অসমিয়া অনুবাদ: রক্তের অন্ধকার (পর্ব-১২) । ধ্রুবজ্যোতি বরা
ডক্টর ধ্রুবজ্যোতি বরা পেশায় চিকিৎসক,অসমিয়া সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য লেখক ২৭ নভেম্বর ১৯৫৫ সনে শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন। শ্রীবরা ছাত্র জীবনে অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ‘কালান্তরর গদ্য’ ,’তেজর এন্ধার’ আরু ‘অর্থ’ এই ত্রয়ী উপন্যাসের লেখক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। ২০০৯ সনে ‘ কথা রত্নাকর’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বাকি উপন্যাসগুলি ‘ভোক’,’লোহা’,’যাত্রিক আরু অন্যান্য’ ইত্যাদি। ইতিহাস বিষয়ক মূল্যবান বই ‘রুশমহাবিপ্লব’দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’,’ফরাসি বিপ্লব’,’মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ’। শ্রীবরার গল্প উপন্যাস হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা, মালয়ালাম এবং বড়ো ভাষায় অনূদিত হয়েছে।আকাডেমিক রিসার্চ জার্নাল’যাত্রা’র সম্পাদনার সঙ্গে জড়িতরয়েছেন।’ কালান্তরর গদ্য’ উপন্যাসের জন্য ২০০১ সনে অসম সাহিত্য সভার ‘ আম্বিকা গিরি রায়চৌধুরি’ পুরস্কার লাভ করেন।শ্রীবরা অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি।
অনুবাদকের কথা
আলোচ্য উপন্যাস ‘রক্তের অন্ধকার'(তেজরএন্ধার) একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ উপন্যাস। এটি লেখার সময় কাল ২০০০-২০০১ ছিল অসময়ের ক্ষেত্রে অত্যন্ত দুর্যোগের সময়। সেই অশান্ত সময়ে, আমাদের সমাজে, আমাদের জীবনে এক দ্রুত অবক্ষয়ের স্পষ্ট ছাপ পড়তে শুরু করেছিল। প্রতিটি অসমিয়াইমর্মেমর্মে একথা উপলব্ধি করে ভেতরে ভেতরে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। রাজ্যের চারপাশে দেখা দেওয়ানৈরাজ্যবাদী হিংসা কোনো ধরনের মহৎ রূপান্তরের সম্ভাবনাকে বহন করে তো আনেই নি, বরঞ্চ জাতীয় জীবনের অবক্ষয়কে আরও দ্রুত প্রকট করে তুলেছিল। আশাহীনতা এবং অনিশ্চিয়তায় সমগ্র রাজ্য ক্রমশ ডুবে যাচ্ছিল। এই ধরনের পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই যেন থমকে যেতে চায় কবির কবিতা , শিল্পীর তুলি, লেখকদের কলম। তবে একথাও সত্যি যে শিল্পী-সাহিত্যিকরা সচেতন ছিলেন যে সমাজ জীবনের ভগ্নদশা’ খণ্ডহর’এর মধ্যে একমাত্র ‘সৃষ্টি’ই হল জীবন এবং উত্তরণের পথ। এই বিশ্বাস হারানোর অর্থ হল মৃত্যু । আর এই বিশ্বাস থেকেই সেই সময় লেখক লিখেছিলেন কালান্তর ত্রয়ী উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব – রক্তের অন্ধকার ।
এবার উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ নিয়ে এলাম। আশা করি ইরাবতীর পাঠকেরা এই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত অসাধারণ উপন্যাসটিকে সাদরে বরণ করে নেবেন ।নমস্কার।
বাসুদেব দাস,কলকাতা
‘ধ্যাৎ, এটা এমনিতেই মরল।’– বলে ছেলেটি বলা কথাগুলি সে আর শুনতে পায়নি।
‘মা এবার কি তরকারি রেঁধেছিস?’– ভাতের থালায় বসে এক গ্রাস মুখে নিয়ে প্রেম বলল।’ একটুও নুন দেসনি। অল্প নুন দে।’
ভোগেই নাড়াচড়া করল না। নুন দেবার কোনো লক্ষণই সে দেখাল না।ঘেমে উঠা মুখটা মুছে সে একই জায়গায় বসে রইল।
‘মা,একটু নুন দে।’–প্রেম পুনরায় বলল।
‘নেই।‘ভোগেইকোনোমতে জবাব দিল।তাঁরকণ্ঠস্বর বেশ অস্পষ্ট ছিল।
‘নেই’।প্রেম বড়ো অবাক হল। ‘নুন নেই ? মানে ?’
‘নুন নেই। শেষ হয়ে গেছে। আজ বোতলটা ধুয়ে তরকারিতে দিয়েছি।’
‘নুনও শেষ হয়ে গেল?’-প্রেম হতাশার সুরে বলল।তার কথাটা স্বগতোক্তিরমতো শোনাল।উনুনের সামনে থেকে ভোগেই মাথা তুলে দেখে একটু নড়েচড়ে বসল।
‘আমাকে আগে বলিসনি কেন?’
‘কতদিন থেকে তোকে বলে আসছি ঘরে কোনোকিছুই নেই।আমার কথায় কান দিয়েছিস?চাল ক্ষেতের ফসল বলে এখনও কোনোরকমে চলছে। কিন্তু ধানেও এবার কম পড়বে বলে মনে হচ্ছে।ফসল উঠার আগেই ধান শেষ হয়ে যাবে।’
প্রেম চুপচাপস্বাদহীন ভাত তরকারি খেতে লাগল। রান্নায় নুন প্রায় নাই বললেই চলে।শাক-পাতার তরকারি,বেগুন ভর্তা কোনোকিছুই গলা দিয়ে নামতে চাইছে না।
‘তোকে এত করে বাধা দিলাম।’-অভিযোগের সুরে ভোগেই বলল–;কোলঘরের ধানগুলিতে হাত দিস না।বিক্রি করিস না। কিন্তু আমার, তোর বাবার কারও কথা শুনলি না। ধানগুলি বিক্রি করে ফেললি। বছরের শেষের দিকে এখন ধানও শেষ হয়ে যাবে।’
প্রেম এবার কোনো কথা বলল না। বলবেই বা কি সে?ভাত খাওয়ার পর্ব শেষ করার জন্য সে তাড়াহুড়ো করছে। সর্বার পরামর্শ অনুসারে আগে থেকেই গ্রামীণ ব্যাঙ্কে সে একটা একাউন্ট খুলে রেখেছে। টাকাটা এলে পুরোটা না হলেও আধা টাকা সে তার নামে সেই একাউন্টে রেখে দেবে বলে ঠিক করেছে।তাই সে কারও বাধা নিষেধ না শুনে ছয়শো টাকার ধান বিক্রি করে দিয়েছে। বিহারী মানুষটার ধান কলের জন্য বাড়ি বাড়ি ঘুরে ধান কেনার মানুষ আছে। সেই মানুষ দুটাকে ধরে এনে সে ধানের দর-দাম করল। এই সময়ে ধান কম পাওয়া যায়। মানুষ সহজে বিক্রি করতে চায় না। তাই মোটামুটি ভালো দামই পেল সে। কোনোমতেটেনেটুনে সারা বছর চলা,কখনও একটা মাস টানাটানি চললেও ধান বিক্রি করতে সে খুব বেশি একটা চিন্তা করে নি। টাকা তো আসবেই।
আরো পড়ুন: অসমিয়া অনুবাদ: রক্তের অন্ধকার (পর্ব-১১) । ধ্রুবজ্যোতি বরা
তখন সে ধান কিনে নেবে, শুধু ধানই কেন, কয়েক বিঘা মাটি কিনে একেবারে বছর খানেক নিশ্চিন্তভাবে চলতে পারার মতো ব্যবস্থা করে নেবে। একটা রিক্সাও কিনবে। গ্রামের দুজনের রিক্সা আছে। গ্রাম থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত,কখনও বা একেবারে পাঁচ মাইল দূরের রেল স্টেশন পর্যন্ত রিক্সা চলে। গ্রামের কোনো একটি ছেলেক সে রিক্সাটা চালাতে দিতে পারবে, দুই চার টাকা হাতে থাকবে একটা রিক্সা থাকলে সেও কখনও কখনও এদিক ওদিকে যেতে পারবে।
ধান বিক্রি করে সে গ্রামীণ ব্যাংকে একাউন্টটা খুলে ফেলেছিল। আর কিছু টাকা হলে ভালো হবে বলে বলায় সর্বার পরামর্শ মতো সে বাগানের কিছু ভলুকা বাঁশ বিক্রি করেছিল। ধান এবং বাঁশ বিক্রি করে পাওয়া টাকা নিয়ে সে সর্বার সঙ্গে তার সাইকেলে উঠে গ্রামীণ ব্যাংকে গিয়েছিল এবং নগদ এক হাজার টাকা দিয়ে তার নামে অ্যাকাউন্ট খুলেছিল ।
ইস আরও কিছু টাকা থাকলে ভালোছিল।
একাউন্টটা খোলার পরে তার আরও টাকা তাতে জমা করার ইচ্ছা হল। বাগানে একটা তিতাচাপা গাছ ছিল ।সেই গাছটা বিক্রি করলেও তিন চার হাজার টাকা পাওয়াযাবে।সর্বাকে সে কথাটা বলেছিল।
‘কখনও এই কাজ করিস না।’– সর্বা তাকে কথাটা শুনেই বাধা দিয়েছিল– ‘কখন ও করিস না।সাংঘাতিকলোকসান।বেপারীকেগাছ বিক্রি করবি না। তার চেয়েকাঠুরিয়া ডেকে এনে নিজে কেটে তক্তা- বাটাম বের করে নে । এক সিএফটিতেএকশো টাকার মতো পাবি। গুয়াহাটির দিকে এক সিএফটির দাম নাকি তিনশো টাকার মতো । নমঃশূদ্রকাঠুরিয়ারাগাছের খোঁজে বাড়িবাড়ি ঘুরে বেড়ায় ।’
কথাটা তার খুব মনে ধরে ছিল। হয়তো,কার বাগানে কী দামি গাছ আছে তা নমঃশূদ্রকাঠুরিয়ারাবাড়িবাড়ি ঘুরে খবর করে বেড়ায়। ওরাই প্রথমে তিতাচপা গাছটা কাটবে নাকি বলে কয়েক মাস আগে তাকে জিজ্ঞেস করেছিল।
কিন্তু গাছটা আর কাটা হল না। ধান আর ভলুকা বাঁশ বিক্রি করার পরে বাড়িতে যে হুলস্থূলহল,তা দেখে প্রেমের আর কাঠুরিয়ার খোঁজে যাবার সাহস হল না।
‘একাউন্ট খোলার আজ অনেক দিন হয়ে গেল কিন্তু,টাকার কোনো খবর নেই দেখছি। যতীনদারবাড়িতেমানুষটা আসার আজ পাঁচ মাসের উপর হয়েছে। তিনি সমস্ত কাজ নিজে করিয়ে,ফাইল-টাইল ঠিক করে ফাইন্যান্সেরসইয়ের জন্য পাঠিয়েদেওয়ার কথা বলেছিলেন। আজ এতদিনেও ফাইন্যান্সের সই হয়ে টাকাগুলি ডিসির হাতে পড়ল না?
না; আমাকে নিজে একবার খোঁজ করতে হবে– প্রেম ভাবল। এভাবে বাড়িতে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে হবে না। এভাবে চলতে থাকলে ব্যাংকে রাখা টাকাগুলিও ভাগ-বাঁটোয়ারা করতে হবে। সে দ্রুত নুন ছাড়া ভাত-তরকারি খাওয়া শেষ করল। তারপর ধীরে ধীরে সে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
বাবা বাইরের কাঁঠাল পিঁড়িটিতে চুপ করে চোখ বুজে বসেছিল।
ধান বিক্রি করা,বাঁশ বিক্রি করা এবং বিশেষভাবে সেই সব বিক্রি করে কত টাকা পেল না পেল,টাকা কী করেছে, সেই সবের কোনো হিসেব না দেওয়ার জন্য বাবা তার সঙ্গে কথাবার্তা বন্ধ করেছে। প্রথম কয়েকদিনঘুরিয়েফিরিয়ে তাকে গালিগালাজ করেছে।
‘বাড়িতে ডাকাত পড়েছে, সবকিছু বিক্রি করে খেয়ে শেষ করল। বুড়ো মা বাবার মুখের ভাত কেড়েনিয়ে বিক্রি করতে তার বিন্দুমাত্র দ্বিধা হল না। নিজের ঘরে সিঁধ কাটা এটা কি গ্রহকে জন্ম দিলিও হেমের মা।’
ছেলে আশেপাশেই রয়েছে জানতে পেরে তাঁর চিৎকার বেড়েই চলছিল।’আমাদের পেটের নাড়ি শুকিয়ে মারার ব্যবস্থা করছে বুঝেছিস হেমের মা।মর,মর।বুড়োবুড়ি দুই আপদ না খেয়েমর!আমার তাতে কী?আমরা মরলে সে একাই সবকিছু ভোগ করবে।’
কিন্তু, দুদিন পরে তিনি যখন দেখলেন যে সব সময় বাবাকে ভয় করা নিরীহ ছেলেটিগালিগালাজকে গুরুত্বই দিচ্ছে না, বরঞ্চ বাবার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকছে। তখন রতিকান্তগালিগালাজ বন্ধ করল। তখন তিনি ছেলের সঙ্গে কথাবার্তা বন্ধ করলেন। ঘরে থাকলে মাঝে মধ্যে তিনি বুক ভেঙ্গে যাওয়া একটা দীর্ঘশ্বাসফেলেন।তাঁর ধারণা যেন সেই দীর্ঘশ্বাসের শব্দটি পেছনে পেছনতেড়ে গিয়ে ছেলের অন্তরে ধাক্কা মারবে…।
ভাতটা খেয়েই প্রেম খুঁড়িয়েখুঁড়েয়ে গ্রামের অন্য প্রান্তের মুদির দোকানটাতে এল। আধঘন্টা পরে যখন সে গিয়ে দোকানে পৌঁছাল তখন দোকানটিতেকয়েকজন মানুষ বসে দোকানির সঙ্গে কথা বলছিল।
প্রেম দোকানে সাজিয়ে রাখা বৈয়ামে এবং প্লাস্টিকের জালি ব্যাগে ঝুলিয়ে রাখা বস্তুগুলির আড়ালনিয়ে মানুষগুলির কথাবার্তা শুনতে লাগল। দোকানির মুখোমুখি হতে তার কেমন যেন সংকোচ হল।
দুপুরের সময়ে দোকানে অন্য গ্রাহক সেভাবেনেই।লোকগুলি দোকানির সঙ্গে বেশ খোলা মনে কথাবার্তা বলছিল।
‘মানুষের ঘরের সামনে দিয়ে যেতে খারাপ লাগে।লোকজনে গিজগিজ করত ঘরটা।’-একজন বলে উঠল।
কার কথা বলছে ওরা?কারকথা?প্রেম উদগ্রীব হয়ে উঠল।
‘এখন বুড়ো-বুড়ি একা থাকে।বুড়োর অসুখ আছে।বাড়ির বাইরে বেরোয় না।’
‘মধুমেহ।’-দোকানি হঠাৎ মন্তব্যকরল।তিনি সাধারণত চুপচাপ থেকে অন্যের কথা শুনেন,নিজে বিশেষ মন্তব্য করেন।
‘কী কীবল্লে?’-মানুষ দুজন একসঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন।
মধুমেহ-প্রস্রাবে চিনি যাওয়া অসুখ।ডায়েবেটিছ।’
প্রত্যেকেই সশব্দে হেসে উঠল।
.

অনুবাদক