ্রস্ত হওয়ার ঘটনাটি।
দ্যূতসভাতে দ্বিতীয়বার পরাজিত হওয়ার পর প্রথম শর্তটি পালনের জন্য তখন তাঁরা দ্বৈতবনে বাস করছিলেন। সেইখানে হঠাৎই একদিন ব্যাসদেব এসে উপস্থিত হলেন। দুটি পরামর্শ দিলেন তিনি। প্রথমত বলে গেলেন, এক বনে বেশিদিন না থাকার কথা। সত্যিই তো! তাঁরা যেখানে থাকবেন, অতি দ্রুত চারপাশের পশুপাখি শেষ হতে থাকবে। এতগুলি খাওয়ার মুখ! তার ওপর স্বয়ং ভীমসেন আছেন! দ্বিতীয় পরামর্শ হল, “অর্জুনকে অস্ত্রলাভ করার জন্য ইন্দ্র বরুণ রুদ্র কুবের ও ধর্মরাজের কাছে পাঠিয়ে দাও যুধিষ্ঠির”।
ব্যাসের পরামর্শ অগ্রাহ্য করার প্রশ্নই ওঠে না। বিশেষত সবাই যখন জানেন ভবিষ্যতে মহাযুদ্ধ অবশ্যাম্ভাবী। সুতরাং যুধিষ্ঠির অর্জুনকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, “ভাই অর্জুন, বৃত্রাসুরের ভয়ে সমস্ত দেবতারা তাঁদের যাবতীয় অস্ত্র ইন্দ্রের কাছে রেখেছেন। তুমি তাঁর কাছে যাও। সেই সব অস্ত্র সংগ্রহ করো। তাদের ব্যবহার শেখ। আগামী যুদ্ধে তুমি আর ভীম আমাদের প্রধান ভরসা। ওদিকে ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ কর্ণ অশ্বত্থামা রীতিমত অস্ত্রনিপুণ। আর দুর্যোধন তাঁদের সবাইকে তুইয়ে পাইয়ে রেখেছে এমনভাবে, যে যুদ্ধে তাঁরা দুর্যোধনের পক্ষেই থাকবেন। এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। তাছাড়াও অন্যান্য যোদ্ধাদের সঙ্গেও দুর্যোধনের যথেষ্ট ভালো সম্পর্ক। তাঁরাও দুর্যোধনের ব্যবহারে সন্তুষ্ট। ফলে দুর্যোধনের এই মুহূর্তে অবস্থা সবরকমে শক্তিশালী। মজবুত। সেখানে তুমি যদি এই কাজটি করতে পারো ঠিক করে, তবেই যুদ্ধে আমাদের জয়ের আশা থাকবে”।
যুধিষ্ঠিরের কথার শেষটুকু শুনতে পেয়েছিলেন দ্রৌপদী। আসলে যেদিনই ব্যাসদেব এসে যুধিষ্ঠিরকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, সেদিন থেকেই দ্রৌপদী-র বুকের মধ্যে কাঁপন ধরেছিল। তিনি বুঝতে পারছিলেন আবার অদর্শন শুরু হবে। আবার অর্জুন তাঁর থেকে দূরে সরে যাবেন। আবার কত…..কত বছর কেটে যাবে অর্জুনের ছোঁয়া পেতে। আর যে ভাইয়ের স্ত্রী রূপেই থাকুন না কেন, অর্জুনকে তো তিনি প্রেমিক ছাড়া আর কোন চোখেই দেখতে পারেন না। যুধিষ্ঠির বুঝতে পারেন তাঁর মনের এই ভাব। তিনি জানেন। এবং যুধিষ্ঠিরের মনে এই নিয়ে ঈর্ষাও আছে খানিক। সেকথাও তিনি জানতেন। তাই বলে এমন সময়ে এমনভাবে সেই ঈর্ষার প্রকাশ ঘটবে? এত বছর ধরে সেই ক্ষোভ তিনি পুষে রেখেছিলেন? ধর্মপুত্র হোন বা ভারতবর্ষের অধীশ্বর, আসলে এক নারীর প্রেম পাওয়ার ক্ষেত্রে নেহাতই সাধারণ পুরুষ! নয়ত দ্রৌপদী এইভাবে পথে পড়ে গেলেন, তখন তিনি উদাসীন সুরে “ও তো অর্জুনকে বেশি ভালোবাসত”, এই কথা বলে এগিয়ে যেতে পারতেন! অধ্যাপিকা, শিক্ষা বিজ্ঞান বিভাগ, রামকৃষ্ণ সারদা মিশন বিবেকানন্দ বিদ্যাভবন ।
প্রাচীন ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে আগ্রহী, লেখালেখি করার বদভ্যাস আছে। পৌরোহিত্য করেন, মূলত পুরোনতুন বৈদিক পদ্ধতিতে বিবাহ দেন এবং রবিগান কঠোপনিষদ ও ঋক্ মন্ত্রসহ অন্যরকমভাবে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।
Related