| 29 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: অমৃতস্য পুত্রা (পর্ব-৩) । অনিন্দিতা মণ্ডল

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

সেদিন বাবার নতুন শিষ্যদল এসেছে। এর আগে দমদম রোডে শ্বেতকরবীতে পরিচালনা ও নাটক লেখার অভিজ্ঞতা বাবাকে একটু অতিরিক্ত সুবিধে দিয়েছে। এসেছে স্বপন গাঙ্গুলি অলোকেশ মিত্র অলোক সরকার ইত্যাদি সব নামজাদা নাটক পাগল। ‘আমরা’ নাট্যসংস্থার সদস্য ও পরিচালক। আজকের সন্ধ্যের সভায় বাবা নতুন নাটক পড়বে। ‘শ্লোগান’। তিন দিনে লেখা। সামনেই একটা কম্পিটিশন আসছে। সেখানে অভিনয় হবে। শিগগির রিহার্সাল শুরু হবে।  

       আমাদের ঘুম পেয়েছে। বাবার সঙ্গে বাকি অনেকগুলো গলা শোনা যাচ্ছে। নেশাতুর সব ছেলেদের দল। সংলাপ বলছে। ঝিমঝিম বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে আমরা ভাইবোনেরা শুয়ে পড়েছি। পেছনে পশ্চিমদিকে পাগলদের বাড়ি, অপুপাগলা আর বিনিপাগলির বাড়ি। ওরা ছাদে থাকতে ভালোবাসে। শোনা যাচ্ছে ওদের বুড়ি মা চিৎকার করে ওদের নীচে নামাতে চাইছে। বাদলায় জ্বরজারি এলে কে দেখবে ওদের?

       হঠাৎ গলির মধ্যে অনেকগুলো পায়ের শব্দ। কারা যেন খুব জোরে ছুটে যাচ্ছে। কার যেন চাপা গলা। আর তারপরই গলির একমাত্র লাইটপোস্টের বাল্বটা কে যেন ভেঙে দিলো। একটা আর্ত চিৎকার। একবার নিঃশ্বাস নেবার জন্যও সেই চিৎকার থামছে না। ধীরে ধীরে গলাটা খাদে নামতে লাগল। আর তারপর একেবারে থেমে গেল। আবার ঝটাপটি দৌড়। ঘর থেকে বাইরের বারান্দায় বেরিয়ে বাবা ততক্ষণে ‘কে কে?’ করে গলা তুলেছে। এত দ্রুত ঘটনা ঘটে যাওয়ার ফলে কাউকে দেখা গেলনা। স্বপনকাকু এগিয়ে এসে বলল, তপুদা ঘরে চলুন। পুলিশ আসবে। সব ধরা পড়বে। বাবা ধরা গলায় বলল—পুলিশ জানতেই যদি পেরে থাকে,  আগে এলো না কেন? অলোকেশ কাকুর ভারি গলা—ওদের যেরকম অর্ডার আছে তেমন আসবে। ঘরে চলুন।

       এরপর আমার আর মনে নেই। ঘুমন্ত ভাই আমাকে মায়ের পাশ থেকে সরিয়ে দিয়েছিল বলে একবার মাঝরাতে উঠে বসে পড়ি। তারপর আবার শুয়ে পড়ি।

       পরের দিন সকালে মায়ের মুখ থমথমে। বাবা ভীষণ ব্যস্ত। বাইরের ঘরের দরজা বন্ধ। ভেতরে কারা যেন রয়েছে। অনিতাদি কাজে এসে বলল, চুপ করে দুধ মুড়ি খেয়ে নাও। পেছনের বাড়ির সজলদাকে কাল কারা যেন মেরে ফেলেছে। মেরে ফেলেছে? কেন? আমার ছ বছরের মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না। অনিতাদি বলল—ও নাকি নকশাল ছিল। মা চাপা স্বরে বলল—এত ভালো ছেলে! ওকে মেরে ফেলল? বাপ মায়ের মুখের দিকে তাকানো যাবে আর? কারা করল এমন? কই? আমরা তো শুনিনি ও নকশাল? অনিতাদি খানিক পরে বলল—নকশাল যারা হয় তাদের বোঝা যায় না ধরা যায় না। ভেতরে ভেতরে খবর ছিল নিশ্চয়। মা এবার স্থির চোখে তাকিয়ে দেখল অনিতাদির দিকে—তুই জানিস ওকে কারা মেরেছে। তাই না? অনিতাদি একটু শিউরে উঠল। বন্ধ দরজার ওপারে তখন চা পৌঁছতে হবে। অনিতাদি বড় স্টিলের থালায় করে চায়ের কাপ বসিয়ে নিয়েছে। মা ওর হাত থেকে থালাটা নিয়ে নিলো—থাক, তোর আর ও ঘরে গিয়ে কাজ নেই। কে যে কাকে কী খবর দেয় সে ভগবানই জানেন! অনিতাদি মাথা নীচু করে রইল। মা ফিরতে অপরাধীর মতো তাকিয়ে বলল—কে যে ভালো কে মন্দ আমরা তার কী জানি বলো? আমারে যা বলেছে তাই বিশ্বেস করেছি।

       সেই থেকে খুকুমণিদির গম্ভীর বাবা কেমন অপুপাগলার মতো হয়ে গেল। পাড়ার কেউ এই খুনকে ভালোভাবে নিলো না। হাজার হোক, ছেলেটা ভালো ছিল। সাতে পাঁচে থাকত না। একদিন রাতে খেতে বসে বাবা মায়ের কথা শুনতে পেলাম। মা বলছিল—অনিতারা জানে। সজল নাকি নকশাল ছিল। বাবা চোখ তুলে তাকাল—যদি থেকেও থাকে তাতে দোষ কী? ও তো কারোর ক্ষতি করেনি? কাউকে মারতেও যায়নি! শান্ত ছেলে ছিল। যেই করুক কাজটা ভালো করেনি।

গলির মধ্যে আমি মান্তু মুনাই আর দিদি খেলতে খেলতে শুনতে পেতাম খুকুমণিদির বাবা আসছেন। শরীরটা আরও নুইয়ে পড়েছে। কবিতা বলছেন জোরে জোরে।

       মাও সে তুং লাল সেলাম

       তোমার জ্বালায় জ্বলে গেলাম

       বাপের নাম ভুলে গেলাম

কবিতাটা মন্ত্রের মতন চিৎকার করে বলতে থাকতেন। খুকুমণিদি ভেতর থেকে দৌড়ে এসে দুহাতে জাপটে বাবাকে বাড়ির মধ্যে নিয়ে যেত।

       আমি অবাক হয়ে দেখতাম, গলির একটা লোকও হাসছে না। উদ্ভট কবিতা শুনে মান্তুর ঠাকুমা চোখে আঁচল দিচ্ছেন। মা ছলছল চোখে ডেকে নিচ্ছে আমাদের,—বাড়ি এসো। খুকুমণিদির দাদা নকশাল আমলে বিপ্লবের নামে পৃথিবী ছেড়েছিল। কে বা কারা সেই ঘাতক, তা কখনও জানা হয়নি। শুধু জেনেছি, মানুষ মানুষকে মেরেছে। প্রাণে মেরেছে। পুত্রশোকে কাতর পিতা স্বাভাবিক সমাজে আর বাঁচতে পারেননি। পাগল হয়েছিলেন।


আরো পড়ুন: অমৃতস্য পুত্রা (পর্ব-২) । অনিন্দিতা মণ্ডল


কিন্তু খুকুমণিদিরা তাঁকে বাড়ির গায়ে লাগোয়া পাগলা গারদে পাঠাবার কথা কখনও ভাবেনি। খুকুমণিদিদের বাড়িতে ঘরের সংখ্যা বেশি ছিলনা। আমাদের শহরের পৈত্রিক বাড়ির মতো তিন মহলা ছিলনা। ছিলনা দরদালান উঠোন ছাতের নানা ভুলভুলাইয়া। একেবারে সাদামাটা একটা ছোট্ট একতলা। কিন্তু আমি যেন মনে মনে ওবাড়িতে অনেক অনেক ঘর দেখতে পেতাম। ওদের কৎবেল গাছের তলায় যেখানে জেঠিমা উনুনে আঁচ দিতো সে জায়গাটা যেন বিশাল একটা অরণ্য মনে হতো। সন্ধ্যের অন্ধকার ঘন হলে সেখান দিয়ে আমি আমাদের সিঁড়িতে উঠতে পারতাম না। ভয় পেতাম খুব। কাঁপা গলায় মাকে ডাকতাম। মা এসে দরজায় দাঁড়ালে দৌড়ে চলে যেতাম। মা হেসে বলত, ভয় পাস কেন? পাঁচ পায়ের তফাতে সিঁড়ি, তাই এত ভয়?   

তখনও অশান্ত চারিদিক। চাপা ভয়। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ভাই ভাইকে নয়, বন্ধু বন্ধুকে নয়। শিক্ষক ছাত্রকে নয়। কে জানে, সজলদাকে তার বাবার ছাত্রদের মধ্যেই কেউ মেরেছিল কিনা?

       এরপরেও বন্ধ দরজার ওপারে নাটকের রিহার্সালের শব্দ শোনা গেছে।

       –আমাদের কী করার আছে বল তো? এই লেখাপড়ার কি দাম? একটা চাকরি জুটছে না। ওদিকে বাবা রিটায়ার করেছে। বাড়িতে মাইরি মুখ দেখানো ঝামেলা হয়েছে। এই কালী, চা দে।

       –চা কি বিনি পয়সায় পাওয়া যায়?

       –অ্যাই শালা! মুখ সামলে।

অন্য একটা গলা শোনা যায়।

       –বিপ্লব হচ্ছে, বিপ্লব। পেটে ভাত নেই, বিপ্লব। এর থেকে শালা খোঁচর হলে আয় ছিল।

নিস্তব্ধ ঘর। হঠাৎ ঝটাপটির শব্দ। –এই তুই খোঁচর? বল শালা! খোঁচর?

একটা একটানা আর্ত চিৎকার।

       মা সজোরে দরজা ঠেলে খুলে দিলো। “এখানে কেউ কারুকে মারবে না বলে দিলাম। কেউ না”। মায়ের উত্তেজিত ভেজা গলা শুনে অলোককাকুই প্রথম কথা বলল—বউদি, চা খাওয়ান। নাটকের ডায়ালগ তো। সত্যি নাকি? রিহার্সাল চলছে তো। “তবে কে ওভাবে চিৎকার করল?” মা তখনও অস্থির। উদয়ভানু নামের রোগা ছেলেটা সামনে এসে দাঁড়ালো। “প্র্যাকটিস করছিলাম বউদি। ঠিক হয়েছে?’ মায়ের চোখ জ্বলজ্বল করছে—ওসব আজেবাজে কান্না প্র্যাকটিস করার দরকার নেই।

       সেদিনের মতো দরজা আর বন্ধ হল না।

       আমরা কিন্তু খুঁজে পেলাম কে মেরেছে সজলদাকে। শান্তশ্রী মুখার্জি। দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা তার নাম। সজলদাকে সেই তো মেরেছে! ফিসফাস শুনেছি আমরা। ভুলোকাকাকে যেন আমরাই গল্প শোনাচ্ছি। কিন্তু ভুলোকাকা প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে গম্ভীর গলায় বলল, যার নামে ‘শান্ত’ কথাটা থাকে সে কি কাউকে মেরে ফেলতে পারে? আর হলই বা উল্টো দল। তাই বলে সে মারবে কেন? আমরা জিজ্ঞেস করলাম—তুমি জানো? আমাদের খুব দুঃখ হয়েছে। আর জানতেও ইচ্ছে করছে সজলদাকে কে মেরেছে। ভুলোকাকা বলল—একটা আন্দাজ করেচি বইকি। তবে সেকথাটা তো পাঁচকান করার নয়। আমাদের ‘মাইরি’ আর ‘মা কালীর দিব্যি’ বলা বারণ। তবু ভুলোকাকাকে তুষ্ট করতে অপশব্দ বলতেই হল। ভুলোকাকা বলল—যদ্দুর মনে হয় সজলদাদার অত লেখাপড়ার জন্যিই প্রাণডা গেল। –কেন কেন? –অনেক জেনি ফেলিচিল কিনা, তাই। যারা অনেক বেশি জানে তাদেরকে মরি যেতি হয়। যারা কম জানে তাদের মুশকিল হয় যে! সেই শুনে আমাদের ধারণা পালটে গেল। শান্তশ্রী যার নাম সে কখনোই সজলদাকে মারেনি। মারতে পারে না। আর, বেশি জানা খুবই খারাপ। তাতে অন্য লোকের মুশকিল হয়, তাই মরে যেতে হয়। আমাদের কী ফুর্তি সেদিন! তাই তো! মাকে বলতে হবে। বেশি লেখাপড়া করলে সজলদার মতো মরে যাবো। কিন্তু বলব কী করে! বলা তো বারণ। পাঁচকান করা বারণ তো। সারাদিন পেটে চাপা রইল সেকথা। সেদিন ঘুমের মধ্যে কেঁদে উঠছি। মা কিছুতেই ভোলাতে পারছে না। শেষে টেনে বিছানায় বসিয়ে দিয়েছে। “কী হয়েছে? পেট ব্যাথা করছে?” আমি না পেরে কেঁদে উঠলাম—সজলদা অনেক জানত বলে ওকে মরে যেতে হয়েছে। মা দুহাতে আমাকে বুকে চেপে ধরেছে। চোখ থেকে বড় বড় ফোঁটায় গরম জল আমার মুখে পড়ছে। মা ফিসফিস করে বলছে—চুপ চুপ। কেউ যেন এসব না শোনে।     

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত