নন্দসিং বরকলা

অসমিয়া অনুবাদ কবিতা: নন্দসিং বরকলা ‘র কবিতা

Reading Time: 4 minutes

নন্দসিং বরকলকবি পরিচিতি-১৯৬৯ সনে নগাঁও জেলার দক্ষিণ পাটে জন্ম। সহকারী আরক্ষী মহাপরিদর্শক,অসম। ‘রা বাঁহর চিকমিকনি’, এবং ‘ইয়াত এতিয়াও মানুহ আছে ’ কবির অন্যতম কাব্যসঙ্কলন।সাম্প্রতিক কবিদের মধ্যে নন্দ সিং বরকলার কবিতায় ঐতিহ্য প্রীতি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়।

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস


 

ফুলগুলি মানুষের চেয়ে সুন্দর

ফুলগুলি মানুষের চেয়ে সুন্দর,উজ্জ্বল,প্রখর,কোমল

মৌমাছি,ভোমরা,প্রজাপতির অতিথির ঘর

মন্দিরের সকালের প্রার্থনা,দেবতার আত্মকথার ভাগবত,মহাকাব্য

ফুলের শরীর বৃষ্টি বৃষ্টি

ফুলের চোখ ধূপ-ধুনো শঙ্খ শিবের প্রদীপ

মানুষের হাতে বিশ্বাসঘাতকতা করে ফুলের আত্মাকে

মানুষের হাতে হাতে ফুলের মৃত্যু

ফুল ফুটলে বুকের অন্ধকারের পথ আলোকিত হয়

রাতে আভাস দেওয়া সূর্য উদয় হল

রক্তরাঙা ফুলের আত্মা বলিদান দেয় আসনের সামনে

তখনই বুকের ভেতরের সূর্য ডুবে যায় রক্তে

কাঁপতে থাকে সকালের প্রার্থনা ঈশ্বরের শরীর…

ফুলের বুকে প্রতিদিন বয়-নদী বাতাসের

ফুলের বুকে প্রতিদিন ভ্রমে,লাফায় কৃষ্ণবাঁশীর সুরের লহর

ফুল হাসলে-আমি প্রাণভরে নিজেকে খুঁজে বেড়াই

ফুল কাঁদলে-কাঁদি গোপনে গোপনে

ডিঙি ছেঁড়া ফুলগুলি মন্দিরে বলি হলে উত্তপ্ত হয় বুকের ধমনী

ফুলের ব্যবিলনের শোকগাথায় প্রায়ই নিঃসঙ্গ হয় মাটি

মাটিগুলি তথাপি গলে-চাঁদ গলে

মাটির শিকড় খুঁজে বেড়ায় মানুষ এবং ফুলের ঠিকানা

মাটির ফুলে কত যাগ-যজ্ঞ-পূজা,নৈবেদ্য…

ভগবানকে সুখী করার স্বার্থের মহা পৃথিবীর চেতনা

আসনের কুরুক্ষেত্রে পড়ে থাকে অনেক ভীষ্ম,দ্রোণ কর্ণের…ফুলের মৃতদেহ

বিলের পদ্ম মূর্ছা যায় -বিক্রমাদিত্যের সূর্য স্তুতিতে

অপদেবতায় পাওয়া মানুষ,

অপদেবতায় পাওয়া দিন,

পূজারীর ঠোঁট নাচে প্রতিটি ফুলের মৃত্যুতে

পলিতে সবুজ করা বুকটা পাথর হয়ে উঠে তখনই

প্রতিরাতে কুয়াশায় পুষে রাখি চাঁদের ফুল

প্রতিরাতে নিঃশব্দ বাতাসে বুকের ওম দিই তারা ফুলকে

সকালগুলি সতেজ,মাধুর্যময় সৌন্দর্যময় করার আশায়

নেবুছেদ নেজারের দুচোখকে টেনে আনি

ফুলগুলিকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে বাগিচায়

মানুষ ভাবে না-মানুষের শ্মশানে যাত্রী হয় ফুল

এবং আত্মার মাটিতে পুনরায় গজায়…

জুঁই,টগর,শেফালি,করবী,চম্পা,গোলাপ…কেতকী…




মানুষ পৃথিবীর অনন্য সম্পদ

কিসের একটা চিৎকারে মাঝে মধ্যে চমকে উঠি কিসের চিৎকার ? কিসের সংকেত !

মাঝে মধ্যে জানার জন্য হাঁটু গেড়ে বসি

কান খাড়া করি, বুকে হাত রেখে হৃদপিন্ডের ধপধপানির আভাস নিই

একদিন সূর্য ডোবার সময় বাড়ি ফেরার শেষ বাসের যাত্রী হই

রঙ্গিন একটা বিকেল জিজ্ঞেস করে যাবে নাকি

পাথর গুলিতে মুখ রাখি দেবতার শৃংখল শোভাযাত্রার

নির্লোভ ভাস্কর্যের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়

সবুজ দিনের একটি আলো…

সুখে না দুঃখে তোমাকে নিয়ে মুখোমুখি বসি

বাতাসে ভরে উঠে বাঁশির সুরের মূর্ছনা

রোদ, বাতাস, বৃষ্টি, তাড়ালেও

যেতে পারি না এই বাড়ি ছেড়ে, যেন বের হলেই

অন্ধকার ঘিরে ধরে

কিসে ডাকে কিসে ডাকে(?) মাঝ রাতে দেখি জোনাকির শোভাযাত্রা

আশীর্বাদ দিয়ে বলতে চায়

মানুষ পৃথিবীর অনন্য সম্পদ

চিৎকার একটার এপারে ওপারে খুঁজি আর ও একটি চিৎকার

যা একটি বরগীতের সুরের মতোই স্নিগ্ধ

যেন দেবতার পাথরের সাম্রাজ্যে নৃত্যরতা নৃত্য পটীয়সীর ভারতনাট্যম

এক ঝাঁক সবুজ বাতাসে বসে

আঁকড়ে ধরতে চাই নিজের কণ্ঠস্বর, নিজের একটা চিৎকার

দুহাতের আঙ্গুলগুলি নীল রঙের– যেন হৃদয়

যা হয়ে আছে নীল এবং নীল

মানুষের হৃদয়ের অনন্য সবুজ…


আরো পড়ুন: তরুণ হিন্দি কবির নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ । অনুবাদক: মিতা দাস


 


উলঙ্গ সময়ের সঙ্গে

কেন এরকম দিনের সঙ্গে মুখোমুখি হই

যে সমস্ত দিনে ভেঙে চুরমার হয় পৃথিবীর স্বপ্ন,

ব্যাবিলনের শূন্যোদ্যান ভেঙ্গে পড়ে,

তাজমহলের ভেতরের মখমল যেন ছিনিয়ে নেয়,

গভীর সবুজ গুলি ছিনিয়ে নেয়

ক্রমশ আমি মানুষটা উলঙ্গ হয়ে পড়ি

কাঁপে দুচোখ, বুক,দুই পা…

কে জানি কখন মাপে আমার রক্তের উষ্ণতা!

কীভাবে জিজ্ঞেস করি নিজেকে কেমন আছে তোমার দিন?

ভালো আছি বলে কাকে বলি, কীভাবে বলি?

দুচোখ বুকের ভেতর দিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে প্রবেশ করতে পারি কি?

কীভাবে ডাকি দুচোখে কেবল যে শূন্যতা এবং আতঙ্ক!

এই ভয়ানক দিনগুলির ওপারে কী আছে?

এরকম দিনের সঙ্গে কেন মুখোমুখি হয় নদী

যা কেবল মৃতদেহ বহন করে চলেছে!

ক্ষুধার খবর কে রাখে- যে খবর না পেলেও

স্বপ্ন দেখি বৃষ্টির

সবুজ হবে পৃথিবী আকাশ ভরে উড়বে পাখি

রামধেনু উঠবে, শিশুরা হাত ধরে গাইবে রঙের গান

কিন্তু কার ও সঙ্গে কথা বলতে পারি না

শুনতে পারিনা বুকের গান

নিঃসঙ্গ শেফালিগাছ একটা

কাঁপে চাঁদের আলোতে

দূরে জলীয় সোনার বুকে অশান্ত পৃথিবী

পৃথিবীর বাড়ে অসুখ

ভাঙ্গে বৃহৎ বৃহৎ অট্টালিকা এবং

রান্নাঘরে ঠাকুরমার কোলে শুনি রণোন্মাদ

ঘোড়ার পদক্ষেপে এই দিনগুলির কথা…

যে সমস্ত দিনে ভেঙ্গে চুরমার হয় পাহাড়-পর্বত,

অঙ্কিয়া ভাওনা, পাঠশালার অ-আ-ক-খ…

 




 

কোথাও ঈশ্বরের মৃত্যু হয়েছে

কোথাও ঈশ্বরের মৃত্যু হয়েছে… এই খবর আপনি জানেন কি?

ঈশ্বরের সন্ধানে যাওয়া রাতে গাছগুলিতে বাতাস উন্মাদ করেছিল

বৃষ্টি ধান গাছগুলিকে ডুবিয়ে ফেলেছিল

চাঁদ ধরে রেখেছিল তারাগুলির আত্মা

ঈশ্বরের মৃত্যু হওয়ার জন্যই নাকি

বর্ণহীন হয়েছে সবুজ

নদীর পাড় ভাঙ্গা নিঃশেষ করে এনেছে নদীর উপত্যকা

আগুন জ্বলে ছাই হয়েছিল‐ পাখি, গাছ, বাতাস, আকাশ

লতার মতো বেয়ে চলো প্রেম মৃতপ্রায় হয়ে শুকিয়েছিল কোথাও

ভালোবাসার আকাশ দুঃখের নোনতায় ভিজেছে

চাঁদ উপুড় হয়ে পড়েছে মাটিতে

বুকের সুগন্ধে ডুবে থাকা নদীগুলি শুকিয়ে এসেছে

পাইন গাছের নিচে আজ কেউ বসেনি,

শিশির খসে পড়া শুভ্র পাহাড়ে বিশ্রাম নেয় নি বাতাস

আপনি আজ আসার কথা

জ্যোৎস্না, তারা, চাঁদের বুকে বসে কথা বলার কথা

নদীর তীরে বসে মাছ গুলির বেদনার কথা শোনার দিন ছিল আজ

কোথাও ঈশ্বরের মৃত্যু হয়েছে… এই খবর আপনি জানেন নাকি?

হ্যাঁ ,হ্যাঁ ‐-ঈশ্বরের মৃত্যু হয়েছে,

না, না‐- ঈশ্বরকে হত্যা করেছে,

না ,না ‐-ঈশ্বরকে অপহরণ করেছে

না ,না ‐-ঈশ্বরকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছে

তাই এতো তুফান আসছে,

সুনামি গ্রাস করছে আলো,

বিদ্যুতে হারিয়েছে ঈশ্বরের ঘর

হ্যাঁ হ্যাঁ কোথাও ঈশ্বরের মৃত্যু হয়েছে




সুখের মোনালিসা

প্রত্যেক মানুষেই নিজের মুখ গড়ে, নিজেই ভাঙ্গে

হাঁটলেই দুপায়ে লাগে মানুষের খুলি

মানুষের জন্য কথা বলবে বলে বাতাস

অপেক্ষা করে থাকে তুফান

আকাশ এবং মাঠও বলতে পারেনা জীবনের অমৃত কথা

এখন রামধেনু বের হবে

দাদুর হাত ধরে নাতি চিৎকার করবে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে

দুচোখে এঁকে নিয়ে মানুষের নক্সা…

এখন দেখছি জ্বলে উঠে

চারদিকে মানুষের সুখের মোনালিসা…

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>