অনুবাদ উপন্যাস: সুবালা (পর্ব-৬) । হোমেন বরগোহাঞি
লেখক পরিচিতি-১৯৩২ সনে লখিমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’,‘বিভিন্ন নরক’,‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোটো গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। ১২ মে ২০২১ সনে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়। সুবালা লেখকের প্রথম উপন্যাস।
১১
বট গাছের গুটির মতো কিছু ঘটনা দেখতে ক্ষুদ্র এবং অর্থহীন কিন্তু তার গর্ভে কখনও লুকিয়ে থাকে বিরাট পরিমাণের সম্ভাবনা। বট গাছের গুটি মাটিতে পড়ে থাকলে চোখে পড়ে না, চোখে পড়লেও মনোযোগ আকৃষ্ট হয় না।হঠাৎ একদিন চোখে পড়ে দ্রুত বেড়ে ওঠা একটি গাছ এবং তার সঙ্গে সঙ্গে তার বিষয়ে আমরা সচেতন হয়ে উঠি।
আমাদের বাড়ি থেকে জোরে আওয়াজ দিলেই শোনা যায় এমন দূরত্বে ছিল নরেনদের বাড়ি। গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে ধনী মানুষ। প্রতিবেশী মানুষ যদিও আমাদের সঙ্গে ওদের আসা-যাওয়া বা কথাবার্তার কোনোো সম্পর্ক ছিল না। আমাদের ওরা বোধহয় মানুষ বলেই গণ্য করত না।।। কেবল টাকার জন্যই নয় অন্য অনেক কারণে নরেনকে গ্রামের মানুষ ভয় করে চলত। মানুষটা ছিল অত্যন্ত উদ্ধত গুন্ডা প্রকৃতির নিষ্ঠুর এবং মদ্যপী ।প্রয়োজন হলে মানুষের সঙ্গে মারপিট করার জন্য সে এক মুহূর্ত দ্বিধা করত না। চেহারাও ছিল সেই অনুপাতে দেখলেই ভয় উদ্রেককারী। উচ্চতায় কি জানি ছয় ফুটের চেয়ে বেশি হবে। শরীরটা ক্ষীণ হলেও হাড় শক্ত কালো ক্ষীণ গাল ভেতরে ঢুকে যাওয়া মুখের মাঝখানে ধনেশ পাখির মতো একটি বিরাট নাক, গর্তে ঢুকে যাওয়া চোখ দুটো সব সময় লাল হয়ে থাকে এবং দৃষ্টিতে এরকম একটি কঠিন হিংস্রতা ফুটে উঠে যে অপরিচিত ছেলেমেয়েরা হঠাৎ তাকে দেখলেই ভয়ে কেঁদে ফেলে। এই চেহারায় সে নিচের মাটি উপর করে বন্য মোষের মতো ঘুরে বেড়ায়।গ্রামে এমন একটি মেয়েও ছিল না যাকে সে অসভ্য ভাষায় কোনো না কোনো দিন অভদ্র ব্যবহার করিনি। কেউ যদি রুখে দাঁড়ায় তার আর রক্ষা নেই। নানা অশ্লীল অসভ্য কথায় জায়গাতেই তাকে অপমান করবে। রাতে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে তার ঘরের দরজায় গিয়ে মা-বাবাকে শুনিয়ে নানা ধরনের অসভ্য কথাবার্তা বলবে। ভবিষ্যতের জন্য সেই মেয়েটি আর নিশ্চিত মনে বা নিরাপদ ভাবে কোথাও যেতে পারে না। কোনো মেয়ের অভিভাবক যদি তার ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে রুখে দাঁড়ায় অক্ষত দেহে ঘুরে যাবে বলে সে আশাই করতে পারেনা। নরেন এরকম বেপরোয়া হতে পারার কারণ ছিল যথেষ্ট।। পাশের গ্রামের প্রতিটি গুন্ডার দল তার হাতের মুঠিতে ছিল। মদ-ভাত খাইয়ে এবং বিপদে-আপদে টাকা পয়সা দিয়ে সে সবাইকে বশ করে রেখেছিল। নরেনের কোনো কথায় প্রতিবাদ করা মানে পুরো দলটার সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়া। তার বিরুদ্ধে মামলা মোকদ্দমা করার কারও সাহস ছিল না কারণ তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টাকা খরচ করার মতো কারও সামর্থ্য ছিল না। তাছাড়া পুলিশ থেকে আরম্ভ করে সমস্ত সরকারি অফিসাররা ছিল তার হাতের মুঠিতে। কাকে কীভাবে খাতিরে করলে তার সুবিধা হয় সেই বিদ্যা নরনের পুরো মাত্রই জানা ছিল। গ্রামের মানুষকে যে নরেন বাঘের চোখে দেখে, দারোগা বা সাব ডেপুটি দেখলেই একশো হাত দূরে থাকা সেই নরেনের মুখ মোলায়েম হাসিতে কোমল হয়ে আসে। তারাও তার জিপে উঠে সপ্তাহে সপ্তাহে শহরে গিয়ে সিনেমা দেখতে বা তার হাতিতে উঠে শিকার করার সুযোগ পেলেই উপকারের প্রতিদান দেবার জন্য সুযোগ খুঁজে বেড়ায়। যে অফিসারই আমাদের জায়গায় বদলি হয়ে আসুক না কেন দুদিনের মধ্যে সে নরেনের জালে ধরা পড়বেই। যার যা প্রয়োজন মাছ, দুধ, মদ, মেয়েমানুষ, হাতি, ঘোড়া, বন্দুক, জিপ গাড়ি, নগদ টাকা, সস্তায় ভাড়া ঘর নরনের ভান্ডারে সমস্ত কিছুই মজুদ থাকে।। ফলে কি হয় সমস্ত কিছুতেই নরেনের সাত খুন মাফ,তার বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা তাদের কাছে বললেও তাদের এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যায়। অন্যদিকে সে তাদের বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে সমস্ত মানুষকে ভয়ে জড়োসড়ো করে রাখে। সত্যি মিথ্যা নানা অজুহাত বের করে মানুষগুলোকে নানা ভাবে ঝামেলায় ফেলে। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই ছিল ভূমিহীন। প্রত্যেকেই নরেনের মাটিতে আধিতে চাষ করে ।ওদের উপরে নরেন সবসময়ই খড়গহস্ত। কোনো কথায় তাকে অসন্তুষ্ট করলেই দিনের মধ্যেই সে মাটি কেড়ে নেবে।। গ্রামে একজন আত্মীয়-স্বজন বিহীন বিধবা মহিলা ছিলেন। একদিন নরেন মদ খেয়ে মাতাল হয়ে মধ্যরাতে সেই বিধবা মহিলার ঘরে জোর করে ঢুকে তাকে নানান ভাবে অত্যাচার করে।। পরের দিন সকালে নির্বোধ মহিলাটি থানায় গিয়ে পুলিশে মামলা দায়ের করে।।পুলিশ তার মামলার কোনো তদন্তই করল না বরং নরেনকে বন্ধু ভাবে থানায় ডেকে নিয়ে মহিলা মামলা করার কথা জানিয়ে দিল।কয়েকদিন পরে নরেন তাকে রাস্তার পাশে দেখতে পেয়ে তর্কবিতর্ক করে মারধর করে তার একটা হাত ভেঙ্গে দিল।। মানুষের উস্কানিতে পড়ে মহিলা সদল বলে গিয়ে কাছারিতে মামলা জারি করল।পুরো দুই বছর মামলা চলল। সাক্ষী এবং প্রমাণের অভাবে নরেন খালাস হয়ে গেল। মহিলাটির লাভ হল কি? মামলার খরচ জোগাতে গিয়ে তার যা যথাসর্বস্ব ছিল একটি হালের গরু, দুই বিঘা মাটি, একটি সোনার আংটি সমস্ত বন্ধকে গেল এবং মহিলাটি রাস্তার ভিখারিণীতে পরিণত হলেন। এখন কেবল নরেন কেন যে কোনো মানুষের জন্যই তার ঘরের দরজা দিন রাতের জন্য খোলা। নিজের সতীত্ব এবং সম্মান রক্ষার জন্য সর্বস্ব পণ করে যুদ্ধ করে সর্বস্বান্ত হয়ে আজ সে একজন পরিচিত বেশ্যা।
আরো পড়ুন: সুবালা (পর্ব-৫) । হোমেন বরগোহাঞি
নরেনের সঙ্গে আমার প্রায়ই পথেঘাটে দেখা হয়। কিন্তু সে কোনোদিন আমাকে ডাকে না বা আমার দিকে মাথা তুলে তাকায় না।। বোধহয় আমি ছোটো ছিলাম সেই জন্যই। ছোটো ছোটো মেয়েরা কখনও তার মনোযোগ আকৃষ্ট করে না। কিন্তু একদিন একটি অভাবনীয় ঘটনা ঘটল। বিকেল বেলা আমি ঘরের দরজার সামনে একা দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ কোথা থেকে নরেন সেদিকেই এল।। স্বাভাবিকভাবেই তার দিকে আমার চোখ গেল। আমি দেখে আশ্চর্য হলাম সে আমাকে দেখে দুম করে থেমে গেল। একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে সে কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে রইল ।তারপর মুখের একটা কুৎসিত ভঙ্গি করে সে হেসে উঠল—‘বাহ’।তাার সেই হাসিটা আমি কথায় বর্ণনা করতে পারব না। জীবনে এরকম হাসি আমি কারও মুখে দেখিনি।হিস হিস শব্দ করে একটা সাপের জিভ যেন আমার মুখটা চেটে দিয়ে গেল একটা ঠান্ডা ভয়াবহ ঘৃণ্য অনুভূতিতে আমার সমস্ত শরীর শিউরে উঠল।নরেন পুনরায় বলে উঠল, বাহ তুই দেখছি দেখতে দেখতে যুবতী হয়ে উঠলি। এবার তোর জন্য ছেলে দেখতে হবে। আমি কিছু না বলে মাথা নিচু করে রইলাম। সে আমার দিকে কয়েক পা এগিয়ে এল ;আমার খুব ভয় হল। আমি পিছিয়ে আসতে চাইলাম, কিন্তু এক পাও নড়াচড়া না করতে পেরে এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার শরীরের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে নরেন পুনরায় বলে উঠল—’বাড়িতে মা আছে কি?’ আমি ঢোক গিলে উত্তর দিলাম,’নেই’। ‘চল ,তোদের ঘরে গিয়ে কিছুক্ষণ বসি’–কথাটা বলে সে ঘরের দিকে এগিয়ে এল। তার গতিবিধি দেখে আমার এত ভয় হল যে আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম, ‘আমি এখন ঘরে যেতে পারব না, মাকে ডেকে আনতে যাচ্ছি’– এ কথা বলে নরেন এগিয়ে আসার বিপরীত দিকে আমি দ্রুত দৌড়াতে লাগলাম। আমার পেছন থেকে নরেন খিলখিল করে হেসে চিৎকার করে বলল, আচ্ছা আচ্ছা এখন যা মাকে বলে দিবি আমি বিকেলে আসব।’
নরেন যাওয়ার পরে আমি বাড়িতে এসে কথাটা চিন্তা করতে লাগলাম। সে অবশ্য আমাকে চিন্তা করার মতো কিছু বলেনি বা কোনো খারাপ ব্যবহার করেনি কিন্তু তার সেই অদ্ভুত হাসিটা, সেই হাসিটা যেন একটা নতুন পরিচয় আবিষ্কারের স্পষ্ট ঘোষণা। আবিষ্কার কেবল তার পক্ষেই নয় আমার পক্ষেও। সে আজ আমাকে নতুন করে আবিষ্কার করল এবং সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও আমার নিজের সম্বন্ধে সচেতন করে দিল। একটা পুরুষের চোখে আমি জীবনে এই প্রথম নিজেকে লক্ষ্য করলাম এবং মুহূর্তের মধ্যে আমার দেহ এবং মনে একটা আশ্চর্য পরিবর্তন ঘটে গেল। প্রত্যেক মেয়ের জীবনে বোধ হয় এরকম একটি মুহূর্ত আসে, যখন কোনো একজন পুরুষের প্রথম স্বীকৃতি সূচক একটি শব্দ বা একটি গোপন চাহনি এসে অতর্কিত তার শরীর বিদ্ধ করে আর ঠিক সেই মুহূর্তে তার নতুন করে জন্ম হয় ।সবাই হয়তো কথাটা সচেতনভাবে অনুভবই করতে পারে না আর সেটাই নিয়ম। কিন্তু ব্যতিক্রম যার ভাগ্যে আছে, সেই জানে সে একটা অক্ষয় আঘাত লাভ করল, সে আর আগের মানুষ রইল না, তার নতুন করে জন্ম হল। এই নতুন জন্মের যন্ত্রণায় সে নিশ্চয় অনেক সময় অসার হয়ে থাকে।
ঘরের ভেতরে ঢুকে আমি দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। সূর্য অস্তযেতে বেশি সময় বাকি ছিল না। ঘরের ভেতরটা প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছিল। পশ্চিমদিকের ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁক দিয়ে অস্তায়মান সূর্যের সোনালি আভা কিছুটা ভেতরে এসে ভেতরের অন্ধকারকে সোনালি করে তুলেছিল। হতবুদ্ধি হওয়া মানুষের মতো আমি কিছুক্ষণ ঘরের মাঝখানটাতে দাঁড়িয়ে রইলাম। সেই নির্জন সোনালি অন্ধকারে এভাবে কিছু সময় একা দাঁড়িয়ে থেকে আমি হঠাৎ বুকের মধ্যে একটা যন্ত্রণা অনুভব করলাম। কিছুক্ষণ আমি যন্ত্র চালিত মানুষের মতো ঘরের চারপাশে ঘুরে বেড়ালাম। আমি যে মনে মনে কিছু একটা ভাবছিলাম সে কথা ঠিক। কিন্তু সেই ভাবনার কোনো ভাষা নেই।হঠাৎ একবার আমি অনুভব করলাম একটা আশ্চর্য নিঃসঙ্গতার অনুভূতি এবং অন্ধকার চারপাশ থেকে আমাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে।। চোখ দুটো বন্ধ করে আমি শরীরটা ঝাঁকুনি দিলাম এবং দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলাম। এইসব কান্ড করতে থাকা অবস্থায় অন্য কেউ আমাকে দেখলে আমাকে নিশ্চয় পাগলী বলে ভাবত।কিন্তু বহু মানুষকে জীবনের নিঃসঙ্গতম রূপে দেখার দুর্ভাগ্য আমার হয়েছে, আর সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি যে বোধহয় প্রায় সমস্ত মানুষই জীবনে অন্তত একবার নির্জনে আপন সত্তার মুখোমুখি হয়ে এই ধরনের ব্যবহার করে; দ্বিতীয় একজন ব্যক্তির চোখে সেই ধরনের ব্যবহার কেবল পাগলের পক্ষেই সম্ভব। পাগল কাকে বলে সেই বিষয়ে এখন আমার একটি নিজস্ব ধারনা গড়ে উঠেছে। প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব জীবনটি এক একটি নির্জন দ্বীপ, সহানুভূতির নৌকায় উঠে সে অন্যান্য দ্বীপে আসা যাওয়া করে। কোনোভাবে সেই নৌকা অচল হয়ে সে যদি নিজের দ্বীপ ছাড়তে না পারে বা তুফানের কবলে মাঝ সমুদ্রে নৌকা ডুবে যায় বাইরের সমস্ত দ্বীপমালার সঙ্গে তার যোগসূত্র বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে কেবল আপন মনের মুখোমুখি হয়ে সে তখন যে ধরনের আচরণ করে, অন্যের চোখে সেটাই পাগলামি।।
অনুবাদক