মহানগরের নয়জন নিবাসী (পর্ব-২৮) । ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী
মিজোরামের আইজল শহরের পদার্থ বিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী (১৯৪৮) অসমিয়া সাহিত্যের একজন সুপরিচিত এবং ব্যতিক্রমী ঔপন্যাসিক। আজ পর্যন্ত আটটি উপন্যাস এবং দুটি উপন্যাসিকা, অনেক ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাছাড়া শিশুদের জন্য দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারই ইংরেজি ভাষার একটি নতুন দিল্লির চিলড্রেন বুক ট্রাস্ট থেকে ১৯৯২ সনে প্রকাশিত হয়। দেশ-বিভাজন, প্রব্রজন, ভেরোণীয়া মাতৃত্ব (ভাড়াটে মাতৃত্ব), ধর্ম এবং সামাজিক বিবর্তন ইত্যাদি তাঁর উপন্যাসের মূল বিষয়। আলোচ্য ‘মহানগরের নয়জন নিবাসী’উপন্যাসে ১৯৩২ সনে স্টালিনের বিরুদ্ধে লেলিনগ্রাডের নয়জন টলস্টয়বাদী গান্ধিজির অহিংসা নীতির দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে করা আন্দোলনের ছবি ফুটে উঠেছে। তাঁর ইংরেজি ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ দুটি হল From Valley to Valley (Sahitya Akademi, New Delhi, 2010) এবং The Highlanders (Blue Rose Publishers, New Delhi, 2010)। বাংলা ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ ‘স্থানান্তর’ (অর্পিতা প্রকাশন, কলকাতা, ২০০৭)। বাসুদেব দাসের অনুবাদে ইরাবতীর পাঠকদের জন্য আজ থাকছে মহানগরের নয়জন নিবাসীর পর্ব-২৮।
স্থানঃ মস্কো
সময়ঃ১৯৮৯ সনের নভেম্বর মাস।
মস্কোতে অধ্যাপক ক্রিয়োসকভওদের জন্য অধীর ভাবে অপেক্ষা করছিলেন।
ওদের সমস্ত কথা শুনে সে বড়ো খুশি হল,সঙ্গে নাদিয়া-প’পভনার জন্য খারাপ লাগল।
সে ওদেরকে – টলস্টয়বাদীরাগান্ধীর যে অহিংসার অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল তা বলশেভিক শক্তির জন্য বড়োভয়াবহ ছিল। নিজের দলের কিছু মানুষের বিরোধ, জনতার একাংশের বিরোধ, গির্জা থেকে বিরোধ,এমনকি পশ্চিমী দেশের চাপ– এই সমস্ত কিছুর মধ্যে স্টালিনের টলস্টয়বাদীদের ক্ষমা করার কথা চিন্তা করার অবকাশ ছিল না। তাছাড়া’– তিনি বলে গেলেন– মহাত্মাগান্ধীর অহিংসার অস্ত্র আফ্রিকা আর ভারতে প্রয়োগ করা হয়েছিল এবং দুটি জায়গাতেই করা হয়েছিলবিদেশি ইংরাজ শক্তির বিরুদ্ধে। দু জায়গাতেই সফল হয়েছিল। কিন্তু–’
অধ্যাপক ক্রিয়োসকভ বললেন –’রাশিয়া ভারত ছিল না। গান্ধীবাদ সফল হওয়ার জন্য রাশিয়ার শাসন ইংরেজের শাসন ছিল না।’
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তিনি তাদের বললেন–’ অনেক হল। এখন তোমরা নিজের নিজেরগবেষণায় মন দাও।’
একমাস পরে নাটালিয়ার ধীরে ধীরে পুনরায় পড়াশোনায় মন বসতে আরম্ভ করেছিল। কেননা বাড়িতে মা তাকে খুব আদর যত্ন করে দেখাশোনা করছিল। মা লিডিয়াপাভল’নার মেয়ের প্রতি ভালোবাসা উথলে ওঠার কারণ কেবল বহুদিন স্থির হয়ে ঘরে না থাকার কারণই ছিল না, অন্য একটি কারণও ছিল। সেটা ছিল তাঁর পিতা পাভল’ভ টেলপুগ’ভক সেই সংকটময়সময়েআরক্ষীর বিভাগে কাজ করলেও – সেই তখনই কয়েকদিন দেখা হয়ে ভালোলাগাফিয়ডরেরবুড়ি ঠাকুরমা য়াকুরিম গ্রামে দেখা করে আসার কারণটা।
‘অ’ নাটাস্কা’– মা তাকে আদর করে ডেকেছিল।–’ ফিয়ডরের ঠাকুরমার সঙ্গে আমার বাবার দেখা হয়েছিল?’
তিনি তাকে পুনরায় আদর করে বলেছিলেন–’অ নাট’সেঙ্কাফিয়ডরকে একবার আসার জন্য বলবি তো। ছেলেটিকেবড়ো ভালো লাগে। আমিও একদিন য়াকুরিম গ্রামে যাব তার ঠাকুমার সঙ্গে দেখা করার জন্য।’
এই স্নেহশীল বাতাবরণে নাটালিয়ার কেবল বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বাড়িতেও পড়াশোনায় মন বসে ছিল। কিন্তু সেই সময় তার মনে হল ফিউডরমাঝেমধ্যে বিভাগ বা গ্রন্থাগার থেকে নাই হয়ে যাচ্ছে। দেখা হলেও তাকে বড়োঅন্যমনস্ক হয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে।
একদিন যখন সে দেখল একনাগাড়ে চার দিনের জন্য সে নাই হয়ে গেছে, সে তখন তার খোঁজে হোস্টেলেগিয়ে পৌঁছাল। পাশের ঘরে থাকা একজন গবেষক তার পরিচয় পেয়ে হাতে একটি ছোট চিঠি তুলে দিল।
সেখানে লেখা ছিল–’ নাটালিয়া, ঠাকুরমা জানতে চাওয়া সার্জেন্ট নিকোলাইয়াগুটকিনের খবরের খোঁজে আমি সাইবেরিয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছি। মৃত্যুর পরে দশ বছরের ছোট্ট একটি মেয়েকে সঙ্গে নিয়েমানুষটা তার অ’য়িময়াকনে পালিয়ে গিয়েছিল বলে জানতে পেরেছি । তুমি জানই জায়গাটা পৃথিবীর সবচেয়ে শীতল জায়গা। তার মধ্যে এখন ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ। আমি একাই বেরিয়েছি। তুমি চিন্তা কর না। ১০ দিনের ভেতরে আমি ফিরে আসব।’– ফিয়ডর।
চিঠিটা সে কয়েকবারপড়ল। তারপরে সে হোস্টেল থেকে বেরিয়ে আসার সময় তার পদক্ষেপ দ্রুত হতে লাগল। বাসে আসার সময় তার মনটা ধীরে ধীরেএতটাই উদ্বেলিত হল যে এতদিন একসঙ্গে ঘুরে ঘুরেরোমাঞ্চ এবং উত্তেজনা অনুভব করা নাটালিয়া অ’য়িময়াকনে যাবে বলে ঠিক করল। সেই তখনকার দিনেই রাজকুমারী মারিয়াভলক’নস্কায়ায়োডিসেম্ব্রিষ্টদেরসঙ্গদানের জন্য বিজলি বিহীন সাইবেরিয়ায় গিয়েছিল।
সে পরের দিনইট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলে উঠে পড়ল। য়াকুটস্কের কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত রেলে গেল । তারপরে সে অ’য়িময়াকানে যাবার জন্য গাড়ির খোঁজ করতে লাগল। গাড়ি মোটর এবং মানুষের সংখ্যা ছিল খুবই কম ।অ’য়িময়াকনে যাবার জন্য একা বের হওয়া এই কম বয়সী যুবতিমেয়েটির দিকে গলা পর্যন্ত মদগিলে গম্ভীর হয়ে থাকতে চেষ্টা করা দু একটি মানুষ কৌতুহলীর দৃষ্টিতে বড়োবড়ো চোখ করে তাকাতে লাগল। ওদের পরনে ভারী জুতোর সঙ্গে মাথা থেকে হাঁটু পর্যন্ত ছিল লোমশহলৌজামা। মুখগুলি থেকে গন্ধ মিশ্রিত ভারী বাষ্প বের হচ্ছিল ।
আরো পড়ুন: মহানগরের নয়জন নিবাসী (পর্ব-২৭) । ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী
নাটালিয়া প্রথমে য়াকুটস্কর থেকে একদিনে লেনা এবং আলডান নদী পার হয়ে খান্ডিগাতে গেল। সে ধীরে ধীরে শীতের তীব্রতা অনুভব করতে লাগল। একজন সহযাত্রী বলল– এর উত্তাপ শূন্যের চেয়ে বাইশ ডিগ্রি নিচে।
তার মনে হল বাইরের চারপাশে শক্ত বরফ। পথের উপরেও তার আস্তরণ। ঘর গুলির চিমনি থেকে বের হওয়াধোঁয়া গুলি বেশ ভারী। ভারী ভিজে বাতাবরণে অতি ধীর গতিতে অলসভাবেধোঁয়াগুলি উপরে উড়ছে। শীততাপনিয়ন্ত্রিত গাড়িটির চারপাশে দুটো করে কাচ। তার সামনে এবং পেছন থেকে অহরহ ওয়াইপার চলছে।
কচ্চিৎ যানবাহন চলা ডিজে পথটা দিয়েনাটালিয়ারা পরের দিন খাণ্ডিগার থেকে ক্যয়োব্যয়োম হয়ে অ’য়িময়াকনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল।সে বুঝতে পারল দিনগুলি ছোটো হয়ে এসেছে। চারপাশের কাজল বর্ণে আলোগুলি ফ্যাকাশে হয়ে পড়েছে। তবু গাছ বন ঢেকে থাকা সাদা বরফ গুলি জ্বল জ্বল করছে। সে চালকের কাছে সামনের সিটে বসেছিল। সেখান থেকেই সে ওয়াইপার চলতে থাকা সামনের কাচ দিয়ে উঁকি দিয়েদিয়ে বাইরে দেখতে লাগল।
‘ এই দুর্গম পথগুলি সেই তখনকার দিনেই গুলাগেরবন্দিরা তৈরি করা।’– পেছনে বসে থাকা কোনো একজন যাত্রী নাটালিয়ার মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য বলল।
সে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল।
ওদের গাড়ি সাবধানে ভেরখায়ানস্ক পর্বত পার হল। তারপরে পথের এক জায়গায় একটা বিশাল পাথরের ওপরে একটা বড়ো ক্রস দেখতে পেল।
এবার গাড়ির গতি মন্থর করে চালক বলল– গুলাগেথাকা হাজার হাজারবন্দির পথ নির্মাণ করার সময় মৃত্যু হয়েছিল। ওদের স্মরণ করে এই ক্রসটা তৈরি করা হয়েছিল।
এরপরেওদেরগাড়িপাহাড়ের ঢালু গা বেয়ে ধীরেধীরে যেতে লাগল। দুটো পাহাড়ের উঁচু অংশ সংযোগকারী একটি অতি উঁচু সেতু ওরা পার হল। অনেক নিচে কন্দরদিয়েবয়ে যাওয়া শব্দ ওরা শুনতে পেল না। কেননা নদীর জল জমাট বেঁধে এখন সাদা চাদরের মতো বরফ হয়ে পড়েছিল।তারপরে আরও কিছু সময়পাহাড়দিয়ে বেয়ে ওদেরগাড়ি ধীরে ধীরে নামতে শুরু করল এবং দূরে থাকা নিম্ন অঞ্চলের টমটর গ্রামে প্রবেশ করল।
টমটর গ্রাম থেকে অ’য়িময়াকন প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার।পথটা কালিমা হাইওয়ের অংশ।
অন্ধকার হয়ে এল। নাটালিয়ার মন অনিশ্চয়তায়ঘিরে ধরল।’ এই অঞ্চলে এই মাসের শেষের দিকে দিনের আলো ক্ষণকালীন। মাত্র তিন ঘণ্টার। জুন জুলাই মাসে আবার দিনগুলি একুশ ঘণ্টার মতোদীর্ঘকালীন।’– কোনো একজন বলল ।
পথের দুপাশেই বরফের স্তূপ। গাড়ির সামনের তীব্র লাইটের আলোতে দেখা গেল বরফে আধা ডুবে থাকা ফলক গুলিতে দূরে দূরে ঘোড়া এবং গরুর ফার্ম থাকার ঘোষণা। তার কিছুক্ষণ পরে তারা একটা দীর্ঘ সুড়ঙ্গ পার হল। সেই সময়েই নাকি আশেপাশের মানুষগুলি খাদ্যের ভাঁড়ার হিসেবে সুড়ঙ্গটিকে ব্যবহার করত। গাড়ির আলোতে সুড়ঙ্গটার ভেতরে ওপরের চাল থেকে বরফের প্রলেপ সূঁচলো হয়ে ঝুলে থাকতে দেখা গেল।
সেটা পার হওয়ার পরে কেউ একজন বলল–”অ’য়িময়াকনে উত্তর মেরুর চেয়েওবেশিঠান্ডা। ১৯২৪ সনে এখানে সবচেয়ে কম উষ্ণতা দেখা দিয়েছিল–৭১.২ সেলসিয়াস। সেটা মনে রাখার জন্য সেখানে একটা কমিউনিস্টের চিহ্ন নির্মাণ করে রাখা আছে। সেটাও পুনরায় সংযোগক্রমে স্টালিন দলপতি হওয়ার বছর।’
নাটালিয়া শুনে গেল।
‘এই কম উষ্ণতার জন্যই জায়গাটিতে বসতি কম । তিনশোর মতো নাকি?’– মানুষটা বিজ্ঞের মতো বলল।
‘এখানে মানুষের তুষারক্ষত হতে পারে। মগজ বিকল হতে পারে ।ফার বা গরম কাপড়দিয়ে মুখ ঢেকে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে হয় । না হলে ফুসফুস মুহূর্তের মধ্যে বরফ হয়ে যেতে পারে। সেই জন্যই’– মানুষটা বলল– কোথাও ঢুকে থাকা পাখি যদি এই আবহাওয়ায়ভুলক্রমে বাইরে আসে, মুহূর্তের মধ্যে বরফের লাড্ডু হয়ে নিচের বরফের স্তূপে খসে পড়ে।’
নাটালিয়ারা আশেপাশেরশিঙওলারেইনডিয়ারের ক্যাম্প পার হল। ওরা গাড়ির লাইটের আলোতে দেখা কুয়াশায় অস্পষ্ট হয়ে থাকা রহস্যময় যেন মনে হওয়া অ’য়িময়াকন গ্রামটিতে ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ল।
অনুবাদক