| 29 মার্চ 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প ধারাবাহিক

মহানগরের নয়জন নিবাসী (পর্ব-২৪) । ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,নাডিয়ামিজোরামের আইজল শহরের পদার্থ বিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী (১৯৪৮) অসমিয়া সাহিত্যের একজন সুপরিচিত এবং ব্যতিক্রমী ঔপন্যাসিক। আজ পর্যন্ত আটটি উপন্যাস এবং দুটি উপন্যাসিকা, অনেক ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাছাড়া শিশুদের জন্য দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারই ইংরেজি ভাষার একটি নতুন দিল্লির চিলড্রেন বুক ট্রাস্ট থেকে ১৯৯২ সনে প্রকাশিত হয়। দেশ-বিভাজন, প্রব্রজন, ভেরোণীয়া মাতৃত্ব (ভাড়াটে মাতৃত্ব), ধর্ম এবং সামাজিক বিবর্তন ইত্যাদি তাঁর উপন্যাসের মূল বিষয়। আলোচ্য ‘মহানগরের নয়জন নিবাসী’উপন্যাসে ১৯৩২ সনে স্টালিনের বিরুদ্ধে লেলিনগ্রাডের নয়জন টলস্টয়বাদী গান্ধিজির অহিংসা নীতির দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে করা আন্দোলনের ছবি ফুটে উঠেছে। তাঁর ইংরেজি ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ দুটি হল From Valley to Valley (Sahitya Akademi, New Delhi, 2010) এবং The Highlanders (Blue Rose Publishers, New Delhi, 2010)। বাংলা ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ ‘স্থানান্তর’ (অর্পিতা প্রকাশন, কলকাতা, ২০০৭)। বাসুদেব দাসের অনুবাদে ইরাবতীর পাঠকদের জন্য আজ থাকছে মহানগরের নয়জন নিবাসীর পর্ব-২৪।


লিঅ’নিডের মাঝেমধ্যে ওদের বাড়ি থেকে  নাই হয়ে যাওয়ার কথাটা নাডিয়ার চোখে পড়েছিল।নাডিয়া একদিনবাড়ি থেকে বেরিয়ে এল এবং চাকা  চালাতে থাকা ডিমভককে দেখে জিজ্ঞেস করল–’এই, তুই  কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছিস?লিঅ’নিডকে দেখেছিস কি?’

‘তখন  ওদিকে যেতে দেখেছিলাম দিদি নাডিয়া।’সে গাছপালার মধ্য দিয়ে যাওয়া একটা পথের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। 

‘তাই নাকি ? আমি তাহলে খুঁজতে  যাই।’

‘আমিও কি তোমার সঙ্গে যাব দিদি?’

ডিমভরের নাডিয়ার সঙ্গে গিয়ে অনেক কথা বলার ইচ্ছা ছিল।অঞ্চলটিতে হয়ে থাকা কিছু কথা জানার ইচ্ছা ছিল।কিন্তু সে দেখল নাডিয়া বড় অন্যমনস্ক ভাবে হেঁটে চলেছে।

কোনো উত্তর না পেয়ে সে জিজ্ঞেস করল–’তুমি কয়েকদিন শহরে যাও নাই নাকি দিদি নাডিয়া?’

নাডিয়া যেন সম্বিত ফিরে পেল।

সে বলল–’যেতে পারিনি।বাড়িতে অতিথি থাকেই।’

সে পুনরায় বলল–’গেলেই তোর জন্য পাউরুটি আর কেভিয়ার আনব,না হলে অন্য কোনো চাটনি।হবে তো?’

‘আনলে তো খুশি হবই কিন্তু না আনলেও হবে,দিদি নাডিয়া।’

ডিমভরের তখনও সে জানতে চাওয়া কথা শেষ হয়নি।আজকাল চমন’ভ মুচি জুতোর কাজে কামাই করে কেন?সঙ্গে নাতি গ্ৰেভিল’ভেই বা ঘনঘন শহরে যায় না কেন?দর্জি খুড্রিক’ভো কাজের প্রতি উদাসীন কেন?’

সে এসব কিছুই জিজ্ঞেস করল না। সে চাকাটা কাঁধে নিয়ে ঘাড়  ঘুরিয়ে নাদিয়ার মুখের দিকে তাকাতে তাকাতে দ্রুতপায়ে যেতে থাকল। অনেকক্ষণ পরে এসে জিজ্ঞেস করল – দিদি নাডিয়া ভিক্টর একছুর্স্কি মহাশয় আজকাল আসছে না নাকি?’

ভিক্টর একছুর্স্কি  এই অঞ্চলের টলস্টয়বাদীদের কাজের মূল কর্মকর্তা।তিনি বড় ব্যস্ত রয়েছেন। নাডিয়া বলল –’ ডিমভ, আমাদের অঞ্চলের অবস্থা ভালো নয়। সেই জন্য তিনি খুব ব্যস্ত রয়েছেন। তোর অর্ধেক আঁকা  ছবিটা আমাদের ঘরেই রয়েছে। তোর ছবিটা রং দিয়ে শেষ করতে না পেরে তার খুব মন খারাপ হয়ে আছে। কাজ রয়েছে যে– পরে  আঁকবে কেমন।’

ছবিটা কেমন হয় দেখার জন্য ডিমভ বড় উদগ্রীব হয়ে ছিল। তবু সে নাডিয়ার কথা বুঝতে পেরেছে এমন একটি ভাব করে মাথা নাড়ল।

ডিমভের আরও কিছু জিজ্ঞেস করার ছিল। কিন্তু নাডিয়াকে বড় ব‍্যগ্ৰ হয়ে এগিয়ে যেতে দেখে বলল – দিদি নাডিয়া, আমি তাহলে এখন যাই।’

‘ যা।’– নাডিয়া বলল’ ঘুরে বেড়াস না। পরিস্থিতি ভালো নয়। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাবি।’

দৌড়ে দৌড়ে চাকা চালিয়ে যেতে যেতে ডিমভ চিৎকার করে নাডিয়ার কথায় সায় দিল ।

নাডিয়া ধীরে ধীরে  পথটা দিয়ে গাছ পালার মধ্যে ঢুকে পড়ল।যতই ভেতরে গেল ততই সে উদগ্রীব হয়ে পড়ল।কিছুদুর যাবার পরে দূর থেকে সে লিঅ’নিডকে দেখতে পেল।সে একটা গাছের গোড়ায় বসে এক দিকে তাকিয়ে কোন এক চিন্তায় মগ্ন হয়েছিল।নাডিয়া তার কাছে গেল।


আরো পড়ুন: মহানগরের নয়জন নিবাসী (পর্ব-২৩) । ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী


লিঅ’নিড হঠাৎ তাকে দেখে মাথা তুলে তাকাল এবং বসে থাকা গাছের গোড়া থেকে উঠে দাঁড়াল।

‘ তুমি?’– সে জিজ্ঞেস করল।

মুচকি হাসার চেষ্টা করে নাডিয়া সায়  দিল। তারপর বলল–’ সেখানে তিনজন মানুষ বসে আলোচনা করছে।তুমি তার মধ্যে নেই । সেই জন্য আমি তোমার খোঁজে এলাম।’

লিঅ’নিডের চিন্তান্বিত মুখটা তখন ও কোমল হয়নি। 

‘ কেন আছ এখানে?”

নাডিয়ার প্রশ্নের উত্তরে লিঅ’নিড বলল–’ একটা বিশেষ কারণে নাডিয়া।’

‘ বসবে নাকি?’– সে গাছের গোড়ার দিকে তাকিয়ে বলল।

নাডিয়া বসল।

‘ তুমিও বস।’ নাডিয়া বলল।

লিঅ’নিড তার পাশে বসল।

‘বল, আমাকে কারণটা বল কেন আছ ওই জায়গায় ?’

লিঅ’নিড কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। তারপরে কিছুক্ষণ দূরে থাকা ভেসিলির কবরের ঢিপিটাকে দেখিয়ে সে বলল – ‘ওটার জন্য।’

নাডিয়া অবাক হয়ে সেদিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল। তারপর জিজ্ঞেস করল–’ ওটা কার কবর?’

লিঅ’নিড বলল–’ এমন একজন মানুষের যে টলস্টয়ের কথা না জেনেই আমাদের চেয়েও আগে থেকে  টলস্টয়বাদী  ছিলেন।’

সে সংক্ষেপে ভেসিলির কথা নাডিয়াকে বলল।

‘ যখনই’– সে বলে গেল–’ আমি আমার আদর্শের প্রতি দুর্বলতা অনুভব করি আমি এই জায়গায় আসি। মনে জোর পাই।’

লিঅ”নিডের কণ্ঠস্বরে আবেগ গড়িয়ে পড়ছিল। তার কথার এই ধরনের সুর নাডিয়া আগে কখনও শুনেনি।সে পাশে বসে থাকা লিঅ’নিডের হাতে নিজের হাতটা আলগোছে রাখল। তারপর বলল – তুমি একটুও চিন্তা কর না লিঅ’নিড।’

লিঅ’নিড নাডিয়ার চোখের দিকে তাকাল। তার নীল  চোখে ছিল আশ্বাসের দৃষ্টি। সেটার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

কিছুক্ষণ পরে এসে বলল–’ আমরা আমাদের নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধে সফল হব কি নাডিয়া?’

নাডিয়া তার হাতটা একটু জোরে ধরল এবং তারপর বলল–’ কেন হবেনা লিঅ’নিড?’

সে বলল –’ভেসিলি মহোদয়দের সঙ্গে কুলাক জন মেক্সিম’ভিস যোগ দেওয়া জায়গায় যে আমাদের প্রতিরোধ কোনো প্রতিরোধ নয় সে কথাই প্রমাণিত হল না কি?

নাডিয়া তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল–’ দুই জায়গাতেই ঘটা ঘটনাগুলি পৃথক ছিল লিঅ’নিড। ভেসিলি মহোদয়দের ওখানে আমাদের মানুষ মরে ছিল। আরক্ষীর  লোক মরেছিল। এমনকি ভেসিলি মহোদয়ও নিজের মানুষের হাতে মরেছিল। কিন্তু কুলাক জন মেক্সিম’ভিচ যোগ দেওয়া জায়গায়?’

নাডিয়া দৃঢ়ভাবে প্রতিটি শব্দে জোর দিয়ে দিয়ে বলল – সেখানে আমরা প্রতিরোধে বিফল হলাম। কিন্তু একজনেরও প্রাণহানি হল না। প্রাণ হানি না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ প্রদর্শন করাটাই সফলতা নয়কি লিঅ’নিড? তোমরা একসময় সফল হবেই।’

নাডিয়া আবেগিক হয়ে পড়ল। সে বলে গেল–’ তুমি মাটিকে  ভালোবেসেছ লিঅ’নিড। তুমি মানুষ ভালো পেয়েছ। তুমি সরকারি আরক্ষী বা সামরিক বাহিনীর কার্যকে প্রতিরোধ করতে চাইছ ওদের পোশাকের আড়ালের মানুষগুলিকে নয়। তুমি আর তোমরা তাদের হিংসা করছ না। হিংসার আশ্রয় নেওয়ার কথা চিন্তা করনি। তোমরা অহিংস।তোমাদের পথ অহিংস।এটাই প্রেম ভালবাসার পথ।এর জয় একদিন অনিবার্য লিঅ’নিড।’

লিঅ’নিড নাডিয়ার চোখের দিকে স্থির ভাবে তাকিয়ে রইল। সে যেন  তার দুচোখের মধ্যে দিয়ে হৃদয় পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে।সে ধীরে ধীরে তার দিকে হেলে পড়ল  এবং তার দিকে এগিয়ে আসা নাডিয়ার ঠোঁটে আলগোছে একটা চুমু খেল।লিঅ’নিড একটু সরে পড়ায় নাডিয়ার  মুখে একটা তৃপ্তির হাসি ছড়িয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পরে আবার ওরা দুজনেই উপর্যুপরি চুমু খেতে লাগল।

অনেকক্ষণ পরে ওরা বসা থেকে উঠে দাঁড়াল এবং লিঅ’নিড আর  নাডিয়া দুজনে পাতায়  করে জল এনে ভেসিলির কবরের উপর ঢেলে দিল ।

ওরা যখন গাছপালার মধ্য দিয়ে আসা পথটি দিয়ে বেরিয়ে এল তখনও বাইরে আলো ছিল। দূরে এটিকের সঙ্গে নাডিয়াদের  বাড়িটা দেখা যাচ্ছিল। 

সেই সময় পেছন থেকে দৌড়ে আসে কয়েকটি ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে পাওয়া গেল। বড় দ্রুতবেগে কেউ ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে। নাডিয়া  এবং লিঅ’নিড সন্ত্রস্ত হল। ওরা রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে রইল। ওরা দেখতে পেল পূর্ণভাবে সজ্জিত তিনজন আরক্ষী অফিসার ওদের অতিক্রম করে যাচ্ছে।কিছুদূর যাওয়ার পরে তিনজনের ঘোড়ার গতি বেগ কম হল। একজন অপর দুজনকে কিছু একটা বলল।এবং তিনি ঘোড়াটা ঘুরিয়ে এনে লিঅ’নিডের  কাছে উপস্থিত হলেন।

‘লিঅ’নিড এডলার মহোদয় নয় কি?’– ঘোড়ার পিঠের ওপর  থেকে একজন অফিসার বললেন।

‘ হ্যাঁ, কিন্তু আপনাকে চিনতে পারলাম না।’

লিঅ’নিডের কথা শুনে অফিসারটি বললেন–’ আমি পাভল’ভ টেলপুগ’ভ।এক মাস আগে সন্ধ্যাবেলা আমার এই পথেই আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল।’

অফিসারটি ঘোড়ার পিঠ থেকে নামল।লিঅ’নিড  তাকে চিনতে পারল। সেই গণআদালতের আরক্ষী অফিসার।

অফিসারটি মাথার টুপি খুলে নাডিয়াকে শুভ সন্ধ্যা জানালো এবং লিঅ’নিডকে  বলল–’ মহোদয়, খবর বড় ভালো নয়। সেদিন ক্রোক করা অঞ্চলে অনর্থ ঘটেছে। গতরাতে কেউ সেখানে থাকার জন্য আশ্রয় নেওয়া তিনজন অসামরিক অফিসারকে হত্যা করেছে। সঙ্গে তাদের থাকা বাড়িগুলিও  জ্বালিয়ে দিয়েছে। তাই–।’

অফিসারটি  বলল – আপনারা একটু সাবধানে থাকবেন ।’

লিঅ’নিডকে দুই কুড়ির কাছাকাছি অফিসারের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললেন – বুঝতে পেরেছি, আপনি অবাক হয়েছেন।আমিও সরকারি আরক্ষী- রেড কার্ড। আমারও বাহুতে লাল কাপড় ঘিরে থাকা বেজ  রয়েছে।তবে আমি সার্জেন্ট নিকোলাই য়াণ্ড টকিনের মতো গোট স্টালিনপন্থী নই। আমি মস্কোতে থাকার সময় লাঝারের প্রতি অনুগত ছিলাম।এখন কোমল মনের ছারজেই কিরভের প্রতি অনুগত। আমরা নিজের মানুষের জমি সম্পত্তি জোর জুলুম করে দখল করার কথা সমর্থন করি না।’

অফিসারটি লাফ  মেরে ঘোড়ায় উঠলেন। যাবার আগে লিঅ’নিডকে পুনরায় গম্ভীর কণ্ঠে বলে গেলেন – একটু সাবধানে থাকবেন।’

ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে এসেছিল। জোরে ঘোড়া ছুটিয়ে দূরে অদৃশ্য হওয়া রক্ষী তিনজনের দিকে লিঅ’নিড এবং নাডিয়া অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল।নাডিয়া লিঅ’নিডের হাতটা খামচে ধরল।

 যতই দিন যেতে লাগল ততই নাডিয়াদের অঞ্চলটির ক্রোক করার দিন কাছে চলে এল। সঙ্গে বেড়ে চলল উত্তেজনা এবং প্রচারকার্য। পিটার যেলেনক’ভ সহ সমস্ত টলস্টয়বাদীরা চারপাশে অহিংস আন্দোলনের প্রচারকার্য চালিয়ে যেতে লাগলেন।লিঅ’নিড আর মিখাইলও একত্রিত হয়ে নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তখনই একদিন ওদের দুজনকে কেউ কানে কানে বলল–’ পুনরায় অনর্থ হয়েছে। সেদিন আক্রমণ করে অসামরিক অফিসার তিনজনকে যে হত্যা করেছিল সেখানে সরকার পুনরায় অফিসার এবং আরক্ষীর সংখ্যা বৃদ্ধি করে পাকা শস্য চাপিয়ে সরকারের ভাণ্ডারে জমা করার বন্দোবস্ত করতে আরম্ভ করেছিল । এবার কেউ কয়েকটি শস‍্যের মাঠও জ্বালিয়ে দিয়েছে।সরকার পুনরায় রুষ্ট  হয়ে পড়েছে ।’

ওরা দুজনেই চিন্তান্বিত হল।তবু মানুষকে সংগঠিত করার কাজ করে গেল। বিকেলবেলা মিখাইল লিঅ’নিডের কাছ থেকে সরে এল। সে বলল–’ আমাকে শহরে যেতে হবে। কয়েক সপ্তাহের জন্য খাবার জিনিস জোগাড় করে রাখতে হবে। তাছাড়া পিটার যেলেনক’ভকে খবরটা দিতে হবে।’

লিঅ’নিডের মনে হল মিখাইল তার মনের  উত্তেজনা চেপে রাখার জন্য বৃথা চেষ্টা করছে।

বিকেলের দিকে মানুষের মধ্যে অহিংসার  আন্দোলনের প্রচার চালিয়ে লিঅ’নিড যখন ফিরে এল সে কেবল ক্লান্তই নয়, দুর্বলও হয়ে পড়ল। সে ধীরে ধীরে গাছপালার মধ্য দিয়ে নিঃসঙ্গ পথটা দিয়ে যেতে লাগল। সে ভেসলির কবরটার কাছে পৌঁছাল। আর গাছের গোড়ার ওপরে চিন্তান্বিত ভাবে বসে রইল। সে মাথার টুপিটা খুলে হাতে নিয়ে নিল।

সে কতক্ষণ সেখানে এভাবে বসে ছিল বলতে পারে না, কিন্তু হঠাৎ সে অনুভব করল তার কাছে এসে নাডিয়া উপস্থিত হয়েছে । নাডিয়া মাথায় একটা কাপড় পেচিয়ে এসেছে।লিঅ’নিড তার দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল।

অনেক সময় তাকিয়ে রইল।

‘ এত করে কি দেখছ?’– সে জিজ্ঞেস করল।

লিঅ’নিড কিছুই বলল না।

সে কেবল তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।সে যেন  একজন সম্পূর্ণা নারীরূপে তাকে দেখছে। গত কয়েকদিন নাডিয়াকে   অনেক রূপে ভেবেছে। নাডিয়া  যখন তার গলা জড়িয়ে ধরে তখন তাকে তার একসময়ে থাকা আদরের ছোট বোনটির মতো মনে হয়।যখন জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে নাডিয়া আস্থাভরা কথা বলে তখন তাকে তার পরম বান্ধব বলে মনে হয়। কিন্তু যখন মাথাটা তার বুকের মধ্যে চেপে ধরে তখন সে তার মধ্যে অনেক বছর আগে মৃত্যু হওয়া মায়ের বুকের উষ্ণতা অনুভব করে। কিন্তু আজ তার ঘিয়ের  চুলের একাংশ ঢেকে মাথায় কাপড় পেচিয়ে আসা নাডিয়া এই সমস্ত গুনে পরিপুষ্টা একজন সম্পূর্ণা নারীর রূপে লিঅ’নিডের সামনে ধরা দিয়েছে।

‘ এত করে কী দেখছ লিঅ’নিড?’– সে জিজ্ঞেস করল।

জড়তা ভরা কন্ঠে সে বলল–’ তোমাকে, তোমাকেই দেখছি নাডিয়া ।’

নাডিয়া  তার পাশে বসল।

‘ তুমি তো সবসময়ই আমাকে দেখ।’

‘ হ্যাঁ দেখি।’–লিঅ’নিডের জড়তা  তখনও দূর হয়নি। সে বলল–’ আজ তুমি আলাদা। তুমি আর ছোট যুবতি নও।’

সে তার মাথায় বেঁধে রাখা কাপড়ের উপর দিয়ে আলগোছে হাত বোলালো।’

‘ খুলে দেব?’– সে জিজ্ঞেস করল।

‘ না না খোল না ।’

সে বলল এবং তার নিজের টুপিটাও মাথায় পরে নিল – বেশ ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে।’

হালকা ঠাণ্ডা বাতাস এসে তার গায়ে লাগল।

‘ হ্যাঁ, ঠাণ্ডা পড়েছে।’– নাডিয়া তার কাছে চলে এল।

ওরা অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।

নাডিয়া বলল–’ আমি কিছু একটা কথা শুনলাম‌। কিছু ফসলের মাঠ নাকি জ্বালিয়ে দিয়েছে।’

লিঅ’নিড সায়   দিল। তারপর সে বলল–’ এখানকার কথা নিয়ে  বড় চিন্তা হচ্ছে নাডিয়া। তিন চার দিনের ভেতরে হয়তো ক্রোক করার জন্য সরকারি পক্ষ আসবে ।’

আমি জানি – তোমার মনের কথা। সেজন্যই আমি তোমাকে খুঁজে খুঁজে এখানে এসেছি ।’

নাডিয়া তার হাত ধরল–’ চিন্তা কর না লিঅ’নিড।তোমরা ভালো কাজ করতে গিয়েছ।প্রত্যেকেই  সাহায্য করবে।’

‘ কিন্তু?’–লিঅ’নিড আর কিছু বলতে পারল না।

নাডিয়া তাকে আশ্বাস দিয়ে অনেক কথা বলতে লাগল।

ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে এল।ওরা কথা বলার সময় চারপাশ অন্ধকার ঘিরে ধরল। নাডিয়া   তাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিল। ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে সান্ত্বনা দিল। অনেকক্ষণ সেখানে বসে রইল। একসময় ওরা দুজনেই উঠল।ওরা ঠাণ্ডা বাতাসের মধ্যে দিয়ে কিছুটা  দূরে থাকা ছোট ঝর্ণাটার কাছে গেল এবং পা টিপে টিপে গাছের পাতায় এক অঞ্জলি জল নিয়ে এল ।ওরা ভেসিলির  কবরের ওপরে অন্য দিনের মতোই জল ঢালতে লাগল ।

নাডিয়ার মনে হল লিঅ’নিডের হাতটা ঠান্ডা।তার জেকেটের  দুটো হাতের কিছু অংশ অন্ধকারে জল আনতে  গিয়ে ভিজে গেছে । সারাদিন টো টো করে মানুষের মধ্যে ঘুরে কাজ করে থাকার সময় লিঅ’নিডের পাতলা জ্যাকেটটা তাকে আবশ্যকীয় উষ্ণতা দিয়েছিল । কিন্তু এই রাত হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে শীত রোধ করার জন্য জ্যাকেটটা যথেষ্ট ছিল না ।ঝর্ণার ঠান্ডা জলে ভেজা হাতটাও তার শরীরে ঠান্ডার ভাব বাড়িয়ে দিল। তার খুব শীত করতে লাগল। দেহটা মৃদুভাবে কাঁপতে লাগল।

নাডিয়া এই  কম্পন অনুভব করল।

‘লিঅ’নিড ‘– সে ডাকল।– এসো আমরা বড় একটা গাছের আড়াল নিয়ে বসি। বাতাস লাগবে না।’

ওরা এক জায়গায় বসে পড়ল।

নাডিয়া লিঅ’নিডের দুটি হাতের তালু তার গালে লাগিয়ে নিল। 

গরম লাগছে লিঅ’নিড?’

লিঅ’নিডের হাত দুটি সে উপর থেকে মর্দন করতে লাগল । বলল – তুমি আমাকে জড়িয়ে ধর। জোরে–।’

সে কিছু সময় লিঅ’নিডকে জড়িয়ে ধরে  বসে রইল। সে এবার তার দুটো হাত লিঅ’নিডের বগলের নিচে ঢুকিয়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরল। সে তার ডান কাঁধে মাথা রেখে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল–’ গরম লাগছে কি লিঅ’নিড?’

লিঅ’নিড তখনও মৃদুভাবে কাঁপছিল। সে তাকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরল‌। 

নাডিয়া আবেগঘন কণ্ঠে তাকে বলল–’ উষ্ণতা আসবে লিঅ’নিড।’

সে অনেকক্ষণ ধরে তাকে এভাবে জড়িয়ে রইল।

প্রকৃতপক্ষে লিঅ’নিডের জেকেটের হাতটাই নয়, অন্ধকারে জল আনার সময় ঝরনার ভেজা তীরেও তার জুতোজোড়া ভিজেছিল । সেই জন্যই তার শরীরের তাপ তখনও ফিরে আসছিল না।

‘ আমার জুতো জোড়া ‘– লিঅ’নিড অস্ফুট স্বরে বলল ।

নাডিয়া তার শরীর  থেকে হাতটা ছাড়িয়ে জুতো জোড়া ছুঁয়ে  দেখল।– তোমার জুতো জোড়া তো একেবারে ভেজা। খোল, খোল।’– সে বলল।

নাডিয়া তার জুতো জোড়া খুলে দিলে।’মোজা জোড়াও  ডিজে।’–নাডিয়া মোজা জোড়া খুলে দিল।তারপর সে গলায় পেছিয়ে আনা স্কার্ফটা দিয়ে তার পা দুটো মুছতে লাগল।

সে নাডিয়াকে বাধা দিতে পারল না।সে স্কার্ফটা দিয়ে তার পা দুটো ঢেকে দিল-‘ভালো লাগছে লিঅ’নিড?’

সে সায় দিল,কিন্তু মৃদুভাবে কাঁপতেই থাকল।

‘তোমার হাতদুটি এখনও ঠাণ্ডা হয়ে আছে’-সে বলল-‘শী্তের ভাবটাও কমেনি।’

নাডিয়া এবার তার গায়ের জ্যাকেটের বোতামগুলি খুলে নিল।

‘দেখি তোমার হাতদুটি।’ সে লিঅ’নিডের ঠান্ডা হাতদুটি বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে নিল।তার ছোট জ্যাকেটটা দিয়ে তার শরীরটা ঢেকে নেবার চেষ্টা করল।

‘ভালো লাগছে কি?এভাবে ধর লিঅ’নিড-এভাবে ধর।’

নাডিয়া মৃদুভাবে উত্তেজিত হয়ে পড়ল।

লিঅ’নিডের দেহ তখনও উষ্ণ হয়ে উঠেনি।

নাডিয়া এবার লিঅ’নিডের একটা হাত তার সোয়েটার এবং শার্টের নিচে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেল।-তোমার গরম লাগবে নিঅ’নিড।নাডিয়ার শরীরে শীতল হাতের স্পর্শ লাগল এবং লিঅ’নিডের হাতে লাগল তার বক্ষের উষ্ণতা।নাডিয়া একটা শিহরণ অনুভব করল।সে এবার লিঅ’নিডের ঠোঁটে চুমু খেতে লাগল।

‘তোমার ভালো লাগবে লিঅ’নিড।’

চুমু খেতে খেতে নাডিয়া উত্তেজনায় কাঁপতে লাগল।ধীরে ধীরে সোয়েটার এবং শার্ট উপরে তুলে সে নিজের বক্ষ এক হাতে উন্মুক্ত করে দিল।নাডিয়া এবার কথা বলল না।অন্য হাত দিয়ে লিঅ’নিডের মাথাটা নিচের দিকে টেনে এনে তার কোমল বক্ষে চেপে ধরল।লিঅ’নিড যেন একটা শিশু হয়ে পড়ল।

লিঅ’নিডের শরীর ধীরে ধীরে উষ্ণ হয়ে উঠল।তার দেহের মধ্য দিয়ে উষ্ণ রক্তের স্রোত তীব্র বেগে বইতে লাগল।সে পুনরায় কাঁপতে লাগল-শী্তের জন্য নয়,উত্তেজনায়।

নাডিয়ার দেহটাও কেঁপে উঠল।তার শ্বাস প্রশ্বাস তীব্র হয়ে এল।সে লিঅ’নিডকে ধীরে ধীরে গাছের গোড়ায় শুইয়ে দিল।উত্তেজনায় সে কাঁপতে থাকল।উর্বর হয়ে পড়া নিম্নভাগের অর্ন্তবাস সে একসময় খুলে ফেলল এবং ওপর থেকে লিঅ’নিডকে জড়িয়ে ধরল।স্বর্গীয় অনুভূতিতে অনেকক্ষণ দুজনে ডুবে গেল।অনেকক্ষণ পরে ওরা দুজন পুনরায় ঠোঁটে কয়েকবার চুমু খেল।

‘অনেক রাত হল।’-লিঅ’নিড বলল –‘আমাদের যাবার সময় হয়েছে।’

ওরা কাপড় চোপড় ঝেড়ে নিয়ে পরে নিল।হাত ধরাধরি করে যাবার  সময় লিঅ’নিড নাডিয়ার মাথায় বাঁধা কাপড়টা একবার নেড়ে

দেখে নিল।হ্যাঁ,খুলে পড়া কাপড়টা মাথায় বেঁধে নিয়ে সে সম্পূর্ণ হয়ে আছে।রাত দুপুর হয়েছিল।কিন্তু রাতের অন্ধকারেও পূব দিগন্তে    সূর্যোদয়ের মতো একটা উজ্জ্বল আলো দেখা গিয়েছিল।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত