| 28 মার্চ 2024
Categories
ইরাবতী তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা

বিশেষ রচনা: নারী বিদ্বেষ । শমীতা দাশ দাশগুপ্ত

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

“পশু, ঢোল,অশিক্ষিত, নীচু জাতি, এবং নারী, অবশ্যই প্রহারযোগ্য। ”(মনুসংহিতা, অনুঃ লেখক)[i]

“নারী নরকের দ্বার।” (প্রবাদ)

নারীকে হেয় করে এই ধরনের উপদেশ এবং প্রবাদ-প্রবচন বহুযুগ ধরেই বাংলা সংস্কৃতিতে জায়গা দখল করে রয়েছে। অনেকে হয়তো বলবেন এত প্রাচীন মনোবৃত্তি আজকের দিনে টেনে আনা মানে লুপ্তপ্রয়োগ–এসব ধারণা অনেকদিন আগেই বাতিল হয়ে গেছে। সত্যি, বাতিল বা অচল হলে ভালোই হত। কিন্তু মনুসংহিতার প্রভাব মুছে ফেলতে হলে আমাদের সামাজিক সংস্কৃতি খোলনলচে পাল্টাতে হবে। তেমন পরিবর্তন এখন অবধি ঘটেনি। মনুর নীতি-নিয়মের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে হিন্দু সমাজে নারী-পুরুষের ভূমিকা, সম্পর্ক, আর সংসার যাত্রার নিয়মাবলী। মনুসংহিতার নবম পরিচ্ছদ খুঁটিয়ে পড়লে বোঝা যায় এই প্রাচীন আইন-প্রবর্তক নারী বিদ্বেষ বুনে দিয়েছেন আমাদের সমাজের পরতে পরতে। সেই বাস্তব থেকেই লোকমুখে তৈরি হয়েছে নারীকে নীচু করে প্রবাদ, প্রবচন, চলতি কথা। তবে নারী বিদ্বেষ শুধু হিন্দু সমাজের বৈশিষ্ট্য বললে ভুল হবে। সেই একই ভাবধারা এবং রীতি চোরা স্রোতের মত প্রবেশ করেছে অন্য ধর্মের বাঙালি সমাজে – মুসলমান, ক্রিশ্চান, বৌদ্ধ। জানি, এক্ষুণি অনেক হিন্দু বাঙালি সমাজে দেবী পুজোর প্রচলন দেখিয়ে বলবেন, নারীকে শ্রদ্ধা না করলে এমনটি হতে পারে কী? তাঁদের বলি, আদর্শ আর বাস্তবের মধ্যে ফাঁক প্রায় সব সমাজেই রয়েছে। কোনো সংস্কৃতিই অবিমিশ্র সাদা বা কালো নয়। তবে হিন্দু সমাজেযতই দেবীপূজার চল থাকুক না, কন্যা ভ্রূণহত্যা, বিধবাদের মঙ্গল উৎসবে যোগদান নিষেধীকরণ এবং কাশীতে পাঠিয়ে দেওয়া থেকে দৈনন্দিন জীবনে নারী নির্যাতন – এসব মেয়েদের সম্মানার্থে হয়েছে বা চলছে বলে মনে করা যায় না।

প্রকট এবং প্রচ্ছন্ন নারী বিদ্বেষ পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি সমাজের অঙ্গ। পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রারম্ভে নারী বিদ্বেষের বীজ রোপণ করেছিলেন দুই গ্রীক দার্শনিক –প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল। তাঁরাই নারীর অপরিণত বুদ্ধিমত্তা, নৈতিকতার খামতি, এবং ক্ষমতার দারিদ্র ইঙ্গিত করে মেয়েদের রাজনীতি ও সমাজের সব দায়িত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

সমাজে দুই লিঙ্গ সম্পর্কে বলি, প্রকৃতিগতভাবে নারীর তুলনায় পুরুষ অনেক বেশি উন্নত। অতএব পুরুষ হবে শাসক আর মহিলারা তার অধীন। (অ্যারিস্টটল,পোয়েটিক্স অনুঃ লেখক)[ii]

হাজার হাজার বছরে এই নীতি পাশ্চাত্য মানসিকতা এবং সমাজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে মিশে গিয়ে মহিলাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক প্রতিপন্ন করেছে। সেই নিগড় ভাঙতেই ইয়োরোপ আর আমেরিকায় নারী আন্দোলনের সূত্রপাত।

বিভিন্ন সংস্কৃতিতে নারী বিদ্বেষের রূপের পার্থক্য রয়েছে। সামাজিক প্রথারপরিপ্রেক্ষিতে নারী বিদ্বেষের প্রকাশ হয় ভিন্ন। তবে সব সমাজেই দেখা যায় পুরুষতন্ত্র, লিঙ্গ-বিভেদ, নারী নির্যাতন, যৌন অত্যাচার,মৌখিক গালিগালাজ,নারীর গতিবিধির ওপর কঠিন বিধিনিষেধ আরোপ, ইত্যাদি ইত্যাদি। এসবেরই মূলে রয়েছে নারী বিদ্বেষ এবং একটি গভীর বিশ্বাস–নারী পুরুষের চেয়ে নিকৃষ্ট জীব। এই বিশ্বাসের ভিত্তিতেই নারীকে সমানাধিকার থেকে বঞ্চিত করা পুরুষপ্রধান সমাজের চোখে অন্যায় নয়।

মেয়েদের হীন বা পুরুষরে চেয়ে নিম্নতর মনে করা যে অত্যন্ত প্রাচীন ও প্রচলিত ধারণা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি কোনো একজন ব্যক্তি মহিলার কথা বলছি না, সমষ্টিগত নারী সমাজকে উল্লেখ করছি। ভেবে দেখুন তো বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই ছেলেরা কী ভাবে মেয়েদের সম্বন্ধে কথা বলে! বাঙালি সমাজে আকর্ষনীয় মেয়েদের ‘মাল’ বলা খুবই চালু ব্যাপার। ‘মাল’ বলা মানে মেয়েটিকে ‘বস্তু’-র স্তরে নামিয়ে আনা– সে আর তখন মানুষ নয়। আর ‘বস্তু’র আবেগ বা মনের খবর না রাখলেও চলে। এছাড়াও মেয়েদের বহু অসম্মানজনক নামে ডাকার রেওয়াজ বাঙালি পুরুষ সমাজে চালু আছে। সেগুলি এখানে আর নাই বা উল্লেখ করলাম।পাশ্চাত্যে মেয়েদের ‘বিচ’ (bitch) আর‘হোর’ (whore/ho) সম্বোধন করা কমবয়সী ছেলেদের মধ্যে খুব ‘কুল’ (cool)। র‍্যাপ গানের কথায় মেয়েদের সম্বন্ধে এই ধরনের অপমানজনক শব্দ যত্রতত্র ব্যবহার করা হয়।

নারীত্ব যে পুরুষের কাছে কতটা খেলো এবং নীচু, তার নিদর্শন পাওয়া যায় যখন কোনো ছেলে আরেকজনের প্রতি তার ঘৃণা প্রকাশ করে। একজন ছেলেকে হেনস্থা করতে ‘মেয়েলি’ বলাই যথেষ্ট। যে পুরুষ সমকামী, তাকে হেয় করতে তুলনা করা হয় নারীর সঙ্গে। ‘পুরুষালী’হওয়া মানে মেয়ে না হওয়া। অর্থাৎ মেয়েদের যে সব বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলী রয়েছে, তা যে ছেলের মধ্যে দেখা যায় তাকে পুরুষালী বলা যাবে না। পুরুষালী হতে হলে ‘না-নারী’ হওয়া দরকার। [iii] বিপরীতে, মেয়েদের কাজ বা বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবেপ্রশংসা করতে বলা হয় তা ঠিক নারীসুলভ নয়। এ ব্যাপারে আশাপূর্ণা দেবী তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি চমৎকার গল্প বলেছিলেন।

খুব অল্পবয়স থেকে তাঁর লেখা ছাপা হলেও আশাপূর্ণা দেবী নিজে কখনো প্রকাশকের দপ্তরে যেতেন না। বাড়ির কোনো লোক লেখাটি জমা দিয়ে আসত। প্রায় তিন দশক লেখালেখির পর উনি ঠিক করলেন এবারে প্রকাশকের সঙ্গে দেখা করবেন। সেখানে যেতেই সকলে অবাক। সেই সময়ের কিছু প্রখ্যাত লেখক সেদিন অফিসে ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন বললেন লেখার ধার দেখে তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন লেখক অবশ্যই পুরুষ। এই অভিজ্ঞতা বিরল নয়। বহু মহিলা লেখক এই ধরনের ‘প্রশংসা’ কারোর না কারোর কাছ থেকে পেয়েছেন। ক’জন পুরুষকে প্রশংসা করে বলা হয়েছে তাঁর লেখা খুবই মেয়েলি জানতে ইচ্ছে করে।

নারী বিদ্বেষের চরম রূপ হল নারী নির্যাতন। নির্যাতন সাংঘাতিক বড়সড় এবং অমানবিক হলে আমরা হয়তো সচকিত হই, কিন্তু নারী বিদ্বেষের ছোটোখাটো প্রকাশ প্রতিনিয়ত চোখবুজে মেনে নিই। যেমন ধরুন রসিকতা।লোকমুখে যত রসিকতা ফেরে তার মধ্যে সিংহভাগ হল মেয়েদের বিদ্রূপ করে– অত্যাচারী গিন্নী,খর্চে বোন, বুদ্ধু মহিলা সহকর্মী, কুচুটে প্রতিবেশিনী, সরল বন্ধুর অকর্মন্য স্ত্রী, সংসারবিমুখ পুত্রবধূ। শ্রোতারা সবাই রসিকতা শুনে এদের নিয়ে হাসাহাসি করে। আপাতদৃষ্টিতে সেই হাসি নির্দোষ মনে হলেও, অচেতন মনে নারীকে ছোটো করার মনোভাব এতে পাকাপোক্ত হয়ে ওঠে। আর যারা এক ঘর লোকের মধ্যেও এসব রসিকতা নারী বিদ্বেষী, অরুচিকর,বলে আপত্তি জানায় তাদের রসকষহীন,‘পার্টি পুপার,’আখ্যা দিয়ে মতামত নাকচ করা হয়।

নারী নির্যাতনের ব্যাপারেও একই অবস্থা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পনেরো বছর বয়সের ঊর্ধে তিরিশ থেকে পঞ্চান্ন শতাংশ মেয়েরা পারিবারিক অত্যাচারের শিকার হয়েছেন। ভারতে সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী একশ’ জন মহিলার মধ্যে ৩৪ জন নির্যাতিত। এখানে আমি শুধু শারীরিক মারধোরের কথা বলছি। ‘ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স’-এর পরিধি অনেক বড়। সেই হিসেব নিলে সংখ্যাটি বহুগুণ বেশি হবে।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,নারী বিদ্বেষ


বাড়ির প্রিয়জন নিগ্রহ করলে অন্যান্যদের মনে প্রথম প্রশ্ন জাগে, ‘মেয়েটি কী করেছে?’ আমরা ভুলে যাই একজন প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা যাই করুক না কেন, তাকে শারীরিক বা মানসিক অত্যাচার করার অধিকার কারোর নেই। বড় আশ্চর্য লাগে যখন দেখি পশ্চিমবঙ্গের বহু মহিলাই মেনে নিয়েছেন তাঁদের শিক্ষা দেবার জন্যে স্বামী গায়ে হাত তুলতেই পারেন। [iv]অর্থাৎ সুরক্ষিত জীবন যাপন করার অধিকার নারীর নেই, এই বিশ্বাস সমাজীকরণের প্রথা তাঁদের শিখিয়ে দিয়েছে। বাড়ির বাইরে ধর্ষণ বা যৌন অত্যাচারের শিকার হলেও নিন্দার আঙুল ওঠে নারীর দিকে। ওই সময়ে, ওই জায়গায় কেন গিয়েছিল, কী ধরনের জামাকাপড় পরেছিল, ভাবভঙ্গী কেমন ছিল, অত্যাচারী পরিচিত কিনা, ইত্যাদি। প্রশ্নগুলি থেকে একটি ব্যাপার পরিষ্কার হয়, এক স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হলেও নারীকে তার গতিবিধি সীমাবদ্ধ রাখতে হবে, নিজের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এছাড়াও মানতে হবে নিগ্রহকারী পরিচিত হলে মেয়েদের সঙ্গে যথেচ্ছ ব্যবহার করার অধিকার তার আছে। এই মনোভাব থেকে পরিবারে এবং সমাজে নারীর অবস্থিতি কোন পর্যায়ে রয়েছে তার একটা সামান্য নমুনা পাওয়া যায়।

অথচ সমস্যার উৎস মহিলারা নন– এর উৎপত্তিস্থল হল পুরুষ। সমস্যার সমাধান করতে কারোর ব্যবহার ও গতিবিধি যদি নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তা হওয়া উচিত পুরুষের। গত শতকের আশির দশকে অস্ট্রেলিয়ার এক মহিলা সাংসদ একটি চমৎকার প্রস্তাব এনেছিলেন– সেই গল্প বলি। সেই সময়ে অস্ট্রেলিয়ার কয়েকটি শহরে রাতের বেলায় পরপর কয়েকটি ধর্ষণ ঘটেছিল। সংসদে আলোচনা চলছিল মহিলা নাগরিকদের কী ভাবে সুরক্ষিত রাখা যায়। তাদের কি কিছু সময়ে, কিছু জায়গায় যেতে বারণ করা হবে? সেই মহিলা সাংসদ তখন প্রশ্ন করেছিলেন, ‘দোষ যখন মহিলাদের নয়, তাদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে লাভ কি?’ তিনি প্রস্তাব দেন, বরং সন্ধে ছ’টা থেকে সকাল ছ’টা অবধি পুরুষদের ওপর কার্ফ্যু জারি করা হোক। প্রস্তাবটি গৃহীত না হলেও অপরাধ বিবেচনার দৃষ্টিকোণ সেদিন পাল্টে গিয়েছিল। ২০২১ সালে রাতের বেলায় লন্ডনের পথে স্যারা এভেরার্ড নামে এক মহিলার হত্যার পর একই প্রস্তাব করেছেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এক মহিলা সদস্য– সন্ধে ছ’টার পর থেকে পুরুষের ওপর কার্ফ্যু জারি হোক। [v] এতে মহিলাদের নিরাপত্তা বাড়বে।

বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে কোনো বিশেষ নারী নির্যাতনের ঘটনা লোকচক্ষুতে আসার পর প্রায়ই দেখি বহু শুভবুদ্ধি সম্পন্ন পুরুষ (এবং মহিলাও) জনসাধারণের সচেতনতা বাড়াবার জন্যে আপীল করছেন,‘আপনার মা, বোন, কন্যা, স্ত্রী যদি ধর্ষণ/নিগ্রহের শিকার হন, আপনার কেমন লাগবে? মনে রাখবেন, সব মেয়েরাই কারোর মা, বোন, কন্যা, স্ত্রী।’ এই বক্তব্য নাকচ না করে বলি,কোনো পুরুষের সঙ্গে আত্মীয়তা না থাকলে কি মেয়েদের নিরাপদে থাকার অধিকার নেই? এই একই কথা বলে পুরুষকে কিন্তু নিরাপত্তা জোগাড় করতে হয় না। মানুষ হিসেবে নারীর সমানাধিকার তাহলে কোথায় গেল?

বাড়ির বাইরে নারী নির্যাতনের সমাধান হিসেবে অনেকে বলেন মহিলাদের নিরাপদ রাখতে পুরুষ সঙ্গী থাকা এবং পুরুষের ‘শিভালরি’র প্রয়োজনীয়। আপাতদৃষ্টিতে হয়তো তা মনে হতে পারে,এবং হয়তো কিছুক্ষেত্রে তা কার্যকরীও হবে। কিন্তু তা পাকাপাকি সমাধান হতে পারে না। প্রথমত, এতে ধরে নেওয়া হচ্ছে মহিলারা অক্ষম – পুরুষ বিনা গতি নেই। দ্বিতীয়ত, এতে বাড়ির ভেতরে মহিলাদের নিরাপত্তার কোনো সুরাহা হবে না। অথচ শিশু ও নারী নির্যাতনের সিংহভাগ ঘটে বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে – প্রিয়জনের হাতে। তৃতীয়ত, যতই মহিলাদের গতিবিধি, স্বাধীনতা খর্ব করা হবে, ততই সমাজে তাঁদের অধিকার নষ্ট হবে। তাঁরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকই রয়ে যাবেন। চতুর্থত, এতে যা সত্যিকারের প্রয়োজন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও ‘টক্সিক’ পুরুষত্বের পরিবর্তন, তা ঘটবে না।

সর্বজনীন নারী বিদ্বেষ মনোবিজ্ঞানে স্বীকৃত। যদিও ফ্রয়েডের অনেক তত্ত্ব আজ বিতর্কীত, নারী বিদ্বেষের বিশ্লেষণ বহু মনোবিজ্ঞানীই গ্রহণীয় বলে মনে করেন। ফ্রয়েডিয়ান মনস্তাত্বিকরা বলেন, প্রতি সমাজে শিশুদের আদর-যত্নে বড় করেন মা– একজন নারী। কন্যা এবং পুত্র, দু’জনেরই প্রথম আদর্শ হলেন মা, যাঁকে অনুসরণ করেসন্তানের ব্যক্তিত্ব বিকাশ লাভ করে। বয়ঃসন্ধিতে এসে কন্যা আরও বেশি করে মা’কে অনুকরণ করে, কারণ তার সামাজিক ভূমিকা হবে মায়েরই মত। কিন্তু ওই বয়সে এসে পুত্রসন্তান হঠাৎ আবিষ্কার করে তাকে মায়ের মতন হলে চলবে না, কারণ সে মায়ের বিপরীত– পুরুষ। আরম্ভ হয় ব্যক্তিত্বের টানাপোড়েন। যেহেতু বেশির ভাগ সময় ছেলেদের জীবনে বাবার আনাগোনা কম, তাকে হাতে করে পুরুষ হবার পাঠ কেউ দেয় না। যেটুকু সে পায় তা দূর থেকে। মেয়েদের লিঙ্গ-ভূমিকা শেখা আরম্ভ হয় জন্ম থেকে, চলে দিনে রাতে, নিরবিচ্ছিন্ন। তার পক্ষে একই পথে এগিয়ে যাওয়াটা অসুবিধের নয়। ছেলেদের পুরুষ হতে হলে প্রথমে বাতিল করতে হয় এত বছরের নারী হবার শিক্ষা, নারীর (মা) আদর্শ। তারপর তাদের শিখতে হয় পৌরুষের মারপ্যাঁচ। কাজটা জটিল এবং শিক্ষা এলোমেলো। পুরুষ হবার শিক্ষা, বিশেষত নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক কেমন হবে, আসে বন্ধু-বান্ধব, চলচ্চিত্র, এবং আরও বিভিন্ন উৎস থেকে। এইসব উৎস বেশিরভাগ সময় বাস্তব ভিত্তিক নয়। পুরুষের যৌন-বিকাশ সম্পর্কীত গবেষক ডার্নের মতে ভারতে ছেলেরা যৌনতার বেশ কিছুটা শেখে হিন্দি সিনেমা থেকে। বয়ঃসন্ধিকালে বহু কিশোরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তিনি জানতে পারেন যে তারা বিশ্বাস করে মেয়েদের রাস্তায় টিটিকারি দেওয়া, জোরাজুরি করা, পেছনে ধাওয়া করা, শুধু পৌরুষের প্রকাশ নয়, মেয়েরা এমন ব্যবহার খুব পছন্দ করে। [vi] এই ছেলেরা কখনো ভাবেনি এতে মেয়েদের অস্বস্তি হয়, তারা ভয় পেতে পারে, তাদের জীবন বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। শিক্ষাটা কোথা থেকে এসেছে বলা বাহুল্য।

তবে পুরুষত্ব এবং নারী বিদ্বেষ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ভাবার কোনো কারণ নেই। স্থান, কাল, পাত্র হিসেবে তা অবশ্যই পাল্টাচ্ছে, নতুনভাবে গড়ে উঠছে। মনোবিজ্ঞানী আর শিশুবিকাশ গবেষকদের মতে, পুত্র সন্তানের জন্ম থেকে মায়ের পাশাপাশি তার দৈনন্দিন জীবনে বাবারা যতই অংশগ্রহণ করবেন, প্রাচীন পুরুষত্ব ফেলে নতুনভাবে সংবেদনশীল পুরুষ হবার পাঠ দেবেন, ততই সমাজে নারী বিদ্বেষ কমবে। পুরুষ মানেই নারী বিশেষত্ব বর্জিত হতে হবে ভাবার কোনো কারণ নেই।

 

 

 

ছবির জন্যে কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ ডোমেস্টিক অ্যাবিউস ইন্টারভেনশন প্রজেক্ট, ডল্যুথ, মিনেসোটা।অনুবাদঃ লেখক।

তথ্যসূত্রঃ

[i] Buhler, G. (Trans.) (ND). The laws of Manu.Sacred books of the East, 25. Available: https://www.sacred-texts.com/hin/manu.htm

[ii]Freeland C. (1994). Nourishing speculation: A feminist reading of Aristotelian science. InB.A. Bar(ed), Engendering origins: Critical feminist readings in Plato and Aristotle. Albany,NY: State University of New York Press.

[iii]‘না-নারী’শব্দটা বাংলাভাষায় প্রচলিত নয় –ভাব প্রকাশের সুবিধার্থে শব্দটি তৈরি করেছি।অর্থাৎ সবকিছু নারীর উল্টো।

[iv]Dasgupta, S. D. and Kapoor, A. (2011). Intimate peril: Domestic violence against wives in West Bengal. A two-site study. Kolkata, India: Swayam. Also, personal communication with N. Jayaraman, Mukti, Sunderban, West Bengal.

[v] Wilcock, D. (2021, March 11). ‘Green party peer says all men should face 6pm curfew: Baroness Jones calls for ban on males after dark to ‘make women feel safer and lessen discrimination’ as women share their fears of violence in wake of Sarah Everard murder.’ Daily Mail. Available: https://www.dailymail.co.uk/news/article-9350711/Green-peer-calls-MEN-face-6pm-CURFEW-wake-Sarah-Everard-murder.html

[vi]Derné, S. (1999). Making sex violent: Love as force in recent Hindi films. Violence Against Women, 5, 548-575.

One thought on “বিশেষ রচনা: নারী বিদ্বেষ । শমীতা দাশ দাশগুপ্ত

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত