| 29 মার্চ 2024
Categories
গীতরঙ্গ

রবির বৌঠান কাদম্বরী: রবীন্দ্রনাথের স্থপতি । আবদুশ শাকুর

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট
ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল-বিশেষজ্ঞ চিত্রা দেব ‘ঠাকুরবাড়ির মহিলাদের চোখে রবীন্দ্রনাথ’ রচনায় লিখেছেন:
 
রবীন্দ্রনাথের কাছের মানুষ ছিলেন তার দুই বউঠান—জ্ঞানদানন্দিনী ও কাদম্বরী। এঁরা দুজনে দুই মেরুর বাসিন্দা।…কিশোর বয়স থেকেই রবীন্দ্রনাথ তাঁদের দেখেছেন। প্রায় সমবয়সী কাদম্বরীর সঙ্গেই ছিল প্রগাঢ় সখ্য। এ সখ্য তত্কালীন পরিবেশে কিছু নতুন। জীবনস্মৃতির পাতায় সে কথা স্পষ্ট না হলেও ছেলেবেলায় এবং পরবর্তীকালের আপনজনদের কাছে এ কথা স্বীকার করতে কবি কুণ্ঠিত হননি।…কিশোর রবীন্দ্রনাথের মনোগঠনে কাদম্বরীর ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। কিশোর দেবরটির জন্যে তিনি এক মায়াময় জগৎ রচনা করতে পেরেছিলেন।…চেষ্টা করতেন তার অন্তরের শক্তিকে জাগাবার। বউদিদির চোখে নিজেকে দামি করে তোলার জন্যে কিশোর কবি যত ব্যাকুল ততই মুখ টিপে দুষ্টুমির হাসি হাসতেন কাদম্বরী। বলতেন, ‘কোনোকালে বিহারী চক্রবর্তীর মতো কবিতা লিখতে পারবে না।’ বলতেন, ‘গলা যেন কী রকম। ও কোনোদিন গাইতে পারবে না।’ এভাবেই কিশোর কবির মনটিকে উঁচু তারে বেঁধে দিতেন কাদম্বরী, ভালোবাসায়, সখ্যে। তিনি নিজে কিছু লেখেননি বলেই মনে হয়, অন্তত ভারতীতে ছাপা হয়নি। এ কথা বলার কারণ হলো, কাদম্বরীর মৃত্যুর পরে মহর্ষির নির্দেশে তার কাগজপত্র, চিঠি, ছবি সবকিছু নষ্ট করে ফেলা হয়। তার দু-তিনটি ছবি শুধু রয়ে যায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির চৌহদ্দির বাইরে।…প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বোঝা যায়, রবীন্দ্র-কাদম্বরীর শিল্পসাধনা, সংগীতচর্চা, সাহিত্যপ্রীতি ছিল পরস্পরনির্ভর। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অচিরেই শ্রোতা ও পাঠকের সংখ্যা বাড়িয়ে ফেললেন। কাদম্বরীর তাতেই সুখ। প্রতিভার প্রদীপে তেল-সলতে জোগানোই যেন তার কাজ। (সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘ধ্রুবপদ’, কৃষ্ণনগর, বার্ষিক সংকলন, ২০০৪, পৃ. ৭০-৭১)
 
বয়ঃসন্ধিকালীন সংবেদনশীল মনে রবীন্দ্রনাথের শক্তির যখন পরিণতি হয়নি অথচ বেগ জন্মেছে, সেই বেগের আবেগকে কাদম্বরী দেবী এভাবে পরিণতির দিকে ছুটিয়ে দিয়েছেন বল্গাহারা অশ্বের মতো। তার হাতের সোনার কাঠির স্পর্শেই কবি-কিশোরের ঘুম ভেঙেছে। তার জীবনের হ্লাদিনী-শক্তি ছিলেন এই নবৌদি, কাদম্বরী দেবী। পরিণত বয়সে রবীন্দ্রনাথ নারীর দুটি রূপের কথা বলেছেন, গৃহিণী আর হ্লাদিনী—‘মেয়েরা যেখানে গৃহিণী সেখানে বিশেষ গৃহেই তাদের অধিকারের সীমা, যেখানে তারা হ্লাদিনী, সেখানে তারা সমস্ত বিশ্বের।’
 
হ্লাদিনীরাই গুণী মনের ভেতরে ‘নারীলাবণ্যের কিরণ’ বিকিরণের মাধ্যমে সফলতা সঞ্চার করেন। তার মতে, এ নারীলাবণ্যের কিরণ পুরুষের আত্মপ্রকাশে এবং তার মহোত্তর সৃষ্টিকর্মে অত্যাবশ্যক। জৈবশরীরের সৃষ্টিক্রিয়ায় পুরুষ দাতা, নারী গ্রহীতা। কিন্তু মনঃশরীরের সৃষ্টিক্রিয়ায় তার বিপরীত লীলা, সেক্ষেত্রে নারী দাতা, পুরুষ গ্রহীতা। মানস-সৃষ্টিতে এ দাতা-গ্রহীতার সম্পর্ক ছিল বৌদি এবং দেবরের মধ্যে—একজনের নবযৌবনে, আরেকজনের বয়ঃসন্ধিক্ষণে।
 
 
শুভেন্দু দাশমুন্সী তাঁর ‘নষ্টনীড় থেকে চারুলতা/লেখার মধ্যে লেখা রহিল’ শীর্ষক রচনায় (প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৩-১২৫) লিখেছেন সত্যজিৎ রায়ের ‘চারুলতা’ ছবির পোস্টারে ‘চারুলতা’-কে ‘রবীন্দ্রনাথের নষ্টনীড়’ বলা নিতান্ত আকস্মিক মনে হয় না! অর্থাৎ তার মতে, গল্পে কথিত ‘নষ্টনীড়’টি কবির নিজেরই। বস্তুতই সত্যজিৎ রায় তার ‘চারুলতা’ সিনেমায় কাদম্বরীকথাই শুনিয়েছেন।
 
‘নষ্টনীড়’-কাহিনীর জীবনীনির্ভর পাঠ-প্রকল্পে নিঃসন্দেহে অবদান রেখেছে, ‘চারুলতা’ মুক্তি পাওয়ার দুই বছর আগে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের অন্তরঙ্গ কবিজীবনী—জগদীশ ভট্টাচার্যের লেখা ‘কবিমানসী’। কবির ব্যক্তিগত জীবনের কিছু ইঙ্গিত শ্রীরায় গ্রহণ করেছেন বইটি থেকে, কিছু সরাসরি ‘নষ্টনীড়’ থেকে আর কিছু মিশিয়েছেন অন্যান্য তথ্যসূত্র এবং রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি ও ছেলেবেলা বই দুটির সাক্ষ্যে।
 
চারুলতা সম্পর্কে দেয়া ইঙ্গিতগুলো নতুন বউঠানের স্মৃতিতে ভরে আছে। যেমন দেবরের সঙ্গে সাহিত্যচর্চার। জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: ‘সাহিত্যে বউঠাকুরানীর প্রবল অনুরাগ ছিল, বাংলা তিনি যে পড়িতেন, কেবল সময় কাটাইবার জন্য তাহা নহে—তাহা যথার্থই তিনি সমস্ত মন দিয়া উপভোগ করিতেন। তাঁহার সাহিত্যচর্চায় আমি অংশী ছিলাম।’ তেমনি আরেক ইঙ্গিত চারুলতার সূচিশিল্পের। বউঠানের সাহিত্যপ্রীতির সঙ্গে তাঁর সূচিশিল্পে নৈপুণ্যের প্রসঙ্গ জীবনস্মৃতিতেই উল্লিখিত, কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীকে বউঠান ‘নিজে হাতে রচনা করিয়া একখানি আসন দিয়াছিলেন।’ এমনি খুঁটিনাটি আরো অনেক কিছু।
 
‘নষ্টনীড়’-এ উল্লিখিত ও ‘চারুলতা’য় গৃহীত দুটি বিষয় লক্ষণীয়। প্রথমত, চারুর ঘরের লাগোয়া ছাদে তার বানানো বাগানের প্রসঙ্গ ও দ্বিতীয়ত, চারুর পাখি পোষার শখের কথা। প্রথম প্রসঙ্গটি কাহিনীতেও আছে, চিত্রনাট্যেও আছে। আর দ্বিতীয় বিষয়টি কাহিনীতে নেই, যুক্ত হয়েছে চিত্রনাট্যে। বউঠানের নিজের হাতে তার ঘরের লাগোয়া ছাদকে বাগান বানিয়ে তোলার আর তাঁর পাখি পোষার শখের খবর পাওয়া যাবে ছেলেবেলার দশম ও একাদশ পরিচ্ছেদে।
 
বিহারীলাল চক্রবর্তীর ‘সাধের আসন’ কাব্যগ্রন্থের ‘আসনদাত্রী দেবী’ (কাদম্বরী) শীর্ষক সর্গের ‘সেই ছাদে তরুরাজি’ ‘সেই জালঘেরা পাখি’ ‘সেই প্রাণখোলা গান’ প্রসঙ্গ জীবনস্মৃতি ও ছেলেবেলার পাঠকের বেশ পরিচিত। এর প্রতিটিই রবীন্দ্রস্মৃতিতে কোনো না কোনোভাবে কাদম্বরী দেবী সম্পর্কে উল্লিখিত।
 
‘নষ্টনীড়’ ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯০১ সালে। কিন্তু সত্যজিৎ ‘চারুলতা’র চিত্রনাট্যে এর ঘটনাকাল হিসেবে নির্দিষ্ট করেছেন ১৮৭৯ সাল। উনিশ শতকের শেষ পাদের একটি চমত্কার বাস্তবতা ‘চারুলতা’ ছবিতে ধরা আছে। লক্ষণীয় যে ১৯০১ সালে লেখাকাহিনীর পটভূমি সত্যজিৎ পিছিয়ে দিয়েছেন ১৮৮৪-পূর্ববর্তী সময়ে, যেহেতু সে বছরই কাদম্বরীর আত্মবিসর্জন ঘটে।
 
কাহিনীর মধ্যে ঘটনাকাল যেমন অনুল্লিখিত তেমনই অনুল্লিখিত প্রধান তিনটি চরিত্রের বয়ঃক্রম। ছবির মধ্যে অমল এসেই চারুকে প্রণাম করে। বোঝা যায় শুধু সম্পর্কের বিচারে নয়, বয়সের দিক থেকেও চারু অমলের চেয়ে বড়। যেমন রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বড় ছিলেন কাদম্বরী। কিন্তু সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়টি হলো সত্যজিৎ নির্ধারিত অমল-ভূপতির বয়স—অমলের ২৩ আর ভূপতির ৩৫। স্মরণীয় যে অমলের এ বয়সটিতেই রবীন্দ্রনাথ হারিয়েছিলেন তাঁর নতুন বউঠানকে, যে মৃত্যুশোকের কথা রবীন্দ্ররচনায় বারবারই ফিরে এসেছে। আরো লক্ষণীয় যে কবির নবৌদির মৃত্যু-বৎসরে নদাদার বয়সও ছিল ভূপতির মতো পঁয়ত্রিশই।
 
অন্যমনস্ক ভূপতির স্ত্রী চারুর নিঃসঙ্গতা ও একান্ত মনোযোগী দেবর অমলের সান্নিধ্যের সূত্রটিকে বিষয়গতভাবে চিত্রনাট্যকার কাদম্বরী দেবীর একাকিত্ব এবং দেবর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্কের প্রসঙ্গটিকে মিলিয়েছেন। সেই প্রসঙ্গটিকে মাঝখানে রেখেই ‘চারুলতা’ ছবির অনুপুঙ্খ তৈরির প্রয়োজনে তিনি ব্যবহার করেছেন ঠাকুরবাড়ির বিবিধ প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ।
 
অ্যান্ড্রু রবিনসনকে ‘চারুলতা’ সম্পর্কে সত্যজিৎ রায় বলেছেন, Tagore had known the pains, the tensions and the anguish that eat into a man’s soul, the real nature of the emotional crisis one has to go through।
 
সত্যজিতের এ মন্তব্য উল্লেখ করে রবিনসন লিখেছিলেন—
 
He (সত্যজিৎ) has seen a very early manuscript of Nashtanirh with marginalia which refers many times to Hecate, Rabindranath’s name for Kadambari. There is even a profile portrait sketch, ‘the sort that one would do when one is groping for ideas and not actually writing’ which is obviously of Kadambari. ‘She was at the back of his mind, there’s no doubt of that’, says Ray, ‘And that I thought was significant’ রবিজীবনীকার প্রশান্তকুমার পালও একটি সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, ‘সিনেমার চারুলতা রবীন্দ্রনাথের বউঠান কাদম্বরীর সঙ্গে অনেকটা মেলানো। কারণ ববীন্দ্রনাথও তাঁর কাদম্বরী বউঠানের মডেলটা অনেকটাই ব্যবহার করেছিলেন “নষ্টনীড়” গল্পে।’
 
কাদম্বরী দেবী সমগ্র রবীন্দ্রকাব্যের নায়িকা
 
কাদম্বরী দেবী কেবল রবীন্দ্র-গল্প নষ্টনীড়-এর নায়িকাই নন, এক অর্থে সমগ্র রবীন্দ্রকাব্যের কাব্যমানসী। এ সত্য অনুধাবনের জন্য রবীন্দ্রগ্রন্থাবলির কয়েকটি উৎসর্গপত্রের সানুধ্যান পাঠই যথেষ্ট। কেননা সেগুলো দুর্জ্ঞেয় রবীন্দ্রমনের এক একটা খোলা জানালা। গবাক্ষগুলোর ফাঁক দিয়ে সন্ধানী চোখে প্রথমাবধি দেখলে সে মনটি সম্পর্কে অনেক কিছু জানা তো যেতই—অনেক আড়ালে ঠেলে দেয়া তথ্যও আবিষ্কৃত হতো এবং অনাবৃত হতো মহীয়সী রমণী কাদম্বরী দেবী সম্পর্কে চেপে রাখা অনেক সত্যও।
 
রবীন্দ্রনাথের গ্রন্থে প্রথম উৎসর্গপত্রটি ছিল বৌদি কাদম্বরী দেবীর উদ্দেশে, ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘ভগ্নহূদয়’ কাব্যে। এটি তাঁর অপর বৌদি জ্ঞানদানন্দিনীকে উৎসর্গ করাটাই স্বাভাবিক হতো—যেহেতু কাব্যটি রচিত হয়েছিল তাঁরই সান্নিধ্যে, ইংল্যান্ডে। কবির জীবিতাবস্থায় প্রকাশিত ২০৮টি গ্রন্থের মধ্যে উৎসর্গিত মোট ৬৪টি, তাও মাত্র ৫১ জনের নামে। এর মানে ১৩ জন ছিলেন একাধিক উৎসর্গলাভে ধন্য। তাঁদের মধ্যে একজন ছাড়া আর কারো ক্ষেত্রেই উৎসর্গপত্রের সংখ্যা দুয়ের বেশি নয়। একমাত্র কবির নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীই দুয়ের বেশি, বস্তুত দুয়ের পাঁচগুণেরও বেশি, উৎসর্গপত্রে স্মরিত।
 
নবৌদির উদ্দেশে রবীন্দ্রনাথের উৎসর্গিত গ্রন্থের সংখ্যা সাধারণত ৭ লেখা হয় যথা—ভগ্নহূদয়, সন্ধ্যাসংগীত, ছবি ও গান, বিবিধ প্রসঙ্গ, ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী, শৈশব সংগীত, প্রকৃতির প্রতিশোধ (দ্র. সুব্রত রুদ্র, কাদম্বরী দেবী, পৃ. ৩১-৩৬, প্যাপিরাস, কলকাতা)। কিন্তু বিশিষ্ট রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ জগদীশ ভট্টাচার্যর গবেষণায় সংখ্যাটি ১১ যথা—উল্লিখিত ৭-যোগ য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র, মানসী, চৈতালি ও কাব্যগ্রন্থ (১৩১০)।
 
শ্রীভট্টাচার্য আবার ‘ভগ্নহূদয়’-এর উৎসর্গ উদ্ধৃত করেছেন দুটি। একটি সাময়িক পত্রিকায় প্রকাশকালে, আরেকটি গ্রন্থাকারে প্রকাশকালে। চৈতালিরও দুটি-একটি উৎসর্গপত্রে আরেকটি কাব্যগ্রন্থের সূচনায় কবির নিজের হস্তাক্ষরে মুদ্রিত।
 
(দ্র. কবিমানসী প্রথম খণ্ড, পৃ. ৪১২-৪১৯, ভারবি, কলকাতা, ১৯৬২)
 
মাত্র পৌনে ২৫ বছর বয়সে আত্মবিসর্জিতা বৌদির প্রতি মাত্র ১৭ বছরের সান্নিধ্যধন্য দেওরের বিস্ময়করসংখ্যক উৎসর্গপত্রের বিশদ বিচার-বিশ্লেষণ করলে কেবল উৎসর্গপত্রের আলোকেই কবির জীবন ও সৃষ্টির সর্বগুরুত্বপূর্ণ পরিচয়টি যথাসময়েই উদ্ঘাটিত হতো। সেই সঙ্গে তার অন্যান্য কিছু তাত্পর্যপূর্ণ মানসবৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও চিন্তাভাবনার উপকরণ পাওয়া যেত। অথচ এ দিকটি মাড়ানোর সাহস কবির জীবত্কালের বিরহবিধুর ৫৭ (১৮৮৪-১৯৪১) বছরে তো নয়ই, বিশ শতকের চল্লিশ এবং পঞ্চাশের দশকেও গণ্যমান্য কেউই করেননি—একমাত্র বিদগ্ধ কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ছাড়া।
 
পরকীয়া প্রেমে এমন কী অস্বাভাবিকতা, যা নিয়ে এত লুকোছাপা করতে হবে? রবীন্দ্রনাথ নিজে তো তা করেননি। এলাকাটিকে নিষিদ্ধ করে রেখেছেন আভিজাত্যভিমানী ঠাকুরবাড়ির স্বভাবসুলভ মুখোশধারীরা এবং যারা কবিগুরুকে গুরুদেব বানানোকেও যথেষ্ট মনে না করে অতিমানব বরং অমানব বানাতে চেয়েছেন তাঁরা। অথচ ‘অভিজাত’ হওয়ার নিন্দনীয় ধান্দার কারণে রবীন্দ্রনাথ নিজে কিন্তু ঠাকুরবাড়ির প্রতিষ্ঠাতাদের পূজারি তো ছিলেনই না, সমর্থকও ছিলেন না।
 
রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় যেমন ঠাকুর পরিবারের ধনসম্পত্তি অর্জনের নিষিদ্ধ এলাকায় প্রবেশ করে অন্ধকার অতীতের ওপর আলো ফেলেছেন (পৃ. ৪-৫, রবীন্দ্রজীবনী, প্রথম খণ্ড), তেমনি রবীন্দ্রনাথের প্রেমোপাখ্যানের নিষিদ্ধ এলাকায় ঢুকে ঠাকুরবাড়ির মুখোশ খোলার প্রথম দুঃসাহসী ও প্রত্যয়ী পদক্ষেপটি নিয়েছেন অধ্যাপক-সমালোচক জগদীশ ভট্টাচার্য তার ‘কবিমানসী’ গ্রন্থটিতে।
 
(১ম খণ্ড, ১৯৬২, ২য় খণ্ড, ১৯৭১)
 
‘শনিবারের চিঠি’-তে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশকালে ২৭.১০.১৯৫৮ তারিখে লেখককে চিঠি লিখে লেখাটির প্রতি সপ্রশংস সমর্থন জানিয়েছিলেন রাজশেখর বসু। পত্রিকাটির সম্পাদক সজনীকান্ত দাস লেখকের বক্তব্যে রবীন্দ্রমহিমা ক্ষুণ্ন হতে পারে ভেবে প্রথমদিকে আশঙ্কিত ছিলেন। একাদশ অধ্যায় প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে সম্পূর্ণ সংশয়মুক্ত হয়ে লেখকের ‘বক্তব্যের সমর্থনে রবীন্দ্রনাথের তরুণ বয়সের রচনা থেকে অজ্ঞাত তথ্য আবিষ্কারেও তিনি আত্মনিয়োগ করেন।’ (পৃ. ১০-১১, প্রগুক্ত)
 
অবশ্য তার প্রায় ছ’দশক আগেই, ১৯০০ সালে, স্বসম্পাদিত সোফিয়া পত্রিকায় ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, তার বহুলখ্যাত ‘দ্য ওয়ার্ল্ড পোয়েট অব বেঙ্গল’ প্রবন্ধে, লিখেছিলেন, রবীন্দ্র-কবিতায় যে ‘spirit of sadness’ আর ‘pain and anguish’ যায়, তার উৎসে আছে ‘an excruciating pain of an unrequited love’।
 
রবীন্দ্রচর্চায় কবিমানসী এখন কার্যত নৈঃশব্দ্যের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বিস্তৃতপ্রায়, কিন্তু প্রকাশকালে এ বই-ই হয়ে উঠেছিল রবীন্দ্রচর্চার কেন্দ্রীয় বিষয় (এ বিষয়ে আগ্রহী পাঠক পড়তে পারেন, তপোব্রত ঘোষের লেখা ‘কবিমানসী: নৈঃশব্দ্যের রাজনীতি’ প্রবন্ধটি। দ্র. রবীন্দ্রচর্চা, মার্চ ২০০১)। বস্তুত বইটি থেকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি সরিয়ে রাখা হলেও সেই বইয়ের প্রতিপাদ্য কিন্তু পরবর্তী রবীন্দ্রচর্চায় নানাভাবে স্বীকৃত হয়েছে এবং হয়ে চলেছে।
 
(রচনাটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত লেখকের রবীন্দ্রজীবন: প্রথম খণ্ড থেকে সংকলিত)
আবদুশ শাকুর: কথাসাহিত্যিক, গবেষক ও সংগীত সমালোচক
 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত