| 17 এপ্রিল 2024
Categories
ইরাবতী তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা

তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা গল্প: আনলকড প্রোফাইল । ক্ষমা মাহমুদ

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

নাতাশার মনটা ভালো নেই কয়েকদিন ধরেই। রুশোর সাথে ঝামেলাটা যেন কিছুতেই মিটছে না। কালকে রাতেও তুচ্ছ একটা ঘটনা নিয়ে হয়ে গেলো আরেক প্রস্থ ঝগড়াঝাটি, যার রেশ ধরে নাতাশার নির্ঘুম রাত। রুশো ঠিকই নাক ডেকে ঘুমালো অফিসে যাওয়ার আগ পর্যন্ত। নাতাশা উঠলো না, ঝিম মেরে পড়ে থাকলো। রুশো নাস্তা করলো কি করলো না সেটা উঁকি দিয়েও দেখলো না। আজকে সকালে কাজের বুয়াটাও আসেনি এখনও পর্যন্ত, মেজাজটা আরো খারাপ হয়ে গেল ওর। রাতের রাগটা ওকে কিছুতেই যেন  শান্ত হতে দিচ্ছে না। অফিসের জন্যে রেডী হতে গিয়েও চুপ করে বসে থাকলো কিছুক্ষণ। নাহ! আজকে অফিসে যাওয়াটা একদম ঠিক হবে না…মনটা অস্থির, কিছুই ভালো লাগছে না। কোন মানুষের সামনে আজকে যেতে ইচ্ছা করছেনা, হেসে হেসে কথা বলতেও ইচ্ছা করছে না। যেদিন মনের অবস্থা এমন থাকে সেদিন পৃথিবীর সব মানুষের সাথেই ঝামেলা হয়, এমনকি অফিসের অতি নিরীহ মানুষ পিওন মনোয়ারের সাথেও ঝামেলা হয়ে যেতে পারে। নিজের মনের অশান্তি তখন সব মানুষের উপর উগড়ে দিতে ইচ্ছে হয়।

ঝিম মেরে কিছুক্ষণ বসে থেকে অফিসে একটা ফোন দিয়ে নাতাশা জানিয়ে দিল, শরীরটা আজ খারাপ, আসতে পারছেনা। অফিসে আজ খুব জরুরী কিছু নেই, না গেলেও চলে। পরে সিক লিভ নিয়ে নেবে না হয়।

দরজাটা জোরে লাগানোর শব্দ পেয়ে বুঝলো রুশো অফিসে বের হয়ে গেলো। যাওয়ার সময় বলেও গেল না। সাধারণত ঝগড়া ঝড়ের পর রুশো অত কিছু মনে রাখেনা, কথা বলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে ফেলে। আজ মনে হয় একটু বেশীই খেপেছে। নাতাশাও মেজাজটা কালকে আর ধরে রাখতে পারেনি রাত বারোটায় যখন রুশো চোখমুখ লাল করে বাড়ি ফিরেছে। বুঝেছে যে নির্ঘাত বন্ধু দঙ্গলের সাথে মালপানি খেয়ে তবেই ফিরেছে। সপ্তাহ জুড়ে আজ অফিস তো কাল পুরনো বন্ধু তো আরেক দিন অন্য কাজের কারণে তার এমন আড্ডা লেগেই থাকে। নাতাশার এত ব্যস্ত জীবন ভালো লাগে না। সারাদিন অফিস করে বাসায় ফেরার পরের সময়টুকু শুধুই নিজেদের করে পেতে ইচ্ছে করে।

প্রায়ই দিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে ঘরের কাজ শেষ করে রুশোর ফিরে আসার প্রতীক্ষা করতে করতে একসময় ক্লান্ত হতে হতে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে নাতাশা। ওর খুব ইচ্ছা করে সন্ধ্যাটা ওরা এক সঙ্গে কাটাবে কিন্তু ছোট্ট এই চাওয়াটাই যেন প্রায়শই আকাশকুসুম স্বপ্ন হয়ে দাড়ায়। প্রায় প্রতিটা সন্ধ্যা একা একা এই বাড়িটার মধ্যে কাটাতে কাটাতে ও ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে উঠেছে। কত আর ফোনে এর, তার সাথে কথা বলে বা একা একা টিভি দেখে, বই পড়ে আর গান শুনে কাটানো যায়! সারাদিনের কত গল্প জমা হয়ে থাকে, রাতে যখন রুশো ফেরে সেসব কিছুই তাকে আর বলা হয় না। রুশোর অতিরিক্ত ব্যস্ত জীবন ওদের দশ বছরের সন্তানহীন সংসারটা বিষময় করে তুলেছে। গতরাতে আর নিজেকে সামলাতে পারেনি নাতাশা, বহুদিনের জমানো ক্ষোভ যেন বিচ্ছুরিত লাভার মত ফেটে পড়েছে রুশোর উপর।

বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় নীল রঙা ল্যাপটপটা কোলের কাছে টেনে নিল নাতাশা। মন খারাপের সময় এই নীলা সুন্দরীই তার প্রিয় সঙ্গী! ভাবলো, কিছু জরুরি ইমেইল চেক করার কাজটা বাসা থেকে সেরে ফেলতে পারলে ভালোই হয়। কাজের মধ্যে থাকলে অস্থিরতাটাও একটু কমবে। ইমেইল চেক করতে গিয়েও মেসেঞ্জারে আইকনে অনেকগুলো নোটিফিকেশন দেখে কৌতূহলবশত সেটাই আগে খুললো। কালকে পুরনো দিনের একটা ছবি পোস্ট করেছিলো স্টোরিতে, মনে হয় সেটারই নানা রকম কমেন্ট এসে বসে আছে। মেসেজগুলো চেক করতে করতে হঠাৎ একটা মেসেজে চোখ স্থির হয়ে গেল … ‘তোর নীল জামা পরা ছবিটা দেখতে খুব ভালে লাগছে! কেমন আছিস? ইচ্ছা হলে উত্তর দিস….’

সুপার গ্লুর মত চোখ দুটো সেটে রইলো লাইনগুলোর দিকে…. একবার পড়ার পর আরো কয়েকবার পড়লো নাতাশা… বার বার পড়লো… পুরনো প্রেমিকের লেখা লাইনগুলো ছবির মত চোখের ক্যানভাসে লেপ্টে রইলো! এক ধাক্কায় সহস্র স্মৃতিময় দিন ওর চোখের সামনে সিনেমার রিলের মত ভেসে যেতে যেতে এক যুগ আগের দিনগুলোয় ওকে ফিরিয়ে নিয়ে গেলো।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রেমে পড়েছিল অনিলের। সদা হাস্যেজ্জ্বল অনিল বন্ধু বান্ধবের দঙ্গল হৈচৈ করে মাতিয়ে রাখতো সবসময়। সেন্স অফ হিউমার ছিল দারুণ। সব মেয়েই চাইতো ওর বন্ধুর লিস্টে থাকতে। অনিলেরও কোন বাছবিচার ছিলনা, সকালে তনিমার সাথে তো দুপুরে ছেলেদের বন্ধু মহলে তো বিকেলে নিশির সাথে দেখা যায় তাকে। কোথাও সে স্থির না। কিন্তু এরমধ্যেই কিভাবে কিভাবে নাতাশার সাথে একটু একটু করে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। দুজনের একসাথে কাটানো সময় বাড়তে থাকে। সময়গুলো উড়ে উড়ে যাচ্ছিল। কোন ফাঁকে প্রায় তিনটে বছর কেটে গিয়েছিল টেরও পায়নি। কিন্তু নাতাশা অনুভব করা শুরু করেছিলো যে ওদের সম্পর্কের ভবিষ্যত নিয়ে দুজনের মধ্যে পরিষ্কার কথা হওয়া দরকার কিন্তু সেটাই হয়ে উঠছিল না। অনিলের সাথে কাটানো সময়গুলোয় নাতাশা এমন ঘোরের মধ্যে থাকে যে এই জরুরি কথাটা আর বলা হয়ে ওঠে না।

দেখতে দেখতে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষের দিকে চলে এলো ওরা। নাতাশা একদিন অনিলকে বলেই ফেললো, ‘আমাদের সম্পর্কের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবছিস কিছু?’

অনিল স্বভাবমত হাসলো, নাতাশার মসৃণ গালে একটু আঙুল বুলিয়ে বললো, ‘এত ভাবার দরকার কি! যেমন চলছে তেমন চলুক না।’

নাতাশা চেপে ধরে অনিলকে, ‘না, আমাদের একটু সিরিয়াস হতেই হবে অনি, কি ভাবিস তুই? আমরা কখনই ভবিষ্যত নিয়ে কথা বলিনা অথচ সবাই সুন্দর একটা ভবিষ্যতের স্বপ্নই তো দেখতে চায় একসাথে। আমি বলতে চাইলেও তুই এড়িয়ে যাস… কিন্তু কেন? সেটাওতো আমার জানতে হবে!’

অনিল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, ‘এগুলো নিয়ে কথা না বললেই নয়? আমি এখনই জীবনের এইসব দিক  নিয়ে এত সিরিয়াস হতে চাইনা। বিয়ে টিয়ে এসব আমার মাথায়ই নেই, তার আগে আমার আরো অনেক কিছু করা বাকী…আমার অনেক স্বপ্ন মাথার ভেতরে… miles to go before I sleep, নীতু, তুমি তো জানো সেটা,’ – গভীর চোখে নাতাশার দিকে তাকিয়ে মুখটা নামিয়ে আনে ওর ঠোঁটে। গভীর চুম্বনের আবেশে নাতাশা অবশ… মাথার মধ্যে তখন বিশ্ব চরাচর লুপ্ত প্রায়!

নাতাশার পরিস্কার মনে পড়ে ঠিক ওইদিন থেকেই অনিল একটু একটু করে ওর থেকে দূরে সরে যেতে থাকলো। নানা ব্যস্ততার ছুতোয় দেখা সাক্ষাত কমে গেল। নাতাশাকে যেন এড়িয়ে যেতে লাগলো অনিল, আর একসময় তো হারিয়েই গেল কোথায়। নাতাশা পাগলের মত অনিলকে আগের মত পেতে চাইলেও অনিল তখন অন্য জগতে, যে জগতের খোঁজ নাতাশা আর পায়নি কখনও।

আজ এত বছর পর হঠাৎ সেই অনিলের মেসেজ দেখে নাতাশা কি করবে প্রথমে বুঝতে পারলো না। আরো বেশী অস্থিরতা যেন ওকে গ্রাস করে ফেললো। অনিলের আনলকড প্রোফাইলে ঢুকে তন্ন তন্ন করে ওর জীবনটা কেমন সেটা দেখতে শুরু করলো। দেখতে দেখতে বুঝলো ভালোই সাজিয়েছে জীবনটা। অফিসের কেতাদুরস্থ ছবি থেকে শুরু করে দেশ বিদেশের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর ছবি,  স্ত্রী সন্তানদের ছবি, সবই আছে সেখানে। দেখেতো মনে হচ্ছে খুব ভালোই আছে, তাহলে এতকাল বাদে ওকে কেন আবার মনে করার দরকার পড়লো!

জীবন থেকে অনিলের হারিয়ে যাওয়াটা ভুলতে নাতাশার অনেক সময় লেগেছিল। বহুদিন অপেক্ষা করেছিলো যদি আবার অনিল যোগাযোগ করে! যদি ফিরে আসে। কিন্তু অনিল ফিরে আসেনি। পরিচিতদের কাছ থেকে মাঝে মাঝে শুধু ওর টুকটাক খবর পেয়েছে। আস্তে আস্তে অনিলের কথা ভুলেছে নাতাশা, ভুলতে হয়েছে। নিজেকে সামলে নিয়ে চাকরীতে ঢুকেছে, জীবন ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। অফিসের এক সেমিনারেই রুশোর সাথে আলাপ আর সেই আলাপ  থেকেই খুব ‌অল্প সময়ের মধ্যে বিয়ে করে ফেলেছিল দুজনে। রুশোও জীবনটা গোছাতে চাইছিল … নাতাশাও চেয়েছিলে সেটেল্ড হতে… ভালোবাসাবাসির থেকেও তখন ওর জীবনে সেটেল্ড হওয়াটাই জরুরি ছিল। দুই পরিবারের সম্মতিতে ভালোভাবেই ওদের বিয়েটা হয়ে গেল। তারপর তো জীবন কেটেছে জীবনের নিয়মে। দুজনের ব্যস্ত জীবন ভালোই কেটে গেছে, শুধু রুশোর অতিরিক্ত ব্যস্ততা ওদের সন্তানহীন জীবনে মাঝে মাঝে নাতাশার একাকীত্বটা খুব বেশী বাড়িয়ে দেয়।

নাতাশা আশ্চর্য হয়ে ভাবে, আচ্ছা এতদিন একদম কেন ওর মনে হয়নি ফেসবুক এ অনিলকে খুঁজে বের করার কথা। অনিলের প্রতি এক ধরণের তীব্র রাগ ওকে ওর প্রতি খুবই বিমুখ করে রেখেছিল সেটাও সত্যি। অনিলের লেখা সমস্ত চিঠি-পত্র পুড়িয়ে ফেলেছিল, কোন স্মৃতিই আর রাখতে চায়নি। ওর নামটাও আর মনে করতে চাইতো না যেন।

আজ নাতাশার কি হলো ও নিজেও জানে না। অনিলের মেসেজের উত্তরে নাতাশা লিখলো, ‘থ্যাংকস।’

লিখে তাকিয়ে রইলো স্ক্রীনের দিকে। সেখানে নড়াচড়ার আভাস পাওয়া গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। কিছু লিখছে … ডট ডট ডট… ঢেউ খেলতে লাগলো…

স্ক্রীনে ভেসে উঠলো, যাক, বরফ গলেছে, এতক্ষণে তবে তোর সাড়া পাওয়া গেল।’

প্রথমে নাতাশা চুপ করে রইলো … অনিলের নানা কথার পিঠে নাতাশা শর্টকাটে কিছুটা নির্লিপ্তভাবে  শুধু হু হা করে … ওর সাথে এভাবে কথা বলে যাওয়া ওর ঠিক হচ্ছে কিনা সেটাও ভাবনার মধ্যে আসে। ও যে অনিলের ব্যাপারে এখনও আগ্রহী সেটা কোনমতেই অনিলকে বুঝতে দেয়া যাবে না যেন। তবে ওর কৌতুহলও হয় অনিলের জীবন আসলে এখন কেমন সে ব্যাপারে! প্রোফাইল দেখে তো মহা কেতাদুরস্থ এক চাকুরে এবং ব্যক্তি জীবনে একজন সফল মানুষ বলেই মনে হয় কিন্তু তাহলে ওর সাথে কেন আবার যোগাযোগ করার ইচ্ছে হলো! প্রশ্নটা মাথার ভেতরে ঘুণপোকার মত নড়ে চড়ে বেড়ায়।

এরপর থেকে প্রায়ই ওদের যোগাযোগ হতে থাকে মেসেন্জারে, হোয়াটসআ্যাপে। আস্তে আস্তে অনিলের ব্যক্তিগত জীবনে উঁকি দিতে শুরু করে নাতাশা। জানা হয়, বাইরে থেকে দেখে যা মনে হয় সেটাই সব কিছু নয়। প্রথম বেশ কিছুদিন সেই প্রথম প্রেমের সময়ের মত কাজের ফাঁকে ফাঁকে দফায় দফায় ফোনে কথা হতে থাকে… এখন কি করছিস,  কখন খাবি, আজকে কাজ শেষে কখন বের হতে পারবি … যেন ওরা ওদের প্রথম যৌবনে ফিরে গেছে। নাতাশার সন্ধ্যেগুলো এখন আর আগের মত একঘেয়ে নয়, তাতে এখন অনেক রঙের মিশেল। এখন আর এক ঘন্টা পরপর কখন আসবে বলে ফোন দিয়ে রুশোকে অস্থির করে তোলে না। রুশো যখন সন্ধ্যাগুলো কাজের মধ্যে বা বন্ধুদের নিয়ে আড্ডায় মেতে থাকে তখন রুশো বিহীন সময়টা ‌অনিলের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা ফোনে বা মেসেন্জারে কথোপকথন চলতে চলতে সন্ধ্যাগুলো যেন হাওয়ায় উড়তে থাকে।

অনিল বলে নাতাশাকে, ‘আমি বুঝিনি তুই আমার জীবনে এত গুরুত্বপূর্ণ ছিলি… ক্যারিয়ারের নেশায় সব ভুলেছিলাম। একটা সময় পরে যখন একটু সেটেল্ড হয়েছি তখন তোকে মনে হয়েছে আবার … মনে হয়েছে জীবনে কি যেন নেই! তোর চিঠি গুলো এখনও রেখে দিয়েছি যত্ন করে…।’ নাতাশা কি বলবে ভেবে পায় না, অনিলের কথা কান পেতে শোনে।

মাঝে মাঝে সন্ধ্যার দিকে অনিলের সাথে সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের মত রিক্সায় ঘুরতে বের হয় নাতাশা। অনিল অনেক কথা বলে যায়, সারাদিন অফিসের নানা কাজ, ব্যস্ততা, নতুন একটা বাড়ী কিনতে চায়, বিদেশে যাওয়ার নানা রকমের প্ল্যান শোনায়।  নাতাশা চুপচাপ ওর কথা শুনে যায়, টুকটাক কথা বলে। নিজের কথা বলার উচ্ছ্বাসে অনিলের খেয়ালই হয়না নাতাশার কথা কিছু শোনা হচ্ছেনা, সে একাই কথা বলে চলেছে।

কিছুদিন এভাবে চলতে চলতে নাতাশা টের পায় কোথায় যেন সুর কেটে গেছে। আগের সেই মুগ্ধতা আর নেই… রিক্সায় ঘোরা এখন ক্লান্তিকর… গরমে ভীড়ের মধ্যে ক্লান্ত লাগে। আগের জীবনের সেই দিনভোর টো টো করে ঘোরার মজা এখন যেন কোথায় মিলিয়ে গেছে! অনিলের সাথে আগে শিল্প সাহিত্যে, বিশ্ব রাজনীতির আগড়ম বাগড়ম থেকে শুরু করে নিজেদের কত কত কথা নিয়ে গল্প করতে করতে রিক্সায় ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেত। এখন অনিলের গল্প জুড়ে থাকে ওর চাকরির নানান সফলতার ফিরিস্তি, বউয়ের ব্যাপারে অসন্তোষ,  বিষয় সম্পত্তি কোন দিকে কতটা বেড়েছে এসব। নাতাশা মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়, কিন্তু অনিল আবার কি মনে করবে ভেবে চুপ করে শুনে যায়। নাতাশা ভাবে এসব কথা শুনে ওর কি লাভ! ওর জীবনের এত সফলতার গল্প শুনে নাতাশা কি করবে ! অনিলের এই জীবনের মধ্যে কোথাও ওর কোন অস্তিত্ব নেই, কোন কিছুর সাথে ওর নিজের জীবন আর জড়িয়ে নেই, একসাথে ওরা আর কোন স্বপ্ন দেখতে পারবে না, অনিলের জীবনে ও এখন কেবলি একজন আগন্তুক মাত্র!

রিক্সায় ঘুরতে নাতাশার ভালো লাগে না তাই অনিল প্রায়ই গাড়ি করে ওকে নিয়ে বের হয়, দুজনে মিলে রেঁস্তোরায় খেয়ে রুশো ফিরে আসার আগেই নাতাশা বাড়ী ফিরে আসে, রুশো টেরই পায়না, নাতাশার জীবনে কতকিছু ঘটে চলেছে। তবে এটুকু বুঝতে পারে নাতাশার মেজাজটা যেন এখন একটু কমেছে, দেরী করে আসলেও খুব বেশী উচ্চ বাচ্য করেনা। গোটা সন্ধ্যাটা প্রায়ই অনিলের সাথে ঘুরে বেড়ানোটা নাতাশা উপভোগ করে, এটুকুই তো সে চেয়েছিল রুশোর কাছে, নাকি? সারাদিন চাকরী, সংসার সামলে বাকী সময়টা নিজেরা নিজেদের মত কাটাবে, ঘুরবে ফিরবে এটুকুই তো চাওয়া ছিল… সেই ছোট্ট চাওয়াটাই জীবনে কত অসম্ভব হয়ে উঠেছিল ওদের জীবনে!

তবে কিছুদিন যেতেই নাতাশার ভেতরে একটু অস্বস্তি তৈরী হতে শুরু করে। অনেক বছর পর অনিলের সাথে আবার দেখা হওয়ার প্রাথমিক উচ্ছ্বাসটা যেন একটু একটু করে স্তিমিত হয়ে আসতে থাকে এই ভাবনায় যে কোথাও কোন ভুল করে ফেলছে নাতো সে? রুশো কি আসলে তার সাথে এতটাই কিছু দোষ করেছে যে সে রুশোর ‌অজান্তে আর একটা সর্ম্পকে জড়াতে পারে? রুশোকে কি সবকিছু জানিয়ে দেয়া উচিত? তার পরে তাহলে কি হবে- এসব চিন্তা নাতাশাকে একটু অস্থির করে তোলে।

নাতাশা বুঝতে পারে অনিল আস্তে আস্তে ওর কাছে আরো কিছু চাইছে। গাড়ির মধ্যে প্রায়ই ওকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে। নাতাশা যে সেটা উপভোগ করে না সেটাও না কিন্তু মনের কোণে অস্বস্তির পোকা নড়া চড়া করতেই থাকে। সমাজের রীতি নীতি নিয়ে ওর মধ্যে তেমন গোঁড়ামি নেই যদিও তবুও ও ভাবে, রুশো আর সেতো এখনও এক সাথে আছে। কিংবা অনিলের জীবনও আর একজনের সাথে জড়িয়ে আছে, নিজেদের ক্ষণিকের ভালো লাগার রেশ আসলে ওদেরকে কোথায় নিয়ে যাবে। অনিল আগে একবার ঝড়ের মত জীবনে এসেছিলো, কোনকিছু না বলে ঝড়ের মত চলেও গিয়েছিল। এবারও যে সেই ঝড়ই হবে না কে বলতে পারে। আবার ভাবে, আসুক না ঝড়, ওর একঘেয়ে ক্লান্ত জীবন নাহয় একটু ভাসিয়ে দিয়েই যাক! অনিলকে জীবনে না পাওয়ার যে খেদ ছিল এবার না হয় সেই খেদ পূর্ণ হোক।

মনের ভেতর অনিলকে নিয়ে নানারকম দোলাচল চলে নাতাশার। কখনও মনে হয় দুজনের মধ্যে এখন একটা সুন্দর বন্ধুত্ব  থাকলেই ভালো ছিল…নিষ্পাপ বন্ধুত্ব। দুজনে দুজনার সব না বলা কথার নির্ভরযোগ্য জায়গা হবে… থাকুক না জীবনে রুশো বা অন্যকেউ। কিন্তু অনিলের আচরণ খুব স্বাভাবিক ভাবেই তেমন না যেমন নাতাশা চাইছে। আবারও সেই চাওয়া আর পাওয়ার যোজন যোজন দূরত্ব। নাতাশার কেন জানি মনে হয় অনিল একটা শুধুই সুযোগ নিতে চাইছে … এরসাথে আগের সেই প্রেমিক প্রবরের তেমন মিল নেই…। আগের অনিল একটা স্বল্প সময়ের সম্পর্কে জড়িয়েছিল ঠিকই কিন্তু কোন সুযোগ নেয়নি কিন্তু এখন অনিল তার চাওয়ার ব্যাপারে খুব খোলামেলা। অনিলের নানা কথার ভীড়ে নাতাশা বুঝতে পারে, অনিল শুধু পুরনো প্রেমের কারণেই ওর কাছে ফিরে আসেনি আবার। অন্য অনেক মেয়েদের গল্প যখন অনিল বলে, সেইসব কলিগ কিংবা পরিচিতদের মধ্যে নাতাশা আরো অনেক নাতাশার ছবি দেখতে পায়। অনিলের প্রতি আগের সেই বিশ্বাসটা জোরালোভাবে অনুভব করে না। আগের চেহারাটা ও বুঝতে পারেনি, কখনও সেটাও মনে হয়,  এখনকার অনিল যেন বা আরো বেশী অবোধ্য যাকে নাতাশা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না।

হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় মেঘ না চাইতে জলের মত রুশো এক গোছা বেলি ফুলের মালা নিয়ে বাড়ি ফিরলো। নাতাশা প্রতিদিনের মতই তার একাকী সন্ধ্যা তার মত করে কাটাচ্ছে। মাঝে মাঝে অনিলের সাথেও গল্প চালিয়ে যাচ্ছে। রুশো বললো, সোজা অফিস থেকে চলে এলাম। আজকে কোথাও যাইনি, ভাবলাম তোমার সাথে একটু সময় কাটাই, কদিন ধরে মুখ ভার করে আছো মনে হচ্ছে! আমার সাথে তো কথা বলাই ছেড়ে দিয়েছো। আসলে কাজের  চাপে চাইলেও তো তাড়াতাড়ি চলে আসতে পারি না। মনে হচ্ছে কাজের চাপটা এবার একটু কমানো দরকার। চলো একটু বাইরে থেকে ঘুরে ফিরে আসি, ডিনারটাও সেরে আসবো। দারুণ একটা রেঁস্তোরার খোঁজ পেয়েছি।’

নাতাশা ফেসবুক থেকে চোখ না সরিয়েই বললো, ‘সূর্য আজ কোন দিকে উঠেছিলো?’

রুশো হেসে বললো, ‘ঠিক মতোই উঠেছিল, এখন রেডি হও তাড়াতাড়ি, আমি একটু শাওয়ার নিয়ে রেডি হয়ে আসি।’

নাতাশার মনে হলো, এই মানুষটাকে সে অনেক বেশী করে চেনে। এই মানুষটা হয়তো তাকে সময় একটু কম দেয়, হয়তো তাকে নিয়ে অনেক আদিখ্যেতা করে না কিন্তু এই মানুষটার জীবনে শুধু তারই একক অস্তিত্ব আছে। অন্য কারো ছায়া এখানে সে কখনও অনুভব করেনি।

বাথরুম থেকে রুশোর শাওয়ার নেয়ার শব্দ ভেসে আসছে। গত কাল রাতে অনিল তাকে একদিনের জন্যে তার সাথে বাইরে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার জন্যে বলেছে। বলেছে এমন একটা দিনের জন্যে ও অনন্তকাল ধরে বসে আছে। নাতাশা এখনও কোন উত্তর দেয়নি, বলেছে জানাবে।  রুশো শাওয়ার নিতে নিতে গান গাইছে, ‘ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে … আমার দেখা তোমার সঙ্গে…’

নাতাশার মনটা কেমন জানি করে উঠলো! কি মনে হতে অনিলের প্রোফাইলে ঢুকলো নাতাশা… আবারও একটু ঘুরে ফিরে ফেসবুকের দেয়ালে দেয়ালে সাজিয়ে রাখা ওর জীবনটা দেখলো, কিছু একটা ভাবলো তারপর ‌অনিলের প্রোফাইলটা ব্লক করে দিল।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত